এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৪২.

0
115

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪২.

কাঠের তৈরী কফিনের বাক্সটা লাল সবুজ কাপড়ের পতাকা দ্বারা মোড়ানো। বাক্সের ভেতর শুয়ে থাকা মানুষটার জানাজা তার স্ব দেশের মাটিতেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জানাজায় শরিক হয়েছেন বিভিন্ন পদস্থ সেনা। সঙ্গে রয়েছে স্বজনদের আহাজারি।

কাঠের বাক্সটা জড়িয়ে ধরে কাদছেন যে ভদ্র মহিলা তিনি এক শহীদের গর্বিত মা। ভদ্র মহিলার জীবনে কোনো কিছুরই অভাব ছিলো না কখনো। তিন মেয়ে এবং স্বামী নিয়ে বেশ সুখের সংসার ছিলো তার। কিন্তু বহু বছর পর একটা পুত্রের অভাব পূরণ করতেই বোধহয় আল্লাহ ছেলেটাকে তার কোল জুড়ে পাঠিয়েছিলেন। সেই একমাত্র ছেলের মৃত্যুর ধাক্কা সামলানো ভদ্র মহিলার জন্য চারটে খানি কথা না।

দূরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছে ছয় জন যুবক। সংখ্যাটা সাত থেকে ছয়ে এসে নেমেছে। এই সাত থেকে ছয়ে নামার যাত্রাটা ছিলো বিষন্ন, বিভৎসকর এবং বিষাদ মাখা। বন্ধু কম ভাইকে হারিয়ে ভিনদেশের মাটিতে প্রত্যয় ও রাফি করেছে পাগলামি, দেশে সেই খবর পেতেই পুরুষালি নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ডুকরে কেঁদেছে ফারদিন ও জুনায়েদ। সাদাত ও সাইফ এই ক্ষেত্রে বিপরীত স্বভাবের। কাছের কাউকে হারানোর বেদনাও এই দুই পুরুষের চোখে জল আনতে পারে নি। তারা শোক পালনের জন্য কেবল খুঁজে নিয়েছে কিছুটা একাকিত্ব।

মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় নীরবে দেখছে এক মায়ের আহাজারি। বুকে এক অদ্ভুৎ ভূমিকম্পের আলোড়ন চলছে তার। আচমকা সে রিদওয়ানের মায়ের জায়গায় নিজের মামণিকে কল্পনা করে। সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠে। দীপ্তটা যদি দেশের বিপক্ষে না গিয়ে দেশের পক্ষেও জীবনটা দিতো তাহলে তার মামণিও নিজের ছেলের জন্য শোক পালন থেকে কখনো বঞ্চিত হতো না।

রিদওয়ানের জন্য কষ্ট হচ্ছিলো দূর্জয়ের। কিন্তু এই মুহুর্তে দীপ্তর কথা মনে পড়তেই তার কষ্টের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। দীপ্ত তার এক গোপন ব্যথা। ভাই হারানোর যন্ত্রণা বুকে বয়ে বেড়ানোটা এখন দূর্জয়ের নিত্যদিনের সঙ্গী। এই যন্ত্রণার কথা সে কখনো কাউকে বলতে পারবে না। পুরুষ বলে নয় বরং সে দূর্জয় বলেই। তার সকল যন্ত্রণা সে চাপা স্বভাবের আড়ালে লুকিয়ে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বলেই।

__________

জুলফিকার মুজতবার অধীনে তার বাড়িতে বাণী আছে আজ প্রায় এক মাস হতে চললো। এই এক মাসে কেবল একদিন দূর্জয় এই বাড়িতে এসেছিলো। তা-ও বাণীকে এক গুরুত্বপূর্ণ সত্যি জানাতে। যেই সত্যিটুকু শুনে বাণী খুব একটা অবাক হয় নি। হিরণ একজন আতঙ্কবাদী। এই সত্যটুকু বিশ্বাস করতে বাণীর মোটেও কষ্ট হয় নি। তবে তার মনে ভয় উঁকি দিয়েছিলো। একজন আতঙ্কবাদীর সঙ্গে নিজের এবং নিজের মেয়ের পরিচয় জড়ানোর ভয় তাকে জেকে ধরেছিলো। কিন্তু মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় তাকে আশ্বস্ত করেছে। এই কেসের কোথাও বাণী কিংবা বহ্নির নাম আসবে না। দূর্জয় কাউকে সেই অনুমতি দিবে না।

