এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৪১.

0
205

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪১.

বিভীষিকাময় এক অভিজ্ঞতার পরে সে রাতে নতুন এক জায়গায়, নতুন এক বাড়িতে বাণীর ঘুমটা খুব দেরি করেই এসেছিলো। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি। ঘন্টা দুয়েকের মাথায়ই বাণীর ঘুমটা ভেঙে যায়। প্রহরটা তখন সুবহে সাদিকের। পূর্ব দিগন্তের ক্ষীণ প্রশস্ত আলো ফুটলো কেবল। বাণী কিছুক্ষণ নীরবে বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। বিড়ালের ন্যায় পা ফেলে নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।

সঙ্গে সঙ্গে সে মুখোমুখি হয় লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার। চল্লিশার্ধো বয়সের সুঠাম দেহের পুরুষ তখন কেবল নামাজ পড়ে জগিং এর জন্য তৈরী হয়ে বেড়িয়েছে। বাণীকে দেখতেই উনি দাঁড়িয়ে পড়ে। বাণীও উনাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মাথা নত করে বলে,

“ আ’ম সরি আংকেল। ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। তাই… “

জুলফিকার মুজতবা নিজের স্বভাবসুলভ গম্ভীর স্বরের পরিবর্তে নরম স্বরে বলে,

“ সরি বলতে হবে না মা। আমার রাতে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তাই তোমাদের আর বিরক্ত করি নি। ভেবেছিলাম সকালে উঠে পরিচিত হয়ে নিবো। “

ভদ্রলোকের মুখে মা সম্বোধন শুনে বাণীর মিশ্র অনুভূতি হলো। মুহুর্তেই তার মনে পড়ে গেলো যাওয়ার পূর্বে দূর্জয়ের বলা কিছু কথা,

“ যার অধীনে তোমাকে রেখে যাচ্ছি তিনি আমার কাছে পিতৃ সমতুল্য। মানুষটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আর সম্মানের পরিধি বিশাল। এখানে তোমাদের অযত্ন, অসম্মান কিংবা নিরাপত্তার খামতি কিছুই হবে না। শুধু নিজের সংকোচ, লজ্জা, ভয়টা ভুলে যাও। আমি জানি তুমি মুক্ত নিজের মতো বাঁচতে চাও। কিন্তু কিছুদিন এখানে থাকতে হবে তোমার। একবার নিরাপত্তাটুকু নিশ্চিত করে নেই, তখন তুমি যা চাইবে তাই হবে। “

ভদ্রলোকের কথায় সম্বিত ফিরে পায় বাণী,

“ আমার তো এখন একটু বের হতে হবে। এক ঘণ্টা পরেই ফিরে আসবো যদিও। আবার নিশাও এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে না। তুমি চাইলে আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পারো মা। অথবা সময় পাড় করার জন্য টিভিও দেখতে পারো। “

বাণী মাথা নত রেখেই বলে,

“ আচ্ছা। “

জুলফিকার মুজতবা বেরিয়ে যেতে নেয়। কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে আসে। বাণীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ বহ্নি ঘুমাচ্ছে? “

“ জি। “

“ হাঁটতে বের হবে মা? বাহিরটা সুন্দর। ভোরের তাজা হাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী। “

বাণীকে সামান্য ভাবুক দেখায়। বহ্নি সকাল আটটার আগে ঘুম থেকে উঠবে না। এর মাঝে বাহির থেকে হেঁটে আসলেও সে টের পাবে না। আর তাছাড়া ভদ্রলোকের এই স্নেহপূর্ণ প্রশ্নের জবাবে না বলতেও ইচ্ছে করছে না বাণীর। তাই সে সম্মতি জানায়।

__________

রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া সম্পূর্ণটা সবুজের ভাজে আবৃত যেন। ভোরের শুদ্ধ বাতাস গায়ে লাগতেই বাণী চোখ বুজে নেয়। এই বাতাসে কি ভিন্ন কিছু মিশে আছে? মুক্তির স্বাদ? তা-ই হবে হয়তো। নাহয় এতো প্রশান্তি অনুভব করছে কেন সে?

