#রোদরঞ্জন
#পর্ব_১০
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
শ্রাবণের মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। ঝংকার তুলে ভূপৃষ্ঠে নিপতিত হচ্ছে বারিধারা। লোকালয় থেকে দূরে নির্জন জঙ্গলের মাঝে মাথা উঁচু করে থাকা অট্টালিকার দোতলার কোণার রুমটায় মৃদু আলোকছটা।
জেহফিলের কথা শুনতে শুনতে ইনান ঘুমিয়ে গিয়েছে। ইনানের মাথাটা সাবধানে নিজের বুকে রেখে দিলো সে। মোমবাতি নিভিয়ে দিলো। এখন সম্পূর্ণ রুম অন্ধকার। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎয়ের ঝলকানিতে মিনি সেকেন্ডের জন্য রুম আলোকিত হয়, তারপর আবার তিমিরে তলিয়ে যায়। গায়ে চাদর টেনে দিলো জেহফিল। ইনানের নরম শরীরের উষ্ণতা জেহফিলকে মাতাল করে দিচ্ছে ক্রমশ। মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছে সে। চোখে ঘোর লাগা চাহনি। গভীর শ্বাস টেনে ইনানের চুলে মুখ গুঁজল। অবাধ্য হাত চলে গেল ইনানের ধনুকের মতো বাঁকানো চিকন কোমরে। মসৃণ পেটে হাত দিতেই জেহফিল যেন আরো মাতোয়ারা হয়ে গেল। শীতল আবহাওয়াতে প্রিয় মানুষকে এত কাছে রেখেও কীভাবে দূরে থাকা যায়? জেহফিল এলোমেলো হয়ে গেল। তার ভারী নিঃশ্বাসের সাথে ইনানের মৃদু গতির নিঃশ্বাস একত্রে মিলিয়ে গেল।
ইনানকে বেডে শুইয়ে জেহফিল তার অর্ধেক ভার ইনানের উপর আলতো করে ছেড়ে দিলো। নেশা ধরানো চোখে ইনানের দিকে চেয়ে থেকে গালে গলায় চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগল…অসংখ্য চুমু। শেষে এমন হলো যে জেহফিলের চুমুর তোড়ে ইনানের গাল গলা ভিজে গেল। তাও থামলো না সে।
গায়ে ভারী পাথরের মতো ওজন এবং গলায় ভেজা অনুভূত হতেই ইনান ঘুমের মধ্যেই এপাশ ওপাশ নড়ল। ইনানকে নড়াচড়া করতে দেখে জেহফিল থমকে গেল। এখন যদি ইনানের ঘুম ভেঙে যায় আর তাকে এই অবস্থায় দেখে তাহলে খুব সীন ক্রিয়েট করবে সে, ভুল বুঝবে তাকে।
জেহফিল ইনানের উপর থেকে সরে গিয়ে ইনানের মাথায় হাত বুলাতে লাগল যাতে ঘুমিয়ে পড়ে। ইনান আবারও ঘুমে তলিয়ে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ঘুমের ট্যাবলেট খায় সে, যদি একটু ঘুম আসে, তাহলে হয়তো ইনান তার হাত থেকে বেঁচে যাবে। মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকে জেহফিল। সে ইনানকে কষ্ট দিতে চায়না, কিন্তু ইনান যদি তাকে দূরে ঠেলে দেয়? ভালো না বাসে? তাকে ঘৃণা ভরা চোখে দেখে? চলে যাওয়ার চেষ্টা করে? মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায় আরও। কী করবে সে? ইনানকে বেঁধে রাখবে? আটকে রাখবে রুমে? নাকি নিজের হাতের সাথে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে রাখবে? কী করলে ইনান তাকে ছাড়বে না?