বাণী সেদিনও মুখ ফুটে ধন্যবাদ বলতে পারে নি। কেবল কৃতজ্ঞতা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিলো। সেই বিকেলের পর কি হলো কে জানে! দূর্জয় আর এমুখো হয় নি। হারিয়ে গেলো না নিজেকে গুটিয়ে নিলো বুঝা গেলো না। তবে নিশার মুখে বাণী শুনেছে, একজন সৈন্য শহীদ হয়েছে। দূর্জয়ের অধিনস্থ স্পেশাল ফোর্সের লেফটেন্যান্ট ছিলো সে। লেফটেন্যান্টের মৃত্যু ঘটেছে ভিনদেশের মাটিতে। বর্বরদের বোমা হামলায়।

একমাস এই বাড়িতে বাণীর সময় যে খারাপ পাড় হয়েছে তেমনটা নয়। নিশা মেয়েটা খুব লক্ষ্মী আর মিশুক স্বভাবের। বহ্নির সাথে ভালো খাতির জমেছে তার। জুলফিকার মুজতবাও যেইটুকু সময় বাসায় থাকে বাণী ও বহ্নিকে অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ ভাবে ট্রিট করেন। মাঝে একদিন কেবল নিশার মা এসেছিলো। ভদ্রমহিলা যথেষ্ট স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করলেও উনার ভাব ভঙ্গিমায় স্পষ্ট ফুটে উঠে যে তিনি বাণী আর বহ্নির এই বাসায় থাকার বিষয়টা নিয়ে সন্তুষ্ট নন। বাণী তা বুঝতে পেরেছিলো। বুঝতে পেরে তার মোটেও খারাপ লাগে নি। এটাই তো স্বাভাবিক!

আজ খুব সাহস করে বাণী একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জুলফিকার মুজতবা রাতে বাড়ি ফিরতেই সে লিভিং রুমে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্তটা জানায়। সে এখন বহ্নিকে নিয়ে নিজের মতো থাকতে চায়, একটু নিজের মতো বাঁচতে চায়। বড়দের কথার মধ্যে বাগড়া দেওয়া নিশার স্বভাবে নেই। সে নীরবে বহ্নিকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।

জুলফিকার মুজতবা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। অত:পর শান্ত স্বরে বলে,

“ এই বাসায় কি তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে বাণী? “

বাণী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়,

“ না আংকেল। মোটেও সেরকম কিছু নয়। কিন্তু একদিন তো আমাকে যেতে হবেই। “

জুলফিকার মুজতবা বলেন,

“ আমি তোমার পয়েন্ট অফ ভিউ বুঝতে পারছি মা। নিজের জীবন গুছিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আমি সবসময় তোমাকে এপ্রিশিয়েট করবো। কিন্তু আমার চিন্তা তোমার এবং বহ্নির সেফটি নিয়ে। হিরণ পলাতক এখনো। “

বাণী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ উনার ভয়ে তো আজীবন আমি লুকিয়ে থাকতে পারবো না আংকেল। সেটা সম্ভব নয়। “

বাণী ইনিয়ে বিনিয়ে আরো কিছু কথা বলে। তবুও জুলফিকার মুজতবার মন মানছিলো না। তিনি অবশেষে বাধ্য হয়ে দূর্জয়কে ফোন করে। সবটা জানাতেই দূর্জয় বলে,

“ ওর জীবনে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমাদের নেই স্যার। জীবনটা ওর, সিদ্ধান্তও ওর। লেট হার লিভ এজ শি ওয়ান্টস। “

__________

সেনাবাহিনীর তরফ থেকে দেশীয় গণমাধ্যমে আতঙ্কবাদীর হামলার সঙ্গে জড়িত দেশের নাম প্রমাণ সহ প্রকাশ করতেই এক প্রকার হুলুস্থুল বেধে যায় সাধারণ জনগণের মধ্যে। দেশীয় গণমাধ্যম থেকে খবরটা আন্তর্জাতিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগে না। সোশ্যাল মিডিয়া ভরপুর হয়ে যায় বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ দিয়ে। রাতারাতি সেই দেশে অর্থ জোগানকারী সকল কোম্পানির পণ্য বাতিল করে সাধারণ জনগণ।

