এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৯.
এতক্ষণ ধরে বাণীর কোলে মুখ লুকানো ছানাটা এবার ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ তুলে পিছনে তাকালো। অপরিচিত লোকটাকে দেখে নিজের কান থেকে হেডফোনটা খুলে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে থাকলো। যেনো চোখের ইশারায় জানতে চাইছে,
“ তুমি কে বাপু? তোমাকে তো চিনলাম না৷ “
সামনে বসা মানুষটা বহ্নির না বলা প্রশ্নটা যেনো বুঝতে পারলো। একহাতে নিজের মুখে বাঁধা রুমালটা নামিয়ে কোমল স্বরে বলে,
“ হাই বহ্নি। ইট’স মি। মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়। রিমেম্বার মি? “
বহ্নি মনে করার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মনে পড়ে। এই লোকটা অনেকটা এরকমই বেশভূষায় সে আগেও দেখেছিলো। সাথে ছিলো অনেকগুলো আংকেল। ষ্টুপিড আংকেলটাও ছিলো। মনে পড়তেই বহ্নি মাথা নেড়ে বুঝায় সে চিনতে পেরেছে। দূর্জয় নিজের মুখের রুমালটা তুলে নেয় দ্রুত। হাতে বেশি একটা সময় নেই তার। সে নিজের পকেট হতে আরো দুটি রুমাল বের করে দ্রুত বাণীর হাতে দিয়ে বলে,
“ তাড়াতাড়ি মুখ বেধে নাও। বহ্নিকেও ভালো করে বেধে দাও। বাহিরে গ্যাস আছে। কাশি উঠতে পারে। “
দূর্জয়ের তাড়াটা বাণীর মস্তিষ্ক সচল করে তুলে। সে দ্রুত অশ্রু মুছে চোখের পলকে নিজের আর বহ্নির মুখটা বেধে নেয় রুমাল দ্বারা৷ এরই মাঝে বড় বড় পা ফেলে রুমে প্রবেশ করে ইউনিফর্ম পরিহিত সাইফ। তাকে দেখতেই বহ্নি প্রফুল্ল গলায় চেঁচিয়ে উঠে,
“ মাম্মা দেখো ওই স্টুপিড আংকেল। “
এইটুকু বাচ্চার মুখে বিরক্তিকর ডাক শুনে সাইফের রাগ উঠে। ইয়াসমিনের ভাইয়া ডাকের পর তার জীবনে শোনা সবথেকে বিরক্তিকর সম্বোধন বোধহয় এটাই। তবুও সে নিজের রাগটুকু চেপে দূর্জয়ের কাছে এসে নিচু গলায় জানায়,
“ স্যার পুরো বাসা সার্চ করেছি। গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা স্কেপ ওয়ে পেয়েছি। আমাদের আগমনের আলামত দেখে হিরণ সেই পথ ধরে পালিয়েছে সঙ্গে কয়েকজনকে নিয়ে। “
দূর্জয় বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,
“ কাপুরষ কোথাকার! “
সাইফ সঙ্গে সঙ্গে আস্বস্ত করে জানায়,
“ চিন্তা করবেন না। পিছনে জুনায়েদ, ফারদিন আর ব্যাক আপ টিমের কিছু সদস্যও গিয়েছে। আশা করছি অসভ্যটাকে ধরতে পারবে। “
হিরণ যে পালিয়েছে এই সূক্ষ্ম কথাটুকু বহ্নি না শুনলেও বাণী ঠিকই শুনতে পেয়েছে। মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। আর কি আশা করা যায় এই পুরুষের কাছ থেকে? বিপদে পড়তেই ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে গেলো। ঠিকি নিজের গা বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে দ্বিধা করলো না। দূর্জয় সাইফের কথা শুনে মৃদু আশ্বস্ত হয়েই বাণীকে নিচু স্বরে বলে,
“ লেট’স নট ওয়েস্ট আওয়ার টাইম এনিমোর। “
বাণী মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে প্রস্তুত এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু তার পূর্বেই দূর্জয় ফের একবার বহ্নির দিকে ইশারা করে বলে,
