#তবু_সুর_ফিরে_আসে
৩২ পর্ব
এই ঘরের দেয়ালে কোন ঘড়ি দেখতে পাচ্ছে না হেরা । মোবাইল টা কোথায় সেটাও খেয়াল নেই। বুঝতে পারছে না কয়টা বাজে। নওশাদ যথারীতি সকাল সকাল উঠে গেছে। সে কখনো মানুষটার আগে উঠতেই পারে না! পাশ ফিরতেই ওর মাথার কাছে একটা চিরকুট রাখা দেখলো । নওশাদ রেখেছে। হাতে চিরকুট টা নিয়ে গত রাতটার কথা চিন্তা করছে হেরা । যা হলো এর পর ওর খুব লজ্জা লাগছে , কিভাবে যাবে সে নওশাদের সামনে !
চিরকুট টা পড়া শুরু করলো হেরা,
” হেরা , তোমাকে কিভাবে ধন্যবাদ দিব বলোতো ? পাথর চাপা বিবর্ণ ঘাসের মতো আমার জীবনটাকে আর দীর্ঘ শ্বাসে মাখা আমার রাত গুলোকে হঠাৎ উৎসবের রাতে পরিনত করে দিলে তুমি। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ । জানি না তোমার মনে, তোমার সবকিছুতে কতটুকু পরিপূর্ণতা আনতে পেরেছি ? তুমি শুধু নাদিয়া আর মিলা কে বলে দিও তাদের ভাইয়া বিড়াল সহ আত্মসমর্পণ করেছে । নিরীহ প্রাণী টিকে মারার কি দরকার বলো ?
তোমার নওশাদ ”
হেরা বিড়ালের কাহিনী আজকেও বুঝলো না শুধু এইটুকু বুঝলো কালকে রাতের ঘটনার সঙ্গে এর একটা সংশ্লিষ্টতা আছে হয়তো। তার ভালো লাগছে শেষে নওশাদ লিখেছে ‘তোমার নওশাদ’ এই দুই টা শব্দ ওর বুকের আবেগে আগুন ঢেলে দিল। চিরকুট টা হাতে নিয়ে সে একটা ভালো লাগায় অস্থির হচ্ছে ।
টালির ছাদ বলেই সে বুঝতে পারছে না বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে নাকি ? জানালায় ভারি পর্দা ঝুলানো আলোও আসছে না ।
হেরা কম্বলের নিচে শুয়ে আবার চিরকুট টা পড়ছে।
হঠাৎ খুট করে দরজায় শব্দ হতেই সে চোখ বন্ধ করে মাথা ঢেকে ফেলল কম্বলের নিচে।
নওশাদ খুব সাবধানে রুমে এসে ঢুকলো। তারপর বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো । দুই চার সেকেন্ড দাঁড়িয়ে কেবিনেটের কাছে কিছু একটা করলো। আবার এসে দাঁড়ালো হেরার কাছে !
তারপর বলল,আমি কি আসব কম্বলের নিচে ? অভিনয় করে লাভ নেই আমি জানি কাঠবিড়ালী লজ্জায় লুকিয়ে আছে !
হেরা কঠিন ভাবে নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে কম্বলের তলায় লুকিয়ে। নওশাদ কম্বলের একটা অংশ তুলে কম্বলের ভেতরে ঢুকে নিজের মাথা ঢেকে ফেলল। কি ব্যাপার ?
হেরা কম্বল মাথার উপর থেকে সরালো । কিভাবে বুঝলেন আমি জেগে আছি ?
যার ক্লাস্টোফোবিয়া আছে সে কখনো কম্বলের নিচে মাথা ঢেকে ঘুমাবে না ম্যাডাম ।
লজ্জা পাচ্ছিলে কেন ?
জানি না।
নওশাদ হেরাকে নিজের দিকে টেনে নিলো । অবশ্য তোমার লজ্জা মাখা মুখটা দেখতে খুব ভালো লাগে।
কখন উঠেছেন আপনি ?