জেহফিল শুষ্ক গলায় ঢোক গিলে। ইনানের দিকে একপলক চেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ইনান কাছে থাকলে তার পাগলামী আরো বেড়ে যাবে। পাশের রুমে চলে যায়। এই রুমটা তার ব্যক্তিগত পেইন্টিং রুম। সব রুমের থেকে এই রুমটাই তার পছন্দ। কেননা রুমের দেয়ালজুড়ে ইনানের পেইন্টিং।
রুমের এক সাইডে আর্টের সরঞ্জাম। জেহফিল টুলে বসে। পাঁচটা মোম ধরিয়ে ক্যানভাসের পাশে রাখে। এখন নিজেকে ব্যস্ত রাখার এই একটাই উপায়। আর্ট করা। কিন্তু কী আঁকবে? তার মন জুড়ে যে এখন ইনান। ইনানের ছবি আঁকবে? তখন হঠাৎ তার নজর যায় টেবিলের উপর। আধভাঙা একটা মোবাইল সেখানে। জেহফিল মোবাইলটা হাতে নেয়। এটা মূলত ইনানের। ইনানকে তখন মিথ্যা বলেছিল যে মোবাইল হারিয়ে গিয়েছে। ইনানের মোবাইলের প্রতিটা ফাইল জেহফিলের দুইবার করে দেখা শেষ। ইনান কাকে মেসেজ দিয়েছে, কী পোস্ট করেছে, কোথায় কমেন্ট করেছে, কী অ্যাপ ডাউনলোড করেছে, কেন করেছে সব খতিয়ে দেখেছে সে। প্রত্যেকটা ছেলে ফ্রেন্ডদের ব্লক করে দিয়েছে টুইটার, ইন্সটা আর এফবি থেকে। যেসব মেয়েদের সাথে ইনানের মেসেজ বেশি তাদেরও ব্লক মেরেছে সে।
ইনানের মোবাইলে ছবি ছিল প্রায় সাত হাজার। তার মধ্যে ইনানের একার দুই হাজার। বাকিগুলো সব ডিলিট করে দিয়েছে জেহফিল। যেসব ছবিতে ইনানের সাথে অন্যরা আছে, এমনকি ইনানের বাবার সাথের ছবিগুলো থেকে ইনানকে ক্রপ করে রেখে সবগুলো ডিলিট করে দিয়েছে সে। ইনানের দুই হাজার ছবি জেহফিল প্রিন্ট করে অ্যালবাম বানিয়েছে। তার নাম দিয়েছে ‘mi amor’
ইনানের কথা ভাবতে ভাবতেই ইনানের ছবি আঁকা শুরু করল সে। দীঘির পাড়ে গোলাপী রঙের ছড়ানো গাউন পরে বসে আছে ইনান। পানিতে ভাসছে গোলাপী রঙের ছোটো ছোটো ফুল। ইনান দুহাতে গাউন ধরে অদূরে নিষ্পলক চেয়ে আছে। চোখের তারা আলোতে ঝিলমিল করছে। শরীরের চারপাশে দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে। এ যেন স্বপ্ন। স্বপ্নময়ী কন্যা ইনান!
.
.
সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ইনানের ঘুম ভাঙে। সূর্যের দেখা দিলেও আলোর তীব্রতা নেই। হাই তুলে ঘুম থেকে উঠে অচেনা জায়গায় অচেনা বেডে নিজেকে দেখে চমকে যায়। পাঁচ মিনিট পর তার মনে পড়ে সে যে বিবাহিত এবং সে জেহফিলের বাসায় আছে। বাবাকে কল করে কথা বলে নেয়। পায়ের ব্যথা তেমন একটা নেই। থেমে থেমে হাঁটা যায়। রুম থেকে বের হয় সে। আজকেও একটা মন মুগ্ধ করা দৃশ্য চোখে পড়ল। অ্যাপ্রোন পরনে জেহফিল খুব মনোযোগ সহকারে প্লেট সাজাচ্ছে। সূর্যের নরম আলোয় জেহফিলের খোঁচা খোঁচা দাড়ি চিকচিক করছিল। সত্যি বলতে কী, গতকাল জেহফিলের নিদারুণ কষ্টের জীবনী শুনে ইনানের মায়া হয়েছিল জেহফিলের প্রতি। নিজেকে জেহফিলের জায়গায় রেখে ভেবেছে, সে কি জেহফিলের মতো করে বাঁচতে পারত? কখনোই না। কারো সাথে কথা না বলে, একা থেকে ইনান দম বন্ধ হয়ে মা’রা-ই যেত।
‘গুড মর্নিং প্রিন্সেস!’