“ আই নিড টু টক টু হার। মে আই? “
বহ্নি সামান্য মাথা নেড়ে অনুমতিটুকু দিতেই দূর্জয় বিলম্ব করে না। হাঁটু গেড়ে ফের বহ্নির সামনে বসে তার হাত দুটো নিজের বড় হাতের মুঠোয় পুড়ে শুধায়,
“ বহ্নি দিজ ইজ এ গেম রুল। আপনাকে জাস্ট তিনটা রুলস ফলো করতে হবে। আপনি কি প্লিজ আমার সঙ্গে কো অপারেট করবেন? “
বহ্নি অবাক হয়। সামনে বসে থাকা লোকটার পারমিশন চাওয়ার ভঙ্গিমা দেখে সে মনে মনে লোকটাকে জেন্টালম্যান হিসেবে খ্যাত করে। অত:পর মাথা নেড়ে বুঝায় সে কো অপারেট করতে রাজি। দূর্জয় মৃদু হেসে বলে,
“ রুল নাম্বার ওয়ান হলো যতক্ষণ না আমি বলবো আপনি চোখ খুলবেন না। রুল নাম্বার টু হলো আপনি গুড গার্ল হয়ে গাড়িতে মাম্মার কোলে বসে থাকবেন, একটুও নড়াচড়া করবেন না। রুল নাম্বার থ্রি হলো আপনি কান থেকে হেডফোন খুলবেন না। “
বহ্নি রুলস গুলো শুনে দাঁত বের করে হেসে বলে,
“ এগুলো তো খুব ইজি। “
দূর্জয়ও আরেকদফা ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি ফুটিয়ে বহ্নির কানে হেডফোনটা পড়িয়ে দেয়। অত:পর উঠে দাঁড়িয়ে সাইফকে বলে,
“ নিচে যাও। আমরা আসছি। “
সাইফ চলে যায়। বাণী আচমকা কিছু একটা ভেবে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে বহ্নির আলমারি থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করে নিজের হাতে নিয়ে নেয়। দূর্জয়ের কাছে এসে বলে,
“ তোমার মায়ের শাড়ি। একদম আগের মতোই আছে। “
দূর্জয় নীরবে একবার বাণীকে দেখে ফের ব্যাগের দিকে তাকায়। বাণী তালুকদার তার মায়ের শাড়ির অযত্ন করে নি। বিষয়টা কি ভালো লাগার? জানে না দূর্জয়। সে নীরব রয়। বাণীও আর কথা না বলে বহ্নিকে কোলে তুলে নিতেই বহ্নি দূর্জয়ের কথা মতো চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখ বন্ধ করে হেডফোন হতে ভেসে আসা গানের শ্রুতিমধুর সুর শুনতে ভালো লাগছে বেশ। দূর্জয় বাণীকে বলে,
“ চলো। “
বলেই দূর্জয় পা বাড়ায়। বাণীও পিছু পিছু বেরিয়ে আসে। সিঁড়ি হয়ে নামার সময় আচমকা বাহির থেকে ফের গুলি বর্ষণের শব্দ ভেসে আসে। আকস্মিক শব্দে বাণী ভীত হয়। ভয়ে কুঁকড়ে উঠে টাল সামলাতে না পেড়ে সে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে। চিৎকার করার সুযোগ পেলো না মোটেও। কোল থেকে বহ্নি পড়ে যেতে নিলেই সামনে থেকে দূর্জয় দ্রুত বলিষ্ঠ বাহু দ্বারা বাধা দেয়। পরপর নিজেই বহ্নিকে কোলে তুলে নিয়ে সতর্ক করে বলে,
“ সাবধানে হাঁটো তবে দ্রুত। “
ছোট্ট মানুষটা একহাতে কোলে জড়িয়ে অপর হাতে পিস্তলটাকে শক্ত করে চেপে ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে দূর্জয়। পিছু পিছু বাণীও। ফ্রন্ট ইয়ার্ডটা তখন সম্পূর্ণ সেনাদের আয়ত্তের অধীনে। দূর্জয় সবার আগে সাইফকে প্রশ্ন করে,
“ কিসের ফায়ারের শব্দ হলো? “
“ স্যার হিরণের একজন লোক ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিলো। সুযোগ পেতেই পালানোর চেষ্টা করে। সাদাত ওর পিছু পিছু গিয়েছে। ও-ই হয়তো ফায়ার করছিলো। “
দূর্জয় আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
“ আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি। তোমরা কাজ শেষ করে সরাসরি হেডকোয়ার্টারে পৌঁছাবে। “
এখানেই অর্ডারের ইতি টেনে দূর্জয় দ্রুত বাড়ির সীমানার বাহিরে বেরিয়ে আসে। বাণী এই ত্রিসীমানার বাহিরে প্রথম কদম রাখতেই মনে মনে বলে,
“ আলহামদুলিল্লাহ। “
দ্রুত পা ফেলে বাড়ি থেকে মিনিট দু’য়েকের দূরে যেতেই বাণী দেখে একটা গাড়ি রাস্তার পাশে অপেক্ষমান। কালো এই জিপ গাড়িটা যে দূর্জয়ের তা চিনতে ভুল করে নি সে। দূর্জয় গাড়ির ফ্রন্ট সিটের দরজা খুলে দিতেই বাণী নীরবে গাড়িতে উঠে বসে। দূর্জয় তাড়া দিয়ে বলে,
“ সিটবেল্ট বাঁধো জলদি। “
বাণী কথাটুকু মেনে সেই অনুযায়ী কাজ করতেই দূর্জয় বহ্নিকে বাণীর কোলে দিয়ে দেয়। অত:পর গাড়ির দরজা আটকে নিজেও দ্রুত ড্রাইভিং সিটে গিয়ে উঠে বসে। এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে গাড়ি স্টার্ট দেয় সে।
__________
বড় বড় পা ফেলে জঙ্গলের মধ্যের পথ ধরে পালানোর চেষ্টা করছে এক যুবক। তাকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে ইউনিফর্ম পরিহিত এক পুরুষ। যুবকটার চোখে মুখে আতঙ্ক এবং বিরক্তি এক সঙ্গে ফুটে উঠেছে। তাকে অনুসরণ করা পুরুষটার প্রতি সে বড্ড বিরক্ত। এই মুহুর্তে তার কাছে পিস্তল থাকলে সে মোটেও না পালিয়ে আগে এই ইউনিফর্ম পরিধেয় পুরুষটাকে খুন করতো। কিন্তু যেহেতু সে নিরস্ত্র সেহেতু পালানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয় আপাতত।
আচমকা এক পাথরে পা লাগতেই সে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে। উঠে দাঁড়ানোর পূর্বেই সেই ইউনিফর্ম পরিহিত লোকটা কাছে এসে পড়ে। যুবকটা ক্লান্ত চোখ তুলে তাকায়। ভালো করে সামনের ব্যক্তিটার মুখ পরখ করে। লেফটেন্যান্ট সাদাত। অন্য এক সেনা সদস্যের মুখে নামটা শুনেছে সে।
সাদাত হাতের পিস্তলটা যুবকের দিকে তাক করে ধরে বলে,
“ সময় অপচয় করা আমার খুব অপছন্দের। এতক্ষণ দৌড়ে শুধু শুধু আমার সময় অপচয় করিয়েছিস তুই। মাথা গরম করে দিয়েছিস। “
যুবক বুঝে যায় তার বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। সে চোখ বুজে নেয়। এই সেনাদের হাতে বন্দী হয়ে অত্যাচারিত হওয়ার থেকে মৃত্যু বরণ করা উত্তম।
সাদাত ট্রিগার পুল করে শুট করতে নিবে এমন সময়ই সেখানে আরেকটা শূন্যে ফায়ারিং এর শব্দ হয়। সাদাত আর সেই যুবক চকিতেই পাশ ফিরে তাকায়। এক নারী পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের পিস্তলটা সাদাতের দিকেই তাক করা। সাদাত বিমূঢ় হয়ে সেই নারীকে পরখ করে। এই নারীকে সে আগেও দেখেছে। সাদাতের স্টকার। যার প্রতি শুরু থেকেই সাদাতের সন্দেহ ছিলো। কিন্তু এই সন্দেহভাজন নারীর অপ্রয়োজনীয় নামটা সে মনে করতে পারছে না। কি যেনো ছিলো নামটা? স্নেহা, সিয়া, সাধনা?
রণচণ্ডী সেই নারী ঝাঁঝালো স্বরে বলে,
“ লিভ হিম এলোন। “
সাদাতের ভ্রু কুচকে আসে। রাশভারী গলায় জানতে চায়,
“ হু আর ইউ? “
“ দ্যাট’স নান অফ ইউর বিজনেস। এখান থেকে চুপচাপ চলে যাও। আমি কিছুই করবো না তোমাকে। “
সাদাত বিরক্ত হয়। মেয়েটা কি তাকে দয়া দেখাতে চাচ্ছে?
