এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৪৬.

0
183

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৬.

সকাল সকাল অনাকাঙ্ক্ষিত নাম্বার থেকে কল পেতেই প্রত্যয় ভ্রু কুচকে স্ক্রিনের পানে তাকায়। ফোনটা একবার রিং হয়ে নিশ্চুপ হয়ে যেতেই পরক্ষণে আবার চিৎকার করে বেজে উঠে। প্রত্যয় এবার অনেকটা বাধ্য হয়েই ফোন রিসিভ করে কানে ধরে বেরস সুরে বলে উঠে,

“ হ্যালো। “

প্রত্যয় ঠিক যতটা বেরস গলায় হ্যালো বলেছে ঠিক ততটাই কণ্ঠে মধু মিশিয়ে অপর পাশের মানুষটা বলে উঠে,

“ গুড মর্নিং। “

প্রত্যয়ের ভ্রু জোড়ার মধ্যিখানে ভাজটা আরো গভীর হয়। সে চোখ মুখ কুচকে ফোনটা চোখের সামনে ধরে আরো একবার নামটা দেখে নেয়। সে কি ভুল দেখছে নাকি ভুল শুনছে? গালিগালাজের মুখ থেকে সকাল সকাল মধু ঝরছে? রহস্য কি? প্রত্যয় ফোন কানে ধরে অভ্যাসবশত সুরে বলে,

“ কি সমস্যা? “

অপর পাশের ব্যক্তিটি কণ্ঠস্বর এবার আরো নমনীয় করে শুধায়,

“ শুনো না, আম্মু বলছে আজ সন্ধ্যায় তোমাকে বাসায় আসতে। রাতের ডিনারটাও আমাদের সাথে করে যেতে। তুমি কি ফ্রি আছো? “

প্রত্যয় প্রশ্ন করে,

“ বিশেষ কোনো কারণ? “

“ আজ আমার জন্মদিন। এই ছোট বিষয়টাও তোমার মনে নেই? “

প্রত্যয় অবাক হয়। এই ছোট বিষয় নামক তথ্যটা কি আসলেই তার মনে রাখার কথা ছিলো? উহু। প্রত্যয়কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জেসি নিজেই বলে উঠে,

“ দেখলে আম্মু? একটা সামান্য বার্থ ডেট মনে রাখতে পারছে না আর এর সাথে নিজের সম্পূর্ণ লাইফ আমি স্পেন্ড করবো? অসম্ভব! “

অভিযোগের সুরে কথাটুকু উচ্চারণ করে জেসি ফোন কাটে। প্রত্যয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার মানে ওই মধুর সুরে কথা বলাটা সম্পূর্ণ নাটক ছিলো। আন্টি সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো বিধায় এই গালিগালাজের কণ্ঠে এতো নম্রতা এসে ভর করেছিলো। কি চতুর মেয়ে! সুযোগে প্রত্যয়কে বিয়ের জন্য অযোগ্য ক্যান্ডিডেটও প্রমাণ করে দিলো।

ভাবনা ছেড়ে উঠতে না উঠতেই আবারও শব্দ তুলে প্রত্যয়ের ফোনটা বেজে উঠে। এবার আর জেসি নয় বরং প্রত্যয়ের মা জননী ফোন করছে। প্রত্যয় কল রিসিভ করতেই তার মা’য়ের প্রথম প্রশ্ন হলো,

“ বাবা কি আজ সন্ধ্যার পরে ফ্রি আছো? “

“ সকাল থেকে সবাই এই এক প্রশ্ন কেনো করছো? “

“ আসলে হয়েছে কি, আলাউদ্দিন ভাই আর ভাবী কল করেছিলো আমাদের গতকাল। জেসির জন্মদিন উপলক্ষে দাওয়াত দিতে। তোমাকেও নাকি গতকাল কয়েকবার ফোন করেছে। কিন্তু তুমি সম্ভবত ব্যস্ত ছিলে। আমাদের এই মুহুর্তে চট্টগ্রাম যাওয়া তো সম্ভব নয়। তুমি না-হয় গিয়ে দাওয়াতটা রক্ষা করলে। আর যাওয়ার সময় জেসির জন্য ভালো কিছু উপহারও নিও। “