জেহফিল প্রফুল্ল হাসল ইনানকে দেখে। ইনান লক্ষ্য করল, জেহফিল যখন হাসে ঠোঁটের কোণা হালকা উঁচু করে, আর ঠিক সেই স্পটে সূক্ষ্ম টোলের সৃষ্টি হয়। জেহফিলের হাসিতে তার ধূসর চোখজোড়াও হাসে। দেখতে প্রাণবন্ত লাগে।
জেহফিল ইনানের কাছে এগিয়ে আসে। হাত বাড়িয়ে ধরে ইনানকে। ইনানের আহত পা নিজের পায়ের উপর রেখে ইনানকে হাঁটতে সাহায্য করে। চেয়ারে বসিয়ে খাবার সার্ভ করে। ডিশগুলো এমনভাবে সাজানো যেন ইনান ফ্যান্সি রেস্টুরেন্টে এসেছে। ইনান বিমোহিত। জেহফিল ইনানের পাশে দাঁড়িয়ে একটা একটা করে তার প্লেটে তুলে দিচ্ছে। ইনান বিমোহিত। সে যেন সত্যি কোনো প্রিন্সেস এমনভাবে ট্রিট করছে জেহফিল।
‘আপনিও বসুন। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
জেহফিল যেন ইনানের আদেশের অপক্ষাতেই ছিল। চেয়ার টেনে ইনানের পাশে এসে বসল। নিজের প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বলল,
‘জীবনে প্রথম এক টেবিলে পাশাপাশি বসে কারো সাথে ব্রেকফাস্ট করছি। তাও মানুষটা আমার ভালোবাসার মানুষ। ফিলিং সো এক্সাইটেড।’
‘আপনার কথাগুলো সত্যি অবিশ্বাস্য। আমার তো এখনো মনে হচ্ছে বইয়ের কোনো ট্রাজেডি গল্প পড়েছি।’
জেহফিল ইনানের প্লেটে আরেকটা প্যানকেক দিল, বলল, ‘পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের কোটি কোটি ভিন্নধারার গল্প। চোখের আড়ালে থাকা বাস্তবতা বেশি ভয়ঙ্কর। যারা নরমাল লাইফ লিড করে তাদের কাছে অন্যের ট্রাজেডিময় জীবনটা স্বাভাবিই ভাবেই অস্বাভাবিক ঠেকে।’
.
খাবার পর্ব শেষে জেহফিল ইনানকে রেডি হতে বলে,
‘কোথায় যাবো?’
‘শপিংএ।’
‘ভার্সিটি যাবো না?’
‘না।’
‘আপনি আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে চাইছেন?’
জেহফিল ইনানের গালে হাত রাখে, ‘এত বেশি বুঝো কেন? মেয়ে মানুষ ক বললেই কলকাতা বুঝে ফেলে। আমি কি বলেছি তোমার পড়ালেখা বন্ধ করে দিবো? বিয়ের দ্বিতীয় দিন আজকে। স্বাভাবিকভাবে বিয়ে হয়নি আমাদের যে বিয়ের আমেজটা থাকবে। তাই আজকের দিনটায় তোমাকে নিয়ে একটু বেরোতে চাইছি। আর বাটারফ্লাই..’
জেহফিল ইনানের হাত ধরল, ম্লান গলায় বলল, ‘আমি কখনোই তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করব না বাটারফ্লাই। আমি ডমিনেটিং না, ইভেন ডমিনেট করা পছন্দ না আমার। প্রথম দিকে তোমার সাথে করা অ্যাগ্রেসিভ আচরণের জন্য ক্ষমা চাইছি। আমি সত্যি সরি। তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো। পড়ালেখাতেও আমার বাঁধা নেই। যেটা তোমাকে খুশি রাখবে সেটা আমাকেও খুশি রাখবে।’
ইনান আশ্বস্ত হয় জেহফিলের কথায়। সে ভেবেছিল সত্যিই জেহফিল তাকে ডমিনেট করবে!!
.
.
শপিং করার সময় ইনানের দেখা হয় মাহিনের সাথে। মাহিন ইনানের দুই ইয়ারের জুনিয়র। ইনান প্রাইভেট পড়িয়েছিল মাহিনকে। লিফটে দেখা হওয়ায় কেউ কাউকে এড়াতে পারেনি। মাহিনকে দেখেই ইনান তার গাল টিপে দিয়েছিল জোরে। ছেলেটা গুলুমুলু অনেক।
‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে?’
