এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৪৫.

0
188

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৫.

কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে গন্তব্য স্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে সারিবদ্ধ ছয়টি সেনাবাহিনীর গাড়ি। তৃতীয় গাড়িটার ভেতর রয়েছে দু’জন আতঙ্কবাদী। ইতিমধ্যে সকল হেডকোয়ার্টারে খবর পৌঁছে গিয়েছে যে, এভার ভিউ রেস্টুরেন্ট এবং চট্টগ্রাম গার্লস মডেল কলেজে আতঙ্কবাদী হামলার মূল হোতা হিরণ এবং তার সাহায্যকারী ইবাত মোশতাক নামক দু’জনকে আজ রাত নয়টা নাগাদ চট্টগ্রাম শহরের এক মফস্বল এলাকা থেকে আটক করেছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

সেনাবাহিনীর সবুজ রঙা দ্বিতীয় গাড়ির ভেতর পিছনের দিকে মুখোমুখি বসে আছে ছয়জন লেফটেন্যান্ট। নজর তাদের তৃতীয় গাড়িটার পানে স্থির। সকলেই চোখ রাখছে চারিদিকে। এই দু’জনকে নিয়ে ঝামেলা বিহীন ভাবে একবার হেডকোয়ার্টারে পৌঁছাতে পারলেই সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।

সাইফ নিচু গলায় বলে উঠে,

“ আমি আশা করি নাই যে এই শালা এতো সহজে সারেন্ডার কইরা দিবো। “

সাইফের কথার বিরোধিতা করে না কেউ। কারণ তারাও এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত। এতো বড় এক ক্রিমিনাল কিনা বিনা বুলেট খরচ করেই সারেন্ডার করে দিলো? এটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? কে জানে!

রাফি নিচু গলায় বলে,

“ ওই লোকটা কি বলছিলো তখন? বাণী আপুকে নিজের সন্তানের খুনী বলছিলো। ওয়াজ শি প্রেগন্যান্ট? “

বাণীর জীবনের কালো অধ্যায় সম্পর্কে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা ও নিশা ব্যতীত ছয়জন লেফটেন্যান্টকেও অবগত করেছে দূর্জয়। জানাতে সে বাধ্য ছিলো। যারা ওতপ্রতভাবে এই মিশনের সঙ্গে জড়িত, যাদের সঙ্গে নিয়ে দূর্জয় বাণীকে উদ্ধার করেছে, তাদের কাছ থেকে এই সত্যটা লুকানো সম্ভব ছিলো না। আরো একটা কারণ হচ্ছে দূর্জয় ছেলে গুলোকে ভরসা করে। এতো মাস একসঙ্গে একটা মিশন পরিচালনা করতে গিয়ে সবাইকেই সে ধীরে ধীরে জেনেছে, বুঝেছে। এরা একেকজন ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে একেক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তবে যেই একটা বৈশিষ্ট্য সবার মধ্যেই আছে তা হলো বিশ্বস্ততা।

সাদাত গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,

“ শি ইজ আনম্যারিড। আর ওই বাস্টার্ড এতো বছর উনাকে কিভাবে আটকে রেখেছিলো তা আমরা সবাই জানি। তাছাড়া উনি হচ্ছেন ভিক্টিম। আর একজন রেপ ভিক্টিমের সম্পূর্ণ রাইট আছে চাইলে প্রেগন্যান্সি টার্মিনেট করার। “

প্রত্যয় ভাবুক গলায় বলে,

“ উনার মেয়ে। বহ্নি। ওই বাচ্চাটাকে তো উনি ঠিকই ভালোবাসে। “

ফারদিন এবার সিরিয়াস স্বরে বলে,

“ গাইস। আই থিংক আমাদের এই ব্যাপারে ডিসকাস না করাই বেটার। কারণ ফার্স্ট অফ অল দিজ ইজ হার লাইফ। আর বাণী আপু যেই সিচুয়েশনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে সেই সম্পর্কেও আমাদের কোনো ধারণা নেই। উনার এরকম ডিসিশনের পিছনে নিজের পয়েন্ট অফ ভিউ থাকতেই পারে। এটা আমাদের ম্যাটার অফ কনসার্ন না। “