প্রত্যয় খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে,

“ এতো বড় একটা মেয়ের জন্মদিন নিয়ে এতো আদিখ্যেতা করার কি আছে? আর আমি কি কোনো মর্নিং টু ইভিনিং জব করি যে সন্ধ্যার পরে আমি ফ্রি থাকবো? উনারা কি আমার প্রফেশনটা সম্পর্কে জানেন না? “

নিজের কথাটুকু শেষ করেই ফোনটা কেটে দেয় প্রত্যয়। সদ্য জগিং শেষ করে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে ছিলো সে। উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরতেই মুখোমুখি হয় সাইফের। সাইফ সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কার সাথে কথা বলছিলি? “

প্রত্যয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ আম্মুর সাথে। “

কথাটুকু বলতে দেরি, সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যয়ের পিঠে স্বশব্দে একটা শক্ত হাতের চাপড় পড়ে। প্রত্যয় ভ্রু কুচকে চাপা আর্তনাদ করে উঠে। বিরক্ত মিশ্রিত স্বরে বলে,

“ মারছিস কেন? “

“ শালা মা আছে তো তাই মা’য়ের কদর বুঝস না। তুই আন্টির সাথে এই টোনে কথা বলতেছিলি? এত বছর আর্মিতে থেকেও ন্যূনতম ডিসিপ্লিন শিখলি না। তোদের মতো পোলাদের এভাবেই কিল ঘুষি মাইরা ডিসিপ্লিন শিখানো উচিত। “

সাইফের কথার পিঠে প্রত্যয় নীরব রয়। মাথা নিচু করে ফেলে। হঠাৎই খুব বড়ো একটা রিয়েলিটি চেক পেলো সে। আসলেই তো! সাইফ পরিবারহীন বলেই হয়তো পরিবারের গুরুত্ব এতো ভালো করে বুঝে!

প্রত্যয়কে চুপ থাকতে দেখে সাইফ প্রসঙ্গ বদলে বলে,

“ বাই দ্যা ওয়ে সকাল সকাল তোর মেজাজ এতো হট কেনো? “

প্রত্যয় পুরো ঘটনা খুলে বলতেই সাইফ বলে,

“ আরে বলদ! চার মাস পরে দুইজন দুইজনকে বিয়ের জন্য রিজেক্ট করবি ভালো কথা। কিন্তু তুই নিজে অযোগ্য প্রমাণিত হয়ে কেনো রিজেক্টেড হবি? ইজ্জত বলতে কিছু নাই নাকি তোর? “

প্রত্যয় ভ্রু কুচকে বলে,

“ তাহলে কি করবো? “

“ নিজের প্রেস্টিজ ঝগড়াঝাটি ভাবীর হাতে ছেড়ে না দিয়ে রক্ষা কর। নিজেকে অযোগ্য প্রমাণ করিস না। চার মাস পরে পুরো দোষ ঝগড়াঝাটি ভাবীর উপরে চাপিয়ে দিয়ে এনগেজমেন্ট অমত জানিয়ে দিবি। ফিনিশ। “

সাইফের কথা শুনে প্রত্যয় ভাবুক হয়। আসলেই তো! ওই গালিগালাজ মেয়েটার হাতে নিজের ইজ্জত এভাবে ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। প্রত্যয়েরই কিছু একটা করতে হবে। নাহয় ওই মেয়ে প্রত্যয়ের নামের পাশে একশো একটা গালি বসিয়ে তার প্রেস্টিজ নিলামে তুলবে।

প্রত্যয়কে ভাবুক হতে দেখে সাইফ মনে মনে কিঞ্চিৎ হাসে। পোলাডা আসলেই বলদ! নাহয় কি এতো সহজে সাইফের কথায় ভাবনায় ডুব দিতো? এই সেম ভাবনার বীজ এখন ঝগড়াঝাটি ভাবীর মাথায় রোপণ করতে পারলেই কেল্লাফতে। এই দুইজনের নিজেকে যোগ্য প্রমাণের চক্করে প্রেমটা আপনাআপনিই হয়ে যাবে। তারপর আর কি? এদের বিয়েতে মুরগির লেগ পিসে সাইফ কামড় বসাতে বসাতে দোয়া করে দিবে দুটো বাচ্চাকাচ্চা ফুটিয়ে যেনো এরা সুখী থাকে। চারটা হলেও মন্দ হয় না!

