এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৭.
তামাটে রঙের, মেদহীন, লম্বাদেহী পুরুষের অসহায় মাখা গলায় করা সেই প্রশ্নের পিঠে নিশার কণ্ঠনালী বিদ্রোহ করে বসলো। বোকা বোকা চোখ মেলে তাকিয়ে থেকে ইতস্তত গলায় জবাব দেয়,
“ কিন্তু ভাইয়া… “
সাইফ এবার অধৈর্য্য গলায় নিশাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“ ট্রাস্ট মি ইয়াসমিন, আপনার মুখের এই ভাইয়া ডাকটা পৃথিবীর সবথেকে বিষাক্ত শব্দ আমার কাছে। “
নিশা বিব্রত অনুভব করে। ভাইয়া ডাকটা চেপে গিয়ে নম্র স্বরে বলে,
“ আমার সময় চাই। “
সাইফ এবার শীতল গলায় বলে,
“ এক জীবন সময় দিলাম। তবে জীবন কতদিনের সেই ধারণা দিতে পারছি না। জীবন ফুরানোর আগে আমাকে জবাবটুকু দিলে মেহেরবানি হতো। “
সেই রাতটায় নিশা আর একটা কথাও বলতে পারে নি। সাইফ তাকে ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। রিকশা থেকে নেমে যখন নিশা সামনে এগোনোর জন্য পা বাড়াচ্ছিল তখন কেবল সাইফ পিছু ডেকে বলেছিলো,
“ আগামীকাল ঢাকা যাচ্ছি ইয়াসমিন। কোথাও যাওয়ার পূর্বে বিদায় নেওয়ার অভ্যাসটা আমার মধ্যে নেই। এর অবশ্য কারণ আছে। এতদিন আমার কাছে বিদায় নেওয়ার মতো কাছের মানুষ ছিলো না। আজও নিবো না। তবে আজ কারণ ভিন্ন। আর সেই কারণটা হলো আমি শীঘ্রই ফিরবো। আপনার জবাবটা শোনার জন্য ফিরবো। ভালো থাকবেন। “
__________
আকাশে মেঘপুঞ্জির ভীড়ে আড়াল হয়ে আছে চাঁদ। প্রকৃতিতে বইছে হিম বাতাস। পর্দাযুক্ত খোলা জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে সেই ঠান্ডা বাতাস। সেই গা হিম করা বাতাসের দিকে ধ্যান নেই নিশার। গায়ে কাটা দেওয়া ঠান্ডার মাঝে সে বালিশ বুকে চেপে চোখ বুজে বসে রয়েছে। বুকের মধ্যে বহমান ভূমিকম্পটা এখনো থামে নি। তবুও প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। তবে সাইফের করা প্রশ্নের উত্তর নয়। বরং অন্য এক প্রশ্নের উত্তর।
ওই লোকটা এমন কাউকে ডিজার্ভ করে যে কিনা যত্নের চাদরে মানুষটাকে মুড়িয়ে রাখতে পারবে। যে কিনা মানুষটার ভরসার স্থান হবে, নির্ভরতার আশ্রয় হবে। নিশার মনের কোণে প্রশ্ন উঁকি দেয়। সে কি আদৌ সাইফের যোগ্য? প্রশ্ন উত্তরের দ্বন্দ্বের মাঝে হারিয়ে যায় নিশা। হয়ে যায় শান্ত, স্থির, বিষণ্ণ। কর্ণকুহরে বেজে উঠে সাইফের করা সেই প্রশ্নটা,
“ আপনাকে চাচ্ছি ইয়াসমিন। শেকড়হীন মানুষটাকে কি আপন করে নিতে পারবেন? “
শেকড়হীন শব্দটা মনে পড়তেই নিশার বিষণ্ণতার মাত্রা আরেকটু বেড়ে যায়। চারিপাশে বয়ে যায় আঁধার রাতের দীর্ঘশ্বাস।