জুলফিকার মুজতবার পায়ের গতি আজ ধীর। সাধারণত সে এই কিছুক্ষণ সময়ে কয়েক চক্কর দিয়ে ফেলতো সম্পূর্ণ এরিয়ার। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রমের কারণ হলো বাণী। মেয়েটা তার হাঁটার গতির সঙ্গে না-হয় তাল মেলাতে হিমশিম খাবে।

হাঁটতে হাঁটতে জুলফিকার সামনে যখন যেই গাছ পাচ্ছিলেন সেটার নাম সহ সামান্য বিষয় নিয়ে বাণীর সঙ্গে আলোচনা জুড়ে বসেন। মেয়েটাকে সামান্য স্বাভাবিক করার প্রয়াশ তার। বাণী কেবল টুকটাক হ্যাঁ না দিয়ে জবাব দেয়। জুলফিকার এবার প্রসঙ্গ তুলে বলে,

“ বাণী। স্কুল লাইফে তুমি কোনো এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসে যুক্ত ছিলে? “

বাণী আনমনে জবাব দেয়,

“ হ্যাঁ। গান করতাম তো… “

এতদূর বলেই বাণী থেমে যায়। সম্পূর্ণ নীরব বনে যায়। জুলফিকার বলে,

“ বেশ তো। দূর্জয়ও তো স্পোর্টস ক্লাবে ছিলো। তুমি তো নিশ্চয়ই দেখেছো… “

বাকি কথাগুলো আর বাণীর কানে পৌঁছায় না। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে অতীতে করা নিজের পাগলামির দৃশ্যপট। সপ্তাহে তিনদিন হাতে গুনে দূর্জয়ের দেখা মিলতো বাস্কেটবল ফিল্ডে। ক্লাস টাইমে দূর্জয়কে দেখেও যখন মন ভরতো না তখন, টিফিন টাইমের সময় বনে বাদরে ঘুরে বেড়ানো বাণী সেই সময়টুকু কেবল দূর্জয়ের জন্য বরাদ্দ করে। টিফিন পিরিয়ডের ঘন্টা বাজতেই পাখির ন্যায় উড়ে চলে যেতো সে বাস্কেটবল কোর্টে। সঙ্গে থাকতো আরমিন। কাঠের বেঞ্চিতে বসে খেলা দেখার নাম করে দূর্জয়কে দেখা, এবং তাকে দেখেই অস্বস্তিতে দূর্জয়ের মুখ ভার হয়ে আসার দৃশ্য ভেবে বাণী হাসে মৃদু। পাগল ছিলো সে। ইম্যাচিওরিটিতে ভরপুর এক পাগল। তাইতো জীবন তাকে টেনে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে যেখানে রাতারাতি তার সকল ইম্যাচিওরিটিকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে।

__________

আইনের কাছে সবাই সমান। অপরাধী যেই হোক না কেনো বিচারের কাঠগড়ার মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। সে যদি কোনো সেনা সদস্য হয় তবুও তার নিস্তার নেই। তবে একজন সৈন্যের বিচার আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো হয় না। তার বিচার করা হয় স্বয়ং সৈন্যদের আদালতে।

আজও তার ব্যতিক্রম নয়। আদালত প্রস্তুত উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধীকে শাস্তি দিতে। বিচারকের স্থানে বসে আছেন একজন সৈন্য। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অপরাধীর উদ্দেশ্যে তিনি প্রশ্ন ছুড়েন,

“ আপনি কি নিজের পক্ষে কোনো যুক্তিগত সাফাই পেশ করতে চান কর্নেল জুবায়ের শিকদার? “

জুবায়ের শিকদার রক্তিম দৃষ্টি মেলে একবার বিচার কক্ষে উপস্থিত দূর্জয়কে দেখে। অত:পর দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“ আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। দিজ ইজ অল আই হ্যাভ টু সে। “

বিচারক বলে,

“ এটা তো কোনো যুক্তিগত সাফাই নয় কর্নেল। আপনার বিরুদ্ধে সাফ প্রমাণ আমার সামনেই আছে। এই ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আপনি কিভাবে আপনার নাম ফাঁসের ভয়ে সেলে প্রবেশ করে এক আতঙ্কবাদীকে খুন করার চেষ্টা করেছেন। “