__________

পুলিশের আওতায় রিমান্ড যতটা না ভয়ংকর তার থেকেও ভয়ংকর সেনাদের আওতায় রিমান্ডে যাওয়াটা। সেই রিমান্ডে করা টর্চারের ফলস্বরূপ অপরাধীদের করা ভয়ংকর চিৎকার যেকোনো সাধারণ মানুষের গায়ে কাটা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু অপরাধীরা কাল বৈশিষ্ট্য ভেদে ভিন্ন ভিন্ন দলের অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যে একদল হলো বেহায়া ধরনের। এই বেহায়া জাতের অপরাধীরা ধরা পড়ার পরও এদের মধ্যে ভয় কিংবা কোনো চিন্তা কাজ করে না। ইবাতও সেই গোত্রের অংশ। রিমান্ডে আনার পর থেকে কেমন বেহায়া ধরনের হাসি মুখে লেপ্টে রেখেছে। কোনো আঘাতের বিপরীতে একটাও কথা পেট থেকে বের করছে না।

শীতের আমেজে মোড়ানো দুপুর তখন। সবুজ এবং খাকি রঙের মিশেলের ইউনিফর্ম পরিহিত দূর্জয় ভুতুড়ে ধরনের সেলে প্রবেশ করতেই আহত ইবাত চোখ তুলে তাকায়। এতক্ষণ ধরে সেলে উপস্থিত থাকা জুনায়েদ ও ফারদিন সঙ্গে সঙ্গে এককোণে সড়ে দাঁড়ায়। স্যারের ইশারা পেতেই তারা সেল থেকে বেরিয়ে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু দূর্জয় তাদের বেরিয়ে যেতে বললো না। বরং সরাসরি ইবাতের সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় বলে,

“ সোজা সাপ্টা প্রশ্ন করবো। সোজা সাপ্টা উত্তর চাই। এক প্রশ্ন দ্বিতীয় বার রিপিট করবো না। “

জুনায়েদ ও ফারদিন আড়চোখে একবার স্যারকে দেখে। গতকাল রাত থেকেই স্যারের মেজাজ বিগড়ে আছে। এই চামচা যদি এখন স্যারের মেজাজ আরো বিগড়ে দেয় তাহলে স্যার এর কি অবস্থা করবে আল্লাহই জানে!

“ হিরণের নেক্সট টার্গেট কোথায় এবং কবে? “

ইবাত নিজের বিচ্ছিরি হাসি বহাল রেখে বলে,

“ ভুল মানুষকে ভুল প্রশ্ন করছেন মেজর। আমি বিশ্বাসঘাতক না। যার নুন খেয়েছি তার প্রতি বিশ্বস্ত আমি। পুরো দুনিয়া স্যারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও আমি কখনো করবো না। এজন্যই আমাদের পাপের জগতে স্যারের নামের সাথে একমাত্র আমার নাম উচ্চারিত হয়। হিরণ ও ইবাত… “

পুরো কথাটা শেষ করার সুযোগ পায় না ইবাত। তার পূর্বেই একটা সিমেন্টের ন্যায় শক্ত হাতের চড় এসে বসে তার ডান গালে। আহত ইবাত আগে থেকেই দূর্বল ছিলো। এই শক্ত চড়ের ভার বইতে না পেরে সে মুহুর্তেই জ্ঞান হারায়।

ফারদিন নিচু গলায় বলে,

“ স্যার আর আধঘন্টার মধ্যে হেলিকপ্টার এসে পৌঁছে যাবে। “

দূর্জয় বেরিয়ে যাওয়ার আগে শুধু বলে,

“ বরফ ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে রাখো। জ্ঞান ফিরে যাবে। “

দূর্জয়ের কথা শুনে জুনায়েদের ঠোঁটের কোণে মিহি হাসি এসে ভীড় করে। শীতকালে কাউকে ঠান্ডা পানিতে চুবাতে পারার মধ্যে একটা পৈশাচিক আনন্দ আছে। আর সেই কেউটা যদি এরকম নেড়ি কুকুর হয় তাহলে আনন্দের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়।

__________

ইবাত ও হিরণকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ আছে দুটো হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টারে উঠার ঠিক আগ মুহুর্তে দূর্জয়ের মুখোমুখি এসে থামে হিরণ। মুখে তার অদ্ভুৎ শিসের সুর। ঠোঁটের কোণে হাসি। দূর্জয় নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে রয়। আচমকা হিরণ মুখ কিছুটা সরু করে বলে উঠে,