অনেক সকালে । উঠে অনেকক্ষণ তোমার পাশেই শুয়ে ছিলাম । তুমি বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছিলে ।
আমি টের পাইনি ।
হুম আপনি অনেক কিছু টের পাননি ম্যাডাম !
কি হয়েছে?
আমি আপনার ঠোঁটের নিচের তিলে কত গুলো চুমু খেয়েছি টের পাননি । বলেই নওশাদ আবার হেরার ঠোঁটের নিচে চুমু খেলো ।
আপনি নিশ্চয়ই ব্রেকফাস্ট করেননি, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি বলে হেরা উঠতে নিলো।
নওশাদ জড়িয়ে ধরে আটকে রাখলো।তোমাকে এত্তো গুলো চুমু খেয়েই ব্রেকফাস্ট করলাম সকালে । তুমি তোমার ব্রেকফাস্ট টা করে নিতে পারো হেরা , নওশাদ ঠোঁট উঁচু করে দিল ।
তাই বুঝি? হেরা হি হি করে হাসছে !
আমি কিন্তু অনেক দুষ্টুমি করবো হেরা গত তিন মাসের বকেয়া সব উসুল করবো একটা একটা করে !
আমি পালাচ্ছি এখন !
কোথায় পালাবে কাঠবিড়ালী, পালাতে দিলে তো তোমাকে ! নওশাদ হেরা কে দুই হাতে জাপটে ধরে ফেলল।
ডীপ গ্রীন আর মেরুন পাড়ের একটা সফট সিল্ক ইক্কত শাড়ি পড়ে হেরা আয়নার সামনে ভেজা চুল গুলো যখন চিরুনি করছে নওশাদ পিছনে এসে দাঁড়ালো।
বাহিরে কি বৃষ্টি হচ্ছে?
হুম ঐতিহাসিক সিলেটের বৃষ্টি , নওশাদ বলল।
তাহলে ?
তাহলে আর কি , টাপুর টুপুর বৃষ্টি নূপুর/জলছবিই গাঁয়ে/তুই যে আমার একলা আকাশ/মেঠো সুরের ছায়। রঙ বেরঙের বেলোয়ারি/ সাত রঙ্গা রং মুখ/ তোর মুখেতেই লুকিয়ে আছে/ জীবন ভরের সুখ । রে জীবন ভরের সুখ/ যখন শিমুল পলাশ ঝড়বে পথে/ দুলবে হাওয়া বুকে । থাকব দুজন দুজনাতে শপথ নিয়ে সুখে/ গাইবো তোরই দৃষ্টি পানে এক সুরেরই গান।
অদ্ভুত সুন্দর গানটা তো ! কার গান?
আমি যখন গাইছি আমার গান । জানি না কার ?
তাহলে বৃষ্টির জন্য ঐ নদীর কাছে যাওয়া যাবে না এখন কি করব তাহলে আমরা?
থাকব দুজন দুজনাতে হেরা ! নওশাদ হেরার কপালে একটা সবুজ রঙের টিপ পড়িয়ে দিল।
বৃষ্টি থামলে তারপর যাব আমরা। নৌকা ঠিক করা আছে শুধু বৃষ্টি থামার অপেক্ষা।
বারান্দায় এসে হেরা অবাক হয়ে গেল। বারান্দার একটা কর্নারে ইজেলের উপর ক্যানভাস পাশে রং, ব্রাশ সব রাখা।
হেরা চিৎকার দিয়ে উঠলো, আপনি ছবি আঁকবেন ? দারুন ! এসব কিছু সঙ্গে নিয়ে এসেছেন?
