এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৩২.

0
192

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩২.

ইলিয়াসের কথা মতন বাড়ির সীমানার বাহিরে রাস্তার অপরপাশের ঝোপঝাড়ের আড়ালে কিছুটা খুঁজতেই আহসানকেও চেতনাহীন অবস্থায় খুঁজে পায় দূর্জয়। তাকেও কেউ মাথায় আঘাত করেছিলো। আহত দু’জনকে একটা উবার ডেকে হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে সে। অত:পর কাউকে কল করে বলে দরজা জানালার লক ফিক্স করার জন্য লোক সঙ্গে নিয়ে যেনো তার দেওয়া এড্রেসে এসে পৌঁছায়।

মেরামত করার লোক এসে পৌঁছাতেই তাকে কাজে লাগিয়ে নিজের গোপন রুমটায় গিয়ে একটা ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে দূর্জয়। দ্রুত ভঙ্গিতে দু হাত চালিয়ে সিসিটিভি ফুটেজের রেকর্ডিংটা ওপেন করে। রেকর্ডিংটা টেনে টেনে দেখতে থাকে সে। আচমকা একটি জায়গায় এসে ভিডিওর প্লে ব্যাক স্পিডটা স্লো করে।

গভীর মনযোগ পূর্ণ দৃষ্টিটা দিয়ে মুখবাধা একজনকে ভালো করে পরখ করে। মুখবাধা লোকটা পিছন থেকে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা ইলিয়াসের মাথায় প্রথমে আঘাত করে। ইলিয়াস মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই সে কাউকে কল করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির সামনে একটি মাইক্রো গাড়ি এসে থামে সাদা রঙের। গাড়ি হতে নেমে আসে আরো সাত আটজন লোক। প্রত্যেকেই মাস্ক পরিহিত। তারা মিলে ধাক্কিয়ে দরজা ভেঙে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে।

তারপর। তারপর ঠিক নয় মিনিটের মাথায় তিনজন বের হয়ে মাইক্রো তে উঠে বসে। এর পরপরই আরো দুই জন লোক বাণীকে টেনে ঘর থেকে বের করে। দুই বাহু চেপে ধরে তাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে থাকে মাইক্রোর দিকে।

দূর্জয় নীরব দৃষ্টি মেলে দেখে বাণীর যথাসম্ভব প্রতিরোধের চেষ্টা। বাণীর চোখে মুখে ফুটে উঠা ভয় আতংক কোনো কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায় না। বাণী আশেপাশে কোনোকিছু না পেয়ে নগ্ন পায়ে উঠোনের মাটি খাবলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই টানা হেঁচড়ার মাঝে বাণীর শাড়ির আঁচলটা অসাবধানবসত কাধ থেকে পড়ে যায়। অসংলগ্ন দৃশ্যটুকু দেখতেই দূর্জয় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও টেনে সামনের দিকে যায় সে। বাণীকে মাইক্রোতে তুলে ফেলার পর তিনটে লোক ফের উঠোনে ফিরে আসে। তাদের মধ্যে একজনের আদেশ মতো বাকি দু’জন ইলিয়াসকে টেনে বাড়ির পিছন দিকে নিয়ে যায়। অতি দ্রুত কাজটা শেষ করেই তারাও সেই মাইক্রোতে চেপে বসে।

দূর্জয় এই পর্যায়ে ভিডিও পজ করে জুম করে মাইক্রোর নাম্বার প্লেটটা দেখার ট্রাই করে। কিন্তু গাড়িটা উঠোনের বাহিরে হওয়ায় নাম্বার প্লেটটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। দূর্জয় ফোন বের করে কারো নাম্বারে কল করে। কলটা রিসিভ হতেই সে স্পষ্ট গলায় আদেশ করে,

