#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৯
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
জেহফিল অনবরত বাথরুমের দরজায় কড়া নেড়েই যাচ্ছে। ইনান গোসলের নামে যে গেছে, আধঘন্টা হয়ে গেছে মেয়েটার বেরোনোর কোনো খবর নেই। এদিকে বৃষ্টির কারণে কারেন্টও নেই। অন্ধকারে একা কী করছে এতক্ষণ? ভেতর থেকে পানির আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না। জেহফিল হাইপার হয়ে যাচ্ছে টেনশনে। বারবার বাথরুমের দরজায় ধাক্কাচ্ছে আর অস্থির গলায় বলছে,
‘বাটারফ্লাই প্লিজ দরজাটা খুলো, অনেকক্ষণ হয়েছে, আর কত টেনশনে রাখবে আমাকে? প্লিজ সোনা, শুধু দরজাটা খুলো, আমি ভেতরে যাব না প্রমিস, বাহিরেই থাকব লাইট হাতে, তুমি খুলোনা দরজাটা! এত কেন অভিমান বাটারফ্লাই?’
ইনান দরজা খুলল না। ভেতর থেকেই কান্নারত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল,
‘আপনি একটা জঘন্য মানুষ। স্বার্থপর। নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে একটা মেয়ের সম্মান নিয়ে খেলতেও আপনার বাঁধে না।’
জেহফিল এবার বুঝল ইনানের রাগের কারণ।
‘এই সামান্য কারণে তুমি বের হচ্ছো না? গড! এত বোকা কেন তুমি?’
‘আপনার মতো মানুষের কাছে এসব সামান্য হতে পারে, আপনি কী বুঝবেন এসবের? মেয়ে হলে ঠিকই বুঝতেন।’
‘আচ্ছা, বাইরে বের হও, তারপর যা ইচ্ছে করো, তাও প্লিজ বের হও। আই ক্যান এক্সপ্লেইন।’
জেহফিলের আরও পীড়াপীড়িতে ইনান শেষ পর্যন্ত দরজা খুলল। ইনানকে বের হতে দেখে জেহফিল জড়িয়ে ধরতে চায় তাকে। ইনান বাঁধা দেয়। কঠোর স্বরে বলে,
‘কী এক্সপ্লেইন করবেন? বলুন। সময় অল্প।’
ইনানকে জড়িয়ে ধরতে না পেরে জেহফিল ছটফটানি শুরু করে। যেন এখন জড়িয়ে ধরতে না পারলে সে ম’রেই যাবে। মিনতি করে বলে,
‘তার আগে একটু জড়িয়ে ধরি? একটু? হালকা করে? নাহলে আমি শান্তি পাবো না।’
‘আগে এক্সপ্লেইনেশন।’ কড়া জবাব ইনানের।
জেহফিল মাথার চুল শক্ত করে চেপে ধরে। সে রাগতে চায় না এখন। বড় বড় ঢোক গিলে ধাতস্থ করে নিজেকে সে। পারে না, নিজের ইমোশন আড়ালে রাখতে ব্যর্থ হয়। ইনানের অনুমতি ছাড়াই জোর করে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে ইনানকে। ইনান জেহফিলের বাহুডোরে থেকেই সাপের মতো মোচড়ামুচড়ি শুরু করে। জেহফিল ইনানকে জড়িয়ে ধরেই খাটের উপরে নিয়ে বসায়। বালিশে আধশোয়া হয়ে ইনানের পিঠ তার বুকে হেলান দিয়ে বসে। পেছন থেকে ইনানকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘নাউ আই ক্যান এক্সপ্লেইন।’ মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলো সে। হলুদ আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল রুমটা। তারপর মোবাইল হাতে নিয়ে সেই ভিডিওটা প্লে করে।
ইনান ইতোমধ্যেই কান্না শুরু করে দিয়েছে। জেহফিল ইনানকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলে,
