এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫১.
মতিউর আরাফাতের তদারকিতে হসপিটালের প্রাইভেট একটা কেবিনে তার ছেলের ঠাই হলো। সম্পূর্ণ কেবিনটা বিভিন্ন মেডিসিনের গন্ধে ভরপুর হয়ে আছে। বিছানায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুয়ে থাকা যুবকটার জ্ঞান ফিরতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। ঝাঁঝালো মেডিসিনের গন্ধ তার নাকে এসে ঠেকে।
রুমে তখন কেবল একজন ভদ্রমহিলা উপস্থিত ছিলেন। ভদ্রমহিলাটি আর কেউ নয় বরং প্রত্যয়ের মা। যিনি ফুপিয়ে কান্নাকাটি করতে ব্যস্ত। ছেলের জ্ঞান ফিরতে দেখেই তিনি উঠে আসেন। ছেলের শিয়রে দাঁড়িয়ে বলে,
“ বাবা, এখন কেমন লাগছে? “
প্রত্যয় মায়ের ক্রন্দনরত মুখটা দেখে গলায় সামান্য জোর নিয়ে বলে,
“ কান্নাকাটি থামাও। “
ফিজা বেগম সঙ্গে সঙ্গে নিজের চোখ মুছে ফেলেন। কেবিন থেকে হাসি হাসি মুখে বেরিয়ে যান অপেক্ষারত সবাইকে ছেলের জ্ঞান ফেরার খবরটুকু জানাতে। ডক্টরের অনুমতি নিয়ে এক সঙ্গে সকল সৈন্য হুড়মুড়িয়ে কেবিনে প্রবেশ করে। সাইফ এসেই প্রথমে বলে উঠে,
“ শালা! ভালো ভয় দেখাইসোস। “
প্রত্যয় নাকমুখ কুচকে বলে,
“ শালা ডাকবি না আমাকে। আমার কোনো বোন নেই যাকে তোর কাছে তুলে দিবো আমি। “
সাইফ নাক উঁচু করে বলে,
“ গুড ফর ইউ। এম্নেও আমি এখন কারো বইনের প্রতি ইন্টারেস্টেড না। দুনিয়ার সকল নারী এখন আমার বইনের জাত। “
সাইফের মুখে এমন একটা কথা শুনে সবাই হা করে রয়। রাফি নাক টেনে বলে,
“ লাগতা হে ডাল মে কুছ কালা হে। “
ফারদিন সুর টেনে বলে,
“ ইয়া ফির পুরা ডাল হি কালা হে! “
প্রত্যয় নিজের পায়ের দিকে একবার তাকায়। এখন পায়ে কিছুটা ব্যথা অনুভব করলেও মনে মনে সে এক প্রকার শান্তি পাচ্ছে। বিস্ফোরণের পর ধোঁয়ার কারণে যখন কিছু দেখা যাচ্ছিলো না আর প্রত্যয় নিজের পায়েও কিছু অনুভব করতে পারছিলো না তখন সে ভীত হয়ে পড়েছিলো। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো তার পা’টা আছে তো?
কারণ এসব মিশনে এরকম ঘটনা বহু সৈন্যের সঙ্গে ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবে। কেউ হয়তো নিজের পা হারিয়েছে কিংবা কেউ নিজের হাত। আবার অনেকে নিজের শ্রবণ শক্তিও হারিয়েছে। আর তারপর? তারপর পুরোটা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। সেই জীবনটা মোটেও সুখকর নয়। সেই অসহায়ত্বে মোড়ানো জীবন কোনো সৈন্যেরই কাম্য নয়। এর থেকে শহীদ হওয়া শ্রেয়।
সবাই যখন খুনসুটিতে প্রত্যয়কে মাতিয়ে রাখতে মশগুল ঠিক সেই মুহুর্তে কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে আলাউদ্দিন সাহেব। উনার পিছু পিছু বিড়ালের মতো প্রবেশ করে ধূসর রঙের টপস আর জিন্স পরিহিত এক রমণী। গলায় তার এক কমলা রঙের স্কার্ফ ঝুলছে। গুটিসুটি পায়ে কেবিনে প্রবেশ করে সে এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়। সৈন্যরা আলাউদ্দিন সাহেবকে দেখতেই সালাম দিয়ে সড়ে দাঁড়ায়।
আলাউদ্দিন সাহেব এসে প্রত্যয়ের হালচাল জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়। প্রত্যয় অসুস্থ অবস্থায়ই ভদ্রতার সুরে বলে,
“ আপনি কষ্ট করে কেনো আসতে গেলেন আংকেল! “
অত:পর আলাউদ্দিন সাহেবকে পাশের চেয়ারটায় বসার জন্য অফার করে। আলাউদ্দিন সাহেব আর বসেন না। ছেলেটাকে জীবিত দেখে এবং এই অবস্থায়ও নম্র ভদ্র ব্যবহার দেখে উনার মন ভরে যায়। তিনি প্রত্যয়কে রেস্ট নেওয়ার সুযোগ করে দিতে বিদায় নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। উনার সঙ্গে আসা বিড়াল ছানাটা পিছু পিছু কেবিনে প্রবেশ করলেও একই ভঙ্গিতে আর পিছু পিছু প্রস্থান করে না। ঠায় দাঁড়িয়ে রয়।
