তবু_সুর_ফিরে_আসে ৪২ পর্ব

0
166

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

৪২ পর্ব

লিফট সাত তলায় এসে থামতেই রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা হেরাদের। হেরাকে অফিসে দেখে রেজোয়ান অবাক হয়ে বলে উঠলো,
আরে আজ তো অফিসের বিগ বস চলে এসেছে । ন‌ওশাদ জানে ?
হেরা বলল, না ভাইয়া উনাকে কিছু বলা হয়নি এই যে দেখছেন না দুই বোন এদের কান্ড আমাকে টেনে নিয়ে আসলো অফিসে। এই ব্যস্ত সময়ে ডিস্টার্ব করার কোন দরকার ছিল বলেন ?
হেরা ওরা দারুন কাজ করেছে ব্যস্ততা তো থাকে ,থাকবেই এসব নিয়ে সব সময় ভাবলে হয় না রেজোয়ান বলল।
নাহিন বলে উঠলো, দেখলে বৌমনি ঠিক কথাই বলেছিলাম আমি ।
ওরা কথা বলতে বলতে ন‌ওশাদের কেবিনের সামনে চলে এলো।‌হেরা অফিস টা দেখছে । ঢুকতেই একটা বিশাল হল রুমের মত সেখানে আলাদা আলাদা কিউবিকলে লোকজন যে যার কাজে ব্যস্ত। কাঁচ ঘেরা রুম‌ও আছে আশেপাশে। এই বিল্ডিং এর তিনটা ফ্লোর জুরে ন‌ওশাদের বিভিন্ন কম্পানির কর্পোরেট অফিস। সবার থেকে আলাদা করে ন‌ওশাদের অফিসের কেবিন টা । এই দিকটা অনেক নির্জন ।
রেজোয়ান দরজা খুলে ভেতরে না ঢুকে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল আড়ালে হেরা আর ঐ দুই বোন ,
বলতো ন‌ওশাদ কে এসেছে ?
ন‌ওশাদ ডেক্সটপ থেকে চোখ তুলে বলল, তোর কোন এক্স, ওয়াই, জেড নাকি তোর চেহারার চকমক দেখে তো তাই মনে হচ্ছে !
ধুর শালা সব সময় ফাজলামি আমার এক্স, ওয়াই, জেড না তোর প্রেজেন্ট এন্ড ফিউচার ।
ন‌ওশাদ তাকিয়ে দেখে হেরা দাঁড়িয়ে আছে রেজোয়ানের পিছনে।
ন‌ওশাদ অবাক হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তুমি !
কি সারপ্রাইজ হয়ে গেলি তো , রেজোয়ান হাসতে হাসতে বলল।
হেরা ন‌ওশাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য, নাহিন দুষ্ট মেয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে ।
ন‌ওশাদ নাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, থ্যাংকস নাহিন তুমি দারুন কাজ করেছো।
ভাইয়া বৌমনি নিচে থেকে আমাকে বকছে সে তো আসবেই না অনেক টেনেটুনে এনেছি ।
হেরা তুমি প্রথম এলে আজ অফিসে তাই না , ন‌ওশাদ বলল।
জ্বি । হেরা ন‌ওশাদের কেবিনটা দেখছে । একটা বিশাল রুম । এক সাইডে সুন্দর সোফা রাখা। ন‌ওশাদের টেবিল, তার সাইডে ডেক্সটপ , টেলিফোন । একটা কর্নারে একটা বুক সেলফে কিছু ব‌ই । কিছু মানিপ্ল্যান গাছ রাখা ছোট ছোট ভাসে । আর বিশাল জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে।
বসো না তোমরা দাঁড়িয়ে কেন , ন‌ওশাদ বলল।
ভাইয়া আমরা একটু ঘুরে দেখে আসি আশেপাশটা , এলিন বলল ?