“ বুমম! “

অত:পর হাসতে হাসতে হেলিকপ্টারের দিকে এগিয়ে যায়। ক্রিমিনালবাহী হেলিকপ্টার দুটো আকাশ পথে যাত্রা শুরু করতেই দূর্জয় জুলফিকারের দিকে তাকায়। অত:পর তাকায় উপস্থিত বাকি সকলের পানে। সকলের মুখই কালো হয়ে আছে। এইমাত্র যেনো হিরণ তাদের সঙ্গে মশকরা করে গেলো।

মশকরা নয়তো কি? একজন টেরোরিস্ট, যে কিনা সৈন্যদের কাছে আটক, সে কিনা জেলের ভেতর আটক থেকেও দেশে আরেকটা ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য প্রস্তুত।

__________

ঠিক সন্ধ্যা নাগাদ কলিংবেলের শব্দ পেতেই বাড়ির বড়ো ছেলে দৌড়ে গেলো দরজা খুলতে। শার্ট প্যান্ট পরিহিত ভদ্র বেশে প্রত্যয়কে দেখতেই হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে ভেতরে আসার তাড়া দিলো। প্রত্যয় মুখে ভদ্রতাসূচক হাসি বজায় রেখে লিভিং রুমে প্রবেশ করতে করতে বলে,

“ ভালো আছেন ভাইয়া? “

জেসির বড়ো ভাই জাঈদ হেসে বলে,

“ আলহামদুলিল্লাহ। “

ততক্ষণে লিভিং রুমে এসে উপস্থিত হয় আলাউদ্দিন সাহেব, তার স্ত্রী এবং জাঈদের বউ চারু। প্রত্যয় সবার সাথে কুশল বিনিময় করে লিভিং রুমের সোফায় বসে। সঙ্গে করে আনা বিশাল ফ্লাওয়ার বুকেটা জাঈদের সাত বছরের ছেলে আকাশের হাতে তুলে দিতেই বাচ্চাটা বুকে হাতে নিজের ছোট ফুপ্পির রুমের দিকে দৌড়ে যায়।

আলাউদ্দিন সাহেবের তিন ছেলে মেয়ে। জাঈদ, জাহানারা, জেসি। বড়ো ছেলে আর ছোট মেয়েকে নিয়ে তিনি নিজের এই এপার্টমেন্টটায় থাকেন। বড়ো মেয়ে স্বামীর সঙ্গে দেশের বাহিরে থাকেন। বহু মাস হয়ে গিয়েছে দেশে আসার সুযোগ পাচ্ছে না। তবে ঠিক করে রেখেছে জেসিটা একবার বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেলেই তার এনগেজমেন্টর এক সপ্তাহ আগে দেশে এসে উপস্থিত হবে।

প্রত্যয় যখন আলাউদ্দিন সাহেব এবং জাঈদের সঙ্গে আলাপে মশগুল তখন জেসি ফুলের বুকে হাতে লিভিং রুমে এসে উপস্থিত হয়। বিস্ফোরিত দৃষ্টি তার। প্রত্যয় তাকে দেখে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,

“ হাই। হ্যাপি বার্থডে। বুকে পছন্দ হয়েছে? “

ভদ্র ছেলেটার ভদ্রতা সহিত করা প্রশ্নে আলাউদ্দিন সাহেব গদগদ হয়ে উঠেন। তার মন গেয়ে উঠে,

“ সুপাত্র! সুপাত্র! “

জেসি নিজের বিস্ময়তাটুকু চেপে গিয়ে হাসি মুখে বলে,

“ আমি ভেবেছিলাম তুমি ব্যস্ত থাকবে। আসবে না। “

“ ব্যস্ততা তো জীবনেরই অংশ। তাই বলে তোমার লাইফের ইম্পোরট্যান্ট একটা ডে মিস করবো? “

জেসির পুরো মুখ রাগে লাল হয়ে যায় মুহুর্তে। কুত্তাটার মতলব কি? এমন চিজি লাইন কেনো ছাড়ছে? আব্বু আর ভাইয়ার সামনে জেসিকে কাবু করতে চাইছে?