জুনায়েদ বলে উঠে,

“ আই এগ্রি। আর তাছাড়াও আমাদের এখন মেজরকে নিয়ে কথা বলা উচিত। উনি কি সুন্দর বাজিমাত মারলেন। “

বলে জুনায়েদ দাঁত বের করে হাসে। প্রত্যয় বলে,

“ এক্স্যাক্টলি! স্যারের প্ল্যান ওয়ার্ক আউট করে গিয়েছে। উনার বিশ্বাস ছিলো যে কখনো না কখনো হিরণ অবশ্যই বাণী আপু আর বহ্নির খোঁজে আসবেই। ভাগ্যিস উনি ২৪ ঘন্টা আড়াল হতে আপুর সেফটি ইনশিওর করার জন্য লোক নিযুক্ত করেছিলেন। নাহয় এই মুহুর্তে আমরা কখনই হিরণের আগমনের খবরটা পেতাম না আর ওর মতো রাস্কেলকে আটক করাও সম্ভব হতো না। “

সাইফ তাল মিলিয়ে বলে,

“ আই অলসো এপ্রিশিয়েট হিজ আইডিয়া। কিন্তু উনি কি শুধুমাত্র মিশনের খাতিরেই ওই লোককে নিযুক্ত করেছিলো নাকি এছাড়াও ব্যক্তিগত ভাবে আপুর সেফটি নিয়ে চিন্তিত ছিলো? “

সন্দিহান গলায় প্রশ্নটা ছুড়ে দিতেই পাঁচটা মুখ চোখ বড় করে সাইফের পানে তাকায়। প্রত্যয় বলে,

“ বুলশিট। স্যারকে আমরা চিনি না? উনার মন জুড়ে উনার চাকরি আর উনার কালো রঙের জিপ গাড়ির স্থান আছে শুধু। সেখানে কোনো নারীর এক্সেস পাওয়া অসম্ভব বিষয়। “

সাইফ হাই তুলে বলে,

“ সম্ভব বন্ধু, সবই সম্ভব। রাফির সাথে যেমন অন্যার বিয়েটা সম্ভব, ঝগড়াঝাটি ভাবীর সাথে যেমন তোর প্রেম হয়ে যাওয়াটা সম্ভব, তেমনই মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়ের মনেও কোনো নারীর এক্সেস পাওয়া সম্ভব। “

প্রত্যয় চোখ গরম করে তাকায়। সাইফ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলে,

“ গরীবের কথা বাসি হলেও ফলে। “

__________

বিছানায় শুয়ে বহ্নির সঙ্গে বিভিন্ন আকাশ কুসুম গল্পে মশগুল ছিলো নিশা। আচমকা ফোনের রিংটোনের শব্দ কানে ভেসে আসতেই সে নিজের ফোনটা হাতে নেয়। স্ক্রিনে সেভ করা নামটা দেখেই দ্রুত কল রিসিভ করে। ফোনের অপর পাশের মানুষটার বলা কথা শুনে দ্রুত উঠে বসে। কল কেটে ফোনটা বহ্নির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“ তুমি শুয়ে ফোনে গেমস খেলো। আন্টি একটু আসছি। ওকে? “

বহ্নি মাথা নেড়ে গেমসে মগ্ন হয়। নিশা দ্রুত ওড়নাটা গলায় জড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। মেইন দরজাটা খুলে সিঁড়ির পানে তাকায়। মিনিট দুয়েক পেরোতেই দেখে দূর্জয় উঠে আসছে। পাজাকোলে রয়েছে বাণী। নিশা আঁতকে উঠে। দূর্জয় ভাইয়া তাকে ফোন করে বলেছিলো শুধু এসে দরজা খুলে দাঁড়াতে। সঙ্গে যে বাণীও আছে আর তা-ও এই অবস্থায় তা তার ভাবনার বাহিরে ছিলো। দূর্জয় ততক্ষণে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠে আসে। জুতা পায়েই ঘরে প্রবেশ করে বাণীকে নিয়ে অপর বেড রুমটায় প্রবেশ করে। নিশাও পিছু পিছু আসে৷ চাপা স্বরে প্রশ্ন করে,