“ এক্সকিউজ মি মিস। একজন সেনা সদস্যের অপারেশনে বাগড়া দেওয়ার শাস্তি সম্পর্কে আইডিয়া আছে? “
“ লুক মিস্টার, ট্রাস্ট মি আমার ব্যাপারে নাক না গলানোই এই মুহুর্তে তোমার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। “
“ সরি? আমি নাক গলাচ্ছি? ইট’স ইউ যে প্রতিবার আমার পথে আসছো। আ’ম ওয়ার্নিং ইউ সরে যাও। ভেবো না নারী দেখে যেতে দিবো। আমার কাজে বাধা দিলে তোমাকে শুট করতে আমার মোটেও হাত কাঁপবে না। “
সাদাত আর অগ্যাত নারীর এই কথা কাটাকাটির মধ্যে সুযোগ বুঝে সেই যুবকটা ধীরে ধীরে এক পা, এক পা করে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়। অত:পর নিঃশব্দে সেখান থেকে পালায়। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে লালচে চুলের নারীটা চেঁচিয়ে উঠে। ক্ষোভ মিশ্রিত গলায় বলে,
“ তোমার কারণে ও আমার হাত ছাড় হয়ে গেলো। “
বলেই সেই নারী দ্রুত ওই যুবকের সন্ধানে দৌড়ে যেতে নিলেই সাদাত এসে তার হাত চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে,
“ নিজের পরিচয় বলো মেয়ে। আমার চোখে ধূলো ছোড়ার চেষ্টা করবে না মোটেও। “
সেই নারী অপর হাতের সাহায্যে সাদাতকে আঘাত করার চেষ্টা করলে সাদাত সেই হাতও চেপে ধরে বলে,
“ নট দিজ টাইম। “
রমণী ক্ষুদ্ধ হয়। চোখ ঠিকরে যেনো তার আগুন বের হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করে। তাতে অবশ্য বিশেষ লাভ হয় না। পরিশেষে ব্যর্থ হয়ে সে সু কৌশলে নিজের পায়ের সাহায্যে সাদাতের হাঁটুর জয়েন্টে আঘাত করে। মুহুর্তেই সাদাত তাকে ছেড়ে ‘আহ’’ বলে চাপা আর্তনাদ করে মাটিতে বসে পড়ে। রমণী সামান্য হেসে বলে,
“ আগেই বলেছিলাম আমার কাজে বাধা দিবে না। আমার কাজে বাধা দেওয়ার ইনাম ছিলো এটা। “
রমণী উল্টো ফিরে এবার সেখান থেকে প্রস্থান করতে নিলেই সাদাত পিছন থেকে বলে উঠে,
“ দৃশান নামরা। এজেন্ট অফ ইন্টিলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট – ইয়েমেন। ইন্টারেস্টিং। “
দৃশান বিস্মিত হয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। সাদাতের হাতে নিজের জব সেক্টরের আইডি কার্ড দেখে আরো বিস্মিত হয়। দ্রুত সে নিজের জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে তল্লাশি চালায়। খালি একদম। তার মানে কি কোনোভাবে সাদাতের সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময় তার আইডি কার্ডটা পরে গিয়েছে? সাদাত ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এঁকে দৃশানকে দেখছে। এই হাসি সাফল্যের। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই রমণীর সঙ্গে এতদিনের চোর পুলিশ খেলার অবসান ঘটলো তবে!