এগিয়ে আসে এশিয়া এবং মিডেল ইস্টের আরো বেশ কয়েকটি দেশ। যেসকল দেশ গত একবছরে বিভিন্ন টেরোরিস্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছে। সকলেই মত্ত হয় তীব্র প্রতিবাদে। ইউরোপীয়ানরা এমতা অবস্থায় সম্পূর্ণ নীরব বনে যায়।

দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় আরো দুটি তথ্য। এই টেরোরিস্ট অ্যাটাকের মূল হোতা শমসের মজুমদার এবং হিরণের ছবি। যাদের একজন নিখোঁজ এবং অন্যজন পলাতক। এই দু’জনকে দেখতেই যেনো তাদের আইনের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

__________

হুট করে নিজের জীবন সাজিয়ে নেওয়া কোনো চারটে খানি কথা নয়। জুলফিকার মুজতবা বাণীর সিদ্ধান্তের সামনে পরাজিত হয়ে শর্ত দিয়েছিলো আগে বাণীর কোনো চাকরি খুঁজে নিতে হবে। তারপরই কেবল তিনি বাণীকে ঘর ছাড়ার অনুমতি দিবেন।

কেবলমাত্র ও লেভেল এবং এ লেভেল এক্সামের সার্টিফিকেটধারী এক নারীর জন্য চাকরি খুঁজে পাওয়া অনেকটা অসম্ভব বিষয়। কিন্তু এই অসম্ভব বিষয়টাকে সহজ করে দেন জুলফিকার মুজতবা। উনার পরিচিত এক পুরনো বন্ধু চট্টগ্রামে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রধান। জুলফিকার মুজতবা উনার কাছে বাণীকে রেফার করে। শিক্ষকতার চাকরিটা পাকাপোক্ত করার জন্য বাণীর একটা ইন্টারভিউ নিতে চায় তিনি। জুলফিকার মুজতবা আপত্তি করে না। বাণী ইন্টারভিউটা দেয় এবং সানরাইজ হোপ স্কুলের ও লেভেলের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা পদে নিযুক্তও হয়।

ভাগ্যিস! ভাগ্যিস দূর্জয়ের উছিলায় হলেও বাণী পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস হয়েছিলো। আর তার পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যমের স্টুডেন্ট হওয়ার বদৌলতে এখানকার পড়ালেখার ধরণ সম্পর্কেও তার ধারণা আছে। নাহয় এই চাকরিটা কখনো তার পাওয়া হতো না।

বাণীর চাকরি পাওয়া নিয়ে জুলফিকার মুজতবা খুশি হলেও নিশা খুশি হতে পারে না। সে আড়ালে নিজের আব্বুকে কিছুটা শাসায়,

“ তুমি আপুকে চাকরি খুঁজে পেতে হেল্প করলে কেনো আব্বু? তুমি হেল্প না করলে আপু কখনোই চাকরি খুঁজে পেতো না। তখন আপুকে আমাদের সাথে রেখে দিতে পারতাম। “

মেয়ের কথা শুনে জুলফিকার মুজতবা সামান্য হাসেন। নিজের আবেগী মেয়েকে পাশে বসিয়ে বুঝায়,

“ ওভাবে তোমার আপু কখনো খুশি থাকতে পারতো না মা। চিন্তা করো না। আব্বু তো আছি। “

চাকরি পাওয়ার সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই একটা দু রুমের বাসা খুঁজে ভাড়া নেয় বাণী। মা মেয়ের জন্য এই দুই রুমের বাসাটাই তার কাছে সবচেয়ে পারফেক্ট মনে হয়েছিলো। আর তাছাড়াও বাসার লোকেশনটাও জুলফিকার মুজতবার পছন্দ হয়েছে। স্কুল এবং হেডকোয়ার্টারের কাছাকাছিই অনেকটা।