“ একটা গাড়ির ছবি পাঠাচ্ছি। নাম্বার প্লেট স্পষ্ট নয়। বিকেল ৫ টা ৩৭ মিনিটের ঘটনা। ইচ্ছানগরের কোন রুট হয়ে গাড়িটা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে সম্পূর্ণ ডিটেইলস আমি জানতে চাই। শহরের সকল রোডের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করো। এজ ফাস্ট এজ পসিবল। আর কেসটা কনফিডেন্সিয়াল। সেই অনুযায়ী কাজ করো। “

__________

সময় রাত ৯ টা ১৩। প্রকৃতিতে তখন চলছে প্রলয়কারী তান্ডব। বাতাসের প্রকোপে ওয়াশরুমের এককোনার ছোট্ট জানালার থাই গ্লাসটা কেমন কেঁপে উঠছে একটু পরপর। নিশী ঝড়ের ডাক এবং জানালার এরকম কেঁপে উঠার শব্দ শুনে মনে হচ্ছে বুঝি কোনো অশরীরী ডাকছে বাহিরে। প্রকৃতি যখন তান্ডবে মত্ত তখন এক ছাট পানি মুখে ছিটিয়ে চোখ তুলে আয়নার পানে তাকায় হিরণ। চোখের পাশে ক্ষত স্থান হতে এখনো তরল রক্ত ঝরছে। সেই রক্ত হিরণের গাল বেয়ে টুপটুপ করে সিংকের উপর পড়ছে। অত:পর পানির কল হতে বহমান পানির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।

হিরণ নীরবে এই দৃশ্যটুকু পরখ করে। এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ফার্স্ট এইড বক্স হতে একটা কাঁচির মাথায় কিছুটা তুলা ছিড়ে তা আটকে সেটা তরল স্যানিটাইজারে ডুবিয়ে আংশিক ভিজিয়ে নেয়। অত:পর কাঁচির সাহায্যে তুলোটা কাঁটা জায়গায় ছোঁয়ায় পরিষ্কারের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে সঙ্গেই কাঁটা জায়গাটা এক প্রকার কামড়ে জ্বলে উঠে। কিন্তু হিরণ সেই যন্ত্রণাটুকু অবলীলায় সহ্য করে নেয়৷ টু শব্দও করে না। এসব সামান্য কাঁটা ছেড়া তাকে যন্ত্রণা দিতে সক্ষম নয়। উল্টো বাণীর থেকে পাওয়া প্রতিটি আঘাতকেও হিরণ স্বযত্নে লালন করে। সেগুলোর দাগ শরীরে বয়ে বেড়ানোর মাঝেও সে শান্তি পায়।

চোখের পাশের ক্ষতটা পরিষ্কার করে সেখানে আপাততর জন্য ব্যান্ডেজ করে নেয় হিরণ। এই কাজটুকু শেষ করে হাত ধোয়ার জন্য সিংকের সামনে সামান্য ঝুকতে নিলেই পিঠে কিছুটা জ্বালা অনুভব করে সে। সঙ্গে সঙ্গে সে একপাশে ফিরে আয়নার পানে তাকিয়ে দেখে হালকা আকাশি রঙা শার্টের পিছনের দিকটা ভেদ করে লাল রক্ত দেখা যাচ্ছে। হিরণের মনে পড়ে যায় যে বাণী রাগের বশে যখন কাঁচের শোপিজ গুলো ছুড়ছিলো সেগুলো এসে তার পিঠে লেগেছিলো। এতক্ষণ পিঠের দিকে হিরণের মনযোগ ছিলো না বিধায় খেয়াল করে নি সে। কিন্তু এখন খেয়াল হতেই সঙ্গে সঙ্গে সে গায়ের শার্টটা খুলে ফেলে। যতদূর সম্ভব পিঠের ক্ষতটাও পরিষ্কার করে নেয় সে।