__________
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে একত্রিত হয়েছে টেরোরিজম মিশনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত সকল সেনা সদস্যরা। দুপুর থেকে চলছে তাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। দীর্ঘ এই মিটিংয়ের শেষ হয় এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে। অতি শীঘ্রই তারা দেশ জুড়ে রেড এলার্ট জারি করবে। গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ করবেন আটককৃত অপরাধীর দেওয়া হুমকি। আসন্ন পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে এবং পুরনো হামলা গুলোকে নজিরা হিসেবে উপস্থাপন করে সর্ব প্রথম সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের জন্য হাই কোর্টে আপিল করবে। সেই সঙ্গে ঘর থেকে সবাইকে বের হওয়ার জন্যও নিরুৎসাহিত করা হবে।
অন্তত এক থেকে দুই সপ্তাহ জনগণকে সচেতন অবস্থান করার জন্য জোর দিবেন। এই এক দু সপ্তাহের মধ্যে সৈন্যরা নতুন এক অপারেশন পরিচালনা করবেন। হিরণের লুকায়িত আতঙ্কবাদীদের ঘাটি খুঁজে বের করার অপারেশন। সেই সঙ্গে সাধারণ জনগণদেরও আহবান করবে যেনো সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লেই ইমারজেন্সি হেল্পলাইন ৯৯৯ এ কল করে তা জানায়।
__________
হিরণের জবানবন্দি থেকে এতদূর জানতে পেরেছে সৈন্যরা যে শমসের মজুমদারকে তন্নতন্ন করে খুঁজে লাভ নেই। সে মৃত। হিরণ নিজ হাতে খুন করেছে তাকে। হিরণের জবানবন্দী নিশ্চিত করতে চট্টগ্রামে উপস্থিত একদল সৈন্যকে পাঠানো হয় হিরণের বিভিন্ন প্রোপার্টিসের তালাশে। সেই প্রোপার্টিস গুলোর মধ্যে এক খামারবাড়ির উঠোন হতে উদ্ধার হয় এক মরদেহ। এতো মাসে লাশ পঁচে কেবল দেহখণ্ড গুলোই অবশিষ্ট ছিলো। সেই দেহাংশ বিশেষ ব্যবহার করে মেডিক্যাল ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় যে লাশটা শমসের মজুমদারেরই। শমসের মজুমদারের মৃত্যুর এই ছোট তথ্যটুকু বাদে আর একটা টু শব্দ উচ্চারণ করে নি হিরণ। ইবাতও নিজের স্যারের অনুসারী। তার মুখ দিয়েও বের হলো না একটা শব্দ।
তবে আটককৃত আতঙ্কবাদীদের মধ্যে কিছুজন রিমান্ডের অত্যাচারের মাত্রা সইতে না পেরে মুখ খুলেছে। জানিয়েছে সম্ভাব্য কিছু ঠিকানা। সৈন্যরা মুহুর্ত অপেক্ষা না করে উক্ত স্থান গুলোতে পৌঁছায়। কিন্তু প্রতিটা জায়গাই মানব শূন্য। সৈন্যরা আশাহত হয় না। উক্ত স্থানগুলো হতে বিভিন্ন ক্লু কালেক্ট করে। সেগুলোর রেশ ধরে চিরুনি তল্লাশি চালানো শুরু করে।
__________
দূর্জয়রা ঢাকায় এসেছে আজ দু’দিন হলো। এই দু’দিন দু দন্ডের জন্যও ফুরসত পায় নি তারা। অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে সময় পাড় করছে। শেষ বিকেলের দিকে আচমকা বেয়ারা ফোনটা বেজে উঠতেই দূর্জয় অভ্যাস সলুভ ধীর গতিতে ফোনটা রিসিভ করে। অপর পাশ হতে এক নারী কণ্ঠ বলে উঠে,
“ খুব বেশি ব্যস্ত তুমি? “
“ হ্যাঁ। “
“ ঢাকায় থেকেও বাসায় আসার জন্যও এক মুহুর্ত সময় হবে না? “