সাইফরা একবার আড়চোখে জেসিকে দেখে আরেকবার প্রত্যয়কে। দু’জনকে দেখে ভাবে এদের কিছুক্ষণের জন্য একা ছেড়ে দেওয়া শ্রেয়। সবাই নীরবে রুম থেকে প্রস্থান করে। সাইফ বেরিয়ে যাওয়ার আগে জেসির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিচুস্বরে বলে,
“ হ্যালো ঝগড়াঝাটি ভাবী। আপনার যদি উদ্দেশ্য গালিগালাজ করে আমার আধমরা ভাইকে ফুল মরা বানিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে কষ্ট করে এখানে থাকবেন না আপনি। আর যদি আপনার উদ্দেশ্য আমার আধমরা ভাইকে সেবা টেবা করে সুস্থ করা হয়ে থাকে, তাহলে থাকুন সমস্যা নেই। ইউর লাভলি দেবর উইল মেক শিওর কেউ যেনো আপনাদের বিরক্ত না করে। “
কথাটুকু বলেই সাইফ চোখ টিপে হাসে। জেসি গরম চোখে তাকায়। বিড়বিড়িয়ে বলে,
“ ম্যানারলেস ছেলে। “
সাইফ সে-সব কথা গায়ে মাখে না। সে মাঞ্জা মেরে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়৷ প্রত্যয় এতক্ষণ নীরবে চোখ মুখ কুচকে দূর হতে জেসিকে দেখছিলো। জেসিও তার পানে তাকায়। মুমূর্ষু লোকটার মুখে বিরক্তির ছাপ বড্ড বেমানান। এই লোকটার উচিত ছিলো এখন আদুরে মুখ করে পড়ে থাকা। কিন্তু তা না করে কুচকানো সুতির কাপড়ের মতো মুখটা করে রেখেছে।
জেসি সূক্ষ্ণ চোখে একবার প্রত্যয়কে মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্ক্যান করে। পরপর বিড়াল রূপী রমণী রিনরিনে ভঙ্গিতে এসে বেডের পাশের চেয়ারে বসে শুধায়,
“ আমার সামনে আসতে মানা করেছিলাম। তুমি তো মিয়া দুনিয়া থেকেই বিদায় নিতে যাচ্ছিলে। “
প্রত্যয় মুখ কুচকে বলে,
“ তুমি এখানে মজা লুটতে এসেছো? “
জেসি হাই তুলতে তুলতে বলে,
“ মোটেও না। সুপাত্রী হতে এসেছি। “
প্রত্যয় অবাক সুরে জানতে চায়,
“ মানে? “
জেসি প্রত্যয়ের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“ এদিকে আশেপাশে শপিং করার জন্য উপযুক্ত জায়গা কোনটা জানো? “
“ কি কারণে? “
“ তাড়াহুড়ায় আসার সময় ভালো করে প্যাকিং করতে পারি নি। আর আমার কাছে হসপিটাল টাইপ দুঃখী দুঃখী জামাও নেই খুব একটা। তাই কিনতে হবে। “
জেসির অদ্ভুৎ সব কথা শুনে প্রত্যয় বিরক্ত হয়ে জানতে চায়,
“ সেগুলো দিয়ে তোমার কি কাজ? আর তাছাড়া দুঃখী দুঃখী জামা কি জিনিস? “
“ দুঃখী দুঃখী জামা মানে শাবানা টাইপ জামা। তোমাকে নাকি আর ক’টা দিন শুনলাম হসপিটালেই রাখবে। এই কয়দিন রেগুলার হসপিটালে আসা যাওয়া করতে হবে আমার। তাই হসপিটাল টাইপ জামা কাপড় কিনতে হবে। “
প্রত্যয় এবার রেগে যায়। মৃদু চেচিয়ে উঠে,
“ এই মেয়ে, এসেছো, দেখেছো, এখন চুপচাপ ফিরে যাও। তোমার নাটক আমার মোটেও সহ্য হচ্ছে না। এসব নাটক করবে না একদম। “
জেসি তার রাগকে থোড়াই কেয়ার করে বলে,
“ আমার সামান্য নাটক সহ্য করতে পারছো না, আমাকে কিভাবে সহ্য করবে তুমি? “
__________
হসপিটালের ক্যানটিনে এক চতুর্ভুজ আকৃতির টেবিলে এসে ভীড় জমিয়েছে পাঁচজন। রাফি ফোনে অন্যার সঙ্গে ফোনালাপে ব্যস্ত। ফারদিন আর জুনায়েদ টেবিলে মাথা এলিয়ে দিয়ে ক্ষনিকের জন্য বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত। সাইফও ফোনের কিবোর্ডে যুদ্ধ চালাচ্ছে। আর সাদাত নীরবে দূর পানে তাকিয়ে আছে।