ফ্রেশ হয়ে অর্ধ উদোম দেহ নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই হিরণ আগে একপল বিছানায় বসে থাকা শাড়ি পরিহিতা নারীকে দেখে নেয়। দেখে নিজের চোখ দুটো জুড়ায়। কলা পাতার ন্যায় সরু দেহতে হালকা জারুল ও সাদা রঙের মিশেলের শাড়িটা খুব মানিয়েছে। হিরণের মনের কোণে এক সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো জীবনে একবার অন্তত বাণীকে শাড়িতে দেখার। কিন্তু মুখ ফুটে সেই ইচ্ছের কথা কখনো প্রকাশ করা হয় নি তার। আর আজ যখন সেই ইচ্ছে পূরণ হয়েছে তখন চোখ ফেরানো দায়। হুট করে হিরণের খুব জানতে মনে চায়, কে সেই ব্যক্তি যার কথায় বাণী শাড়ি পড়েছে?

বাণী ঘাড় ঘুরিয়ে হিরণকে দেখে। দৃষ্টি স্থির হয় হিরণের চোখের পাশে কাটা জায়গাটায়। সঙ্গে সঙ্গে তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করে সে। বাণীর হাসি দেখে হিরণ নীরবে সোফায় গিয়ে বসে। এই হাসিটুকু দেখার জন্য আরো হাজারটা ঘাত সহ্য করতে রাজি আছে সে। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে সে একজনকে কল করে। কাটকাট গলায় প্রশ্ন করে,

“ কোথায়? “

“ বহ্নি ঘুমিয়েছে? “

এতদূর শুনতেই বাণী নিশ্চিত হয় ফোনের অপরপাশের ব্যক্তিটা ইবাত। হিরণ আবারও প্রশ্ন করে,

“ শমসের মজুমদারের ব্যবস্থা করা হয়েছে? “

“ তোমার ম্যাডামের সাহায্যকারীর নাম পরিচয় বের করো ওর পেট থেকে। “

এতটুকু শুনতেই বাণী বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তাকায়। হিরণও বাণীর দিকে তাকিয়ে ছিলো। বাণীকে এমনভাবে তাকাতে দেখে ও সামান্য হাসে। সেই হাসি দেখে বাণীর গা জ্বলে যায়। হিরণ ফোন রাখতেই বাণী বলে উঠে,

“ কেউ সাহায্য করে নি আমাকে। “

হিরণ ফোন চালাতে চালাতে জবাব দেয়,

“ আচ্ছা। “

হিরণ যে বাণীর কথা বিশ্বাস করে নি তা বাণী ভালো করেই জানে। সে আবার চেঁচিয়ে উঠে,

“ বললাম তো আমাকে কেউ সাহায্য করে নি। “

হিরণ একই ভঙ্গিতে বলে,

“ আচ্ছা। “

বাণী এবার ক্ষুব্ধ স্বরে বলে,

“ বিশ্বাস করছেন না কেনো আমাকে? “

হিরণ ফোনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই জবাব দেয়,

“ ঘুমাও বাণী। “

বাণী হিরণের কথার তোয়াক্কা করে না। সে ক্ষোভ মিশ্রিত দৃষ্টি নিয়ে হিরণের পানে তাকিয়ে রয়। হিরণ এবার ফোন রেখে চোখ তুলে তাকায়। স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ পালানোর আগে এবং কারো সাহায্য নেওয়ার আগে ভাবা উচিত ছিলো তোমার। এর দায়ভার আমার না। “

বাণী ক্রুদ্ধ স্বরে বলে,

“ ঘৃণা করি আপনাকে। “

হিরণ হাসে। হেসে বলে,

“ এক এক করে আমাকে ঘৃণা করার কারণ গুলো বলো তো। গুণে দেখি তোমার কাছে আমাকে ঘৃণা করার কয়টা কারণ রয়েছে। “