“ এইসব মেজর দূর্জয়ের চক্রান্ত। “

“ এটা যদি চক্রান্তই হয় তবে আপনি তা-তে পা দিলেন কেনো? একজন আতঙ্কবাদী মুখ খুলতে রাজি হয়েছে শুনতেই আপনি ভীত হয়ে কেনো সবার অগোচরে তার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন? আর তাছাড়াও সেই আতঙ্কবাদী স্পষ্ট সাক্ষী দিয়ে বলেছে আতঙ্কবাদীদের মূল হোতা শমসের মজুমদার এবং হিরণের সঙ্গে আপনি হাত মিলিয়েছিলেন। “

জুবায়ের শিকদার আর কিছু বলে না। শেয়ানাটা কি কায়দা করেই না তাকে হাতেনাতে ধরলো ভাবতেই তিনি আবার রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দূর্জয়কে দেখে। জুবায়ের শিকদারের সেই দৃষ্টি জুলফিকার মুজতবারও চোখ এড়ায় না। তিনি একবার পাশ ফিরে দূর্জয়কে দেখে যে গম্ভীর মুখ করে বসে আছে।

বিচারক নিজের ফয়সালা শোনায়,

“ আতঙ্কবাদীদের সঙ্গে হাত মেলানো, তাদের পক্ষ হয়ে কাজ করা দেশদ্রোহীতার সমতূল্য। আর তাছাড়াও ইনভেস্টিগেশনে আপনার বিরুদ্ধে অপারেশন চলমান অবস্থায় বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্তের অভিযোগ উঠে এসেছে। সুতরাং সকল সাক্ষী প্রমাণের ভিত্তিতে এই আদালত কর্নেল জুবায়ের শিকদারকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি এবং পদচ্যুত করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। আর সেই সঙ্গে একজন দেশদ্রোহী হিসেবে উনার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আদেশ জারি করছে। “

বিচার কক্ষে উপস্থিত সকলেই যেনো এক প্রকার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

বিচারক আবার বলে উঠে,

“ আর শমসের মজুমদার এবং হিরণকে যতদ্রুত সম্ভব আটকের আদেশ দেওয়া হলো। “

এক এক করে সবাই হাসিমুখে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। কেবল দূর্জয় এবং জুলফিকার মুজতবা টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। জুবায়ের শিকদারকে হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি দূর্জয়ের সামনে এক মুহুর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে। কণ্ঠে একরাশ বিদ্রুপ মিশিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ আগুন নিয়ে খেলছো মেজর দূর্জয়। হিরণ ছেড়ে দিবে ভেবেছো? প্রতিদ্বন্দ্বী কে সেই সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও নেই তোমার। “

বলেই সামান্য হাসে জুবায়ের শিকদার। দূর্জয় কোনো প্রতুত্তর করে না। জুবায়ের শিকদারকে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জুলফিকার মুখ খুলে,

“ বাণীর সঙ্গে কথা বলো। সত্যটা জানাও। ওর নিজের সতর্ক থাকাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “

__________

আধঘন্টা হয়েছে দুপুরের খাবার সেড়ে নিজের রুমে এসে বসেছে নিশা। সঙ্গে নিয়ে এসেছে বহ্নিকে। খাবারের টেবিলেই বসে বাণীর ঘুম ঘুম চোখ জোড়া দেখে সে হেসে বলেছিলো,

“ আপনি লাঞ্চ সেড়ে একটু ঘুমিয়ে নিন আপু। বহ্নি ততক্ষণ নাহয় আমার কাছে থাকলো। আমরা মোটেও আপনাকে বিরক্ত করবো না। “

বাণী প্রথমে আপত্তি জানায়। নিশা মেয়েটার বয়স নিতান্তই কম। তার উপর ওর পায়ে অপারেশনের ব্যাপারটাও সকালে জুলফিকার আংকেলের কাছে শুনেছে সে। যদি বহ্নিকে সামলাতে হিমশিম খায়? কিন্তু নিশা বাণীকে আশ্বস্ত করে ঠেলেঠুলে রুমে পাঠিয়ে দেয়।