নতুন বাসায় উঠার জন্য প্রয়োজনীয় যত ফার্নিচার, আসবাবপত্র, যাবতীয় ইলেকট্রনিকস আছে সব কিছুর ব্যবস্থা করে জুলফিকার নিজেই লোক ঠিক করে বাসাটাকে থাকার উপযুক্ত করে সাজিয়ে দিয়েছে। বাণী বারবার বারণ করছিলো। তার ভীষণ লজ্জা লাগছিলো। জুলফিকার মুজতবা ইতিমধ্যে বাণীর আর বহ্নির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই বাড়ির সামনে দু’জন পাহারাদার নিযুক্ত করেছেন। যতদিন না হিরণ ধরা পড়ছে ততদিন এই পাহারার মধ্যেই বাণীকে থাকতে হবে। মানুষ গুলো বাণীর জন্য কম করে নি। সে আর ঋণী হতে চায় না। জুলফিকার মুজতবা তার মনের কথা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি কেবল বাণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

“ এসব কিছু আমার আর নিশার তরফ থেকে উপহার মা। মানা করো না প্লিজ। “

__________

রিদওয়ানের মৃত্যুর কেবল দু মাস সম্পন্ন হলো। বন্ধুর মৃত্যু শোক তখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি প্রত্যয়। এরই মাঝে একদিন তার আব্বু মতিউর আরাফাত এবং আম্মু ফিজা রেহানা এসে উপস্থিত হয় চট্টগ্রামে। জরুরি তলবে ছেলেকে ডাকে এক শপিং মলে। প্রত্যয় বিরক্ত হয়। তার আব্বু আম্মু এতো উদ্ভট কেনো? কখনো কফি শপে দেখা করতে চায় তো কখনো শপিং মলে!

প্রত্যয় শপিং মলে যেতেই তার আম্মু তাকে নিয়ে একটা জেন্টস শো রুমে প্রবেশ করে। নিজের পছন্দ মতো ছেলেকে বিভিন্ন শার্ট ট্রায়াল দেওয়ায়। অবশেষে একটা ধূসর নীল রঙের শার্ট এবং সেই সঙ্গে একটা জিন্স পড়িয়ে ছেলেকে নিয়ে বের হয় মল থেকে।

প্রত্যয় বারবার জানতে চায় তারা কোথায় যাচ্ছে। মতিউর আরাফাত কেবল হাসি হাসি মুখে জানায়,

“ আমার এক বন্ধুর বাসায় আজ আমাদের ডিনারের দাওয়াত আছে। সেখানেই যাচ্ছি। “

প্রত্যয় আর কোনো প্রশ্ন করে না। তার মোটেও ইচ্ছে করছে না এই মুহুর্তে কোনো গেদারিং এ যেতে। কিন্তু আম্মু আব্বুকে তা বোঝানো সম্ভব হবে না তার দ্বারা। তাই সে নীরব রয়।

__________

বারো তলা ভবনটার লিফটে উঠতেই ৮ এ চাপে মতিউর আরাফাত। প্রত্যয় তখন লিফটে দাঁড়িয়ে নিজের শার্টের হাতা গোটাতে ব্যস্ত। লিফট এসে অষ্টম তলায় থামতেই তারা বের হয়। মতিউর আরাফাত বলতে থাকে এই অষ্টম তলার পুরোটা নিয়ে তার বন্ধুর এপার্টমেন্ট। কথাগুলো যদিও তিনি প্রত্যয়কে শোনানোর জন্যই বলছিলো কিন্তু প্রত্যয়ের ধ্যান সেদিকে নেই। সে ফোনে ফারদিনকে ম্যাসেজ পাঠাতে ব্যস্ত। মতিউর আরাফাত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কলিং বেল চাপে।

বন্ধুর বাসায় ডিনারের দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য কি তা প্রত্যয় বুঝতে পারে যখন সেই বাড়ির ছোট কন্যা সালোয়ার কামিজ পড়ে পরিপাটি সেজে মাথায় এক লম্বা ঘোমটা টেনে চায়ের ট্রে হাতে তাদের সামনে উপস্থিত হয়। হালকা গোলাপি রঙের কামিজ পরিহিতা মেয়েটার চেহারা দেখতেই প্রত্যয়ের ভ্রু কুচকে আসে। মেয়েটাও সেই মুহুর্তে ট্রে থেকে একটা কাপ তুলে প্রত্যয়ের দিকে এগিয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে দুই জনের দৃষ্টি বিনিময় হয়। প্রত্যয়কে দেখতেই মেয়েটাও বিস্ফোরিত চোখ করে তাকায়। বেখেয়ালিবশত তখন তার হাতের কাপ সামান্য বাকা হয়ে গরম ধোঁয়া উঠা চা প্রত্যয়ের হাতের পিঠে পড়ে। বিরক্তিতে প্রত্যয় চ বর্গীয় শব্দ করে উঠে। একবার অগ্নিদৃষ্টি মেলে সামনের মেয়েটিকে দেখে অত:পর আবার নিজের আব্বুর দিকে তাকায়।