রেজোয়ান বলল, শিওর চলো তোমাদের একটা দারুন এক্যুরিয়াম দেখিয়ে আনি আগে । ওরা দুজন থাকুক এখানে ।
চলেন ভাইয়া বলে দুই বোন রেজোয়ানের সঙ্গে চলে গেল ।
ওরা যাওয়ার পর ন‌ওশাদ হেরার কাছে এসে হেরার মাথায় হাত রেখে দাঁড়ালো , কি হয়েছে তোমার মুখ এত শুকনো কেন কাঠবিড়ালী ?
হেরা চোখ নামিয়ে বলল, কোথায় আমি ঠিক আছি তো।
তাকাও আমার দিকে ।
হেরা উঠে দাঁড়িয়ে ন‌ওশাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, হঠাৎ খুব খারাপ লাগছিল আজ।
কেন শরীর খারাপ ?
না আমার যেন কি হয়েছে কারো কোন কথাই সহ্য হয় না ।কেমন অসহ্য লাগে, ভার্সিটিতে ছোট্ট কারণে মাহাদিকে অনেক গুলো কথা শুনিয়ে দিয়ে এলাম হেরার চোখ ভিজে উঠেছে।
ন‌ওশাদ হেরার কপালে চুমু খেয়ে বললো, হয় এমন কখনো কখনো। যখন মানুষ কোন একটা কিছু নিয়ে খুব বেশি যন্ত্রণার ভেতরে থাকে তখন আশেপাশের মানুষের কথা গুলো এমন‌ই লাগে। তখন কি করতে হয় জানো ?
কি করতে হয় ?হেরা ন‌ওশাদের বুকে মাথা রেখেই প্রশ্ন করলো।
ভালোবাসার মানুষের বুকে জড়িয়ে থাকতে হয় !
তাই বুঝি, এভাবে জড়িয়ে থাকতে হয় হেরা হেসে দিলো ?
এভাবে আরো শক্ত করে, ন‌ওশাদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরল হেরাকে ।
আপনার‌ও কষ্ট হচ্ছে খুব ?
না আমি কষ্ট টা ভুলে যেতে চাচ্ছি। তুমি ঠিক আছো আমার জন্য এটাই যথেষ্ট হেরা।
আমার কেন এত খারাপ লাগছে ?
তুমি বেশি বেশি চিন্তা করছো ব্যাপার টা নিয়ে, তাই । চিন্তা করে না । চিন্তা করলে, মন খারাপ করে থাকলে কি সব ফেরত চলে আসবে যা আমরা হারিয়েছি বলো ?
ভুলতেই তো পারছি না নিশালের পাপা!
সে জন্যই তো বললাম চলো কোন জায়গায় থেকে ঘুরে আসি । কয়েকটা দিন এসব কিছু থেকে দূরে থাকলে দেখবে ভালো লাগছে ।
কিন্তু নিজের মনটা থেকে দূরে থাকব কিভাবে, হেরা বলল।
সে জন্য তো আমি আছি তোমার মন ভালো করার জন্য ম্যাডাম।
ন‌ওশাদের টেবিলে রাখা নিশালের ছবিটার দিকে তাকিয়ে হেরা বলল, নিশালের সঙ্গে কথা হয়েছে আপনার ?
হুম ।
ওর অনেক মন খারাপ তাই না ?
মন খারাপ হয়েছে অনেক , খবর টা শুনে তো কথাই বলতে পারেনি কিছুক্ষণ। আমি আর এত কিছু বলিনি কি হয়েছিল তোমার সঙ্গে । তবে আমাকে বলল, মামনির মন অনেক খারাপ তাই না পাপা ? আমি বললাম তুমি কথা বলো ভালো হয়ে যাবে। তখন বলল , আগে মামনি সুস্থ হোক এখন আমার সঙ্গে কথা বললে মামনি আরো বেশি কষ্ট পাবে ।
হেরার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ।
একি আবার কাঁদছো ,হেরা প্লিজ ।
ছেলেটা অনেক কিছু ভেবেছিল ভাই- বোন হলে কি করবে ?