“ ভাইয়া, আপুকে কোথায় পেলে? কি হয়েছে? “

দূর্জয় বাণীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলে,

“ হিরণ এসেছিলো। “

নিশা ভীত স্বরে বলে,

“ হোয়াট! “

দূর্জয় এবার সরাসরি নিশার চোখে চোখ রেখে বলে উঠে,

“ লুক নিশা, আমি জানি লাস্ট কয়েক মাসে বাণী শুধুমাত্র তোমার সাথেই একটু স্বাভাবিক ভাবে মিশেছে। তাই সরাসরি তোমাকেই প্রশ্ন করছি। প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে শুধু হ্যাঁ বা না হিসেবে উত্তর চাই। “

নিশা ভীত হয়। ভাইয়া হঠাৎ এতো সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলছে কেনো?

“ ওয়াজ বাণী এক্সপেক্টিং? “

নিশা অবাক হয়। তবে মিথ্যা বলে না।

“ হ্যাঁ। “

“ ও এবরশন করেছে? “

এবারও নিশা সত্যিটা বলে,

“ হ্যাঁ। “

দূর্জয় আর কোনো প্রশ্ন করে না। জানতে চায় না কোনো কারণ। নিশা নিজেই প্রশ্ন করে,

“ ভাইয়া, ওই লোকটা কি কোনোভাবে এই খবরটা জানতে পেরেছে? “

দূর্জয় নিজের ফোন বের করে কিছু একটা ম্যাসেজ পাঠাতে পাঠাতে মাথা নেড়ে শুধু হ্যাঁ বলে। নিশা সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে বলে,

“ লোকটা আপুকে দোষারোপ করেছে তাই-না? বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার দোষ দিয়েছে তাই-না? কিন্তু আপু তো এবরশন করাতে বাধ্য ছিলো। উনার ফিজিক্যাল কন্ডিশন… “

বাকি কথাটুকু শেষ করতে পারে না নিশা। দরজায় বহ্নির উপস্থিতি দেখে নীরব বনে যায়। দূর্জয়ও ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার পানে তাকায়। বহ্নি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“ মেজর? “

দূর্জয় নিশাকে ইশারায় বাণীর সাথে থাকতে বলে বহ্নির কাছে এগিয়ে যায়। কোলে তুলে নিয়ে সোজা চলে যায় বসার ঘরে। একটা সোফায় বসে বহ্নির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,

“ হাই। “

বহ্নি ভাবুক স্বরে প্রশ্ন করে,

“ মাম্মার কি হয়েছে? “

দূর্জয় বহ্নির কপাল ছুঁয়ে তাপমাত্রা পরখ করে বলে,

“ কিছু হয় নি। ঘুমোচ্ছে। “

বহ্নি মুখ কালো করে বলে,

“ আমি ভেবেছিলাম পাপা এসেছে। আবার মাম্মাকে মেরেছে। “

বহ্নির কথা শুনে দূর্জয়ের ভ্রু দ্বয়ের মাঝে ভাজ পড়ে। মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সন্দিহান গলায় জানতে চায়,

“ মেরেছে? “

__________

চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীদের অধীনস্থ উচ্চ নিরাপত্তা সম্পূর্ণ বিশেষ এক সেলে স্থান হয়েছে হিরণের। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ রাতটা ওকে এখানেই রাখা হবে। আগামীকাল ইবাত সহ হিরণকে ঢাকায় সেনাবাহিনীর প্রধান প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে।

ঢিলে হয়ে নিচে নেমে আসা শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটাতে গোটাতে সেই সেলের ভেতর প্রবেশ করে দূর্জয়। অঙ্গভঙ্গি বেশ স্বাভাবিক। রুমের ঠিক মাঝখানটায় মেঝেতে বসা পুরুষটাকে শান্ত দৃষ্টি মেলে দেখে। হিরণ চোখ তুলে তাকায়। অত:পর দাঁত কেলিয়ে হাসতে শুরু করে। কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে বলে,

