এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৪৪.

0
121

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৪.

হিরণের উচ্চারণ করা প্রশ্ন শুনতেই বাণী চোখ জোড়া বুজে নেয়। প্রাণ ভরে একটু নিঃশ্বাস কুড়িয়ে নেয়। সঙ্গে কুড়িয়ে নেয় কিছুটা সাহস। বুকের ভেতর সঞ্চার হওয়া জোরটুকুকে হাতিয়ার করে সে চোখ মেলে তাকায়। দুঃসাহসিক জবাবে জানায়,

“ আপনাকে সন্তানহারা এক ভঙ্গুর পুরুষে পরিণত করতে। “

হিরণের ক্ষিপ্র আগুন চোখের দৃষ্টিতে যেনো এক বালতি পানি ঢেলে দিলো বাণী। থমকে রইলো সে। বাণীর গলা চেপে ধরা হাতটা খানিকটা আলগা হয়ে আসলো। বিমূঢ় ভঙ্গিতে কেবল একটা শব্দ উচ্চারণ করে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ কেনো? “

“ ভাইয়ের রক্তের দাম নিতে ভুলে যাবো ভেবেছিলেন? “

প্রশ্নের পিঠে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বাণী ঠোঁটের কোণে মিহি হাসি ফুটিয়ে তুলে। হিরণ দেখে তা। অবিশ্বাসের লেশ তার দৃষ্টি থেকে বিলীন হচ্ছে না। নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীকে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে তার। এটা বাণী হতে পারে না। তার বাণী নিজের সন্তানের প্রতি নমনীয় ছিলো। নিষ্ঠুর ছিলো না। এ কেমন অদ্ভুত শাস্তি? কি অদ্ভুৎ নিষ্ঠুরতা! হিরণ ভঙ্গুর স্বরে বলে,

“ ও নিষ্পাপ ছিলো। “

“ আমার ভাইয়ের কি পাপ ছিলো? “

“ এতটা অমানবিক কিভাবে হলে? “

“ আপনি মানবিকতা দেখিয়েছিলেন? “

“ তোমার বিবেক তোমাকে বাঁধা দেয় নি? “

“ না। “

বাণীর স্পষ্ট জবাবের পিঠে হিরণ অস্থির হয়ে উঠে। বিস্ময়তা ছেড়ে হিংস্র হয়। শক্ত করে বাণীর গলা চেপে ধরে তাকে পিছনের দিকে নিয়ে যায়। পার্ক করে রাখা একটা গাড়ির বোনাটে গিয়ে বাণীর পিঠ ঠেকে। হিরণ ঝুঁকে তার মুখের উপর। পরপর আরো শক্ত করে গলার রগটা চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ এতো সাহস? প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে এতো বড় একটা কাজ করলে? আমার বাচ্চার অস্তিত্ব মিটিয়ে দিলে। তুমি… “

কথা আটকে আসে হিরণের। রাগে সমস্ত শরীর কাপছে তার। মুখের অসম্পূর্ণ কথাটুকু পুরো করতে বলে,

“ সন্তানহারা হই নি আমি। আমার বহ্নি আছে। আমার মেয়ের পাপা আমি। “

গলা চেপে ধরায় বাণী জবাব দিতে পারে না মুখ ফুটে। নাহয় সে মুখের উপর বলে দিতো,

“ আপনি বহ্নিকেও হারিয়েছেন। আমার মেয়ে আপনাকে ঘৃণা করে। নিজের মা’য়ের প্রতি অন্যায়কারীকে ও কখনোই পাপা বলে স্বীকৃতি দিবে না। “

হিরণের ক্ষোভ মিশ্রিত নিঃশ্বাস যখন বাণীর মুখ জুড়ে আছড়ে পড়ছে ঠিক সেই মুহুর্তে সরু গলির মাথায় দাঁড়িয়ে পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত ইবাত তার কাছে দৌড়ে আসে। ভীত গলায় বলে,

“ স্যার চলুন। কেউ আসছে। “

হিরণ একচুল পরিমাণ নড়ে না। বাণীকেও ছাড়ে না। অনড় রয়। ইবাত ভীত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে হিরণকে পিছন থেকে জাপটে ধরে টানা শুরু করে। তবুও ছাড়াতে পারে না। বাণীর দুই চোখের কার্নিশে তখন অশ্রু এসে ভীড় করলেও তার ঠোঁটের কোণে লেপ্টে রয় হাসি। হিরণকে শারীরিক ভাবে আঘাত করেও কখনো এরকম শান্তি অনুভব করে নি সে। কারণ শারীরিক আঘাতে হিরণের কখনোই কিছু যায় আসতো না। কিন্তু এইবার বাণী জায়গা মতো বাজিমাত মেরেছে। হিরণ ভেঙেছে। নড়বড়ে হয়েছে তার পিতৃক সত্তার অনুভূতিগুলো।