হেরা শক্ত হ‌ও নিশাল অনেক বুঝদার একটা ছেলে ও নিজেকে সামলে নিয়েছে। তুমি ভেঙ্গে পড়ছো দেখে সবাই তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। নিশাল, বুবু সবাই বলছে পরে কথা বলবে তোমার সঙ্গে। তুমি নিজেকে শক্ত করো আমার জন্য হেরা। আমার তোমাকে এরকম দেখলে অনেক অনেক বেশি কষ্ট হয়।
হেরা চোখের পানি মুছে ফেলল।
হঠাৎ বলল, ছাড়ুন আমাকে কেউ এসে পড়বে আমার তো খেয়ালই ছিল না , হেরা ন‌ওশাদের হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো।
কেউ আসবে না হেরা আর আসলেই কি আমি আমার বিয়ে করা ব‌উ কে জড়িয়ে ধরে আছি কার কি ?
ঠিক আছে ঠিক আছে এখন ছাড়ুন ওরা আসছে হয়তো ।
তার আগে বলো হেরা আর মন খারাপ করবে না তুমি ।
আচ্ছা আর মন খারাপ করবো না ।
প্রমিজ ।
হুম প্রমিজ।
ন‌ওশাদ হেরার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো ।
সব কষ্ট নিয়ে নিলাম এখন থেকে আর মন খারাপ করে থাকা চলবে না কাঠবিড়ালী ।
হুঁ।
ন‌ওশাদ হেরাকে নিয়ে অফিসটা ঘুরে দেখালো।‌ নাহিন, এলিন দুইবোন অফিস দেখে খুব মজা পেয়েছে। যদিও শোয়েব দুই বোনকে ডেকে হালকা একটা ঝাড়িও দিয়েছে হঠাৎ অফিসে আসার জন্য। তারপর ন‌ওশাদ ওদের সবাইকে নিয়ে লাঞ্চ করতে রেস্টুরেন্টে গেল।
পুরো এক সপ্তাহের পর হবে হেরার মুখে হাসি দেখলো ন‌ওশাদ। সুন্দর মুখটা হাসিখুশিই মানায়। কিন্তু এই কয়দিন বিষাদের এক মেঘ সারাক্ষণ ঢেকে রেখেছিল এই সুন্দর মুখটাকে ।
চলে আসার সময় ন‌ওশাদ হেরার কানের কাছে এসে বলল, এভাবেই হাসিখুশি থেকো প্লিজ আমার জন্য । আমার আর কিছু লাগবে না হেরা।

বাসায় ফিরে হেরা গাড়ি থেকে নামতেই দেখে পারুল দাঁড়িয়ে আছে। হেরার সামনে এসে বিলাপ জুড়ে দিলো।
আম্মা গো আমি ফোন দিসিলাম রিয়াজ ভাইরে কাইলকা , রিয়াজ ভাই আপনার খবর ক‌ইলো তারপর থেইকা আমার কষ্টে কলিজা ফাইটা যাইতাছে । আইজ ছুইটা আসছি তাই। পারুল ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছলো।
হেরা হাসিমুখে পারুল কে বলল, ভালো করেছো চলে এসেছো তোমার কথা মনে হচ্ছিল বারবার। পুতুলের কি খবর কেমন আছে ?
আছে আম্মা পড়ায় পাড়ায় ঘুইরা বেড়ায় মুখ পুরি ।
নাহিন পারুলকে বলল, পারুল তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি ?
হেরা নাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, নাহিন আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি ইনকুয়েরি রাইট নাউ ।
বৌমনি ?
লেট মি হেন্ডল ইট প্লিজ নাহিন।
নাহিন বৌমনির কথা শুন, এলিন নাহিনকে আটকালো।
আফা কি কথা জিজ্ঞেস করবেন , পারুল নাহিনকে প্রশ্ন করলো ?