অর্ডারকৃত গরম গরম ধোঁয়া উঠা পাঁচ কাপ কফি নিয়ে হাজির হয় ওয়েটার। ওয়ান টাইম কাপ গুলো টেবিলে রেখে যায় তিনি। কফির সুঘ্রাণ পেয়ে দ্রুত মাথা তুলতে নিলেই জুনায়েদের হাতের সঙ্গে লেগে একটা কাপ সাদাতের গায়ে পড়ে যায়। গরম তরলের সংস্পর্শে আসতেই সাদাত লাফিয়ে উঠে। জুনায়েদও অপ্রস্তুত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে,
“ শিট! জামা খুল। “
সাদাত আঁতকে উঠে,
“ না। “
সাইফ ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি তুলে সন্দিহান ভঙ্গিতে সাদাতের পানে তাকায়। বাকিরাও একই কাজ করে। ফারদিন তো বলেই ফেলে,
“ এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? ও তো স্লিপ অফ টাঙে বলে ফেলেছে। তোকে দেখে মনে হচ্ছে তোর ইজ্জত ধরে টান মেরেছে। “
সাদাত মাথা নেড়ে বলে,
“ ওইরকম কিছু না। আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি। “
বলেই সাদাত চোরের মতো পালিয়ে যায়। সাইফ বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ পোলাডা অদ্ভুৎ আচরণ করতেসে না? “
রাফি আর ফারদিন বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আর জুনায়েদ বোকার ন্যায় তাকিয়ে থাকে। সাদাত এতো ভয় পেলো কেনো? সে তো কেবল ইউনিফর্মের চিন্তা করে মুখ ফসকে জামা খুলতে বলেছিলো।
সিংকের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে পানি নিয়ে ইউনিফর্ম যথাসাধ্য পরিষ্কার করতে ব্যস্ত সাদাত। হঠাৎ আয়নার দিকে চোখ পড়তেই সাদাত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মনে পড়ে যায় চার মাস আগের ঘটনা।
জঙ্গলে আঁধারে তলানো সেই রাতে সাদাতের সাহায্যের পূর্ব শর্ত হিসেবে ইন্টিলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের এজেন্ট দৃশান নামরা তাকে সত্যটা জানিয়েছিলো। কার পিছু করছে সে এবং কেনো করছে সেই সত্যটুকু বলেছিলো।
সবটা শুনে সাদাত নীরব রয়। মনে মনে ঠিক করছিলো এই নারীকে সাহায্য করা উচিত হবে কি না! দৃশান হয়তো তার সেই সংশয় আন্দাজ করতে পেরেছিলো। তাই আশ্বস্ত করতে সে বলে,
“ আই হ্যাভ ভ্যালিড প্রুফ। আই ক্যান শো ইউ। জাস্ট কিপ ইট এ সিক্রেট এন্ড হেল্প মি। “
সাদাত শান্ত স্বরে বলে,
“ প্রুফ দেখে তারপর ডিসাইড করবো আমি। “
কথাটুকু বলে সাদাত দৃশানের দিকে তাকাতেই দেখে দৃশান সরু চোখে তার পানে তাকিয়ে আছে। সাদাত কোনো এক গাছে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। দৃশানের অদ্ভুৎ দৃষ্টি দেখতেই সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করে,
“ আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? “
দৃশান স্পষ্ট গলায় বলে,
“ টেক অফ ইউর ক্লথ। “
সাদাত বিস্মিত হয়েছিলো। পরমুহূর্তে দৃশান নামরার দ্বিধাহীন দৃষ্টি দেখে আঁতকে উঠে। তার মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে,
“ ছিহ। “
দৃশান তাড়া দিয়ে বলে,
“ দ্রুত খুলো। “
সাদাত এক প্রকার দূরে ছিটকে গিয়ে বলে,
“ বিহেভ ইউরসেল্ফ। “
দৃশান ভ্রু কুচকে সাদাতের দিকে তাকিয়ে রয়। পরমুহূর্তেই সে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে,
“ আল্লাহ! তোমার ফিগার দেখতে চাইছি না ডাফার। আই হেভ নো ইন্টারেস্ট ইন ইউ। একটা জোক তোমার ঘাড় বেয়ে শরীরে নেমে গিয়েছে। তাই বলছিলাম। “
অতীত থেকে ফিরে আসে সাদাত। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। এই সেকেন্ড হ্যান্ড এম্বারাসমেন্টের ঘটনাটা কি কোনোভাবে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা সম্ভব না?