হুম। ভাবলাম তোমাকে সামনে বসিয়ে আঁকার চেষ্টা করি কিছু একটা।
প্লিজ প্লিজ শুরু করেন। হেরা খুব এক্সাইটেড।
এক কাজ করো তুমি শুরু করে দাও আমাকে ! এখান থেকে যেকোন একটা রঙ দিয়ে আঁকিবুঁকি করে দাও আমি তারপর হাতে নিব।
হেরা লাল রঙ দিয়ে ক্যানভাসে একটা দাগ দিয়ে দিলো।
তারপর নওশাদ ব্রাশ ঘষার কাজ শুরু করলো।
হেরা দুই মিনিট পাশে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো , ছবি কোথায় ফুটে উঠেছে না তো কিছুই?
বোকা মেয়ে এত তাড়াতাড়ি হবে নাকি অনেক সময় লাগবে। আর অনেক দিন আঁকি না, কি হবে আই এম নট শিওর।
এখন তো আপনি ফ্রি আছেন সারাক্ষণ চেষ্টা করতে থাকেন দেখবেন পারবেন।
তাই না আমি এখানে ছবি আঁকার জন্য এসেছি শুধু, আমার আর কোন কাজ নেই ? নওশাদ বলল।
এখানে কি কাজ আপনার ? আপনি না বললেন অফিসের কোন কাজ করবেন না!
নওশাদ ঝাট করে হেরাকে টান দিয়ে বুকের কাছে নিয়ে এলো , দেখাবো কি কাজ আমার ? তারপর হেরার নাকে নাক ঘষে দিলো ।
আচ্ছা ঠিক আছে আপনি শুরু তো করবেন তারপর ছবি যতটুকু ই হয় ঢাকায় নিয়ে বাকিটা করবেন।
সুমনা সেদিন রঙ গুলো দিলো বলেই সঙ্গে নিয়ে এলাম । তা না হলে ভুলেই গিয়েছিলাম ছবি এঁকেছি কোন এক সময়।
হেরা নওশাদের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো আপনার এত গুণ আমি যত দেখি মুগ্ধ হয়ে যাই। সেজন্যই নাদিয়া ভাবি আর মিলা ভাবি বলে আপনি অলরাউন্ডার। আমার ও মনে হয় আপনার মত মানুষ খুব কম হয় । সবচেয়ে বড় গুণ হলো আপনি খুব ভালো একজন মানুষ। আমি আপনাকে দেখি আর মুগ্ধতায় বিভোর হয়ে থাকি। জানেন কালকে যখন আপনি ঘুমিয়ে গেলেন আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইলাম মুগ্ধ হয়ে আপনাকে দেখেছি শুধু । এরকম একটা মানুষের এত ভালোবাসা পাওয়ার ও যোগ্যতা কি আমার আছে ! আমার ভাগ্যে এই ভালো মানুষটা কে রেখেছেন আল্লাহ সে জন্যই কি আমার জীবনের শুরু টা খুব কষ্টে কেটেছে ? আল্লাহ পরীক্ষা করেছেন ? রাতভর তাই ভেবেছি।
সেরকম কিছু না হেরা আমি চেষ্টা করি আমার প্রিয়জনদের ভালো রাখতে, ভালোবাসতে। তারপর হাসতে হাসতে বলল, আমি খুব বাধ্যগত, গৃহপালিত স্বামী বউ এর কাছে পরাধীন থাকতেই ভালোবাসি কারণ আমি জানি ঘটনা যাই হোক সরি আমাকেই বলতে হবে মাঝখান থেকে ক্যাজুয়েল্টি বাড়ে সম্পর্কে র ভেতরে।
হেরা হেসে দিল। আমাদের মাঝে সেরকম কিছু নিশ্চয়ই হবে না ।
হবে না হেরা , তুমি তো আমার অবুঝ বালিকা বধূ যে শুধু মুগ্ধতা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। যতদিন মুগ্ধতা থাকবে তুমি আমাকে শাসন করবে না।
তাহলে সারাজীবন শাসন করা হবে না। আপনার প্রতি আমার মুগ্ধতা কমবে না কখনো ।
ওদের কথার মাঝখানে ঝলমলে রোদ দেখা গেল আকাশে।
নওশাদ , হেরা কে নিয়ে নৌকায় উঠার জন্য বের হলো। পুরো দুপুর নৌকায় করে ওরা ভোলাগঞ্জ ঘুরলো।পরিচিত বিজিবির অফিসারের কল্যাণে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ঘুরে এলো। পাহাড় দেখে মুগ্ধ হেরা। পাথরের নদীতে নীল জল দেখে বারবার চাইছিল সে পানিতে পা ভিজাতে । নওশাদ আটকে রাখলো ওকে । তোমার এজমার কথা ভুলে যাচ্ছো হেরা ?