‘ট্রাস্ট মি বাটারফ্লাই। ঐদিন তোমার সাথে খারাপ কিছুই করিনি। শুধু তোমার পেটেই হাত দিয়েছি বিশ্বাস করো। এর বেশি কিছুই করিনি। এই দেখো আমি ভিডিওটা ডিলিট করে দিচ্ছি। তোমার সামনেই।’
জেহফিল ফোল্ডার থেকে এমনকি ট্রাশ ক্যান থেকেও ভিডিও ডিলিট করে দিলো।
তারপর ইনানকে নিজের মুখোমুখি বসাল, ইনানের হাত দুটো চেপে ধরে নিজের বুকে রাখল। অসহায় গলায় বলল,
‘আমি সত্যিই সরি বাটারফ্লাই। আমি জানি যা করেছি খারাপ করেছি। কিন্তু ঐ মুহুর্তে..ঐ মুহুর্তে কী যে হলো, আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমাকে নিজের করে পাওয়াটাই তখন মেইন ফোকাস ছিল। তাই খুব বাজে একটা কাজ করে ফেলেছি। আমি জানি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না, তাও ক্ষমা চাইছি।’
জেহফিল ইনানের ছোট্ট মুখটা নিজের দুহাতের মাঝে নিলো, ‘তুমি কি ভেবেছ? আমি এই ভিডিওটা সত্যি সত্যি অনলাইনে ছেড়ে দিতাম? আমি খারাপ হতে পারি, কিন্তু আমার ভালোবাসার মানুষের সম্মান নিয়ে কখনো ছেলেখেলা করতে পারি না, এতটাও বাজে নই আমি বাটারফ্লাই। আমি শুধু তোমাকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে ভিডিওটা বানিয়েছিলাম, যাতে তুমি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাও।’
ইনান ফোঁপাচ্ছে। জেহফিলের করা কাজটায় সে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
‘তুমি..তুমি আমাকে শাস্তি দিতে চাও? কী শাস্তি দিবে বলো? মাথা পেতে নেব সব। কী শাস্তি পেলে তুমি খুশি হবে…?’
জেহফিল এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজে। তারপর বেডসাইড ড্রয়ার খুলে ধারালো ব্লেড নিয়ে হাতে পোঁচ মারা শুরু করে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় ইনান।
‘কী করছেন এসব?’ চেঁচিয়ে উঠে ইনান।
ততক্ষণে জেহফিলের সাত আটটা পোঁচ মারা শেষ। সে বিড়বিড় করে বলছিল, ‘আমার বাটারফ্লাই, আমাকে ক্ষমা করো… বাটারফ্লাই… ক্ষমা করো..’
ইনান জোর করে জেহফিলের হাত ধরে থামালো। জেহফিলের হাত থেকে রক্ত টুপটুপ করে ঝরে পড়ে সাদা বেডশিটটাকে রঞ্জিত করে তুলছে। ইনান মাথা ঘুরাচ্ছিল রক্ত দেখে।
‘এইড নিয়ে আসুন তাড়াতাড়ি।’
‘তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো বাটারফ্লাই?’
জেহফিলের চোখে ব্যথার ছাপ নেই। সে আকুল হয়ে আছে ইনানের ক্ষমা পাওয়ার জন্য।
‘আপনি প্লিজ এইড বক্স আনবেন? আমার মাথা ঘুরছে রক্ত দেখে।’
জেহফিল নিজের জন্য না বরং ইনানের কথাতেই বক্স নিয়ে বসল।
‘তুমি নিজ হাতে ব্যান্ডেজ করে দিবে? একহাতে পারব না।’
জেহফিলের হাত ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় ইনানের অন্য হাতে নজর গেল। মোমের আলোয় দেখল জেহফিলের বাম হাতেও ব্লেডের কাটা দাগ। পুরোনো মনে হচ্ছে দেখে। এমনকি ডানহাতেও আগের কাটা দাগের চিহ্ন আছে। একটা দুইটা দাগ নয়, চিকন ব্লেডের অসংখ্য দাগ জেহফিলের হাতে। দেখে মনে হয়, নির্মমভাবে একাধারে হাত কেটেছে।
ইনান কৌতুহল মেশানো চাহনিতে জেহফিলকে প্রশ্ন করল,
‘এত কাটা দাগ কিসের? আপনি এর আগেও হাত কেটেছেন?’