পারুল আমার এক জোড়া স্যান্ডেল খুঁজে পাচ্ছি না একটু খুঁজে দিও তো।
ঠিক আছে আফা ।
হেরা এলিন, নাহিনকে নিয়ে দোতলায় উঠে এলো।
নাহিন তোমরা কেউ পারুলের সঙ্গে কোন কিছু নিয়ে কথা বলবে না প্লিজ ।
কিন্তু কেন বৌমনি ? ভাইয়া আজ আসলে ভাইয়াও ধরবে পারুলকে !
তোমরা কেউ কিছু বলবে না । কেউ কিছু দেখেছো ? আন্দাজ করে কাউকে দোষারোপ করা ঠিক না , হেরা দৃঢ় গলায় বলল নাহিনকে।
ঠিক আছে বৌমনি আমি কিছু বলব না তুমি চিন্তা করো না।
দুই বোন তিন তলায় উঠে গেল।
হেরা নিজের ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে র‌ইলো বিছানায় । তারপর বেড সাইড ড্রয়ার টা খুলল সেখানে একটা এক হাজার টাকার নতুন নোট রাখা । টাকাটা কিছুটা মোড়ানো, মুঠোয় চাপ দিয়ে ধরে রাখলে যেমন হয়ে যায় টাকাটা সেরকম। যার হাতে টাকাটা ছিল সে যে টাকাটা মুঠোয় ধরে রেখেছিল বোঝা যাচ্ছে।
এই বাসায় সংসার খরচের টাকা কখনো হেরার হাত দিয়ে দেয়া হয় না। আগে থেকেই শোয়েব দেখে বিষয় টা। হেরা এসব হিসাবপত্র বুঝেও না । কিন্তু প্রতিমাসে ন‌ওশাদ ওর হাত খরচের জন্য ত্রিশ হাজার টাকার একটা খাম ওর হাতে দেয় । সেখান থেকে হেরা‌র কখনো চার হাজার টাকাও খরচ হয় না । থেকে যাওয়া টাকাটা ন‌ওশাদকে ফিরিয়ে দিতে গেলে ন‌ওশাদ বাকি টাকা রিফিল করে আবার খাম হেরার হাতে তুলে দেয়। তবুও ন‌ওশাদ প্রতি মাসে টাকাটা দেয়। একটা জিনিস খুব ভালো লাগে হেরার, টাকা গুলো সব নতুন থাকে সব সময়। সেদিন পারুল আর পুতুল কে সেখান থেকে দুটো নতুন এক হাজার টাকার নোট নিয়ে দিয়েছিল সে। পরদিন হসপিটাল থেকে আসার পর আনারের মা স্টোর রুম থেকে এক হাজার টাকার নোট পেয়ে হেরাকে এনে দিয়েছে যখন, হেরা তখন‌ই বুঝতে পেরেছে কাজটা কার বা কাদের !
হেরা টাকা টার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। পারুল কি চায় জানতে হবে তাকে । এত বড় সাহস পারুলের কিভাবে হলো এটাও তাকে জানতে হবে।

ন‌ওশাদ যখন রাতে বাসায় ফিরলো হেরা এলিন, নাহিনের সঙ্গে বসে একটা কমেডি মুভি দেখছে। ন‌ওশাদ নিচে থেকেই শুনতে পাচ্ছে ওদের হাসাহাসি। এত দিন পর হেরা আগের মত হাসিখুশি থাকছে এতেই তার খুব ভালো লাগছে। এই কদিন অফিস থেকে এলে নিজের ঘরেই চুপচাপ শুয়ে বসে থাকতে দেখতো ওকে। কথা কম বলতো। সব কথা হ্যাঁ, হুঁ ছাড়া আর কোন উত্তর দিতো না। আজ স্বাভাবিক আছে এটাই অনেক বড় ব্যাপার।
দোতলায় উঠে ন‌ওশাদ ওদের কাছে গিয়ে হেরার পাশে বসলো।
কি মুভি এত হাসাহাসি হচ্ছে তোমাদের ।
ভাইয়া কমেডি মুভি , এলিন বলল।
দুই মিনিটের মধ্যে মুভি শেষ হলো । নাহিন ন‌ওশাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইয়া পারুল এসেছে ।
কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ন‌ওশাদের চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। কোথায় সে ?