প্লিজ একটু নামি ।
না আমার কথা শুনো। ঠিক আছে পাথরের উপর বসে থাকি কিন্তু পানিতে নামবে না।
কটেজে এসে লাঞ্চ করে দুটো হ্যামক ঝুলানো ছিলো গাছের সঙ্গে দুইটাতে শুয়ে দুজনে দোল খেতে খেতে গল্প করলো হাত ধরাধরি করে।
হেরা একটা কথা বলব ?
আমি শুনছি বলুন ।
থ্যাংকস আমার জীবনে এতো আলো নিয়ে আসার জন্য। এত ছন্দ নিয়ে আসার জন্য। হেরা দশ বছরের একটা ছেলেকে নিয়ে হুট করে এক সন্ধ্যায় একা হয়ে গেলাম। যে মানুষ টার উপর নির্ভর করে ছিলাম পনের বছর বিবাহিত জীবনে তার আগে আরো প্রায় সাত বছর হঠাৎ একদিন সে কোন কথা বার্তা নেই চলে গেল । আমি ব্যাপার টা বুঝে উঠতে ই কয়েক মাস সময় লাগলো। আমি গীতির জন্য যতটা পাগল ও বেঁচে থাকতে ছিলাম তারচেয়েও বেশি পাগল গীতি মারা যাওয়ার পর হয়ে গেলাম। রাতে শোয়ার সময় ভাবতাম গীতি পাশে শুয়ে আছে। কথা বলতাম ওর সঙ্গে। আমি সব সময় গীতিকে আশেপাশে ফীল করতাম কিন্তু বেশ অনেক দিন আমি গীতিকে সেভাবে ফীল করে পাই না। আমি আমার পাশে তোমার অস্তিত্ব টাকে চাওয়া শুরু করলাম। শারীরিক ব্যাপার টা যে ছিল না অস্বীকার করব না তারচেয়ে ও বেশি মানসিক ভাবে আমি তোমার প্রতি অনুভব করা শুরু করলাম। তোমাকে ভালোবাসা শুরু করলাম।
কথা বলতে বলতে ওরা দুজন নিজের ঘরে এসে ঢুকলো।
তোমার কাছে থাকতে , তোমাকে দেখতে তোমার সঙ্গ টা উপভোগ করতে ভালো লাগা শুরু হলো হেরা।
হেরা এই জায়গাটা আমি গীতির জন্য কিনেছিলাম ভেবেছিলাম ওকে দিয়ে চমকে দিব। কিন্তু কিছু করার আগেই গীতি চলে যায়। তোমাকে নিয়ে আমি এখানে আসার প্রধান কারণ এখানে গীতি কখনো আসেনি । আমার আর তোমার কাছাকাছি আসার জন্য এই জায়গাটা সে জন্যই বেছে নিয়েছি। আমি তোমাকে পুরোপুরি পেতে চেয়েছি এমন কোথাও যেখানে আমার আর গীতির কোন সৃত্মি নেই । আমি চাইনি গীতির কিছু আমার সামনে চলে আসুক। হেরা এই প্রোপার্টি টা আমি তোমার নামে যদি করি তুমি কি কষ্ট পাবে ?