জেহফিল চুপ থাকল।
‘বলছেন না কেন?’
‘হুম।’
‘কেন কেটেছেন।’
‘সরি।’
‘আজব, সরি বলছেন কেন, জিজ্ঞেস করেছি কেন কেটেছেন?’
জেহফিল মৃদু শ্বাস ফেলে এইড বক্স সরিয়ে ইনানের কাছ ঘেঁষে বসল। ইনানের কাঁধে মাথা রেখে বলল,
‘দুনিয়াতে একা থাকা অভিশাপ। সেই অভিশাপে অভিশপ্ত আমি। অভিশপ্ত ছিলাম..তুমি আসার আগ পর্যন্ত। এখন আর একা নই আমি।’
‘একা থাকলে মানুষ হাত কাটে? এই প্রথম শুনলাম।’
জেহফিল কাঁধ থেকে মাথা উঠালো। ইনানের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘বাটারফ্লাই, তুমি ছোটো থেকেই ফ্যামিলি-ফ্রেন্ডসের মাঝে বড় হয়েছো, আর আমি এতিমখানায়।’
ইনান হতবাক। জেহফিল এতিমখানায় বড় হয়েছে? সে তো জানতো না? উৎসুক গলায় বলল,
‘আপনি এতিমখানায় বড় হয়েছেন?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেহফিল। খাটে আধশোয়া হয়ে ইনানকে নিজের বুকে এনে ফেলল। ইনান আপাতত কিছু বলল না, জেহফিলের কাহিনী শোনার জন্য সে জেহফিলের দিকে চেয়ে আছে। ইনানের সিল্কি চুল নিয়ে খেলা করতে করতে জেহফিল বলল,
‘আমি জানি না আমার বাবা মা কে বা কোথায়! বুঝ হবার পর থেকেই জেনেছি আমাকে কুড়িয়ে পাওয়া হয়েছে। পরিবার আসলে কী জিনিস, আমি কখনোই বুঝিনি! এতিমখানায় একঝাঁক ছোট বড় ছেলেমেয়ের মাঝে আমিও বড় হয়েছি।’
‘তারপর?’
জেহফিল হাসে। হলদেটে আলো লেগে থাকা ইনানের মায়াবী মুখের দিকে চেয়ে বলে, ‘তারপর তোমাকে পেয়েছি।’
‘এতিমখানায় থেকেও আপনার ফ্রেন্ডস ছিলো না?’
‘না, জানি না কেন আমি অন্যদের থেকে আলাদা হলাম! চুপচাপ থাকতাম, আর ছবি আঁকতাম। কেউ আমার সাথে মিশতো না, শুনেছি আমাকে নাকি তারা ভয় পায়, আমাকে দেখতে নাকি আজব লাগে, গোমড়ামুখো থাকি বলে সবাই দূরে দূরে থাকতো। এতে আমিও খুশি ছিলাম। কারো সাথে কথা বলা, খেলাধুলা এসব বিরক্তিকর লাগতো আমার কাছে। বই আর আর্ট এই দুইয়ের মাঝেই আমার আমার জীবনটা সীমাবদ্ধ ছিল। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তবে আমার এত বছরের জীবনটায় ঊর্ধ্বে দশ-পনেরোজন মানুষের সাথেই ভালোমতো আলাপ হয়েছিল। তার মধ্যে অধিকাংশই ছিল আশ্রমের আঙ্কেলরা যারা আমার আর্ট বিক্রি করতে সাহায্য করেছিল।’
ইনানের মুখ হা হয়ে গেল। মানুষের জীবন আদৌ এমন হয়?