__________
পাথরের মূর্তির ন্যায় পরিচিত লিভিং রুমের সোফাটায় বসে আছে বাণী। তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে ছোট্ট দেহটা। ঘুমোচ্ছে না। দু চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। দূর্জয় রান্নাঘরে আছে। বাসায় বাজার ছিলো না। তাই আসার পথে নেমে একটা রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খাবার প্যাক করে নিয়েছিলো। সঙ্গে সুপারশপ থেকে কিনে নিয়েছে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস।
একটা খাবারের প্লেটে সুন্দর করে বিরিয়ানি সেই সঙ্গে সালাদ সাজিয়ে সে খাবার টেবিলে এনে তা রাখে। কাচের গ্লাসটায় পানি ঢেলে রাখতেও ভুলে না। প্রতিটা কাজে মার্জিতের ছাপ। সে লিভিং রুমে এসে বাণীর পানে তাকায়। পুরোটা রাস্তা এরকম পাথরের মতোই চুপচাপ বসেছিলো। একটাও কথা বলে নি।
দূর্জয় এগিয়ে এসে বলে,
“ বহ্নি আমার সঙ্গে থাকুক। তুমি খেয়ে নাও। “
বাণী ফ্যাকাশে চোখ তুলে তাকায় দূর্জয়ের পানে। দূর্জয় কিছু বলে না। এগিয়ে এসে বহ্নিকে নিজের কোলে নিয়ে বলে,
“ ডোন্ট ওয়ারি। আই ক্যান হ্যান্ডেল হার। “
বাণী আর কিছু বলে না। নীরবে উঠে খাবার টেবিলের দিকে যায়। তার বুকে বয়ে যাওয়া কষ্টটাও যেমন সত্য একইভাবে তার পেটের ক্ষিধেটাও সত্য। সেই শেষ সকাল এগারোটার দিকে খেয়েছিলো সে। তারপর আর খাওয়া হয় নি। বহ্নি… বাচ্চাটাও সারাদিন অভুক্ত। কিছু খাবে কি-না কে জানে!
বাণী ধীমি গলায় বলে,
“ বহ্নিকে খাইয়ে নেই আগে। “
দূর্জয় বলে,
“ ওর কথা আমি ভুলে যাই নি। ওকে নিয়ে চিন্তা করো না। তুমি খেতে বসো। “
বাণী আর কথা বাড়ায় না। দূর্জয়ের কথার বিপরীতে সে কখনো কিছু বলতে পারে না। কেনো পারে না জানে না।
বাণী খেতে বসতেই দূর্জয় এগিয়ে এসে বলে,
“ তুমি খাও। আমরা ভিতরেই আছি। “
বাণী ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি মেলে দেখে দূর্জয় তার মেয়েকে নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত রুমে প্রবেশ করছে। সেই রুমটা! যেই রুমটা নিয়ে দূর্জয়ের এতো গোপনীয়তা! বাণী দৃষ্টি ফিরিয়ে খাওয়ার দিকে মনযোগ দেয়। খিদায় তার পেট ও বুক দুটোই ব্যথা করছে।
আচমকা বাণীর মনে পড়ে যায় ছয় বছর পূর্বের অতীত। যখন বহ্নি তার পেটে ছিলো। সারাটা দিন বাণী না খেয়ে থাকতো। যত ধরনের অবহেলা আছে সব করতো নিজের প্রতি, পেটের বাচ্চাটার প্রতি। কিন্তু শেষ রাতে খিদের যন্ত্রণাটা আর সহ্য করতে পারতো না। বুক ব্যথাটা যখন অসহ্যকর ঠেকতো তখন বাধ্য হয়ে জেদের সঙ্গে সন্ধি বিচ্ছেদ করতো। সবার আড়ালে লুকিয়ে রান্নাঘরে ঢু মারতো। ফ্রিজ থেকে বের করে ঠান্ডা সাদা ভাত খেতো। সেই ভাত মুখে দিয়ে চোখের পানি ফেলতো।