হেরা ন‌ওশাদের দিকে ফিরে বলল, কেন কি করবেন ?
হেরা আমার ধারণা স্টোর রুমের দরজাটা পারুল লাগিয়েছিল।
আপনি কিংবা বাসার আর কেউ তো দেখেননি শুধু শুধু দোষারোপ করার কি দরকার, হেরা বলল?
ন‌ওশাদ বলল, হেরা আমি দুই মিনিটের মধ্যে ওর চেহারা দেখলেই বুঝবো এটা ওর কাজ কিনা ।
আপনি জিজ্ঞেস করলে এমনিতেই ভয় পাবে । যেহেতু কেউ দেখেনি তাহলে এটা নিয়ে কথা বাড়ানোর কিছু নেই।
আনারের মা ওর নিজের ফ্যামিলির থেকে আমার ফ্যামিলির প্রতিটি মানুষ কে ভালোবাসে হেরা। নিশালকে জন্ম থেকে ও লালন পালন করে বড় করেছে। তুমি প্রেগন্যান্ট খবর শুনে খুশিতে সে কি লাফালাফি করলো।‌সারাক্ষন তোমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। ও জীবনে তোমার খারাপ চাইবে না হেরা।
আমিও তাই বিশ্বাস করি নিশালের পাপা।
নাহিন বলল, তখন বাকি থাকে পারুল বৌমনি ?
সে ও অনেক দিন এই বাসায় থাকে নাহিন , হেরা নাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল।
হেরা বাকি কাজের মানুষ দোতলায় ভুলেও উঠে না। রাজু বাসায় ছিল না । তাহলে তো পারুল ছাড়া আর কে বলো ?
হেরা উঠে দাঁড়িয়ে ন‌ওশাদের দিকে তাকিয়ে বলল , একটা অনুরোধ করছি আপনার কাছে এবং তোমাদের দুজনের কাছে এই বিষয়টা আমি দেখব প্লিজ আপনারা কেউ পারুলের সঙ্গে কথা বলবেন না ।
হেরার মুখে এক ধরনের কাঠিন্য ছিল যা দেখে ন‌ওশাদ নিজেই অবাক হয়ে গেল !
শুধু বলল, ঠিক আছে আমি কিছু বলব না তুমি নরমাল থেকো শুধু।
হু। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসেন আমি ডিনার দিতে বলছি বলে হেরা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
বেশ অনেক দিন পর হেরা রান্নাঘরে এসে ঢুকলো। ওকে দেখে রান্না করে যে জরিনা বুয়া দৌড়ে এসে কাছে দাড়ালো , আম্মা কিছু লাগবো ?
সবার জন্য ডিনার দাও বুয়া।
আনারের মা কোথায় ?
আম্মা খালা দাদারে ভাত খাওয়ায় ।
আর পারুল কোথায় দেখছি না যে ?
পারুল সন্ধ্যা থেইকা মোবাইলে কথা বলে কত মানুষের সাথে, কাম কাজ নাই তার ।
ঠিক আছে ওকে আসতে বলো ।‌
খবর পেয়ে পারুল দৌড়ে এলো। আম্মা ডাকেন।
স্যার আসছে ডিনার না দিয়ে কোথায় বসে আছো তুমি ?