বাণী সঙ্গে সঙ্গে বলতে শুরু করে,

“ আমার ভাইয়ের খুনি হিসেবে আপনাকে ঘৃণা করি। “

হিরণ হাতের আঙুলের সাহায্যে কারণ গণনা শুরু করে।

“ আমাকে জোর করে বন্দী করে রাখার জন্য আপনাকে ঘৃণা করি। “

“ আনিসুজ্জামান তালুকদারের থেকে আমাকে পণ্যের মতো কিনে নেওয়ার কারণে আপনাকে ঘৃণা করি আমি। “

“ আপনার লাইফস্টাইলের জন্য আপনাকে ঘৃণা করি আমি। “

“ ঘরের বাহিরে আপনার অনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য আপনাকে ঘৃণা করি আমি। “

“ কাফের আপনি। রবের অস্তিত্বে বিশ্বাস নেই আপনার। তাই ঘৃণা করি। “

“ আর… আর আমাকে যেই দুইবার রেপ করেছেন সেজন্য ঘৃণা করি। “

এতদূর বলে বাণী আর বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকে সে। হিরণ অবাক হয়ে বলে,

“ মাত্র সাতটা কারণ? আমি ভেবেছি হাজারটা কারণের লিস্ট ধরিয়ে দিবে তুমি। “

বাণীর কাছে হিরণকে ঘৃণা করার অগণিত কারণ রয়েছে। কিন্তু আপাতত এই কয়েকটা কারণ বলেই সে নীরব হয়ে গিয়েছে। আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না তার। হিরণ এবার হেসে বলে,

“ তোমার কাছে আমাকে ঘৃণা করার জন্য সাতটা কারণ রয়েছে। অথচ আমার তোমাকে ভালোবাসার পিছনে কোনো কারণ নেই। কি অদ্ভুৎ! “

বাণীর এসব কথা শোনার আর ধৈর্য্য নেই। সে একটা কাথা টেনে মাথা পর্যন্ত ঢেকে শুয়ে পড়ে। মনে নতুন ভয় হানা দিয়েছে তার। ওই শমসের নামক লোকটা যদি মুখ খুলে? দুঃশ্চিন্তা বাণীর বুক কামড়ে ধরে। আরো একবার সে কারো বিপদের কারণ হতে রাজি না। আরো একবার সে কারো মৃত্যুর কারণ হতে রাজি না।

__________

হেডকোয়ার্টারে পৌঁছাতেই দূর্জয়কে জুলফিকারের কেবিনে ডাকা হয়। দূর্জয় কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখে সেখানে আগে থেকেই সাইফ,সাদাত, ফারদিন, জুনায়েদ উপস্থিত রয়েছে। দূর্জয়কে দেখতেই জুলফিকার থমথমে গলায় বলে,

“ সেল নং এ থ্রি তে থাকা টেরোরিস্টদের একজনের ডেথ হয়েছে। “

দূর্জয় কপাল কুচকে তাকায়। এটাই সেই ইমারজেন্সি কেস? হুট করে একজন বন্দী টেরোরিস্টের মৃত্যু? বিষয়টা শুনতে যতটা স্বাভাবিক লাগছে বাস্তবিকভাবে ততটা স্বাভাবিক নয় তা দূর্জয় নিশ্চিত। সে আগ্রহী দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই জুলফিকার ফের বলে উঠে,

“ ওই টেরোরিস্ট মুখ খুলতে রাজি হয়েছিলো। তবে ওর শর্ত ছিলো শুধু আমাকেই ও সবটা জানাবে। কিন্তু আমি সেলে পৌঁছে ওকে মৃত অবস্থায় পাই। ক্যান ইউ গেস দ্যা সিচুয়েশন দূর্জয়? “

দূর্জয় অকপটে বলে উঠে,

“ কেউ একজন চায় না আমরা কিছু জানতে পারি। “

এতটুকু বলেই দূর্জয় ভাবুক স্বরে বলে,

“ আর সেই কেউ একজনটা আমাদের মধ্যেই কেউ। “

সাইফ ভনিতা ছাড়া বলে উঠে,

“ স্যার আ’ম সরি। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো একজন প্রতারক হলে আমি সন্দেহের তালিকায় সর্বপ্রথমে কর্নেল জুবায়ের শিকদার স্যারকে রাখবো। উনার আচরণ এবং এই কেস রিলেটেড বিভিন্ন ডিসিশন অত্যন্ত সন্দেহজনক। “