__________
দুই কিলোমিটার দীর্ঘ সুরঙ্গ পথের ইতি ঘটে জঙ্গলের মধ্যে এসে। টানেলের মুখ দিয়ে মাথা বের করে এক এক করে বেরিয়ে আসে পলাতকরা। এতক্ষণ মাটির নিচে ওই পথ ধরে আসতে বড্ড কষ্ট হয়েছে তাদের। একে তো অদ্ভুৎ ভ্যাপসা গরম, তার উপর যেনো অক্সিজেন স্বল্পতা। সকলেই মাটিতে হাত পা ছড়িয়ে বসে কিছুক্ষণ প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়। অত:পর ইবাত দ্রুত টানেলের দরজাটা বন্ধ করে হিরণকে তাড়া দেয়,
“ স্যার উঠুন। বেশিক্ষণ এখানে অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। “
হিরণের বুকের উঠানামার গতি অস্বাভাবিক। সে বলে,
“ ওরা আসুক। “
ওরা দ্বারা হিরণ কাকে বুঝিয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না ইবাতের। সে বড্ড বিরক্ত হয়। এই লোকটা কি নিজের ভালো বুঝে না নাকি? সে তবুও ধৈর্য্যশীল গলায় শুধায়,
“ স্যার ওরা সেফ থাকবে। চিন্তা করবেন না। এই মুহুর্তে আপনি বিপদে আছেন। বুঝার চেষ্টা করুন। নিজের কথা চিন্তা করুন একবার। “
হিরণ এবার রেগে যায়। ফুসে উঠে বলে,
“ কে বলেছে তোমাকে আমি নিজের কথা চিন্তা করছি না? নিজের কথা চিন্তা না করলে আমি কখনোই পালাতাম না। নিজের অর্জনগুলো এই কুকুরদের কাছে খোয়াতে রাজি না আমি। কিন্তু তাই বলে বাণী আর বহ্নিকে আমি ছেড়ে দিবো ভাবলে কি করে? “
ইবাত নীরব বনে যায়। স্যার ক্ষেপেছে। এই মুহুর্তে কিছু বললে উল্টো স্যারের রাগের পরিমাণ আরো বাড়বে। আচমকা টানেলের গোল মুখের ন্যায় দরজাটার অপরপাশ হতে করাঘাতের শব্দ হয়। সকলেই সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে উঠে দাঁড়ায়। হিরণ ভ্রু কুচকে দরজাটার পানে তাকিয়ে রয়। ইবাত সহ বাকিরা পরামর্শ দেয় পালানো শ্রেয়। হিরণ কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পূর্বেই দরজার অপর পাশ হতে একটা পুরুষালী গলা বলে উঠে,
“ দরজা খুলো। আমি আয়ান। কেউ আছো? প্লিজ দরজা খুলো। “
আয়ানের কণ্ঠ শুনেই চিনতে পারে ইবাত। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে টানেলের দরজা বেয়ে বেরিয়ে আসে আয়ান। মাটিতে চিত হয়ে পড়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। হিরণ একদফা আয়ানকে দেখে নিয়ে আবার দরজার ভেতর তাকায়। কাউকে খুঁজতে মগ্ন তার চোখ জোড়া। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মুখ দুটো দেখতে না পেয়ে সে অধৈর্য্য গলায় প্রশ্ন করে,
“ বাণী কোথায়? আমার মেয়ে কোথায়? ওদের সাথে নিয়ে আসার কথা ছিলো। “
আয়ান কোনো মতে বলে,
“ স্যার আর্মিরা বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে ফেলেছিলো। আরাভ বাণী ম্যাডাম আর বহ্নিকে নিয়ে বের হতে পারে নি। আমি বহুকষ্টে টানেল দিয়ে পালিয়ে এসেছি। “
হিরণের মাথা বিগড়ে যায়।
“ বের হতে পারে নি মানে? আমার বাণী আর মেয়ে কোথায় তাহলে? “
“ হয়তো আর্মিদের হাতে ধরা পড়েছে স্যার। কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আসার পথে আমাদের বাহিরের লোককে ফোন করে জানিয়েছি। তিনটে গাড়ি তিন রোডে অপেক্ষারত থাকবে। জানোয়ার গুলো ম্যাডামকে নিয়ে যেতে পারবে না। আমাদের লোকেরা ম্যাডাম আর বহ্নিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবে যেকোনো মূল্যে। “
