রোদরঞ্জন #পর্ব_৭ #আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

0
427

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৭
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

দুপুরের দিকে ইনানের ছটফটানি বেড়ে গেল দ্বিগুণ। গত দুই ঘন্টা সে যে কীভাবে এই নরকের সামনে বসে ছিল একমাত্র সে-ই ভালো জানে। জেহফিল ইনানের সামনে থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও নড়েনি। ইনানকে বারান্দায় বসিয়ে সে নিজেও রং তুলি নিয়ে ইনানের মুখোমুখি বসে আছে। মূলত ইনানের পোর্ট্রেট আঁকছে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে জেহফিল গভীর চোখে ইনানকে দেখছে আর রং তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে তুলছে। জেহফিলের ধারাল দৃষ্টির তোপে পড়ে ইনান টু শব্দটিও করতে পারছে না। মুখ স্বাভাবিক রাখলেও ভেতরে ভেতরে চিন্তায় আছে কখন সে বাড়ি ফিরবে।

‘জান, মাথাটা একটু এদিকে।’

ইনান বিরক্ত চোখে তাকায়। রাগে তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে।‌ কিন্তু মুখে কিচ্ছুটি বলতে পারছে না ভয়ে। তাই একটু অভিনয় করল, যদি একটু জেহফিলের মন গলে।

‘পা অনেক ব্যথা করছে জেহফিল।’

কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই জেহফিল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। ‘বেশি ব্যথা করছে সোনা? পা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে?’

ইনান মাথা উপর নিচ করল। ভেবেছিল এবার বোধহয় একটু নিস্তার পাবে। কিন্তু না। জেহফিল আরেকটা চেয়ার এনে তাতে কুশন রেখে ইনানের বাম পা হালকাভাবে রেখে দিলো। হতাশ শ্বাস ফেলে ইনান। এমনই চলছে গত দুই ঘন্টা, ব্যথার কথা বললেই জেহফিল এসে আরামের ব্যবস্থা করে দেয় তবে ইনানকে একা ছাড়ার কথা ভুলেও ভাবে না।

ইনানের বিরক্ত দৃষ্টি জেহফিলকে খুব আনন্দ দিচ্ছে। ইনানের ছবি আঁকা শেষ হলেও সে ইচ্ছে করেই ইনানকে বসিয়ে রেখেছে। বারান্দার সাথে লাগোয়া কদম ফুল গাছ। ফুল জেহফিলের কখনোই পছন্দ ছিল না। সে ভেবেছিল এই গাছটাও কেটে ফেলবে। কিন্তু এখন সে ডিসিশান চেঞ্জ করেছে।

ইনানকে নিয়ে প্রতিদিন সে এইখানে বসবে, তারপর কদম ফুলের সাথে ইনানের তুলনা করবে। দেখবে কার ফুল বেশি সুন্দর। গাছের নাকি তার?

এক জীবন্ত ফুল ইনান, যে কিনা প্রাণহীন‌ ফুল গাছের সামনে বসে সেটাকেও জীবন দিচ্ছে। চেহারা মায়াবী.. সদ্য ফোঁটা ফুলের মতো স্নিগ্ধ। তার বাটারফ্লাই এত সুন্দর!! জেহফিলের মাথার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে গেল। শুষ্ক ঢোক গিলে সে। ইনানকে যত দেখছে ততই সে মুগ্ধ হচ্ছে। উফফ! এত মন দহন করা জ্বালাপোড়া হচ্ছে কেন ভিতরে!!

‘খিদে পেয়েছে।’ আচমকা বলে উঠল ইনান।

‘কী খাবে সোনা?’

‘আপনার মাথাটা দেন। চিবিয়ে খাই। শালা পাগল!’ মনের কথা মনেই রেখে মুখে বলল, ‘কী কী বানাতে পারেন?’

‘কী কী খাবে বলো!’

‘চিকেন বার্গার আর চকলেট কেক।’

‘এই দুপুরে?’