জুলফিকার এবং দূর্জয় নীরবে সাইফের কথা শুনে। তারা এই ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ করে না কারণ তাদের মাথায়ও সন্দেহের তালিকায় প্রথম এই নামটাই এসেছে। সাদাত বলে,

“ আমি লেফটেন্যান্ট সাইফের সঙ্গে একমত। “

জুলফিকার গলা ঝেড়ে বলে উঠে,

“ মোদ্দা কথা হলো এখন কাউকেই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যাবে না। এই অপারেশন রিলেটেড প্রতিটা ইনফরমেশন এখন নিজেদের মধ্যেও কনফিডেন্সিয়াল রাখতে হবে আমাদের। গুরুত্বপূর্ণ সকল ইনফরমেশন সবার আগে আমি অথবা মেজর দূর্জয় ছাড়া অন্য কাউকে জানাবে না। “

সাইফ প্রশ্ন করে,

“ স্যার প্রতারক কে সেটা আগে জানা কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ না? “

দূর্জয় স্থির গলায় বলে,

“ একটা উপায় আছে। “

জুলফিকার প্রশ্ন করে,

“ কি? “

দূর্জয় শুধু শান্ত গলায় বলে,

“ সময়মতো প্ল্যান জানিয়ে দিবো সবাইকে। “

এক এক করে সবাই জুলফিকারের কেবিন থেকে প্রস্থান করলে দূর্জয়ও বেরোনোর জন্য পা বাড়ায়। জুলফিকার সেই মুহুর্তে তাকে পিছু ডাকে,

“ আই নিড টু টক টু ইউ দূর্জয়। “

__________

ফিনফিনে বাতাস বইছে চারিদিকে। তেরো তলা উঁচু দালানের ছাদ হতে রাতের টিমটিমে আলোর শহরটা দেখছে একজোড়া চোখ। এইতো আর কিছুক্ষণ। তারপরই এই দালানের নীরবতা ভেঙে যাবে। সবাই মিলে হন্যি হয়ে খুঁজে বেড়াবে এক পাগলকে। পাগলই তো। একা একা কথা বলা, হুটহাট তীব্র ভয়ে মিইয়ে যাওয়া, বিষন্ন মনে সারাদিন চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকাটা হয়তো পাগলেরই লক্ষ্মণ। নাহয় কি সবাই মিলে তাকে বারবার ধরে বেধে ওই সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিতো?

পাতলা টপের উপর কালো জ্যাকেট আর একটা প্লাজো পরিহিত নারী কায়া নির্ভীক ভঙ্গিতে ছাদের রেলিঙে বসে এসবই ভাবছিলো। হুট করে এক দমকা হাওয়া এসে তাকে ছুঁয়ে যায়। খুলে রাখা চোখ জোড়া সঙ্গে সঙ্গে বুজে আসে। চোখের সামনে ভেসে উঠে অতীত। যেইবার সে প্রথম ও শেষবারের মতো সিনেমা দেখতে হলে গিয়েছিলো। সঙ্গে ছিলো ওই প্রেমিক রূপী প্রতারক।