“ সময় পেলে অবশ্যই আসবো। “
নারী কণ্ঠটা এবার নীরব হয়ে যায়। আর কোনো প্রশ্ন ছুড়ে দেয় না। দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ তুমি ভালো আছো মামণি? “
“ আছি আলহামদুলিল্লাহ। “
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে এবার নারী কণ্ঠটা বলে উঠে,
“ বাড়ি ফিরলে এবার অন্তত হাতে দু’দিন সময় নিয়ে এসো। “
“ বিশেষ কোনো কারণ? “
“ হেনা আপাদের আসতে বলতাম তাহলে। “
দূর্জয় চোখ কুচকে ফেলে। হেনা আপা নামক কোনো পরিচিত মানুষের কথা এই মুহুর্তে তার মনে পড়ছে না। সে জানতে চায়,
“ হেনা আপা কে? “
“ তোমার ফুফুর ননাশ। “
দূর্জয়ের কপালের ভাজ দৃঢ় হয়। সে কৌতূহল মিশ্রিত স্বরে জানতে চায়,
“ উনাদের বাসায় আসার সঙ্গে আমার বাড়ি ফেরার কি কানেকশন? “
“ তোমার ফুফু খুব প্রশংসা করেছে উনাদের পরিবারের। হেনা আপার মেয়েটা নাকি অত্যন্ত সুন্দর এবং মার্জিত। কানাডা থেকে কম্পিউটার সাইন্সের উপর মাস্টার্স করে দেশে ফিরেছে সবে। বয়সটাও একদম নাদান নয়, তোমার সঙ্গে মানানসই। তোমার আপত্তি না থাকলে একবার দেখা করার ব্যবস্থা করতাম। “
মায়ের সূক্ষ্ণ ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেই দূর্জয় স্পষ্ট গলায় বলে,
“ মেয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো তবে আমি ইন্টারেস্টেড নই। “
মিসেস সুহালা ছেলের উপর কখনোই নিজের কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় না। তবে এইবার তিনি স্বভাবের বাহিরে গিয়ে খানিকটা রাগ দেখিয়ে বলে,
“ তোমার ইন্টারেস্টটা কবে আসবে শুনি? এই বয়সে তোমার আব্বু দুই ছেলের বাপ ছিলো। আর তুমি? ইউ আর ইম্পসিবল! “
দূর্জয় মায়ের রাগ দেখে এবার চাপা কৌতুক করে বলে,
“ তোমার অভিযোগটা ঠিক কি নিয়ে মামণি? আমি এখনো বিয়ে করছি না সেটা নিয়ে? নাকি আমি এখনো বাপ হচ্ছি না সেটা নিয়ে? “
সুহালা বেগম বাকরুদ্ধ বনে যায়। তার ছেলে কৌতুক করার পাত্র না। তবে আজ ঠিক সময়মতো নিজের কৌতুক দ্বারা সুহালা বেগমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে একদম। অত:পর ভদ্র ছেলের মতো কোমল স্বরে বলে,
“ এখন রাখছি মামণি। খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ। “
__________
অন্ধকারাচ্ছন্ন আর্মিদের আওতাভুক্ত সেলে জীবনটা বেশ দূর্বিষহ কাটছে হিরণের। এতো বছরের পাপের জীবনে কেউ তার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পায় নি কখনো। যে হাত তোলার সাহস করেছে সে নিজের হাতের সঙ্গে জীবনটাও খুইয়েছে। কিন্তু এখন! রোজকার টর্চারের ফলস্বরূপ আঘাতে আঘাতে সম্পূর্ণ দেহ জর্জরিত। কোমড়ের আঘাত গুলো খুব গুরুতর। মেঝেতে শুতে নিলেই তা টের পায় হিরণ। তবে গায়ে মাখে না সে। শারীরিক আঘাত তো সে কম সয় নি জীবনে। শেষ রাতে যখন মেঝেতে শরীরটুকু এলিয়ে দেয় তখন চোখের সামনে ভেসে উঠে অদ্ভুৎ এক শৈশব।