আমার নামে করে দিতে হবে কেন ? আপনার নামে থাকলে কি সেটা আমার হবে না ?
আমি চাই তোমার আমার জীবনের বিশেষ এই জায়গাটা তোমাকে উপহার দিতে ।
মুখে বলেছেন এতেই হবে আমি পেলাম উপহার ধন্যবাদ।
কাগজে কলমে হলে সমস্যা কিসের হেরা? আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবেসে উপহার দিতেই পারি !
আমার কাছে উপহারের চেয়ে ভালোবাসা টাই বড় প্রাপ্তি।
উপহার ও ভালোবাসার চিহ্ন বুঝলে ।
হেরা নওশাদের দিকে তাকিয়ে হাসলো শুধু।
ডিনারের পর দুজন কফি নিয়ে কটেজের সামনে এসে বসলো। নওশাদ হেরার কে বলল, তুমি কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা টা করবে। আমি চাই তুমি খুব ভালো ভাবে পড়াশোনা টা শেষ করবে। নিশালের পড়াশোনা শেষ হলে নিশাল আর তুমি আমার বিজনেস সামলাবে আমি রিটায়ার্ড করব ।
কি বলেন এসব আপনি ! আমি আপনার বিজনেস দেখব আমি দশটা মানুষের সামনে গেলেই নার্ভাস হয়ে যাই আমি করব বিজনেস !
তোমাকে আমি সেভাবেই তৈরি করে তুলব !
কিন্তু আমি যে আপনার আর আমার সংসার টা সামলাতে চাই ।
তোমাকে নিশ্চয়ই বাজার করা রান্না করে সংসার সামলাতে হবে না ?বাচ্চাও সামলাতে হচ্ছে না । কথাটা বলেই নওশাদ তাকালো হেরার দিকে । হেরার মুখটা কি একটু গম্ভীর হয়ে গেল কথাটা শুনে। নওশাদ চুপ করে রইলো । তারপর দুই জন বেশ অনেক্ষণ চুপচাপ বসে রইল।
ওরা ঘরে গিয়ে ঢুকতেই নিশালের ফোন এলো !
হ্যালো পাপা ।
নিশাল কি খবর তোমার বাবা পরীক্ষা কেমন হচ্ছে ? হেরা কাছে এসে দাঁড়ালো । নওশাদ ফোনটা স্পিকার মুডে দিল।
আমার খবর ভালো পরীক্ষা ও ভালো হচ্ছে । মামনি কোথায় ?
এই যে আমি, কেমন আছো তুমি ? হেরা বলল।
মামনি কি করো ?
কিছু না তোমার পাপার সঙ্গে গল্প করছি।
নিশাল তোমার মামনির সঙ্গে ছুটি কাটাতে সিলেটে এসেছি ।
গ্রেট পাপা মামনি কে খুব ভালো করে সব ঘুরিয়ে দেখাবে ।
নিশাল তোমার পাপা আমাকে নদীতে নামতে চেয়েছিলাম দেয়নি , তুমি থাকলে ভালো হতো তোমার সঙ্গে পানিতে নামতাম।
পাপা ঠিক কাজ করেছে এসব নদীতে সাপ থাকে মামনি ।
কি ? চিৎকার দিয়ে উঠলো হেরা । তোমার পাপা তো সেই কথা বলেনি । আমি সাপ খুব ভয় পাই।
নিশাল হাসছে । মনে রেখো তুমি মামনি । নওশাদ ছেলের বুদ্ধি দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। হেরা কে এক কথায় শান্ত করে দিলো।
নিশাল পাপার চেয়ে বেশি তার মামনির সঙ্গে কথা বলল।
ফোন রাখার পর নওশাদ বলল, ছেলে তো দেখি আমার চেয়ে বেশি তার মামনির সঙ্গে কথা বলে।
হুম নিশাল আমার ফ্রেন্ড হয়ে গেছে বুঝলেন। হেরা নওশাদের দিকে হেসে বলল।
ভালো।
আমার ছেলেটা কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেছে ! বড় সে মা মারা যাওয়ার পরই হয়ে গিয়েছিল। নিজে হাতে খেতে পারতো না গীতি আর আনারের মা খাইয়ে দিতো । গীতি যাওয়ার পর আনারের মায়ের কাছেও খাবে না একাই খেতো।
বলেছে আনারের মা আমাকে। নিশালকে খুব ভালোবাসে ও ।
হুম ও ই তো বড় করেছে । ওর কাছে রেখে গীতিকে নিয়ে দেশের বাহিরে চলে গেছি । আনারের মায়ের কাছে থাকলে নিশ্চিন্তে থাকতাম আমরা।
হেরা একটা কথা বলব? নওশাদ হেরা কে বুকের কাছে টেনে নিলো।
বুবু যাওয়ার সময় আমাকে কিছু কথা বলেছে তোমাকেও কি কিছু বলেছে ?