‘হু, অন্য কিছুর রুচি নেই আপাতত।’

‘অ্যাজ ইউ সে মাই প্রিন্সেস।’

জেহফিল উঠে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ইনান। এটাই তো চেয়েছিল। জেহফিলকে ব্যস্ত রাখা! এবার একটু শান্তিতে থাকবে। তবে তা আর হলো না, ইনানের আরাম হারাম করে জেহফিল এসে ইনানকে কোলে তুলে নিলো।

‘আজব তো! কোলে নিচ্ছেন কেন? নামান বলছি।’ রাগে গজগজ করে বলল ইনান।

জেহফিলের কঠোর জবাব, ‘চিৎকার করবে না আমার উপর বাটারফ্লাই। চেঁচামেচি আমি পছন্দ করি না। কী ভেবেছ! তোমার প্ল্যান আমি বুঝি না? এই ছোটো ব্রেইনের বুদ্ধিগুলোও তো দেখি কাঁচা।’

কিচেনের কাছে চেয়ার রেখে বসিয়ে দিলো সে ইনানকে। তার সামনে টি টেবিলে পা উঠিয়ে দিলো সাবধানে। অ্যাপ্রোন পরতে পরতে বলল,

‘এইখান থেকে এক পাও নড়ার চেষ্টা করবে না কিন্তু লিটল কিটি। ফল ভালো হবে না।’

‘কীসব আলতু ফালতু নামে যে ডাকেন, গা জ্বলে।’

বিরক্তির শ্বাস ফেলে বলে ইনান।

জেহফিল দুষ্টু হাসে। তা দেখে পিলে চমকে উঠে ইনানের। আবার কী বাজে চিন্তা করছে এই ছেলে!! জেহফিল চেয়ারের পেছনে এসে ইনানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘জ্বলুনি দূর করে দিবো মাই লিটল কিটি? ভালো মেডিসিন আছে আমার কাছে।’

‘নো থ্যাংকস। এখন গিয়ে কাজ করুন, ক্ষুধায় পেট ফেটে যাচ্ছে।’

জেহফিল হাসতে হাসতে কাজে ফিরে গেল। অবশ্য কাজ করার টাইমেও ইনানকে নিস্তার দিলো না। ক্রীম গালে লাগায়, গলায় লাগায়, কানের কাছে ফু দেয়, নানাভাবেই ইনানকে টিজ করে। ইনান দাঁতে দাঁত চেপে এসব সহ্য করছিল।

.

.

বিকেলে যাওয়ার সময় হয়ে যায়। জেহফিল ইনানকে কোলে নিয়েই গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার টাইমে, ইনান কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায়।

‘এনিথিং রং কিউটিপাই?’

‘এই নাকি গাড়ি নষ্ট, বিকালে মেকানিক আসবে? কাউকেই তো দেখলাম না আসতে, আপনি নিজেও তো আঠার মতো আমার সাথেই চিপকে রইলেন সারাদিন।’

শয়তানি হাসির রেখা ফুটে উঠে জেহফিলের বাদামী ঠোঁটে। ইনানকে চোখ টিপ দিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করে। ইনানের আর বুঝতে বাকি রইল না কিছুই। জেহফিল কালকে ইনানের অসুস্থতার সুযোগ নিয়েই এসব মিথ্যে বানিয়েছে, কিন্তু এসব করে জেহফিলের কী লাভ হয়েছিল? কনফেস করতে চাইলে তো কালকেই করতে পারত? ওকে এখানে রাখার কারণ কী ছিল?

জেহফিলের আরেকটা মিথ্যা বেরিয়ে আসে রাস্তার মাঝেই। ও বলেছিল রাস্তায় নাকি গাছ ভেঙে পড়ে গেছে অথচ সিঙ্গেল ডালেরও চিহ্ন পেল না ইনান। মনে মনে জেহফিলকে যত প্রকারের বাজে বাজে গালি জানে সবগুলোই দিতে লাগল।

গাড়ি থামল একটি মসজিদের সামনে। চোখে এক ঝাঁক প্রশ্ন নিয়ে তাকাল ইনান।

‘এখানে কেন?’