বেশ ক্ষানিকটা সময় বহ্নি আর নিশা মিলে ফোনে গেমস খেলে সময় কাটায়। হঠাৎ ফোনের স্ক্রিনে তামজিদ সাইফ নামক আইডি হতে একটা ম্যাসেজ এসে ভীড় জমাতেই নিশা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ফোনটা সেই মুহুর্তে বহ্নির হাতে ছিলো। চ্যাট হ্যাডে পরিচিত মুখটা দেখেই বহ্নি বলে,

“ ষ্টুপিড আংকেল। “

নিশা অবাক হয়ে জানতে চায়,

“ তুমি উনাকে চিনো? “

“ হ্যাঁ আন্টি। এই আংকেল তো অনেক ষ্টুপিড। আমাকে স্পাই ভেবেছিলো। তুমি বলো, ফাইভ ইয়ারসের বেবি কি কখনো স্পাই হয়? “

বহ্নির আদর মাখা স্বরের প্রশ্ন শুনে নিশা সামান্য হাসে। বহ্নি নিজেই আবার প্রশ্ন করে,

“ তুমি এই আংকেলকে কিভাবে চিনো? “

নিশার মনে পড়ে যায় এই মাথা নষ্ট লোকের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতের কথা। সে ফিসফিসিয়ে বহ্নিকে বলে,

“ সেটা সিক্রেট। “

বহ্নি বোকার ন্যায় তাকিয়ে থাকে। বড়দের এতো সিক্রেট কেনো থাকে তা তার জানতে ইচ্ছে হয়।

নিশা ফোনটা নিয়ে ম্যাসেজ চেক করে। একটা ছবি পাঠিয়েছে সাইফ। একটা কাগজের পত্রিকার উপর কাঁচা আমের ভর্তার ছবি। ছবির সঙ্গে ছোট বার্তাও রয়েছে।

“ মামার হাতের আম ভর্তা অমৃত। ট্রাই করে দেখতে পারেন ইয়াসমিন। “

লোকটা এখনো অনলাইনেই আছে। ফ্রি নিশ্চয়ই? নিশা কিছু না ভেবে কল দেয়। কিছু মুহুর্তের মধ্যেই কলটা রিসিভ হয়। ফোনের স্ক্রিনে ইউনিফর্ম পরিহিত মুখটা ভেসে উঠতেই বহ্নি ও নিশা একসঙ্গে বলে উঠে,

“ হাই ষ্টুপিড আংকেল,
হাই ভাইয়া। “

একমুঠ আম ভর্তায় দু মুঠো চিনি ঢেলে দিলে এর স্বাদ যতটা বিদঘুটে হবে, ঠিক ততটাই বিদঘুটে ঠেকে এই ভাইয়া এবং ষ্টুপিড আংকেল ডাকটা সাইফের কাছে। সে মুখ কালো করে বলে,

“ আপনাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব দিচ্ছি ইয়াসমিন। এই ছোট নাগাকে একটু ম্যানারস শিখাবেন প্লিজ। ওর এই ষ্টুপিড আংকেল ডাকটা আই জাস্ট হেইট ইট। “

বহ্নি মুখ লটকে বলে,

“ আই ডোন্ট লাইক ইউ অলসো। “

সাইফ রাগে জিভ বের করে বহ্নিকে ভেঙায়। বহ্নিও সাথে সাথে একই ভঙ্গিতে সাইফকে ভেংচি কাটে। নিশা ওদের কাহিনী দেখে হাসছিলো। হাসতে হাসতেই সে বলে,