আয়ানের কথা শেষ হতে না হতেই হিরণ একটা কাজ করে। নিজের হাতের পিস্তলে অবশিষ্ট সবকয়টা বুলেট আয়ানের বুকে ফায়ার করে। শরীরটা বুলেট দ্বারা ঝাঁঝরা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মুহুর্তেই। ইবাত সহ উপস্থিত সকলেই ভীত হয়। হিরণ নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,
“ আমি কাউকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বেতন দেই না। বিপদ দেখতেই যারা আমাকে কিংবা আমার পরিবারকে রেখে পালানোর দুঃসাহস দেখাবে সবার পরিণতি এক হবে। “
হিরণের বলা কথাটা যে উপস্থিত সবার জন্য নীরব হুমকি ছিলো তা বুঝতে কারো অসুবিধা হলো না। হিরণ পিস্তল হাতে সেই জায়গা পরিত্যাগ করতে করতে শান্ত গলায় আদেশ দেয়,
“ কে, বা কারা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে এক্ষুনি খোঁজ নাও ইবাত। স্পষ্ট ভাষায় তাদের বলে দাও আই ওয়ান্ট মাই ওয়াইফ এন্ড ডটার সেফ এট এনি কোস্ট। “
স্যারের আদেশ পেতেই ইবাত পকেট থেকে ফোন বের করে স্যারের পিছু ধরে। বাকিরাও তাদের পিছু পিছু অনুসরণ করে। পিছনে পড়ে রয় এক রক্তাক্ত লাশ।
___________
গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে তৈরী পাকা রাস্তা হয়ে। সু বলিষ্ঠ হাতে গাড়ি ড্রাইভে মনযোগী দূর্জয়। চেহারায় আবার পূর্বের গাম্ভীর্যটা ফুটে উঠেছে। বাণী আড়চোখে একবার দেখে নেয় সেই মুখশ্রী। এক সাগর কৃতজ্ঞতা তার দৃষ্টিতে উথলে পড়ছে। কিন্তু তা প্রকাশ করার শাব্দিক ভাষা খুঁজে পায় না সে। তাই অতি নীরবে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করে,
“ আমাকে অন্ধকার থেকে মুক্তি দেওয়া মানুষটার জীবন চিরকাল আলোকিত রেখো আল্লাহ। “
গাড়ি সু কৌশলে চালাতে ব্যস্ত দূর্জয় আচমকা গাড়ির লুকিং মিররে তাকাতেই থমকে যায়। নীরব শুনসান রাস্তায় পিছনে অতি নিকটে থাকা গাড়ির অস্তিত্ব ও তার গতিবিধি অবলোকন করে দূর্জয়ের মুখভাব আরো গম্ভীর হয়। মাথাটা ঠান্ডা রেখে গাড়ির গতি বাড়ায় সে। পিছনের ওই সাদা রঙা গাড়িটাও পাল্লা দিয়ে গতি বাড়ায়। দূর্জয় রাস্তাটা আরেকবার পরখ করে। সর্বোচ্চ গতিতে চালানোর পরও এই জঙ্গল পেরিয়ে মূল হাইওয়েতে পৌঁছাতে আরো বিশ মিনিটের অধিক সময় লাগবে। এতটা সময় কি আদৌ তার হাতে আছে? দূর্জয়ের সচল মস্তিষ্ক জবাব দেয় ‘নেই।’’
দূর্জয় শান্ত গলায় বাণীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ একটা গাড়ি আমাদের ফলো করছে। পিছনে ফিরবে না, ভুলেও তাকাবে না। উত্তেজিত না হয়ে শান্ত থাকো। শক্ত হয়ে বসে থাকো। আমি আছি। সামলে নিবো ইনশাআল্লাহ। “
বাণী বিচলিত হয় শুরুতে। কিন্তু দূর্জয়ের বলা ‘আমি আছি’ তে সে ভরসা খুঁজে পায়। নদীর পানির মতো শান্ত রয়। কিন্তু পিছনের গাড়িটা শান্ত রয় না। হিংস্র হায়নার ন্যায় যেনো ধাওয়া করছে। কেবল ধাওয়া করেই ক্ষান্ত হয় না। দূর্জয় দেখে সাদা গাড়ির ভেতর বসা দু’জনের একজন একটা রাক্ষুসে পিস্তল হাতে নিয়ে তার গাড়ির দিকে তাক করেছে। দূর্জয় সঙ্গে সঙ্গে মৃদু চেঁচিয়ে আদেশ দেয়,
“ বাণী হেড ডাউন। “
তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে ফায়ার ছুঁড়ে হায়নার দল। বাণী বহ্নিকে সহ মাথা নিচু করে ফেলে দ্রুত। দূর্জয় খপ করে নিজের পিস্তলটা হাতে তুলে নিতেই আরেকটা গুলি ছুড়ে পিছনের গাড়ি থেকে। এবার গুলিটা এসে দূর্জয়ের গাড়ির ব্যাক সাইডের কাঁচে লাগে। মুহুর্তেই পিছনের সিটটা চূর্ণবিচূর্ণ কাঁচ দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যায়। দূর্জয়ের এতক্ষণের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে। সে একহাতে গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরে অন্য হাতে পিছনের গাড়ির দিকে ফায়ার করতে করতে চেঁচিয়ে উঠে,