‘বিয়ে করব।’ ভাবলেশহীন জবাব জেহফিলের।

‘কীহ??’ উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠে ইনান।

জেহফিল থেমে থেমে বলে,’বি য়ে ক র ব।’

‘হাহ! সিরিয়াসলি!’‌ অবজ্ঞার হাসি হাসে ইনান, ‘মামার বাড়ির আবদার যেন।’

‘মামার না, তোমার স্বামীর আবদার।’

‘একটা কথা বলব জেহফিল? ইনান হাত ভাঁজ করে তাকায় জেহফিলের দিকে, সরাসরি।

‘গো অ্যাহেড প্রিন্সেস।’

‘ইউ আর আ ফাকিং অ্যাসহোল।’

জেহফিলের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, কপালের রগ ফুলে উঠল রাগে, ‘মুখ সামলাও বেবিগার্ল।’

‘পারবো না। আমার মুখ আমার ইচ্ছা।’ কাষ্ঠ গলা ইনানের।

গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়ল জেহফিল। মুখে হাত বুলিয়ে নিজেকে শান্ত রাখল, ‘শুধু সময়ের ব্যাপার বাটারফ্লাই। মুখ কীভাবে বন্ধ রাখতে হয় শিখিয়ে দিবো, নো প্রবলেম।’

‘শালা বাস্টার্ড।’

এবার যেন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না জেহফিল। খপ করে ইনানের গাল চেপে ধরল শক্ত হাতে। হাতের পাঁচ আঙুল বসিয়ে দিলো ইনানের কোমল গালে। ব্যথাতুর শব্দ বেরিয়ে আসল ইনানের গলা থেকে।

দাঁত কটমট করে চোখ রাঙিয়ে বলল জেহফিল, ‘বেশি প্রশ্রয় পেয়ে মাথায় উঠে গেছ একদম। কিছু বলি না, রাগ দেখাই না, তাই বলে যে কখনো করব না এটা তুমি ভাবলে কীভাবে সোনা? এমন হাল করব না!! কথা বলার অবস্থাতেও থাকবে না।’

ইনান দুই হাতে জেহফিলের শক্তপোক্ত হাত সরাতে লাগল, পারল না কিছুতেই। জেহফিলের শক্তির কাছে তার শক্তি পুটি মাছের মতো। জেহফিলের হাতের মাঝে গাল থাকা অবস্থাতেই ইনান ফ্যাসফ্যাস করে বলল,

‘কিছুই করতে পারবি না তুই এখন। তখন তো তোর বাড়িতে ছিলাম বলে কিছু বলতে পারিনি, এখন যদি চিৎকার করি, জনগণের হাতে উত্তম মধ্যম খেতে হবে তোকে।’

ইনান তাকে তুই করে বলাতে রাগ আরও চড়াও হলো জেহফিলের মাথায়। দপদপ করে জ্বলে উঠল সে। গালে রাখা আঙ্গুল আরো শক্ত হয়ে উঠল তার।

‘ছাড় বলছি, তোর মতো সাইকোকে তো আমি মরে গেলেও ভালোবাসবো না, বিয়ে তো দূরে থাক।’

ইনানের কথা জেহফিল যেন হঠাৎ মজা পেল। বাঁকা হেসে ইনানকে ছেড়ে দিলো।

‘বিয়ে করবে না তাই না? আচ্ছা ঠিকাছে মানলাম।’
তারপর নিজের ফোন বের করে ইনানের চোখের সামনে ধরল, চিন্তিত হবার ভান করে বলল, ‘দেখো তো কিটেন, এটা কে? তোমার মতো দেখাচ্ছে মনে হয়।’

ভিডিওটা দেখে ইনানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এটা গতরাতের ভিডিও। ইনান ঘুমিয়ে ছিল যখন তখনকার। ভিডিওতে দেখাচ্ছে, জেহফিল খালি গায়ে শুধু প্যান্ট পরনে ইনানকে জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ গুঁজে আছে। ইনানের টি-শার্ট পেট পর্যন্ত উঠানো, সেখানে হাত বুলাচ্ছে জেহফিল। জেহফিল ইনানকে এমনভাবে পেঁচিয়ে গালে গলায় চুমু খাচ্ছে দেখে মনে হয় স্বামী স্ত্রীর কোনো ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের প্রথম চিত্র। ইনান আঁতকে উঠল, হাত চলে গেল মুখে। কান্নায় ভরে উঠল তার দুচোখ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।

জেহফিল মোবাইল সরিয়ে নিলো, বাঁকা হেসে বলে, ‘দেখে মনে হচ্ছে সফ্ট প’র্ণ তাই না?’