জেসি মুখ ফুলিয়ে নিজের রুমে ফেরত যায়। বিছানায় বসে কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবে। অত:পর ফ্লোরে রোবো কার নিয়ে খেলতে ব্যস্ত নাদুসনুদুস আকাশকে কাছে ডেকে বলে,

“ লিভিং রুমে গিয়ে ওই আংকেলকে ডেকে নিয়ে আয় তো। বলবি না আমি ডেকেছি। নিজের কথা বলে ডেকে আনবি। “

আকাশ সরু চোখে কিছুক্ষণ জেসিকে দেখে বলে,

“ তুমি আমাকে মিথ্যা বলা শিখাচ্ছো ছোট ফুপ্পি? “

জেসি ধমকে বলে,

“ কানের নিচে একটা দিবো আমার সত্যবাদীর বাচ্চা। চুপচাপ যা বলেছি তা কর। “

আকাশ সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যয়কে ডাকতে চলে যায়। ছোট ফুপ্পির কোনো ভরসা নেই। দেখা গেলো সত্যি সত্যিই আকাশের দু কানের নিচে তবলা বাজানো শুরু করে দিলো।

মিনিট পাঁচেকের প্রত্যয়কে সহ রুমে এসে উপস্থিত হয় আকাশ। ঠোঁট উল্টে বলে,

“ আংকেলকে ডেকে এনে দিয়েছি। এখন আমাকে সালামি দাও ছোট ফুপ্পি। “

জেসি চোখ রাঙিয়ে বলে,

“ দুই ঈদে যে আমার সালামিতে ভাগ বসাস সেটা যথেষ্ট না মোটু? একদম চুপচাপ বসে খেল এখন। কেউ আসলে আমাকে ডাক দিবি। “

বলেই প্রত্যয়ের হাত ধরে টেনে তাকে বারান্দায় নিয়ে যায়। প্রত্যয় বিরক্ত মিশ্রিত গলায় বলে,

“ বাচ্চাদের সাথেও এতো রুড তুমি? “

জেসি প্রত্যয়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে তাকে রেলিঙের দিকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করে,

“ এইযে গলির মোড়ের শাকিব খান। তোমার শয়তানি পেটে কোন খিচুড়ি পাকাচ্ছো, আমাকে বলো। মতলব কি, হ্যাঁ? “

প্রত্যয় বিরক্ত হয়। এই পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চের মেয়ে তাকে রেলিঙে ঠেলে ভয় দেখাতে চাচ্ছে এই ব্যাপারটা আরো বিরক্তিকর। সে বেরস গলায় বলে,

“ এসব আজগুবি কথা বলার জন্য তুমি কি আলাদা কোনো কোর্স করেছো? “

“ কথা ঘুরাবে না একদম। তুমি আমার বাসায় কি করছো? আমার বার্থডে নিয়ে তোমার আগ্রহ জেগেছে কবে থেকে? “

প্রত্যয় এবার উল্টো ঘুরে জেসিকে রেলিঙের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে,

“ তুমি কি ভেবেছিলে, আমাকে সবার সামনে অযোগ্য প্রমাণ করে, সেই এক্সকিউজ দেখিয়ে তুমি বিয়েতে অমত করবে? আর আমি তা বসে বসে দেখবো? “

মুহুর্তেই জেসির কলিজা ধক করে উঠে। খোলা রেলিঙের এই নয় তলা বারান্দা থেকে ভুল করেও পরে গেলে সে সোজা ইন্না-লিল্লাহ হয়ে যাবে। কুত্তাটা কি তাকে হার্ট এট্যাক দিয়ে মারতে চায় নাকি? প্রত্যয় নিজ থেকেই আবার বলে উঠে,

“ আই ওন্ট লেট দ্যাট হ্যাপেন। “

“ তাই বলে আজকের দিনে নিজের এই কুত্তামার্কা চেহারা নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়ে আমার দিনটা নষ্ট করবে তুমি? “

প্রত্যয়ের মেজাজ বিগড়ে যায়। তার ভদ্র সুপুরুষ গড়নের চেহারাকে কিনা কুকুরের সাথে মিলালো? এই মেয়ের সাথে তর্কে জড়ানো মানে আরো একশোটা গালি খাওয়া। নিজের ইজ্জতের মায়া করে প্রত্যয় গম্ভীর স্বরে বলে,