“ আমি জানতাম তুই আসবি। “

দূর্জয় অত্যন্ত ভদ্রলোকের মতো রুমের এককোণ থেকে একটা চেয়ার টেনে হিরণের মুখোমুখি বসে। ফের শান্ত দৃষ্টি মেলে দেখে হিরণকে। হিরণ এবার হাসি বাদ দিয়ে নিজেও মুখভঙ্গি গম্ভীর করে। দূর্জয়ের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,

“ বাণী ঠিক আছে? “

দূর্জয় শীতল গলায় বলে,

“ কিসের তৈরি তুই? আঘাত দিয়ে পরে মিছে মলম লাগানোর অভিনয় করে কি হাসিল করতে চাস? বাণীর মন? “

হিরণ নিঃশব্দে মৃদু হেসে বলে,

“ মিছেমিছি অভিনয় করে ওর মন পাওয়া গেলে আমি সেরা অভিনেতা হতেও পিছুপা হটতাম না। ট্রাস্ট মি। “

দূর্জয় এবার নিজের হাত ঘড়ি দেখতে দেখতে বলে,

“ আমি এখানে আসার পথে খুব ভেবেছি, যে তোর জন্য উপযুক্ত শাস্তি কি হতে পারে। তোর মতো একজন আতঙ্কবাদী, খুনী, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী, রেপিস্ট ও নিকৃষ্ট মানুষকে ঠিক কোন শাস্তিটা দিলে তোর বিচার হবে! ঠিক কোন শাস্তিটা দিলে ভিক্টিমদের সঙ্গে জাস্টিস হবে! কিন্তু বিশ্বাস কর, তোকে যদি আমি পৃথিবীর সবথেকে কষ্টদায়ক মৃত্যুদন্ডটাও দেই তবুও কোনো ভিক্টিমের এক তিল পরিমাণও ক্ষতিপূরণ হবে না। বাকি ভিক্টিমদের হিসাব আপাতত একপাশে রেখে না-হয় বাণীর কথাই বলি। হোয়াট ডু ইউ থিংক? তোর থেকে দূরে থেকে ও ভালো আছে? শি ইজ নট ওকে এট অল। একটা মৃত দেহ বয়ে বেড়াচ্ছে ও। কি বলছিলি তুই? ও তোর বাচ্চাকে খুন করেছে, তাই-না? তুই কি করেছিস? খুনী তো তুইও। বাণীকে খুন করেছিস। ইউ ডিস্ট্রোয়েড হার মেন্টালি। শুধু ডিস্ট্রোয় করে ক্ষান্ত হস নি, এই অসহনীয় জীবনের ভার ওকে বয়ে বেড়াতে বাধ্য করেছিস। স্টিল তুই ক্লেইম করিস ইউ লাভ হার? এভ্রিথিং ইউ ডিড টু হার ওয়াজ বিকজ অফ লাভ? টু হেল উইথ ইউ, এন্ড টু হেল উইথ ইউর লাভ। “

শেষ কবে একসঙ্গে এতগুলো কথা বলেছে দূর্জয়ের খেয়াল নেই। আপাতত সে সেসব দিকে খেয়াল করতেও চায় না। নিজের অতিমাত্রার রাগটাকে শীতলতার চাদরে মুড়িয়ে শান্ত স্বরে বলে,