তার প্রেগন্যান্সির জার্নিটা আর দশটা স্বাভাবিক প্রেগন্যান্সির মতো না হলেও সেই সময়কার ক্রেভিংস গুলো সন্তান সম্ভাবা দশটা নারীর মতোই ছিলো। মনের সুপ্ত কোণে বিভিন্ন কিছু খাওয়ার ইচ্ছে জাগলেও তা কখনো প্রকাশ করতো না সে। সেটাও একপ্রকার অবহেলা ছিলো তার। নীরব অবহেলা।
পুরনো সেই বিভৎসকর দিন গুলোর কথা মনে পড়তেই বাণীর চোখ ভিজে উঠে। সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে বর্তমানে ফিরে আসে৷ তখনই তার কানে ভেসে আসে টুংটাং কোনো এক যন্ত্রপাতির শব্দ। বাণী অবাক দৃষ্টি মেলে তাকায় দূর্জয়ের ব্যক্তিগত রুমের দিকে। সেখান থেকেই শব্দটা ভেসে আসছে।
বাণী খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে যায় সেই রহস্যময় রুমটার দিকে। যত কাছে এগোচ্ছে ততই পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে সবটা। দরজার কিঞ্চিৎ অংশ ফাঁকা ছিলো। সেই ফাঁক গলে ভেতরে তাকাতেই বাণী দেখে রুমের সঙ্গে লাগোয়া অন্ধকার বারান্দাটায় দুটো ছায়া অবয়ব দেখা যাচ্ছে। ছোট বাচ্চাটা একটা মোড়া জাতীয় কিছুতে বসে আছে। তার সামনে মেঝেতে পা ভাজ করে বসে আছে সুঠাম দেহী পুরুষটা। কোলে তার একটা বাদ্যযন্ত্র। বাণী দূর হতে গঠন দেখেই বুঝতে পারে ওটা একটা গিটার।
ইউনিফর্ম পরিহিত পুরুষটা সুকৌশলে গিটারে নিজের আঙুলের সাহায্যে সুর তুলছে। সেই সুরকে পরিপূর্ণ করতে মেলাচ্ছে নিজের পুরুষালী স্বর,
“ এক দিন আপ ইউ
হামকো মিল জায়েঙ্গে
ফুল হি ফুল রাহো মে
খিল জায়েঙ্গে
মে নে সোচা না থা।
এক দিন জিন্দেগী
ইতনি হোগি হাসিন
ঝুমেগা আসমান
গায়েগি ইয়ে জামিন
মে নে সোচা না থা। “
বাণী অদ্ভুৎ দৃষ্টি মেলে দেখে সেই ছায়া মানবকে। বিস্মিত হয়ে শুনে সেই সুর। বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। শাহরিয়ার দূর্জয় গাইছে? গান গাইতে জানে এই ছেলে? বাণী মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রয়। পরমুহূর্তেই অন্ধকারাচ্ছন্ন বারান্দা হতে শুনতে পায় কারো খিলখিল হাসির শব্দ।
বাণী ফের তাকায় সামনে। বাচ্চা মেয়ের অবয়বটা এবার মোড়া ছেড়ে মেঝেতে গিয়ে সেই পুরুষের কোলে জায়গাটুকু দখল করে বসে আছে। দু’জন ফিসফিস করে কি যেনো বলছে। পরমুহূর্তেই বাচ্চাটা স্নেহপূর্ণ খিলখিল হাসিতে মাতিয়ে তুলে চারিপাশটা। খুব সন্তর্পণে বাণীর বুক থেকে একটা বিশাল পাথর সড়ে যায়। সে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। দরজার পাশের দেয়ালটায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। দু চোখের পল্লব বন্ধ করে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা স্বাভাবিক স্বর শুনে চোখ মেলে তাকায়। দরজার সামনে এসে দাঁড়ানো দূর্জয় একপলক বাণীকে দেখে নিয়ে বলে,
“ ভয় কেটে গিয়েছে। আপত্তি না থাকলে ও আমার সঙ্গে আমার রুমে ডিনার করুক? “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]