কোন ব্যাপারে ?
নওশাদ কিছুক্ষণ চুপচাপ হয়ে রইলো কিভাবে বলবে কথাটা ভেবে পাচ্ছে না।
হেরা বুবু নিশালের আরো ভাই বোন হোক তাই চায় !
হেরা চুপ করে শুনছে ।
তোমাকে কিছু বলেছে , আমার ধারণা তোমাকেও বুবু বলেছে এই কথা ।
হুম।
কি বলেছো তুমি ?
আমি কি বলব ?
তোমার কি ইচ্ছে?
আপনার ইচ্ছে ই আমার ইচ্ছে । আমি বুবুকেও এই কথা বলেছি।
হেরা তোমাকে পড়াশোনা শেষ করতে হবে, বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকো আমি সেটা চাই না।
আমাদের তো অবশ্য একটা ছেলে আছেই এটাই যথেষ্ট । কি বলেন ?
নওশাদ হেরা কে জড়িয়ে ধরলো , ওর মনে হচ্ছে হেরা কি মন খারাপ করলো ওর কথায় । কষ্ট পেলো না তো !
হেরা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে অন্য গল্প শুরু করলো।
ওরা পুরো সাত দিন সিলেটে কাটালো। হেরার স্বপ্নের মতোই কাটলো দিন গুলো। নওশাদ ওকে ভালোবাসা দিয়ে , আদরে ভরিয়ে রাখলো।
মানুষটা যে এত রোমান্টিক সে সিলেট না গেলে জানতেই পারতো না । গিটার বাজিয়ে গান শুনিয়েছে , ওর ছবি এঁকেছে । চা বাগানে দুজন ঘুরে বেড়িয়েছে। বাগানের মালিক নওশাদের বন্ধু ওরা সারাদিন বাগানে ঘুরলো, কিভাবে চা পাতা তৈরি হয় ম্যানেজার তাদের ঘুরে ঘুরে দেখালো । হেরা খুব উৎসাহ নিয়ে দেখলো।
চা বাগানে বেড়ানোর সময় ওর কুষ্টিয়া ইউনিভার্সিটির এক ক্লাসমেটের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মেয়েটা হাজব্যান্ড আর ফ্যামিলি নিয়ে এসেছে। আগের হেরা আর এখনকার হেরা কে দেখে সে চমৎকৃত। প্রথমে চিনতেই পারেনি।
হেরা নওশাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
নওশাদ যখন বাগানের ম্যানেজারের সঙ্গে সামনে এগিয়ে গেল ।হেরা রিমা নামের তার সেই বান্ধবীর সঙ্গে হেঁটে হেঁটে গল্প করছে।
আমি তো ভেবেছিলাম বিয়ে হয়ে গেছে তোমার তাই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছো হেরা ?