দিতাসি আম্মা।
হেরা খেয়াল করলো পারুল স্যারের কথা শুনে একটু বিচলিত হলো । পরোক্ষনেই নিজেকে সামলে নিলো আবার।
হেরার কথা রাখতেই ন‌ওশাদ পারুল কে দেখে কোন রিয়েক্ট করে নাই । আর দশটা সাধারণ রাতের মত ডিনার করেই যে যার ঘরে চলে গেল।‌ ন‌ওশাদ রুমে ঢুকে বলল, খুশি তো তুমি আমি পারুলকে কিছু বলিনি ।
হেরা ন‌ওশাদের হাত ধরে বলল, ধন্যবাদ আমার কথা রাখার জন্য।
ধন্যবাদের কিছু নেই তুমি ভালো থাকলেই আমি খুশি। তোমার সংসার তুমি যেভাবে বলবে সেভাবেই সব হবে হেরা।
হেরা সুন্দর করে হাসলো ন‌ওশাদের দিকে তাকিয়ে তারপর বলল, আইসক্রিম খাবেন ?
ঠিক আছে দিতে বলো ।
আমি নিয়ে আসছি ।
তোমাকে কেন যেতে হবে আনারের মাকে বললেই তো হয় ?
একটা কাজ আছে আমার, সেটা করে আইসক্রিম নিয়ে আসছি আপনি ততক্ষন টিভি দেখেন। হেরা ড্রয়ার খুলে এক হাজার টাকার সেই নোটটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে র‌ওনা হলো।
রান্নাঘরের পেছনে এই বাসার কাজের মানুষদের থাকার ঘর।
রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখে আনারের মা নারকেল তেল বাটিতে ঢেলে ওভেনে গরম করছে ।
হেরা জিজ্ঞেস করলো, কি করছো ?
আফারা মাথায় গরম তেল দিবে ।
ঠিক আছে নিয়ে যাও ।
আনারের মা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে যেতেই হেরা পারুলের খোঁজে ওদের ঘরের দিকে গেল। ওদের ঘর থেকে টিভির সাউন্ড আসছে । জরিনা বুয়া জলসা চ্যানেলে সিরিয়াল দেখছে । কিন্তু পারুল নেই ওখানে।
পারুল পেছনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছে ।
হেরার ভাগ্য বলবে নাকি কাকতালীয় ব্যাপার বলবে পারুল বীথির সঙ্গে কথা বলছে।
হেরা চুপ করে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছে পারুলের কথা গুলো।
আপনারে কতবার ফোন দিসি খালাম্মা আপনে ধরেন নাই ।
খালাম্মা এইখানে কোন ঝামেলা নাই আমারে কেউ কিছু জিগায় নাই । আম্মা তো আগের মতই কথা ক‌ইছে আর স্যার‌ও কিছু বলে নাই। তয় খালাম্মা বাসায় আইয়া শুনলাম, আম্মা আর স্যারের মন খুব খারাপ আসিলো । হ বাচ্চাডার লাইগা। আপনে কিন্তু ক‌ইছিলেন খারাপ কিছু হ‌ইতো না স্টোর রুমে আটকায় রাখলে ।
আইচ্ছা আইচ্ছা আমার কিতা এমনি ক‌ইলাম । যাই হোক এই বাসায় সব ঠিক আছে কোন ঝামেলা নাই। আমি ফোন দিমুনে আপনেরে ।
কথা শেষ করে পারুল আরো কিছুক্ষণ মোবাইল এ কি টিপাটিপি করছে ।
হেরা নিজের চোখের পানি মুছলো তারপর পারুলের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো ।
হঠাৎ এই মুহূর্তে পিছন ফিরে এখানে হেরাকে দেখে পারুল থতমত খেয়ে গেল ! এতটাই অপ্রস্তুত হলো যে ওর হাত থেকে মোবাইল টা পড়ে গেল।
ভয়ে ভয়ে বলল, আম্মা আপনে এইনে ?