বয়স হয়তো তখন কেবল সাত ছিলো হিরণের। যখন থেকে বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই নিজেকে আবিষ্কার করে চার দেয়ালে আবদ্ধ ভিন্ন এক জগতে। পিতৃ মাতৃ পরিচয়হীন এক অনাথ হিসেবে অনাথ আশ্রম টুকুতেই তার ঠাই হয়েছিলো। অনাথ আশ্রমের মালিক ছিলো কালো বাজারির সঙ্গে জড়িত। সমাজে নিজের সনামধন্য খ্যাতির পিছনে লুকিয়ে ছিলো তার কুলষিত এক রূপ। সেই রূপটা জড়িত ছিলো হাজারো অপকর্মের সঙ্গে।
ভালো মানুষীর মুখোশ পড়ে তিনি অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের দ্বারা দু ধরনের ব্যবসা করতেন। প্রথমটা হলো বাচ্চাদের শরীরে অস্ত্রোপচার করে অবৈধভাবে অরগ্যান ডোনেশন। আর দ্বিতীয়টা হলো বাচ্চাদের দিয়ে শহরের ব্যস্ত মোড় গুলোতে ভিক্ষা করানো। হিরণের ভাগ্য ভালো ছিলো নাকি খারাপ তা তার জানা নেই। তবে সে ছিলো ভিক্ষা করানো দলের অংশ। সেই ভিক্ষার রেশ ধরেই একদিন তার পরিচয় হয় শমসের মজুমদারের সঙ্গে।
মিরপুর ১০ এর সামনে বিলাসবহুল গাড়িতে বসে থাকা শমসেরকে দেখেই হিরণ বুঝেছিলো লোকটা সম্ভ্রান্ত ঘরের। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন হিরণ দুটো টাকা বেশি লাভের আশায় নিজের কথার দ্বারা লোকটার মনযোগ পেতে সক্ষম হয়েছিলো। তবে তার বুদ্ধিমত্তা শমসেরকে এতটাই মুগ্ধ করে যে তিনি পরের দিনই সেই অনাথ আশ্রমে এসে হাজির হয়। উদ্দেশ্য এই সুন্দর দেখতে বুদ্ধিমান বাচ্চাটাকে দত্তক নেওয়া।
দত্তকের মানে কি তা বুঝতে অসুবিধা হয় নি হিরণের। তবুও এই নিয়ে আলাদা কোনো প্রতিক্রিয়া ছিলো না তার। তবে যখন দেখলো অনাথ আশ্রমের বাকি বাচ্চাগুলো তাকে ঈর্ষাপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছে তখন মনে পৈশাচিক এক আনন্দ অনুভব করে সে। জীবনে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করে অন্যের ঈর্ষার কারণ হওয়া কতটা আনন্দপূর্ণ। মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় একদিন সে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাবে যেখানে সবাই তাকে এবং তার ক্ষমতার মাত্রাকে ঈর্ষা করবে।
শমসের মজুমদারের হাত ধরে এক বিলাসবহুল বাড়িতে পা রেখে হিরণের চোখ চিকচিক করে উঠেছিলো। ভেবেছিলো এই বুঝি তার জীবনটা সুন্দর হবে। অন্ধকার চিরে আলোর জগৎ বোধহয় একেই বলে। অবশেষে হয়তো সে একটা পরিবার পাবে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন।
সেদিন রাতে আউট হাউসে যাওয়ার পথে শমসের তার কাধে হাত রেখে গম্ভীর স্বরে বলেছিলো,
“ শুনো ছেলে। জীবন অনেক নির্মম এক খেলার মঞ্চ। এই মঞ্চে প্রতিটা জিনিসই তোমার নিজ যোগ্যতা এবং চেষ্টায় জিতে নিতে হবে। এখানে কেউই তোমাকে সোনার থালায় সাজিয়ে সব দিয়ে দিবে না। এটা হলো আমার তরফ থেকে তোমার প্রথম শিক্ষা। “