‘এইতো আপু, রেস্টুরেন্টে যাব, ফ্রেন্ডদের সাথে।’
‘তোমার না এক্সাম চলে? পড়াশোনা বাদ দিয়ে এসব করা হচ্ছে?’
‘ইয়ে.. এরকম সবাই-ই করে, তুমিও তো করেছো কতো।’
ইনান মাহিনের গালে দুষ্টুমি করে হালকা চাপড় দিলো, ‘আমি আর তুমি এক নাকি? আমাদের সময়ে এসব জায়েজ ছিল, তোমাদের সম্পূর্ণ হারাম।’
জেহফিল ইনানের লিফ্টের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে ছিল। ইনান আর একটা ছেলের খুনসুটি করাটা তার ভালো লাগল না একদমই। ম্যানারলেস ছেলে একটা! বড়দের তুমি তুমি করে বলে? বাস্টার্ড! পরিবার থেকে শিক্ষা পায়নি!! হাত মুঠ করে রাখল জেহফিল। তার চোয়াল শক্ত।
.
শপিং করে ফেরার পথে জেহফিল ড্রাইভ করতে করতে শান্ত গলায় বলে,
‘ছেলেটা কে?’
ইনান আয়না সামনে নিয়ে কিনে আনা সবগুলো লিপস্টিক ট্রাই করছিল। জেহফিলের কথা শুনে বলে,
‘কোন ছেলেটা?’
‘লিফ্টের ছেলেটা।’
‘ওও, ও আমার স্টুডেন্ট। ইন্টারে থাকতে ও’কে পড়িয়েছিলাম।’
‘কত বছর?’
‘বছর না, চার মাস পড়িয়েছিলাম।’
‘পড়ানোর পাশাপাশি ম্যানারস শেখানোটাও টিচারদের কর্তব্য।’
ইনান লিপস্টিক রেখে জেহফিলের দিকে তাকালো, ‘কী বলতে চাইছেন?’
‘মানে ছেলেটাকে দেখলাম তোমাকে তুমি করে বলছে, নরমালি আমরা টিচারদের তুমি ডাকি না। তাই বলছি।’
‘ওহ, আরে বাচ্চা ছেলে তো, এগুলো কিছু না।’
‘তাও বাটারফ্লাই। এখনকার যুগে ক্লাস ফাইভের ছেলেরাও এডাল্টদের মতো বিহেভ করে। তাই তোমার উচিত এসব ছেলেদের থেকে দূরে থাকা।’
ইনান কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায়, তা দেখে জেহফিল হাসার চেষ্টা করে বলে, ‘আরে বলতে চাইছি, ছেলেটা দেখলাম কলেজ ফাঁকি দিয়ে এদিক সেদিক যায়, বলা তো যায় না, যদি খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে। ভবিষ্যতের জন্য খারাপ।’
‘এগুলা হয়ই। এতটাও স্ট্রিক্টে রাখা দরকার নেই এসব ছেলেমেয়েদের। এমন কত করেছি আমি।’
‘কার সাথে?’
‘আর কে, ফ্রেন্ডদের সাথে।’
‘তোমার ছেলে ফ্রেন্ড মোট কয়জন?’
‘স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি মিলিয়ে অনেকজনই। যদিও এখন আর তেমন দেখা সাক্ষাৎ হয় না। এত কিছু জিজ্ঞেস করছেন কেন বলুন তো?’
জেহফিল জোর করে হাসল, ‘এমনিই বলছি, আমার বউয়ের ফ্রেন্ড মানে তো আমারও ফ্রেন্ড তাইনা? তাদের খোঁজ নেওয়াটাও আমার কর্তব্যের মতো।’
ইনান হাসল। জেহফিলকে সে যেমনটা ভেবেছিল আসলে তেমন না, মানুষের সাথে মেশার চেষ্টা করলেই মিশতে পারবে, আপন করে নিতে পারবে। সারা রাস্তা সে তার ফ্রেন্ডদের গল্পই বলে যেতে লাগল। আর এদিকে জেহফিলের হাসি থেমে গিয়ে স্টিয়ারিংয়ে রাখা হাত শক্ত হয়ে গেল নিমিষেই।
.
.
চলবে…