হিরণকে সরিয়ে আনতে না পেরে ইবাত ঘাড় ঘুরিয়ে একবার গলির শেষ মাথার বাউন্ডারির দিকে তাকায়। একটা গাড়ি বেয়ে উঠে এই বাউন্ডারি টপকে পালিয়ে যাওয়া ইবাতের জন্য বড়ো কোনো বিষয় নয়। কিন্তু তার ভৃত্য স্বত্তা তাকে সেই অনুমতি দেয় না। সে ঠায় হিরণের পাশে দাঁড়িয়ে রয়। অসহায় দৃষ্টি মেলে একবার নিজের স্যারকে দেখে পরমুহূর্তেই ক্ষোভ মিশ্রিত দৃষ্টিতে দম প্রায় ফুরিয়ে আসা বাণীকে দেখে। এই মহিলা! এই মহিলা তার স্যারের জীবনের সবথেকে বড়ো ঝামেলা। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ইবাতের মনে হচ্ছে তার উচিত ছিলো বহু পূর্বেই স্যারের জীবন থেকে এই মহিলাকে সরিয়ে দেওয়া।

“ গেট এওয়ে ফ্রম হার। “

বজ্রধ্বনির মতো স্বর কানে পৌঁছাতেই হিরণ চোখ তুলে পাশে তাকায়। গলির মাথায় এক পুরুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। দু’হাত তুলে কিছু একটা তাক করে ধরে রেখেছে। তবে কৃত্রিম আলোর অভাবে তার মুখখানা স্পষ্ট নয়। হিরণ মানুষটাকে না চিনলেও বাণী কণ্ঠ শুনেই তাকে চিনতে পারে। সে স্বস্তিতে চোখ বুজে নেয়। অবয়ব ধারী মানুষটা ধীর পায়ে সামনে এগোতেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার মুখ পরিষ্কার দেখা যায়। কালো শার্ট প্যান্ট পরিহিত বলিষ্ঠ দেহের পুরুষটা আবার বাজিখাই গলায় ধমকে উঠে,

“ ছাড়তে বলেছি ওকে। “

আগত পুরুষের মুখ দেখেই হিরণ আরো হিংস্র হয়ে উঠে। একটানে বাণীকে নিজের সামনে ঢাল হিসেবে দাঁড় করিয়ে নিজের অতি শখের পিস্তলটা বের করে নেয়। চোখের পলকেই তা তাক করে বাণীর মাথার ডানপাশে। আগ্রাসী গলায় বলে উঠে,

“ আর এক পা সামনে আসবি না কুত্তার বাচ্চা। “

হিরণকে অনুসরণ করে ইবাতও নিজের পিস্তল বের করে সামনের মানুষটার দিকে তাক করে। দূর্জয় বিচলিত হয় না। একপলক বাণীর চেহারা দেখে দূর হতে নিশানা তাক করে হিরণের কপালের মাঝ বরাবর। ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠে,

“ নারীর পিছনে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করতে চাচ্ছিস। কাপুরষ কোথাকার। “

“ তুই মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়। চিনি তোকে। তোর সাথে ব্যক্তিগত হিসাব মেটানো বাকি আছে আমার। “

দূর্জয় আত্মবিশ্বাসের সুরে বলে,

“ অবশ্যই। হিসাবের হালখাতা খুলে বসবো। কোনো হিসাব বাকি রাখবো না। “

দূর্জয়ের কথা শেষ হতে না হতেই ইবাত পিছন থেকে ভীত স্বরে বলে,

“ স্যার, আমাদের ঘিরে ফেলেছে। “

হিরণ নিজের দৃষ্টি বুলিয়ে একবার দেখে চারিদিকটা। গলির দুই পাশে দুটো চারতলা বিল্ডিং রয়েছে। দুই বিল্ডিংয়ের ছাদে রাতের আঁধারে কিছু মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকেই স্পাইনার রাইফেলের নিশানা তাক করে রেখেছে হিরণ ও ইবাতের পানে। উপর পান থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখে গলির মাথা দিয়ে আরো ছয়জনের এক দল অস্ত্র হাতে দৌড়ে এগিয়ে আসছে। প্রত্যেকেই সেনা কর্মকর্তা। তাদের পোশাকই তাদের পরিচয় বহন করছে।