হিরণ অবুঝের ন্যায় তাকিয়ে ছিলো। লোকটার মুখের সেই কথার অর্থ বুঝতে পারছিলো না। তবে বুঝতে পারে, যখন শমসের মজুমদার আউট হাউসের ভেতর তাকে ঠেলে দিয়ে দরজাটা বাহির থেকে বন্ধ করে দেয়। হিরণ বিস্মিত হয়েছিলো। ভেতরটা ছিলো গুটগুটে অন্ধকার। আঁধারকে হিরণ ভয় পেতো না। তবে সেকেন্ড পাঁচেক পেরোতেই যখন রুমের লাইট জ্বলে উঠে তখন সে ভীত হয়। রুমের দুই কোণে লোহার শিকল গলায় ঝুলানো দুটো কালো রঙের স্বাস্থ্য সম্মত কুকুর বাধা ছিলো। ক্ষুধার্ত কুকুর দুটোর এক হাত সমান জিভ মুখের বাহিরে ঝুলছিলো। হিরণ ভীত হয়ে চিৎকার করে দরজা ধাক্কানো শুরু করে। তার চিৎকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কুকুর দুটোও লেজ নাড়িয়ে সোল্লাসে মেতে উঠে। যেনো ভীত হিরণকে দেখে তারা খুব মজা পাচ্ছে।
রুমের এককোণে ছিলো একটা জানালা। সেই জানালার বাইরে থেকে শমসের অদ্ভুৎ হাসি দিয়ে বলেছিলো,
“ এইমাত্র যেই শিক্ষার বুলি আওড়িয়েছি তার জীবনমুখী ক্লাস এটা। এই রুমটা হলো পরীক্ষার হল, কুকুর দুটো তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী আর রুমের মাঝখানটায় রাখা একটুকরো বনরুটি হলো পুরুষ্কার। আমি জানি তোমার অনেক খিদে পেয়েছে। দুপুর থেকে না খাওয়া। তাই বনরুটিটা কুকুর দুটোর সামনে থেকে ছিনিয়ে নাও। তাহলে তোমার রাতের খাবারটাও তুমি উপার্জন করে নিতে পারবে আর এই বন্ধ রুমটা থেকেও বের হওয়ার সুযোগ পাবে। “
সে রাতে হিরণ বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছিলো। বুঝতে পেরেছিলো এক অন্ধকার জগত থেকে বের হয়ে সে অন্য এক অন্ধকার জগতে পা রেখেছে। যেখানে টিকে থাকাটা তার জন্য সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামে জয়ী সে কেবল তখনই হবে যখন কি-না, সে এই শমসের মজুমদার নামক লোকটাকে টপকে গিয়ে নিজের স্থান তৈরী করতে পারবে।
হিরণ জয়ী হয়েছিলো শেষ পর্যন্ত। শমসের মজুমদারকে টপকে গিয়েছিলো সে পাপের জগতে। রাজ্য জয় করেছিলো। সেই রাজ্যে এক রমণীকেও রাণী বেশে আনতে চেয়েছিলো। নিজের অন্ধকার রাজ্যে এক শুভ্র মুক্তার দানার ন্যায় যে আলো ছড়াবে। রমণীকে রাণী করে আনার জন্য এক সুন্দর ছক সাজায় হিরণ। রমণীর পিতা মহোদয়কে টাকার বিনিময়ে কন্যা দানের প্রস্তাব দেয়। রমণীর পিতা সেই প্রস্তাবে রাজি হয়। তবে জেদি রমণী সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
হেরে যাওয়ার অভ্যাস হিরণের কোনো কালেই ছিলো না। জেদি রমণীর প্রত্যাখ্যানকে থোড়াই কেয়ার করে সে তাকে ছিনিয়ে আনে। জগৎ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আশা ছিলো একদিন না একদিন ঠিকই রমণীর মনে ঠাই খুঁজে পাবে। কিন্তু জেদী রমণী ভুল করে। হিরণের বিধ্বংসী রাগের শিকার হয়। অত:পর? অত:পর রাণী না পেলেও হিরণ এক রাজকন্যা পেয়েছিলো।