“ ওহ। আমি হয়তো আসল কথা থেকে সরে আসছি। কথা হচ্ছিলো তোর শাস্তির হিসাব নিকাশ নিয়ে। তো বাণীর সাথে কিংবা সকল ভিক্টিমদের সাথে তুই যা করেছিস তার বিনিময়ে ওদের সকলকেই একটা লাইফ টাইম ট্রমা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এই-যে ওদের সকলকে যেই ট্রমাটা দিয়েছিস না তুই, এর বিনিময়ে তোর একমাত্র যোগ্য শাস্তি হলো সেম মেন্টাল ট্রমা। কারণ মৃত্যু তোর জন্য কোনো শাস্তি নয়, প্রতিদিন একটু একটু করে মানসিক যন্ত্রণায় ধুকে ধুকে মরাটাই তোর জন্য সবথেকে বড়ো শাস্তি। আর এই শাস্তির শুরু কোথা থেকে জানিস? বহ্নির মাধ্যমে। শি হেটস ইউ। ওর কাছে তুই একটা এবিউসার ছাড়া আর কিছুই না। যদিও এতো ছোট একটা বাচ্চার জন্য এবিউজিং শব্দের ভার বওয়াটা কষ্টকর। কিন্তু ও খুব সুন্দর করেই বুঝে গিয়েছে যে তুই ওর মাম্মার এবিউজার। চিন্তা করিস না। আপাতত তোকে ঘৃণা করার জন্য ওর এতটুকু জানাই যথেষ্ট। বড় হতে দে ওকে। বুঝতে শিখুক। তখন ও সম্পূর্ণ সত্যটা জানবে। জানবে যে তোর এই গুড ফাদার ইমেজের পিছনে কি ভয়ংকর একটা পরিচয় লুকিয়ে ছিলো! কেমন হবে যখন ও জানবে যে তুই ওর মাম্মা’র রেপিস্ট? “

হিরণের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। দুই চোখ ঠিকরে ক্রোশ ও আক্রোশ ঝড়তে থাকে। উত্তেজিত হয়ে বলে,

“ কিচ্ছু জানবে না আমার মেয়ে। কিচ্ছু না। “

“ অবশ্যই জানবে। “

দূর্জয় খেয়াল করে হিরণের শরীর মৃদু কাঁপছে। কপালের শিরা ফুলে কেমন দপদপ করছে। সম্ভবত রাগে। হাত দুটো হ্যান্ডকাফ দিয়ে পিঠের পিছনে নিয়ে আটকানো। পা দুটোও এক জোড়া শক্ত শিকল দ্বারা বাঁধা। সেজন্যই বোধহয় রাগ মেটানোর পথ খুঁজে পাচ্ছে না। হিরণ মেঝেতে অনেকটা দ আকৃতির মতো করে বসে ছিলো। চোখ জোড়া বুজে সে সামনের দিকে উবু হতেই তার মাথা গিয়ে ঠেকে হাঁটুর সঙ্গে।

দূর্জয় নীরবে দেখে সে-ই দৃশ্য। জায়গা মতো আঘাত করেছে সে। পাচ্ছে। শয়তানটা মানসিক যন্ত্রণা পেতে শুরু করেছে। আগুনে ঘি ঢালতে দূর্জয় বলে উঠে,

“ এতো গুলো পরিবারের সুখ নষ্ট করে ভেবেছিলি নিজের পরিবার গড়তে পারবি? এতো সহজ? তোর মতো মানুষ পরিবারের সুখ ডিজার্ভ করে না। তুই একা ছিলি, একা আছিস আর আজীবন একাই থাকবি। “

নিজের কথাটুকুর ইতি টেনেই দূর্জয় উঠে দাঁড়ায়। প্রস্থানের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ঠিক সেই মুহুর্তে হিরণ শীতল গলায় বলে,

“ দেশের সাহসী সৈন্য দেশের চিন্তা কর, শেষ হামলা রুখে দেওয়ার প্রস্তুতি নে। “

দূর্জয়ের ভ্রু দ্বয়ের মধ্যে ভাজ দেখা যায়। সে পিছু ফিরে তাকায়। হিরণ ঠোঁট বাকা করে হাসে,

“ কি মনে হয়? মানসিক যন্ত্রণা শুধু তুই-ই দিতে পারিস? আমার দেওয়া যন্ত্রণার ভার বইতে না পেরে মানুষ পাপের বাপ ডাকে আমাকে। অন্যের সন্তান নিয়ে মাথা না ঘাটিয়ে মস্তিষ্কটাকে একটু খাটা। ভাব, শেষ হামলাটা কোথায়, কখন এবং কিভাবে হবে। ভাব আর মাথার চুল ছিঁড় শালা। “