বিয়ের পরই পড়াশোনা আবার শুরু করলাম। ঢাকায় ভর্তি হয়েছি প্রাইভেট একটা ভার্সিটিতে।
তুমি কি ঢাকায় থাকো রিমা?
হুম আমার বর একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে অনেক ভালো চাকরি করে । আমি এখন আর ক্লাস করি না সামনে গিয়ে শুধু পরীক্ষা দিয়ে চলে আসব। তোমার বর কি করে হেরা ?
বিজনেস !
কিসের?
আমি জানি না এত কিছু।
কেন জানো না ?
জানার ইচ্ছে হয়নি তাই।
এটা কেমন কথা ! তোমার বর কি করে , কিসের বিজনেস তোমার জানা দরকার না ?
আমি সব কিছু নিয়ে এত উৎসাহি না রিমা !
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রিমা হেরার দিকে। তুমি ভালো আছো তো হেরা ?
খুব ভালো আছি রিমা ! একদিন বাসায় এসো বেড়াতে।
আসব ,বাসা কোথায় তোমার হেরা ? ঢাকায়ই থাকো ?
ঠিকানা টা উনার কাছ থেকে নিয়ে দিতে হবে ।
তুমি জানো না তোমার বাসার ঠিকানা ?
জায়গাটা র নাম জানি শুধু বনানী আর কিছু জানি না।
তুমি সব সময়ই একটু কেমন জানি ছিলে হেরা । এখনও তাই আছো । কিন্তু তোমার সাজ পোশাকের পরিবর্তন দেখে ভালো লাগছে।
হেরা হাসলো রিমার দিকে তাকিয়ে।
আমরা সিলেট শহরে একটা হোটেলে উঠেছি তোমরা কোথায় উঠেছো ? কালকে চলো ঘুরতে যাই এক সঙ্গে ।
জায়গাটা র নাম জানি না কিন্তু এখান থেকে অনেক দূরে উনার একটা রিসোর্ট আছে সেখানেই আছি। আমরা কালকে চলে যাব ঢাকায় ।
তোমার বরের রিসোর্ট ! রিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে হেরার দিকে।
নওশাদ হেরার নাম ধরে ডাক দিতেই হেরা ঐ দিকে তাকালো , তাই দেখতে পেলো না কতটা বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে ওকে দেখছে রিমা!
রিমা তোমার মোবাইল নাম্বার টা দাও ঢাকায় বাসায় এসো কেমন।অনেক বছর পর দেখা হয়ে ভালো লাগছে । ভালো থেকো আমি আসছি।
হেরা নিজের মোবাইল এ রিমার নাম্বার সেইভ করে নিলো । রিমা অবাক হয়ে দেখছে, যে হেরাকে সে আগে একটা মাত্র মলিন বোরখা পড়া দেখতো। অতিসাধারণ মেয়ে হিসেবে খুব একটা পাত্তা দিত না, আজ তার হাতে দামী ফোন, ব্যাগ, গয়না সাজে একদম অন্যরকম এক হেরা ! ওর স্বামী কে দেখেও অবাক হলো কত স্মার্ট, গুড লুকিং ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই দেখতে পেল হেরা আর নওশাদ বিশাল এক গাড়িতে করে ওদের সামনে দিয়ে চলে গেল !
মানুষ আসলে নদীর মত কখনো উত্তাল ঢেউ তরঙ্গ আবার কখনো কচুরিপানা ভরা এক মৃত জলাশয়।
সাত দিনের জায়গায় নয় দিন কাটিয়ে নওশাদ হেরা কে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলো।
বিকালে গলফ খেলতে গিয়ে রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা।
আপনি হানিমুন শেষ করে আসলেন শেষ পর্যন্ত নওশাদ আজমী।
আসলাম। তুই কি ভেবেছিলি ?
ভেবেছিলাম এক মাস অন্তর থাকবি !