“ আর দেখতে হবে না এই চেহারা। চলে যাচ্ছি কাল। আশা করছি তোমার সকাল, দুপর, রাত সুন্দর কাটবে আগামীকাল থেকে। “

আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না প্রত্যয়। প্রস্থান করে। জেসিও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে। পরমুহুর্তেই তার মনে পড়ে প্রত্যয়ের এই মাত্র বলে যাওয়া কথা। যাবে মানে? কোথায় যাবে? নিজের উৎসুক হাবভাব দেখে জেসি নিজেকেই গালি দেয়। এই ছেলে জাহান্নামে যাক। তার কি আসে যায়?

__________

হেডকোয়ার্টার থেকে পিতৃ নিবাসে ফিরছে দূর্জয়। সুঠাম হাতটা গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে নিবদ্ধ। অদ্ভুৎ এক রজনী! আকাশে চাঁদের অস্তিত্ব নেই। চারিদিকটা কেমন অন্ধকার। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় যা একটু আলোকিত হয়ে আছে। মধ্য পথে আচমকা তার গাড়ির গতি ধীরে ধীরে কমে আসে। একটা পর্যায়ে সম্পূর্ণ থেমে যায়। সে গাড়ির জানালা ভেদ করে দৃষ্টি স্থির করে রাস্তার অপর পাশের দালানটার দিকে। তিন তলার বাম পাশের ইউনিটের বারান্দায় তাকিয়ে মনে মনে কিছু একটা ভাবে।

তার ব্যক্তিগত গুপ্তচর খবর দিয়েছে বাণী আজ স্কুলে গিয়েছিলো। দেখতে খুব স্বাভাবিকই নাকি লাগছিলো। কিন্তু দূর্জয়ের সাব-কনশাস মাইন্ড বলছে বাণী ঠিক নেই। তুফান চলছে মেয়েটার ভেতর। কিন্তু সেই তুফান সে ভিতরে চেপে রেখেছে। দেখানোর মতো মানুষ নেই বলেই কি? যদিও এখন আর বাণীর উপর হয়তো নজর রাখার জন্য গুপ্তচরের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তবুও দূর্জয় রিস্ক নিচ্ছে না। গতকাল বহ্নির মুখে যা শুনেছে তার পরে তো আরো আগে না।

দূর্জয়ের ভাবনার মাঝেই অন্ধকার বারান্দাটায় উপস্থিত হয় এক নারী কায়া। দূর হতে দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার কোলে ছোট বাচ্চা মেয়েটা মিশে আছে। হয়তো ঘুমোচ্ছে। সেই নারী অবয়বটা ধীর গতিতে বারান্দা জুড়ে পায়চারি করতে থাকে। দূর্জয় আচমকা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মেয়েটা আজকাল তাকে পথের মাঝে থামতে বাধ্য করছে। এ কেমন দাপুটে অধিকারবোধ?

আচমকা দূর্জয়ের চিন্তা হয়। আগামীকাল তার টিম সহ ঢাকা যেতে হবে। জুলফিকার মুজতবাও তাদের সঙ্গে যাবে। কবে ফিরবে নিশ্চয়তা নেই। বিশাল একটা বিপদ অপেক্ষা করছে সামনে। কিন্তু কোথায়, কখন, কিভাবে অপেক্ষা করছে তা জানা নেই দূর্জয়ের। এই ক’দিন এই দুটো মানুষ নিরাপদ থাকবে তো আদৌ? হুট করেই দূর্জয় দেশের পাশাপাশি এই দুটো মানুষের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত হয়। একদম হুট করেই।

__________

অনেকটা চোরের মতোই আব্বুর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে নিশা। পড়নে তার বাসার একটা টপস আর স্কার্ট। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া পেরিয়ে কিছুটা দূরে আসতেই একটা রিকশায় চড়ে বসে সে। চলে যায় বায়েজিদ সবুজ উদ্যানের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে রিকশা থেকে নেমে সে আশেপাশে উৎসুক দৃষ্টি মেলে তাকায়। সে জানে না সে এখানে এই রাতের বেলা কেনো এলো। কিন্তু সাইফের জরুরি তলবকে সে সম্পূর্ণ এড়িয়েও যেতে পারে নি।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা রিকশায় চড়ে সেখানে উপস্থিত হয় সাইফ। গায়ে তার সাদা রঙের একটা শার্ট। ভাড়া মিটিয়ে রিকশা থেকে নামতেই নিশা বলে,