সিনেপ্লেক্সে তখন ২০১৩ সালে রিলিজ প্রাপ্ত সিনেমা আশিকী ২ এর জন্য উপচে পড়া ভীড়। ১০ বছর আগে রিলিজ প্রাপ্ত একটা রোম্যান্টিক সিনেমার এতো হাইপ দেখে সাইন্স ফিকশন জনরা প্রেমী রুহী খুব কৌতূহলী ছিলো। এতো ভীড়ের মধ্যে আব্রাহাম তার হাত চেপে কোল-ড্রিংকস সহ হাবিজাবি কিনে সিনেমা হলে প্রবেশ করেছিলো। মুভি চলমান অবস্থায় আব্রাহাম কেবল একবার বলেছিলো এই মুভির জিউকবক্স তার খুব প্রিয়। সেদিন রাতেই রুহী নিজের ফোনে আশিকী ২ এর সম্পূর্ণ জিউকবক্স ডাউনলোড করে ফেলে। সেই জিউকবক্স প্রেমী রুহীর জীবনে আর না থাকলেও জিউকবক্সটা এখনো তার ফোনে রয়ে গিয়েছে।

অতীতের ভাবনা ছেড়ে রুহী বর্তমানে ফিরে। চোখ খুলে ফোনটা হাতে নিয়ে ডাউনলোড লিস্ট হতে আব্রাহামের প্রিয় জিউকবক্স প্লে করে নীরবে বসে রয়। আচমকা নিজের পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তার থেকে একহাত দূরেই রেলিঙের উপর কালো টি শার্ট পরিহিত এক যুবক বসে রয়েছে। যুবকের দৃষ্টি রুহীর পানেই নিবদ্ধ। মুখভঙ্গি নির্লিপ্ত। রুহী সেই নির্লিপ্ত মুখপানে চেয়ে রয় অনেকটাক্ষণ। দু’জনের মধ্যে এক অসীম শূন্যতা সম দূরত্ব। যেই দূরত্বটা কেবল এক বিষন্নতার সুতোয় দু’জনকে বেঁধে রেখেছে। রুহী মলিন গলায় প্রশ্ন করে,

“ আমি কি পাগল হয়ে গিয়েছি? “

নিষ্ঠুর যুবক নিরুত্তর রয়। রুহী উত্তরের অপেক্ষা করে না। সে আপনমনে বলতে থাকে,

“ আম্মু আব্বু শুধু বলে আমি অসুস্থ। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গেলেই নাকি সুস্থ হয়ে যাবো। কিন্তু আমি তো জানি আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। “

এবারও সেই যুবক নিরুত্তর রয়। রুহী এবার কণ্ঠে গোপন দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ প্রতারণা করাটা কি খুব জরুরী ছিলো? “

নিষ্প্রভ কণ্ঠে শেষ প্রশ্নটা করে রুহী,

“ সত্যিই কখনো ভালোবাসো নি? “

প্রশ্নটা করার সময় এক করুণ যন্ত্রণা রুহীর হৃদয়ে উথাল-পাতাল ঢেউ তুলে। অস্তিত্বহীন এই যুবকের অস্তিত্ব তাকে ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দেয় সে খুব ঠকেছে। আর এই ঠকানোর দায় বুকে নিয়ে যুবকটা পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেলো। রুহীর শেষ প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই যুবকটা ফের হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। রুহী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবে রেলিঙের উপর উঠে দাঁড়ায়। তার একটা গোপন ক্ষত রয়েছে। ঠকে যাওয়ার ক্ষত। এই ক্ষত কখনো সেরে উঠবে না তা রুহী ভালো করেই জানে। কিন্তু এই ক্ষত বয়ে বেড়ানোও আর তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাইতো জীবনের সঙ্গে সন্ধির ব্যবচ্ছেদ ঘটাতে সে কেবল এক কদম বাড়ায়। পিছনে ফেলে যায় ফোনে প্লে করা গানের বিষন্ন সুর।

“ খিলেঙ্গি যাহা, বাহারে সাভি
মুঝে তু ওয়াহা, পায়েগা
রাহেগি যাহা, হামারি ওয়াফা
মুঝে তু ওয়াহা, পায়েগা।
মিলুঙ্গা মে ইস তারাহ, ভাদা রাহা
রাহুঙ্গা সাঙ্গ মে সাদা, ভাদা রাহা
তুঝে জিনা হে মেরে বিনা। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here