রান্নাঘরে এসেছিলাম পুতুলের একটা জিনিস আমার কাছে ছিল পারুল ভাবলাম দিয়ে যাই তোমার কাছে । এই নাও বলে হেরা টাকাটা এগিয়ে দিলো পারুলের দিকে ! হেরা তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পারুলের চোখের দিকে।
পারুল টাকাটা দেখে একটু সন্দেহের সৃষ্টিতে তাকালো। হেরার চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন একটা ভয় হচ্ছে ওর।
তবুও পারুল হাতটা বাড়িয়ে দিল হেরার দিকে।
এই টাকাটা পুতুল স্টোর রুমের দরজাটা আটকানোর সময় তাড়াহুড়োয় ওখানেই ফেলে গিয়েছিল বলেই হেরা আচমকা পারুলের বাড়ানো হাতটাকে পেছনে মুড়িয়ে দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠুকে দিলো।
তুই কি ভেবেছিলি পারুল আমি জানবো না আমার এত বড় সর্বনাশ টা কে করেছে ?
আম্মা ,আম্মা কি করছি আম্মা ?
পুতুল তোর কথায় সেদিন দরজা টা পেছন থেকে লাগিয়ে দিয়েছিল আর তুই কার ইশারায় এই কাজ করেছিস বল আমাকে পারুল ?
আম্মা কি কাজ আমি কিছু জানি না আম্মা ।
পারুল যার খাস তার এত বড় সর্বনাশ করতে যখন পারিস তুই ,আরো কিছু করতে পারবি আমি জানি কিন্তু তুই জানিস না ন‌ওশাদ আজমী কি কি করতে পারে। তোর চৌদ্দ গুষ্টিকে তার জুতার নিচে পিষে ফেলতে পারে জানিস তুই । আমি একবার বলব তোর ভাইয়ের মেয়ে সহ তুই সব মরবি।
আম্মা আমারে মাফ করেন আম্মা পারুল হেরার পায়ে ধরলো।
মাফ! তুই আমার সন্তান কে মেরে ফেলেছিস পারুল তোকে কিভাবে মাফ করব বল। হেরা পাগলের মত পারুলের চুলের মুঠি ধরলো।
আম্মা আমি বুঝতে পারি নাই এত বড় কাম হ‌ইব বিশ্বাস করেন।
তোকে টুকরো টুকরো করে নিশালের কুকুরকে দিয়ে খাইয়ে দিলেও তোর গুষ্টির লোকজন এই বাসায় ঢুকে দেখতে আসবে না, এখন সত্যি করে বল কার কথায় এই কাজ করেছিস ?
আম্মা বীথি খালাম্মা বীথি খালাম্মা ক‌ইছে, আমার কোন দোষ নাই আম্মা । আমারে মাফ করেন আম্মা।
তোকে মাফ করবো তুই আর তোর খালাম্মা আমাকে কি ভেবেছিস আমার সঙ্গে যা খুশি করবি। আমি নিজের জন্য কোপ দিয়ে মানুষের হাত কাটতে যদি পারি আমার বাচ্চার জন্য তোদের মত খারাপ মানুষের গলাও কাটতে পারব। দেখবি ?
আম্মা গো আমার কোন শত্রুতা নাই আপনার সাথে। বীথি খালাম্মা আপনারে দেখতে পারে না।
কেন দেখতে পারে না বল ?
পারুল চুপ করে আছে ।
বল পারুল ? হেরা চিৎকার দিয়ে উঠলো।
খালাম্মা স্যাররে ভালাবাসে, বিয়া করতে চাইছিল কিন্তু স্যার করে নাই। স্যার আফনেরে বিয়া করছে । আর ভাইয়া আপনারে মা ডাকে। আপনার লগে কত ভালা সম্পর্ক এই জিদে আম্মা খালাম্মা এই কাম করতে ক‌ইছে । আমারে মাফ করেন আম্মা ।
হেরা পারুলের চুল ছেড়ে দিলো। অনেক বড় একটা ধাক্কা খেলো পারুলের কথা শুনে সে।
পারুল কাঁদছে আম্মা সত্যি বিশ্বাস করেন সব বীথি খালাম্মার কথায় করছি। আমি গরীব মানুষ, মানুষের কথায় কাম করি।
হেরা নিজেকে সামলে নিয়ে পারুলের দিকে তাকালো তুই যদি নিজেকে বাঁচাতে চাস আমি যা বলব তাই করবি এখন থেকে ।
বীথির সঙ্গে কোনো কথা যদি বলিস, যে আমি জেনে গেছি সব কিছু তাহলে তুই আর তোর ভাইয়ের মেয়ে জেলে থাকবি নাকি কবরে সেটা আমি ঠিক করব। আর যদি এই বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করিস কুকুর দিয়ে কামড়িয়ে শেষ করব তোকে মনে থাকবে ?