“ এই ভর দুপুরে আপনি ভাত ছেড়ে কাঁচা আম খেতে কেনো বের হলেন? “

সাইফ নিশ্চুপ হয়ে যায়। নিশার বান্ধবীর মৃত্যুর খবর তার অজানা নয়। সেই রাতের পর থেকে মেয়েটা আর তাকে নিজে ম্যাসেজ করে নি। এমনকি অনলাইন আসাই বন্ধ করে দিয়েছিলো। এই ক’টা দিনে সাইফ এক নতুন অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। তার নাম হলো অস্থিরতা। এই অস্থিরতাটা গত ক’টা দিনে তাকে বেশ জ্বালাতন করেছে। সাইফ বুঝতে পারে ইয়াসমিন নামক মেয়েটা তার এক বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই মেয়ের সঙ্গে ক্ষনিকের কথাপোকথন যেমন সাইফকে স্বস্তি দেয়, তেমনই মেয়েটার অনুপস্থিতি তাকে পীড়া দেয়। আজ দুপুরে যখন সে একটু কাজে বেরিয়েছিলো তখন আচমকা রাস্তার পাশে একটা লোককে বিভিন্ন মৌসুমে ফলের ভর্তা এবং আচার বিক্রি করতে দেখে সাইফের ইয়াসমিনের কথা মনে পড়ে। সে দ্রুত বিশ টাকার আম ভর্তা কিনে নিয়ে সেটার ছবি তুলে ইয়াসমিনকে পাঠায়। সেই ছুতোয় সঙ্গে জুড়ে দেয় ছোট ম্যাসেজ।

নিশার ডাকে সাইফের ঘোর কাটে। নিশা প্রশ্ন করে,

“ কোথায় হারিয়ে গিয়েছেন ভাইয়া? “

সাইফ ছোট্ট করে জবাব দেয়,

“ হু? আছি৷ “

__________

দুপুর গড়িয়ে নেমে আসা বিকালটা আজ অন্য রকম। আকাশ জুড়ে বিরাজ করছে কমলা রঙা উত্তাপহীন সূর্যের আভা। আর কেবল এক ঘন্টা বাকি। ঠিক এক ঘন্টা পরই বাংলাদেশ থেকে আগত সৈন্যরা নিজ মাতৃভূমির উদ্দেশ্যে রওনা হবে।

শেষবারের মতো নিজের ব্যাগেজ আরেকবার চেক করে নেয় রিদওয়ান। সব আছে। তবুও তার মনে হচ্ছে কিছু একটা ভুলে যাচ্ছে সে। রিদওয়ান বিষন্ন মনে বসে রয়। এরই মধ্যে প্রত্যয় এবং রাফি তার তাবুতে প্রবেশ করে। রিদওয়ানকে এভাবে বসে থাকতে দেখে রাফি মশকরা করে বলে,

“ কি মামা! তোরে এমন বিধবা বিধবা লাগতেসে কেন? “

রিদওয়ান চোখ গরম করে তাকায়। রাফি মুখ টিপে হেসে বলে,

“ সরি ব্রো। আমি তোর পেইন বুঝতেসি। অন্যাকে রেখে আসার সময় আমারও এমন বিধবা বিধবা ফিল হইতেসিলো। তুইও তো এই দেশে নিজের প্রিয়াকে ফেলে রেখে যাবি। কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। “

এই পর্যায়ে প্রত্যয়ও সামান্য হাসে। রিদওয়ান বিরক্ত মাখা গলায় বলে,

“ শালা তোরা জীবনেও ভালো হবি না। “

বলেই রিদওয়ান উঠে দাঁড়ায়। হাঁটু ভেঙে বসে নিজের পায়ের জুতার ফিতা বাধতে থাকে। আচমকা তার কিছু একটা মনে পড়ে। চকিত্যসে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত নিজের ব্যাগ খুলে একটা ভারী জ্যাকেট বের করে নেয়। প্রত্যয় ও রাফি এতক্ষণ নীরবে ওর কার্যকলাপ দেখছিলো। এই পর্যায়ে রাফি প্রশ্ন করে,

“ কি করতেসোস? “

রিদওয়ান জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে একবার নিজের চেহারাটা দেখে নেয়। ইউনিফর্ম পরিহিত তাকে আজ কিছুটা অন্যরকম দেখাচ্ছে। সেই অন্য রকমটা কি তা ঠিক ঠাওর করতে পারে না রিদওয়ান। সে ফোনটা অফ করে পকেটে ভরে নিয়ে সামান্য হেসে বলে,