মেয়েটার চোখ থেকেও ততক্ষণে বিস্ময়তা কেটে গিয়ে রাগী ভাব এসে ভর করেছে। পৃথিবীতে ৭ বিলিয়ন মানুষের বসবাস। সেই ৭ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে যদি ৩ বিলিয়ন মানুষ পুরুষ হয়, আর সেই ৩ বিলিয়ন পুরুষের মধ্যে ১ বিলিয়ন যদি বিবাহিত এবং আরো ১ বিলিয়ন যদি ইন এ রিলেশনশিপ পুরুষ হয় তবুও তো আরো ১ বিলিয়ন পুরুষ সিঙ্গেল অবশিষ্ট থাকে। তার শ্রদ্ধেয় পিতা আলাউদ্দিন সাহেবের চোখে সেই ১ বিলিয়ন সিঙ্গেল পুরুষের মধ্যে এই কুত্তাকেই নিজের কন্যার উপযুক্ত মনে হলো?

__________

হাত ঘড়িটার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে সাইফ। বিকাল সবে ৪ টা বেজে ৩২ মিনিট। গতরাতে ইয়াসমিন ম্যাসেজ করে বলেছিলো আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৪ টা বাজে যেনো সাইফ গুলিয়াখালী সি বিচে ইয়াসমিনের জন্য অপেক্ষা করে। সাইফ জানতে চেয়েছিলো কি কারণে। কিন্তু ম্যাডাম তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সেই যে অফলাইন হলো তারপর সারাদিনে আর একবারও অনলাইন আসে নি।

সময়জ্ঞানহীনতা সাইফের অতি অপছন্দনীয় একটা ব্যাপার। কিন্তু এই অপছন্দনীয় ব্যাপারটাও আজ আর তার বিরক্তির কারণ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কিছু অপেক্ষা অদ্ভুৎ সুন্দর হয়। অস্থিরতা মেশানো, আকুলতা মেশানো কিংবা বেনাম অনুভূতি মেশানো।

ঘড়ির কাঁটা যখন ৪ টা ৪৫ এ ঠেকে তখন নিশার আগমন ঘটে। একহাতে শপিং ব্যাগ এবং অন্য হাতে স্কার্ট সামলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। আবার মাঝপথে থেমে বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল ঘাড় নেড়ে পিছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সাইফ মিনিট খানিকের জন্য মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দেখে সবুজের বুকে বিচরণ করা সেই রমণীকে। অত:পর নিশার তাড়াহুড়ো ভঙ্গিমা দেখে কপাল কুচকে ফেলে। এই মেয়ের এতো তাড়া কিসের? দু’দিন হলো না পা ঠিক হয়েছে তবুও সেদিকে কোনো ধ্যানজ্ঞান নেই।

নিশা সামনে এসেই হেসে বলে,

“ সরি দেরি করে ফেলেছি। এক রিকশাওয়ালা মামাকে পথ চেনাতে চেনাতেই সময় লেগে গিয়েছে। “

সাইফ মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে বলে,

“ ওহ আচ্ছা। “

নিশা আনমনে সাইফের হাত ধরে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ তাড়াতাড়ি চলুন ভাইয়া। নাহয় এখানে বেস্ট ভিউ এর জায়গা গুলো দ্রুত বুকড হয়ে যায়। “

সাইফের কানে আর সেই কথা পৌঁছায় না। সে বিস্মিত দৃষ্টি মেলে সেই দুধে আলতা রঙের হাতের মুঠোয় নিজের রোদে পুড়ে যাওয়া তামাটে হাতটা দেখে। অত:পর চোখ তুলে ফের নিশাকে দেখে।