“ আমি ভেবেছিলাম আপনি আগে থেকেই এখানে উপস্থিত আছেন ভাইয়া। “

সাইফ এক পলক দেখে নিশাকে। তার বলতে ইচ্ছে করে সে নিশার পিছন পিছন অন্য রিকশায় করেই এসেছে। এই রাতের বেলা নিশাকে একা একটা জায়গায় ডাকার মতো ইনসেন্সিবল নয় সে। রাস্তায় বিপদ আপদের বালাই নেই।

নিশা প্রশ্ন করে,

“ খুব জরুরি কোনো কথা ভাইয়া? “

সাইফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ চলুন হাঁটা যাক ইয়াসমিন। “

নিশা আর কোনো প্রশ্ন করে না। নীরবে সাইফের সঙ্গে কদম মিলিয়ে হাঁটতে থাকে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে নীরবতা ভেঙে নিজেই বলে উঠে,

“ ভাইয়া, ওদিন আমার একটা ফ্রেন্ডের সঙ্গে ছবি পাঠিয়েছিলাম আপনাকে। মনে আছে? “

সাইফ নিচু স্বরে বলে,

“ হু? “

“ কেমন? “

সাইফ আনমনে জবাব দেয়,

“ সুন্দর। “

নিশা সঙ্গে সঙ্গে খুশি হয়ে যায়। প্রফুল্ল গলায় বলে,

“ ওর নাম ঐশী। খুব নম্র, ভদ্র মেয়ে। আপনার সাথে সুন্দর মানাবে। আপনি ওকে বিয়ে করবেন? “

সাইফ আচমকা চোখ বড়ো বড়ো করে নিশার দিকে তাকায়। নিশা ভীত হয়। অযাচিত ঘটকালিতে কি লোকটা ক্ষেপে গেলো নাকি? কে জানে! কিন্তু নিশার নিয়ত তো খারাপ ছিলো না! এই লোকটার জন্য তার মায়া হয়। মনে হয় লোকটা আপন একটা নিজের মানুষ ডিজার্ভ করে। তাই তো নিশা এই লোকের কি ধরনের মেয়ে পছন্দ সেই হিসাব কষে নিজের চারিদিকে মেয়ে খুঁজে বেড়ানো শুরু করেছিলো। ঐশী মেয়েটাও তো খারাপ না। দেখতে সুন্দর, নমনীয় ব্যবহার, বেশ সংসারীও হবে দেখে বুঝা যায়। সাইফের মতো মানুষকে বেশ আগলে রাখতে পারবে।

সাইফের পরিষ্কার জবাবে নিশার ঘোর কাটে,

“ আমি ওই মেয়েকে বিয়ে করবো না। “

নিশা মুখটা একটুখানি করে নুইয়ে ফেলে। সে কি বেশি অধিকারবোধ দেখিয়ে ফেললো? তার ভাবাবেগকে ভুল প্রমাণ করে আচমকা সাইফ বলে উঠে,

“ আপনাকে চাচ্ছি ইয়াসমিন। শিকড়হীন মানুষটাকে কি আপন করে নিতে পারবেন? “

নিশা মুহুর্তেই চোখ তুলে তাকায়। দৃষ্টি গিয়ে আটকায় সাইফের চোখের পানে। মশকরা ও দুষ্টুমি ভর্তি সেই দৃষ্টিতে আচমকা নিশা এক আকাশ অসহায়ত্ব খুঁজে পায়। কেমন অদ্ভুৎ সেই দৃষ্টি! গল্প সিনেমার মতো মুহুর্ত থমকালো না, চারিদিকে হাওয়া বয়ে গেলো না, আকাশ হতে বর্ষণও নামলো না। তবে নিশার বুকে অদ্ভুৎ এক কম্পন শুরু হয়। যেই কম্পন রিখটার স্কেলের মাত্রা পেরিয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর গতিতে বাড়ছে। সাইফের কণ্ঠে অস্থিরতা। সে ফের প্রশ্ন করে,

“ আমাকে আপনার নিজের যোগ্য মনে হয় ইয়াসমিন? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here