“ এখুনি চলে আসবো। “

প্রত্যয় বলে উঠে,

“ এই! রওনা হতে হবে আমাদের কিছুক্ষণ পরে। কোথায় যাচ্ছিস? “

রিদওয়ান দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ চিন্তা করিস না। আমাকে ছাড়া দেশে ফিরতে হবে না তোদের। সময়মতো পৌঁছে যাবো। “

প্রত্যয় পিছু ডাকতে নিলেও রিদওয়ান আর কোনো কিছুর তোয়াক্কা করে না। দৌড়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে একজনের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করাটা হুট করেই তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এই শেষ সাক্ষাৎটা না হলে হয়তো তার মনও তৃপ্ত হবে না।

__________

প্রত্যয় ও রাফি তাবু থেকে বের হয়ে দাঁড়ায়। গল্প করতে করতে দু জনে চোখ মেলে দেখতে থাকে চারিপাশটা। মনে মনে এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়া ভূখন্ডের জন্য প্রার্থনাও করে। দেশটা যেনো মুক্তির স্বাদ পায়। এই দেশের মানুষ গুলো যেনো মুক্তির স্বাদ পায়।

আচমকা অদূরে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাফি অবাক সুরে বলে,

“ জারিয়াহ না? “

রাফির কথা শুনে প্রত্যয়ও সেই দিকে তাকায়। শালীন বেশভূষার মেয়েটাকে দেখে সে মুহুর্তেই চিনতে পারে। আর চিনতে পেরে বেশ অবাকই হয়। বিস্ময় নিয়েই দু’জন এগিয়ে যায় সেই পানে। জারিয়াহর সামনে গিয়েই প্রত্যয় প্রশ্ন করে,

“ তুমি এখানে? “

জারিয়াহ সামান্য হাসি হাসি মুখ করে বলে,

“ আপনাদের বিদায় জানাতে এলাম। “

রাফি মশকরা করে বাংলায় বলে,

“ আমাদের বিদায় জানাতে নাকি প্রিয় ভীনদেশীকে বিদায় জানাতে? “

জারিয়াহ বুঝতে না পেরে বোকার ন্যায় তাকিয়ে থাকে। প্রত্যয় রাফির কথায় পাত্তা না দিয়ে হেসে বলে,

“ বিদায় জানাতে আসার জন্য ধন্যবাদ জারিয়াহ। সাহায্যের জন্যও ধন্যবাদ। তোমার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লেগেছে খুব। “

জারিয়াহ মৃদু হাসে কেবল। পর মুহুর্তেই সন্ধানী দৃষ্টি মেলে চারিদিকে তাকায়। কাউকে খুঁজছে যেনো। রাফি ও প্রত্যয় বুঝতে পারে। বুঝতে পেরে রাফি হেসে জানায়,

“ যাকে খুঁজছো সে তোমাকে খুঁজতে বেরিয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। “

জারিয়াহ অবাক হয়ে তাকায়। পর মুহুর্তেই ধরা পড়ে যাওয়ায় লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে। প্রত্যয় বলে,

“ এখানেই অপেক্ষা করো। খুঁজে না পেয়ে এখানেই ফিরে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। তখন… “

কথাটুকু সম্পূর্ণ করার আগেই তীব্র শব্দে তিনজন চমকে উঠলো। চমকে উঠলো আশেপাশের সবাইও। প্রত্যয়ের ভ্রু জোড়া কুচকে এলো। সে চোখ তুলে আকাশ পানে তাকালো। পরিষ্কার আকাশটার কমলা আভা যেন আচমকা ছাই রঙা ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। অদূরে একজন সেনা সদস্য চেঁচিয়ে উঠলো,

“ বোমা ফেলছে বর্বরগুলো। “

প্রত্যয় ও রাফির মুখ মুহুর্তেই পাংষণ্ডে বর্ণ ধারণ করে। বাংলায় বলা কথাটার অর্থ বুঝতে পারে না জারিয়াহ। সে প্রশ্ন করে,