নিরিবিলি এক গাছের নিচে সবুজ ঘাসের বুকে বসে আছে দু’জন। অদূরে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের স্তব্ধতা। সূর্যটা সবে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়তে শুরু করেছে। নিশা খুব মনযোগ দিয়ে শপিং ব্যাগটা থেকে সাবধানে একটা বক্স বের করে খুলে সাইফের সামনে ধরে। আর প্রফুল্ল গলায় বলে,

“ হ্যাপি বার্থডে। “

সাইফ আরেকদফা চমকায়। বিস্মিত দৃষ্টি মেলে একবার নিশার হাতের কাপকেক-এর দিকে তাকায় ফের নিশার দিকে তাকায়। অবাক গলায় জানতে চায়,

“ আপনাকে কে বললো আজ আমার জন্মদিন? “

নিশা মুখ হাসি হাসি করে বলে,

“ আপনার আইডির এবাউট ইনফো তে দেখেছি। ভাববেন না আবার স্টক করছিলাম। আউট অফ কিউরিওসিটি আরকি! “

সাইফ এক মুহুর্ত সরল মুখশ্রীটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ ওটা ফেক বার্থ ডেট মিস ইয়াসমিন। “

নিশা অবাক হয়ে জানতে চায়,

“ হ্যাঁ? ফেক? আসল ডেট কবে তবে? “

“ জানি না। “

নিশা ভাবে সাইফ মজা করছে। সে বিদ্রুপের স্বরে বলে,

“ নাইস জোক। “

সাইফ এবার শীতল স্বরে বলে,

“ আ’ম সিরিয়াস। “

নিশা সাইফের কণ্ঠের গাম্ভীর্যতা টের পায়। অবাক স্বরে জানতে চায়,

“ জানেন না কেনো? “

“ এতিমদের জন্মদিন বলতে কিছু হয় না ইয়াসমিন। এসব বিলাসিতা কেবল। “

নিশা চোখ বড় বড় করে সাইফকে দেখে। সাইফের কণ্ঠ কি সামান্য কাঁপলো? কে জানে! কিন্তু সেই স্বর নিশাকে আঘাত করে। অজান্তে, খুব গভীরে।

__________

সবে মাত্র চারজন স্টুডেন্টকে বিদায় দিয়ে বসার ঘরে সোফায় এসে বসলো বাণী। নিজের এই নতুন জীবনের প্রায় এক মাস পাড় হলো। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় স্কুলের জবটার পাশাপাশি বাসায়ও পড়ানোর জন্য চারটা স্টুডেন্ট পেয়ে গিয়েছে বাণী। এতে অবশ্য তার জন্য ভালোই হয়েছে। সপ্তাহে ছয় দিন তিনটা সাবজেক্ট পড়ায় সে। বিনিময়ে মাস শেষে প্রত্যেক স্টুডেন্টের থেকে পাঁচ হাজার করে পাবে। স্কুলের বেতন এবং প্রাইভেটের বেতন মিলিয়ে আপাতত মা ও মেয়ের একার সংসার বেশ স্মুথলিই যাচ্ছে।

মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে অলস চোখে তাকায় বাণী। সম্পূর্ণ গতিতে ঘুরতে থাকা ফ্যানটাও আজকাল কেনো জানি বাণীকে স্বস্তি দিতে পারে না। এক অদ্ভুৎ অস্থিরতা কাজ করছে শরীর জুড়ে। শরীর কেমন তিরতির করে ঘামছে।

ভেতরের রুম থেকে বহ্নির ডাক ভেসে আসছে,

“ মাম্মা। “

বাণী উঠে দাঁড়াতে নিলেই আচমকা মাথা চক্কর মেরে উঠে। সে সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। নিস্তেজ শরীরটা পিছনের দিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে ফেলে সে। মনে মনে নিজেকে বুঝ দেয় হয়তো প্রেশারটা ফল করেছে।

__________

দু’দিন পরের ঘটনা। কোনো এক অলস দুপুরে নিজের কালো গাড়িতে করে হেডকোয়ার্টার যাওয়ার পথে সানরাইজ হোপ স্কুলের সামনে এসে মনের অজান্তে গাড়িটা থামায় দূর্জয়। স্কুলের ভেতর থেকে ছেলে মেয়েরা দৌড়ে বের হচ্ছে। ছুটি হয়েছে খুব সম্ভবত।