রাজকন্যা তার ঘর আর জীবন দুটোই আলোকিত করে রেখেছিলো। জীবনের পাঁচটা বছর যেনো চোখের পলকেই কেটে গেলো। অকস্মাৎ একদিন রাজকন্যা হিরণের নিকৃষ্ট রূপটার সাক্ষী হলো। আর তারপর? তারপর পৃথিবীটা কেমন মলিন হয়ে গেলো হিরণের।
মেয়ের ঘৃণার মাধ্যমেই যেনো হিরণের পাপের সাম্রাজ্যের ধ্বংস শুরু হয়েছে। বাণী আর বহ্নিকে হারিয়ে ফেলা, তার সত্যটা গোটা দুনিয়ার সামনে আসা অত:পর পলাতক হয়ে জীবন পাড় করা। হিরণ দেখতে পেয়েছিলো, নিজের ভবিষ্যৎ স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলো সে। সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে যে বেশিদিন পালিয়ে বেড়ানো তার পক্ষে সম্ভব হবে না তা সে বুঝতে পেরেছিলো। তাই তো শেষবারের মতো দেশের কালো অধ্যায়ে নিজের নাম লেখার জন্য আরো একটা হামলার প্ল্যান ম্যাপ রেডি করে।
এবারের হামলার সঙ্গে জড়িত নেই কোনো বহিরাগত শক্তি। নেই কোনো আলাদা মুখ্য হোতা। এই হামলা একান্তই হিরণের কারুকার্য। একান্তই তার।
এই পথের শেষ কোথায় তা-ও হিরণ ভালো করেই জানে। কিন্তু মানসিক অশান্তি ধীরে ধীরে তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। প্রতি মুহুর্তেই সে কানে শুনতে পায় বহ্নির বলা,
“ আই হেইট ইউ পাপা। “
শব্দ চারটা কর্ণগোচর হতেই হিরণের মাথার ভেতর একশো পিপড়া যেনো দংশন করা শুরু করে। সেই যন্ত্রণায় সে মাঝেমধ্যে দেয়ালে জোরে জোরে নিজের মাথা ঠুকে। কিন্তু বিন্দু পরিমাণ যন্ত্রণা কমে না। উল্টো যন্ত্রণা তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে যখন সে উপলব্ধি করে, এই পৃথিবীতে আর কেউই তাকে চায় না। বাণীর সাথে নিজের দুটো সন্তানকেও হারিয়ে ফেলেছে সে। পথ আলাদা হয়ে গিয়েছে তাদের। কোনো ক্ষমতা খাটিয়েও সেই পথ আর এক হবার নয়!
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]
[ আমি শুরু থেকেই বলে এসেছি গল্পটা কোনো নির্দিষ্ট নায়ক নায়িকা কেন্দ্রিক নয়। কতগুলো চরিত্রের জীবনগাথার মিশেল হলো রক্তসন্ধ্যা। প্রতিটি চরিত্রই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি চরিত্রেরই এখানে নিজস্ব পয়েন্ট অফ ভিউ আছে। সেই পয়েন্ট অফ ভিউ ধরে বিবেচনা করতে গেলে গল্পের সকল পাপীই অলি আউলিয়া। আমি এখানে কোনো অপরাধ জাস্টিফাই করছি না। কেবল চরিত্র গুলোর জীবন গল্প লিখছি। তাই চরিত্রের ডেভলপমেন্ট কিংবা অধ্বঃপতনের সঙ্গে আমাকে টেনে আনবেন না। ধন্যবাদ।
এবার আসি অন্য কথায়। সবাই কেমন আছেন? নিরাপদে আছেন তো? বিশেষ করে চট্টগ্রাম বাসিন্দারা। আপনাদের জন্য দোয়া রইলো। সাবধানে থাকুন, ভালো থাকুন, ভালো রাখুন। ]