শালা তোর মত নাকি আমি ! কাজ কাম নাই আমার ! হাসছে নওশাদ।
আমার মত না তুই তাই বললাম নওশাদ । কেমন ছিল হানিমুন?
যেমন ভাবছিস সেই রকম।
তুই সিলেট গেলি কেন, ওখানে রিসোর্ট তো এখনো অনেক দেরি আছে রেডি হতে?
একমাত্র ওখানেই গীতিকে নিয়ে যাই নি কখনো। আমি গীতির সৃত্মির বাহিরে গিয়ে হেরাকে গ্রহণ করতে চাইছিলাম।
ভালো করেছিস। খুব ভালো লাগছে বন্ধু তুমি শেষ পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পেরেছো । খুব খুশি হয়েছি হেরার প্রাপ্য অধিকার তুই তাকে দিয়েছিস । তোর ভালোবাসার দরকার ওর, তা না হলে কিরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে দেখলি তো।
রেজোয়ান বীথি হেরা কে সহ্য করতে পারছে না । ওর ধারনা আমি ওর জীবনটা নষ্ট করেছি ?
মানে ?
ও নাকি আমার সঙ্গে তুলনা দিতো ফয়সাল কে সেই থেকে তার আর ফয়সালের সংসারের অশান্তি শুরু তারপর তো ডিভোর্স হলো।
তুই শিখিয়ে দিয়েছিলি তোর সঙ্গে তুলনা দিতে ? পাগল নাকি!
সেটাই তো! আমার খুব অশান্তি লাগছে এটা শোনার পর থেকে।আর সবচেয়ে বড় কথা ও হাসিবের সঙ্গেও এরকম করছে !
তোকে বিয়ে করতে চেয়েছিল কিন্তু তুই না করেছিস ও তো নিজেই রাজি হলো হাসিব কে বিয়ে করতে।
সেটাই । ও কেন বুঝতে পারে না আমি আপোস করতে পারতাম ওকে বিয়ে করে কিন্তু গীতির বোনকে কিভাবে স্ত্রী র জায়গা দেই ! যাদের ছোট থেকে দেখে আসছি ছোট বোনের মত !
এত অবুঝ বীথি !
আমার ওকে নিয়ে ভয় হয় হেরার না কোন ক্ষতি করে আবার।
চিন্তা করিস না হেরা অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে, ও ঠিকই সামলে নিবে সব কিছু।
হেরা প্যাচ বোঝে না রে।
এটাই ভালো বয়স তো কম সংসার করতে করতে সব বুঝে যাবে ।
দেখা যাক।
নওশাদ খুব ভরসা পায় না বীথির উপর সব সময় একটা বিষয় কাঁটা হয়ে থাকে ওর। হেরা এতটা সহজ সরল ভালো করে দুটো কথা বললেই ওকে ভুলিয়ে ফেলা যায়।
ইদানিং খুব এক্সাইটেড হয়ে আছে সামনে ওর ক্লাস শুরু হবে। ছেলেদের সঙ্গে পড়তে যাবে সে জন্য আবার খুব নার্ভাস। প্রথম দিন নওশাদ কে সঙ্গে যাওয়ার জন্য আবদার করেছে।
নিশালও আবার ফোনে বারবার বলছে পাপা তুমি মামনি কে দিয়ে আসবে।
নওশাদ হাসতে হাসতে বলেছে, তোমার মামনি প্লেগ্রুপের বেবি বাবা যে হাত ধরে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিয়ে আসতে হবে ?
একথা শুনে হেরা গাল ফুলিয়ে রেখেছে নওশাদের উপর। নওশাদের খুব মজাই লাগছে ওর অভিমান দেখে। কত বছর পর কেউ একজন তার উপর অভিমান করে আছে। এখন কিভাবে এই অভিমান ভাঙ্গাবে তাই ভাবছে সে। কিন্তু খুব উপভোগ করছে বলেই অভিমান টা জিয়ে রাখছে সে।
( চলবে )