এতো এতো ছেলে মেয়ের ভীড়ে এক নারীকে দেখতেই সেই পানে মনযোগ স্থির হয় দূর্জয়ের। মলিন রঙা কামিজ পরিহিতা নারী ধীর পায়ে হেঁটে বের হচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে তার ৫ বছরের কন্যা। বাচ্চাটা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে অনেক কথা বলতে ব্যস্ত। কিন্তু সেই নারীর সেদিকে মনযোগ নেই।

দূর্জয় নীরবে সেই নারীর মুখপানে তাকিয়ে থেকে উপলব্ধি করে অন্য সময়ের তুলনায় আজ বেশি রুগ্ন দেখাচ্ছে বাণীকে। একা হাতে সব সামলাতে কি বেশ হিমশিম খাচ্ছে মেয়েটা? নাকি অসুস্থ?

আচমকা নিজের এতো কৌতূহল দেখে দূর্জয় চমকায়। পরমুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। মুখভঙ্গি ফের গম্ভীর করে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আজকাল ভুল স্টপে গাড়ি থামানোর বদভ্যাস হয়েছে তার।

__________

চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৫০১ কিলোমিটার দূরে রাজশাহী শহর। রাতের নিস্তব্ধতায় লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে জঙ্গলের মাঝে এক দুই কক্ষের কুটিঘরটাকে বাহির থেকে দেখতে অনেকটা ভুতুড়ে লাগছে। বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে কেমন অদ্ভুৎ এক শব্দ।

শ্বেত চামড়ার এক পুরুষকে টিমটিমে হলুদ আলোয় দেখতে বেশ ভয়ংকর লাগছে। সে অতি মনযোগের সহিত চাপাতি দিয়ে টেবিলের উপর আঘাত করতে ব্যস্ত। কিছু একটা কাটছে।

জ্বলজ্যান্ত এক মানুষকে কেটে টুকরো টুকরো করে পলিথিন বন্দী করে সে কুটিঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বাড়ির সামনে কিছু গাছের ডাল ও পাতা জোরো করে আগুন জ্বালিয়েছে ইবাত। সেই আগুনের ধারেই একটা মোড়ায় বসে ছিলো সে। স্যারকে বেরিয়ে আসতে দেখেই মাথা তুলে তাকায় সে।

সবসময় ছোট ছোট করে কেটে রাখা দাড়ি গুলো কিছুটা ঘন হয়েছে। চেহারার মধ্যেও অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। বোকা সৈন্যের দল ইবাতের স্যারের এই নতুন লুক দেখে উনাকে চিনতে ভুল করবে।

হিরণ নীরবে এসে আগুনের ধারে আরেকটা মোড়া টেনে বসে। শান্ত শীতল স্বরে বলে,

“ পলিথিনটা নিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিবে। “

ইবাত কাঁপা গলায় বলে,

“ স্যার ভাসিয়ে দিলে তো পুলিশ জেনে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। জঙ্গলেই টুকরো গুলো দাফন করে দেই? “

“ জানুক। আমি চাই সকলে এই জানোয়ারের পরিণতি দেখুক। আমার বাণীকে কুপ্রস্তাব দেওয়ার ফল এরকম ভয়াবহই হবে। “

ইবাত ভীত দৃষ্টি মেলে হিরণকে দেখতে থাকে। স্যার আজকাল আগের তুলনায় আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। এই দু-মাস তা-ও মোটামুটি শান্ত হয়ে ছক কষছিলো। নতুন প্ল্যান ম্যাপ রেডি করছিলো। কিন্তু যখনই নিজের গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর পেলো যে বাণী ম্যামকে স্কুলের এক স্যার কু প্রস্তাব দিয়েছে আর এই নিয়ে বাণী ম্যাম একা বসে কান্নাকাটিও করেছে তখনই উনার মাথা বিগড়ে যায়। তিন দিনের মধ্যে সেই লোককে চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহীতে তুলে আনে। অত:পর নিজ হাতে কুপিয়ে হত্যা করে।