থাকব আম্মা , থাকব।
দে তোর মোবাইল দে আমার কাছে । হেরা পারুলের মোবাইল হাতে নিয়ে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলল। শোন বীথিকে যদি কিছু জানাবি তুই তাহলে তোকে আমি কাঁচা খেয়ে ফেলব এই কথাটা মনে রাখবি ।
আম্মা আম্মা মনে থাকব আমার, আমি কাউরে কিছু কমু না । আফনে আমারে মাফ কইরা দেন।
হেরা ছুটে চলে এলো দোতলায় ।
বীথি নিশালের পাপাকে ভালোবাসে ? কথাটা শুনে হেরার কান গরম হয়ে গেছে । হেরা নিজের চোখের পানি মুছলো। মনে মনে বলল, বীথি তুমি এত হিংসুটে এত জঘন্য মানুষ ! ছিঃ। আমি এতদিন সব সহ্য করেছি কিন্তু আমার বাচ্চা টা কি দোষ করেছিল ! এর স্বাস্তি তোমাকে আমি দিব এবং যাদের দিয়ে দেয়ালে তুমি বেশি কষ্ট পাবে তাদের হাত দিয়েই দিব শুধু অপেক্ষা করো বীথি । হেরা জীবনে সব হারিয়েছে কিন্তু কোন দিন কাউকে পাল্টা আঘাত করেনি কিন্তু আজ আমি সন্তান হারানো এক মা। যার জন্য আমি আমার বাচ্চা কে জন্মের আগেই হারিয়েছি তাকে কোন দিন ক্ষমা করবো না । কখনোই না।
হেরা চোখ মুছে নিজের ঘরে ঢুকলো ।
ন‌ওশাদ টিভি থেকে চোখ সরিয়ে তাকালো কি ব্যাপার তুমি না আইসক্রিম আনতে গেলে ?
ভুলে গেছি সরি দাঁড়ান নিয়ে আসছি ।
না থাক লাগবে না। এখন বাদ দাও । তোমার কি হয়েছে চোখ মুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন ?
ভালো লাগছে না বলেই হেরা বিছানায় শুয়ে ন‌ওশাদকে জড়িয়ে ধরলো !
ন‌ওশাদ কিছুটা অবাক হলো , কি হয়েছে মন খারাপ আবার !
হুম ।
হেরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ন‌ওশাদ বলল, আবার সবকিছু মনে করে কষ্ট পাচ্ছো তাই না ?
হেরা ন‌ওশাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো । ওর বীথির মুখটা মনে পড়ছে আর রাগে ঘৃনায় শরীর কাঁপছে ।
কি ব্যাপার এত শক্ত করে ধরে আছো যে আমাকে হেরা !
হেরা ন‌ওশাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি অনেক ।
ন‌ওশাদ হেরার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, আমি তোমাকে কখনো বলিনি হেরা তোমাকে কতটা ভালবাসি । তুমি কি জানো কতটা ভালোবাসি ?
আমি জানি ।
কি হয়েছে তোমার ? হঠাৎ করে তোমাকে এমন লাগছে কেন?
কিছু হয়নি আপনি আমাকে একটু আদর করে দিন প্লিজ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ।
ন‌ওশাদ হেরাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো । হেরা চোখের পানি মুছে ফেলল, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সে আর কাঁদবে না ।

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here