“ বাস্টার্ড! হাও ডেয়ার ইউ টাচ মাই লাভ? “
এরকম সিরিয়াস একটা সিচুয়েশনেও দূর্জয়ের বলা কথা শুনে বাণী স্তব্ধ বনে যায়। চোখ তুলে সে দূর্জয়কে দেখে, দূর্জয়ের হিংস্র রূপটা দেখে। ফের বিমূঢ় হয়। সে কি এইমাত্র ঠিক শুনলো? দূর্জয় কাউকে মাই লাভ বললো? তাও কোনো মানুষ নয় বরং একটা গাড়িকে মিন করে? আর কিছু ভাবার সুযোগ পায় না বাণী। সামনের রাস্তার দৃশ্যটা দেখে সে চেঁচিয়ে উঠে,
“ দূর্জয় সামনে দেখো। “
দূর্জয় মুহুর্তেই সামনে তাকায়। আর ভয়ংকর দৃশ্যটা দেখে সে দ্রুত স্টিয়ারিংটা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে ফেলে। গাড়ি প্রবেশ করে অন্য রাস্তায়। বাণীর তখনও বুক কাপছে। তার চোখের সামনে ভাসছে এই মাত্র দেখা দৃশ্যটা। দূর্জয় যখন পিছনের গাড়িকে কাবু করতে ব্যস্ত সেই সুযোগে সামনে থেকে আরেকটা গাড়ি সম্পূর্ণ গতিতে তাদের দিকে এগিয়ে আসছিলো। আর এক মুহুর্ত দেরি হলেই হয়তো সংঘর্ষটা হয়েই যেতো।
ভিন্ন রাস্তায় প্রবেশ করার পরও গাড়ি দুটো ক্ষান্ত দেয় নি। এখনো দূর্জয়ের গাড়িকে ধাওয়া করে চলেছে। দূর্জয়ের একহাত স্টিয়ারিঙে এবং অপর হাতে পিস্তল ধরা। সে ব্যস্ত গলায় বাণীকে শুধায়,
“ সামনে স্টোরেজ বক্সের ভেতর আমার ফোনটা। দ্রুত নাও। “
বাণী ভয়কে পাশে রেখে মাথা ঠান্ডা করে। এই মুহুর্তে বাঁচতে হলে তার মাথা ঠান্ডা রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। দূর্জয়ের মতো। বাণী সঙ্গে সঙ্গে স্টোরেজ বক্স খুলে কালো ব্যাক কাভারের ফোনটা হাতে তুলে নেয়। ফোন অন করতেই সেখানে সিকিউরিটি হিসেবে পিন নাম্বার জানতে চায়। দূর্জয় নির্দ্বিধায় বলে,
“ ফোর ওয়ান ফোর ওয়ান। “
বাণী ফোন আনলক করতেই দূর্জয় বলে,
“ কল লিস্টে যাও। সাইফ লেখা নাম্বারটা ডায়াল করো। তারপর ফোনটা স্পিকার মুডে দাও। “
বাণী কথামতো কাজ করে। ঠিক দুইবার রিং বাজতেই কলটা রিসিভ হয়। সাইফকে হাই, হ্যালো বলার সুযোগ না দিয়ে দূর্জয় বলে,
“ আই নিড ব্যাক আপ রাইট নাও। ফোনের লোকেশন অন করা আছে। ট্র্যাক করে এই মুহুর্তে ব্যাক আপ পাঠানোর ব্যবস্থা করো। এজ ফাস্ট এজ পসিবল। “
সাইফ দ্রুত অর্ডারটা কাউকে ডেকে বুঝিয়ে দিয়েই প্রশ্ন করে,
“ স্যার ইউ ওকে? “
“ দুটো গাড়ি ফলো করছে সাইফ। শুট করে যাচ্ছে অনবরত। সিচুয়েশন আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যাচ্ছে। “
“ স্যার আপনার কাছে বুলেট আছে পর্যাপ্ত? “
দূর্জয় এবার নীরব রয়। তার কাছে আসলেই পর্যাপ্ত বুলেট নেই। এই জন্যই সে আর পিছনের গাড়ি দুটোর উদ্দেশ্যে ফায়ার করছে না। কারণ আপাতত এই বুলেট কয়টাই তার আত্মরক্ষার শেষ সম্বল। দূর্জয়ের নীরবতা আর সেই সঙ্গে বেড়িয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস দেখে বাণীও পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পারে। সাইফও হয়তো বুঝতে পারে মেজরের নীরবতা। সে ফোনটা রেখে দেওয়ার আগে আশ্বাস দেয়,
“ চিন্তা করবেন না স্যার। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]