হিরণ হাসে। অদ্ভুৎ সেই হাসি। ফিসফিসিয়ে বাণীর কানের কাছে বলে,

“ এই মাত্র বুঝতে পারলাম আমি সন্তানদের থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবাসি। নাহয় এই মুহুর্তে নিজের বন্দুকের একটা বুলেট তোমার শরীরে খরচ করতে দ্বিতীয় বার ভাবতাম না। অন্য কেউ হলে খুন করে ফেলতাম। “

বলেই বাণীকে ছেড়ে দেয় হিরণ। নিজের পিস্তলটা হাত থেকে ফেলে দেয়। আত্মসমর্পণ করে। করতে বাধ্য সে। অন্য কোনো পথ অবশিষ্ট নেই। বাণী ধীরপায়ে পিছু হটতে হটতে হিরণের থেকে দূরে সড়ে যায়। ইবাতের চোখে তখন অবিশ্বাস। এতো সহজে স্যার আত্মসমর্পণ করে দিলো? একটা বুলেটও ছুড়লো না এই অসভ্যদের দিকে?

হিরণ আত্মসমর্পণ করতেই এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলো না সেনাদল। দ্রুত পায়ে দৌড়ে এগিয়ে আসে। হিরণ ও ইবাতকে আটক করে। হ্যান্ডকাফ পড়ায় পাপিষ্ঠ দু হাতে। হিরণ পুরোটা সময় নির্লিপ্ত দৃষ্টি মেলে বাণীর দিকেই তাকিয়ে রয়। চোখ ফেরায় না এক মুহুর্তের জন্য। বাণী একটা গাড়ির সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দেখে সেই দৃশ্য।

হাতের হ্যান্ডকাফে টান পড়তেই হিরণ মুখ খুলে। বাণীর চোখে চোখ রেখে স্বাভাবিক গলায় উচ্চারণ করে,

“ আমাদের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য নেই বাণী। তুমি নিজ হাতে আমাদের মধ্যের পার্থক্য মিটিয়ে দিয়েছো। “

হিরণের কথা উপস্থিত সবার কানেই পৌঁছায়। দূর্জয় সহ ছয় লেফটেন্যান্টের কেউই সেই কথার মর্মার্থ ঠাওর করতে পারে না। হিরণ এবার গলার স্বর আরেকটু উঁচু করে বলে,

“ তুমিও খুনী। আমি যদি অন্যের সন্তানের খুনী হই তাহলে তুমি নিজের সন্তানের খুনী। পাপ তুমিও করেছো। “

দূর্জয় চমকায়। বড়ো বড়ো চোখ মেলে বাণীর পানে তাকায়। বাণী নিরুত্তর রয়। কথাগুলো তার শরীরে কাঁটার মতো বিঁধছে। তার মাতৃস্বত্তা কেপে উঠে। হিরণ আবারও চেঁচিয়ে উঠে,

“ সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় আমি একা ভুগবো না বাণী। তুমিও ভুগবে। কারণ যাকে তুমি মেরেছো ও তোমারও অংশ ছিলো। “

হিরণকে আর কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হয় না। লেফটেন্যান্টরা তাকে টেনে সেখান থেকে নিয়ে যায়। দূর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে একবার সেই দৃশ্য দেখে বাণীর দিকে ফিরে তাকায়। বাণী নিথর ভঙ্গিতে তখন দাঁড়িয়ে ছিলো গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে।

দূর্জয় ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। বাণীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শীতল স্বরে ডাকে। বাণী চোখ তুলে তাকায়। নিষ্প্রাণ গলায় বলে,

“ পাষাণ হয়েছি। অনাগত সন্তানকে খুন করেছি। আমিও এখন খুনী, তাই-না? “

কথাটা বলতে বলতে বাণী বোধশক্তি হারায়। দূর্বল দেহটা হেলে পড়তে নিলেই দূর্জয় এগিয়ে যায়। নিজের সংকোচ শিক্ত মন নিয়ে একহাতে আগলে ধরে। জীবনের সমীকরণ কঠিন সেই সম্পর্কে দূর্জয় অবগত। কিন্তু বাণী তালুকদারের জীবনের সমীকরণ গুলো কি একটু বেশি-ই এলোমেলো না?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here