ইবাত সামান্য ইতস্তত করে বলে,

“ স্যার, অসীম কল করেছিলো। “

হিরণ আগ্রহী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে বলে,

“ কি বললো? বাণী আর বহ্নি ঠিক আছে? “

“ ম্যাডামকে নাকি আজ সন্ধ্যায় হসপিটাল যেতে দেখা গিয়েছে। “

হিরণ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ হসপিটাল মানে? ঠিক আছে ও? “

“ ঠিক আছে। উনি নাকি শুধু ডক্টর দেখিয়ে বাসায় চলে গিয়েছে। “

হিরণ কপালে চিন্তার ভাজ রেখেই বলে,

“ অসীমকে ফোন করো দ্রুত। কোন ডিপার্টমেন্টের ডাক্তার দেখিয়েছে এসব ডিটেইলস জেনে আমাকে জানাতে বলো। কুইক। “

__________

সারাদিনের কাজ শেষে আজ আর মেসে ফিরে গেলো না দূর্জয়। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ফিরে এলো নিজের পৈতৃক নীড়ে। সব সময় লক করে রাখা নিজের ব্যক্তিগত রুমে প্রবেশ করে হলুদ টিমটিমে আলোর সুইচটা চেপে জ্বেলে দেয়। নিজের গলার কাছের দুটো বোতাম খুলতে খুলতে এগিয়ে যায় আলমারির কাছে। আলমারির একটা দরজা খুলতেই ভেতর থেকে একটা ফোটো এলব্যাম বের করে সে। সেই সঙ্গে বের করে সযত্নে তুলে রাখা গিটারটা।

বিছানার সঙ্গে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে সে। এলব্যামটা খুলতেই বেরিয়ে আসে স্মৃতিচিত্র। কত শত ছবি। এতো ছবির ভীড়ে দূর্জয়ের চোখ আটকায় একটা বাচ্চা ছেলের ছবিতে। খেলনা বন্দুক হাতে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে দাঁত বের করে। ছবির নিচে এককোণে কলমের কালি দ্বারা লেখা ইংরেজি পাঁচ অক্ষরের একটা নাম। দীপ্ত।

দূর্জয় আর এলবাম ঘাটে না। এলবামটা একপাশে রেখে গিটারটা কোলে তুলে নেয়। আনমনে কিছুক্ষণ গিটারে টুংটাং শব্দ করে। একবার সুর তুলতে সক্ষম হলেই খালি গলায় গেয়ে উঠে,

“ তবু এই দেয়ালের শরীরে
যত ছেঁড়া রং, ধুয়ে যাওয়া মানুষ
পেশাদার প্রতিহিংসা তোমার চেতনার
যত উদ্ভাসিত আলো রং
আকাশের মতন অকস্মাৎ নীল
নীলে ডুবে থাকা তোমার প্রিয় কোনো মুখ
তার চোখের কাছাকাছি এসে কেনো পথ ভেঙে

দু’টো মানচিত্র এঁকে, দু’টো দেশের মাঝে
বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ।

তবু এইখানে আছে অবলীল হাওয়া
জানালা বদ্ধ ঘরে আসে যায়
দেয়াল ধরে বেড়ে ওঠে মধ্যরাত
তোমার ছায়ায় জমে এসে ভয়
আলোকে চিনে নেয় আমার অবাধ্য সাহস
ভেতরে এখন কি নেই কাপুরষ অন্ধকার একা?

তোমাকে ঘিরে পথগুলো সব সরে যায়
রাত্রির এই একা ঘর ঝুলে আছে শূন্যের কাঁটাতারে
দু’টো মানচিত্র এঁকে, দু’টো দেশের মাঝে
মিশে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

[ প্রায় তিন হাজার শব্দের বিশাল এক পর্ব নিয়ে এলাম আজ। প্রথম অংশের যাত্রা এই ৪২ পর্ব পর্যন্তই ছিলো। পরবর্তী অংশ লিপ দিয়ে শুরু হবে। সেই অংশ হবে প্রণয়, পরিণতি, প্রশান্তি ও পীড়াদায়ক অনুভূতিতে মোড়ানো। ভুলক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আর এই পর্ব পড়ে জলদি জলদি নিজেদের মূল্যবান মন্তব্য লিখে ফেলুন। আপনাদের মন্তব্যের ঝুলি পড়ে শেষ করে পরবর্তী পর্ব লিখতে বসবো। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here