“ কি বললো? “

রাফি কাঁপা গলায় উচ্চারণ করে,

“ গ্যানোসাইড। “

রাফির কথাটুকু শেষ হতে না হতেই তাদের মাথার উপর দিয়ে আগুনের গোলা চোখে পড়লো। মুহুর্তে সেই আগুনের গোলাটা খুব কাছেই কোথাও গিয়ে পড়তেই আরো একবার বিকট শব্দে চারিদিকটা কেঁপে উঠলো। প্রত্যয়ের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক মুহুর্তেই সজাগ হয়ে উঠলো। পরিস্থিতি আঁচ করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না তার। বাকি সৈন্য সদস্যরা চেঁচিয়ে তাদের ডাকছে,

“ লেফটেন্যান্ট চলুন। নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। “

প্রত্যয় ও রাফির কানে সেই কথা এসে পৌঁছালেও তাদের মন বন্ধুর দিকে টানছে। ভাইকে ছাড়া নিজেরা নিরাপদ স্থানে ঠাই খোঁজার মতো স্বার্থপর তারা নয়। তারা কিছু বলার পূর্বেই জারিয়াহ নিজের বোনের নাম নিয়ে চেঁচিয়ে উঠে। অত:পর ছুট লাগায় নিজের বাড়ি যাওয়ার পথ ধরে। প্রত্যয় এবং রাফিও তার পিছু পিছু ছুটে যায়। হয়তো! হয়তো রিদওয়ানকে জারিয়াহর বাসার আশেপাশেই খুঁজে পাবে তারা।

একের পর এক আগুনের গোলা উড়ে এসে পড়ছে শহরটার বুকে। মানুষ জন এলোমেলো ভাবে ছোটাছুটি করছে। নিজের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই জারিয়াহ বোনকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও খুঁজে না পেয়ে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। ছোটাছুটি করা মানুষদের মধ্যে একজনের হাত চেপে ধরে নিজ ভাষায় প্রশ্ন করে,

“ আপা! জুবেদা কোথায়? আমার বোনকে দেখেছেন? “

মাঝ বয়সী নারী অস্থির গলায় বলে উঠে,

“ তুমি বের হওয়ার পরই তো ও তোমার পিছু পিছু যাওয়ার জন্য দৌড়ে বের হয়। কিন্তু রাস্তায় পড়ে হাত ছিলে ফেলে। একজন সৈন্য তখন তোমার খোঁজে এসেছিলো। তোমার বোনকে এই অবস্থায় দেখে দ্রুত কাছের হসপিটালে নিয়ে গিয়েছে। “

জারিয়াহ আরো কিছু প্রশ্ন করতো। কিন্তু তার পূর্বেই সেই নারীর স্বামী এসে তাকে টেনে দ্রুত নিয়ে যায়। প্রত্যয় এবং রাফিও বন্ধুর খোঁজে এসেছিলো। কিন্তু বন্ধুকে এখানে না পেয়ে তারা আশেপাশে সবাইকে ইংরেজিতেই বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলো। কিন্তু কেউই সেদিকে তোয়াক্কা করে না। সবাই ছুটছে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। জারিয়াহ প্রত্যয়ের সামনে এসে জানায় রিদওয়ান আর তার বোন হসপিটালে আছে।

এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে তারা তিনজন ছুটে হসপিটালের দিকে। এই এলাকায় কেবল একটিই বিশাল সরকারি হসপিটাল আছে। যার দূরত্ব জারিয়াহর বাসা থেকে কেবল আট মিনিটের মতো। হসপিটালের মুখ্য দরজার সামনে আসতেই জারিয়াহর পা জোড়া থেমে যায়। সে থমকে দূরে হসপিটাল বিল্ডিংয়ের প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।

জংলী ছাপের ইউনিফর্ম পরিহিত রিদওয়ানও দূর হতে জারিয়াহকে দেখে থমকে যায়। একবার জারিয়াহকে দেখে ফের তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ভাইকেও দেখে। তাদের দেখে রিদওয়ানের মুখে সামান্য হাসি ফুটে উঠে। মনে মনে আওড়ায়,