দূর্জয়ের ধৈর্য্যের বাধ ভাঙ্গে। সে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিজের শক্তপোক্ত হাতে সজোরে হিরণের গালে একটা চড় বসায়। ডান কানটা সঙ্গে সঙ্গে যেনো ঝিম ধরে যায় হিরণের। তবুও সে অদ্ভুৎ ভঙ্গিতে নির্লজ্জের মতো হাসতে থাকে। বোকা বাঘের দল। হিরণ কি এতটা কাঁচা খেলোয়াড়? সে জানতোই ভালো যে তার ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বাণীর সাথে মুখোমুখি না হলেও সে শান্তি পেতো না। তাইতো সব ব্যবস্থা করে রেখেই সে এসেছে। দেখুক লোকে, জানুক লোকে। হিরণকে বন্দী করেও তারা এই দেশের বুকে আরেকটা হামলা থামাতে পারবে না।

__________

রাত্রির শেষ প্রহর তখন। অন্ধকারে নিমজ্জিত গোটা ঘরটা। পাশের রুমে নিশা ও বহ্নি একসঙ্গে ঘুমোচ্ছে। বাণী একা এই রুমটায় অন্ধকারের মাঝে বসে আছে। বিছানার হেড সাইডটায় ওর পিঠ ঠেকে আছে। তার হুশ ফিরেছে দূর্জয় যাওয়ার ১০/১৫ মিনিট পরেই। তারপর থেকে বহ্নি আর নিশা এক দন্ড তাকে একা ছাড়ে নি। কিন্তু ওরা ঘুমিয়ে পড়তেই এই অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে শুরু করেছে। কানের কাছে বাজছে হিরণের বলা কথাগুলো।

মনে পড়ে যায় নিজের প্রেগন্যান্সির নিউজ জানতে পেরে ওর অনুভূতি। আর দশটা সাধারণ নারীর মতো বাণী খুশি হতে পারে নি বাচ্চাটার অস্তিত্বের কথা জানতে পেরে। কেমন যেনো অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছিলো নিজেকে। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না। নির্লিপ্ত ছিলো।

কিন্তু তার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হয়ে যায় যখন ডক্টর তাকে জানায় ওর ফিজিক্যাল কন্ডিশন এই বেবি ক্যারি করার মতো স্ট্যাবল নয়। আর যদি বাণী এই প্রেগন্যান্সি কন্টিনিউ করতেও চায় তবে এতে তার লাইফ রিস্কে রয়েছে। বাণী নিশ্চুপ ছিলো সেই মুহুর্তে। এটা সত্য যে আগে তার নিজের জীবনের প্রতি কোনো মায়া ছিলো না। কিন্তু এখন আছে। নিজের জন্য না বরং নিজের মেয়ের জন্য। বহ্নি আছে। ওই বাচ্চাটার জন্য হলেও তাকে বেঁচে থাকতে হবে। নিজের মেয়েকে কারো ভরসায় রেখে মরার ফুরসতটাও বাণীর হাতে নেই।

তাই সে ডক্টরের কথা মেনে নিয়েছিলো। এবরশন করাতে রাজি হয়ে যায়। এই পুরোটা সময় বাণী অনুভূতিহীনের ন্যায় আচরণ করলেও মাইনর ওটির রুমটায় আর শান্ত থাকতে পারে নি। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সে। বারবার নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিলো। মহিলা ডাক্তারটা খুব অমায়িক ছিলো বিধায় মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করেছিলো ওই পরিস্থিতিতে।

হিরণের মুখোমুখি অবস্থায় তখন ওইভাবে বাণীর কথাগুলো বলার একটাই কারণ ছিলো। তা হলো হিরণকে কষ্ট দেওয়া। কিন্তু হিরণের বলা কথাগুলো বাণীর ক্ষতে লবণ ছিটানোর মতো কাজ করেছে। অপরাধবোধ আবার পিষ্ট করে দিচ্ছে তাকে। চারপাশটা কেমন অসহায় লাগছে হুট করেই। বাণীর খুব মন চাচ্ছে এই মুহুর্তে আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে। পৃথিবী সমান দুঃখগুলো নিজের আত্ম চিৎকারে ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। চাইলেও বাণীর কেঁদে বুক ভাসানোর অনুমতি নেই।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here