‘এ…এগুলো.. আপনি…’

কান্নার দমকে কথা বলতে পারল না ইনান। হেঁচকি তুলে কাঁদছে সে।

‘এগুলো তেমন কিছুই না। কালকে জাস্ট ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছিলাম তোমাকে, তারপর একটু আকটু আদর করলাম। চিন্তা করো না, এর বেশি কিছুই করিনি, গড প্রমিস।’ জেহফিল কণ্ঠনালীতে চিমটি কেটে ধরল নিষ্পাপ চোখে।

ইনানের চোখের পানি মুছে দিয়ে তার ছোট্ট মুখটা হাতের আঁজলায় ধরল জেহফিল। নরম সুরে বলল,

‘জান, আজকে, এই মুহুর্তে তোমার আমার বিয়ে হবে। তারপর তোমার বাবাকে বলে বিয়ে করব, যদি মানে তাহলে তো ভালোই আর না মানলে..’

তারপর হুমকির সুরে বলল, ‘তুমি তোমার বাবাকে যে করেই হোক মানাবে, জানি না কীভাবে মানাবে বাট মানাবেই! কাল বিকেলে তোমার বাসায় যাবো। ব্যাগ নিয়ে রেডি থাকবে। কালকেই তুমি ফিরে আসছো আমার সাথে। আজকের দিনটা সময় দিলাম নিজেকে আসন্ন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করতে। এখন চলো, বিয়ে করব।’

ইনানের কান্না থামছে না দেখে জেহফিল বলল,’কান্না থামাও বাটারফ্লাই। আমি ভিডিওটা কাউকে দিচ্ছি না, তবে, যদি তুমি আমাকে অমান্য করো…’

ইনানের গাল ধরে নিজের দিকে ফিরালো জেহফিল, চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, ‘তোমার বাবা আর ফ্রেন্ডসের কাছে যাবে প্রথমে..তারপর অনলাইনে…’

ইনান চোখ বন্ধ করে আছে, তার ইচ্ছে করছে এখনই ম’রে যেতে। এতটা নীচে নামতে পারবে জেহফিল সে কখনো ভাবতে পারেনি।

‘কান্না থামাও, একদম চুপ। এই সুখের মুহুর্তে কেউ কাঁদে নাকি? কান্না থামাও বলছি, গাড়ি থেকে নামার সময় যাতে হাসি হাসি মুখ দেখি। নাহলে কিন্তু..’

জেহফিল ইনানকে গাড়িতে রেখে বেরিয়ে গেল, আবার দুমিনিটের মাথাতেই ফিরে আসলো। তার হাতে গোলাপের মালা। ইনানের চুলে ফুল গুজে দিয়ে হাতেও পরিয়ে দিলো।

‘সরি সোনা, এই অল্প সময়ে এর থেকে বেশি কিছুই পাইনি তোমাকে দেয়ার মতো। চলো এখন। মুখ স্বাভাবিক রাখো।’

জেহফিল ইনানকে গাড়ি থেকে ধরে নামালো। ইনান যেন নিজের মধ্যে নেই। রোবটের মতো জেহফিলের সঙ্গে হেঁটে চলছে সে। তার বিবেকবুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে সেই মুহুর্তে। নিজেকে কেমন অনুভূতিহীন লাগছে। কী হতে চলেছে ভবিষ্যতে ভেবে ভেবেই তার সারা গা কাঁটা দিচ্ছে।

সেই মুহুর্তেই কোনো আয়োজন ছাড়া বিয়ে হয়ে গেল তাদের।

.
.
চলবে…

(চোখের সমস্যার কারণে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। তাই ছোটো করেই লিখেছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here