“ শালা তোরা জীবনেও ভালো হবি না। “

রিদওয়ানের কোলে থাকা আট বছরের মেয়েটা দূর হতে বোনকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠে। তার গায়ে রিদওয়ানের জ্যাকেটটা জড়ানো। জুবেদা এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে কোল থেকে নেমে বোনের দিকে ছুটে যায়। বিশাল মাঠের ন্যায় জায়গাটুকু পেরিয়ে বোনের বুকে গিয়ে হামলে পড়ে। বোনকে সহি সালামতে পেতেই জারিয়াহ মনে মনে রবের নিকট শুকরিয়া আদায় করে। অত:পর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি মেলে সামনে তাকায়। রিদওয়ান তখনো তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। চোখে চোখ পড়তেই জারিয়াহ মৃদু হাসে। রিদওয়ান এগিয়ে আসার জন্য পা বাড়াবে ঠিক সেই মুহুর্তে একটা আগুনের গোলা ছুটে এলো। একটা বিধ্বংসী শব্দ তুলে কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই চোখের পলকে চারিদিকটা ঝাপসা হয়ে উঠে।

ঠিক কতক্ষণ পর জারিয়াহ নিজের সম্বিত ফিরে পেয়েছে তা তার জানা নেই। কিন্তু মস্তিষ্ক সচল হতেই সে দেখতে পায় ধোঁয়ার কারণে চারিদিকটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অদ্ভুৎ বারুদের গন্ধ। চারিদিকে শোনা যাচ্ছে মানুষের আহাজারি। জারিয়াহ জোরে জোরে শ্বাস টেনে দাঁড়িয়ে পড়ে। অত:পর সবকিছু ভুলে সামনের দিকে ছুটে। সে যত সামনে এগুচ্ছে ততই দৃশ্যটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

নেই। হসপিটালটা নেই সামনে। ওই মানুষটাও নেই। যা আছে তা হলো কেবল ধ্বংস স্তুপ। এই দৃশ্যটুকু স্পষ্ট হতেই জারিয়াহ আর এক পা-ও সামনে বাড়াতে পারে না। সেখানেই থমকে যায়। পরপর মাঠে বসে পড়ে।

জারিয়াহ নিশ্চুপ বনে গেলেও প্রত্যয় ও রাফি চুপ থাকে না। তারা দৌড়ে এগিয়ে যায়। চিৎকার চেঁচামেচি করে বাতাসটা ভারী করে তুলে। খালি হাতে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ধ্বংস স্তুপ সরানোর চেষ্টায় মত্ত হয়। আশেপাশের আরো মানুষ এগিয়ে আসে। স্বজন হারার শোকে সবাই পাগলামি শুরু করে।

কেবল জারিয়াহই পারে না কিছু করতে। ওই মানুষটা তার স্বজন ছিলো না। খুব কাছের কেউও ছিলো না। না ছিলো জারিয়াহর স্বদেশী মানুষ। তবুও জারিয়াহ তার জন্য এক বিন্দু অশ্রু বিসর্জন করলো। কেন করলো জানা নেই। কিসের ভিত্তিতে করলো তা-ও জানা নেই। লোকটাকে নিয়ে তার অনুভূতিও তার জানা নেই। জুবেদা এতক্ষণ দূর হতে বোনের এই রূপটা দেখে। অত:পর এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,

“ লোকটা কে ছিলো আপা? “

জারিয়াহ অস্ফুটে মাথা নেড়ে বলে,

“ জানি না। “

দুটো শব্দ উচ্চারণ করেই জারিয়াহ ফুঁপিয়ে উঠে। অন্যায় হলো। ঘোর অন্যায়। ওই লোকটার তো আজ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো। লোকটা ফিরতে পারলো না কেন? কিসের দায়ে লোকটা ছুটে এসেছিলো? জারিয়াহর জন্য নাকি লোকটার মৃত্যুই তাকে টেনে এখানে নিয়ে এসেছে?

রিদওয়ান দেখতে পেলো না। সমুদ্র নীল চোখের মেয়েটার চোখের এক বিন্দু অশ্রু তার জন্য বিসর্জন করা হয়েছে তা দেখার বিন্দুমাত্র অপেক্ষাও করলো না। কেবল হারিয়ে গেলো। এক ধ্বংস স্তুপের ভীড়ে। এক ভিনদেশের মাটিতে। এক রমণীর নয়নে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here