‘যখন তারা দেখল আমি আর্ট করেই নিজেকে চালাতে পারব তখন আশ্রমের হেড আমাকে এই বাড়িটা কিনে দেয় আমার টাকাতেই। মূলত আমার পছন্দেই, একা থাকা, লোকালয় থেকে দূরে নির্জনে থাকাটাই আমার পছন্দ। তারপর আর কী, আর্ট, বই পড়া, আর কলেজেই জীবন চলছে।’
‘আপনি কিন্তু আমার কথার জবাব দিলেন না এখনো?’
‘দিতেই হবে?’
‘অবশ্যই।’
‘আগে একটা কিস দাও।’
‘উফ! বলা লাগবে না।’ ইনান বিরক্ত নিয়ে উঠে যেতে নিলো। জেহফিল হাত টেনে আগের জায়গায় নিয়ে আসলো,
‘বলছি বলছি।’
ইনানকে বুকের মধ্যে নিয়ে আবার বলা আরম্ভ করল,
‘দিন ভালোই চলছিল, আর্ট ইন্টারন্যাশনাল পর্যায়ে পৌঁছাল। টাকা পয়সা সবই হলো। কিন্তু ভেতর থেকে আমি মরে যাচ্ছিলাম একাকিত্বের কারণে। কলেজে ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্ব, রাস্তায় পরিবারের বন্ধন, এসব দেখলে খুব হীনম্মন্যতায় ভুগতাম। ঘরে কেউ নেই যে আমার জন্য অপেক্ষা করবে, আমার অসুস্থতায় পাশে বসবে, কেয়ার করবে, আমার সব দুঃখ কষ্টের ভাগ নিবে…একাকীত্ব আমাকে কুড়ে কুড়ে খেত। জ্বরে পড়লে নিজেই নিজের সেবা করা, ক্লান্ত হয়েও রান্না করা.. বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম জীবনের প্রতি।’
জেহফিলের কণ্ঠ বিষাদময়, ‘যারা আমাকে জন্ম দিয়েছে তাদের দোষারোপ করতাম, কেন এমন জঘন্য দুনিয়াতে এনে ফেলেছে! আমাকে মে’রে ফেললেই তো এত কষ্টে থাকতে হতো না। সুই’সাইড করতে চেয়েছিলাম। সুই’সাইড করতে যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য হাত কেটে ট্রায়াল দিয়েছিলাম। দেখলাম আসলে আমার কষ্ট হয় কিনা। তবে মনে কষ্টের কাছে শরীরের কষ্টটা তুচ্ছ ঠেকল।’
ইনানের দিকে তাকালো একবার, ইনানের হাত নিজের গালে চেপে ধরে চুমু খেয়ে বলল,
‘মনে আছে বাটারফ্লাই, আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা? ঐদিন আমি ডিসাইড করেছিলাম সুই’সাইড করব। কিন্তু কী মনে করে আমি সেদিন তোমার ক্লাসে ঢুকে পড়েছিলাম, আর তোমাকে দেখলাম। বোধহয় উপরওয়ালা আমাকে বাঁচানোর জন্যই তোমাকে পাঠিয়েছেন। কারো প্রতি আকৃষ্ট না হওয়া আমি প্রথম দেখাতেই তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম। তোমার হাসি মুখ আর চঞ্চলতার প্রেমে। সেই মুহুর্তেই ম’রার চিন্তা নিমিষেই দূর হয়ে গেল। মনে হতে লাগল, কেউ আছে আমার, সে আমার হলে আমার একাকীত্ব দূর হবে, আমি বাঁচতে পারব। তোমাকে স্টক করতে লাগলাম প্রতিটি সেকেন্ড। তোমাকে নিজের করে পাওয়াটার তীব্র বাসনা ক্রমে ক্রমেই আমাকে তাড়া দিতে লাগল। তারপর আর কী…আমাকে বাঁচানোর জন্য তুমি আমার হলে…একান্তই আমার।’
.
.
চলবে…