#রোদরঞ্জন
#পর্ব_১৫
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
পলক গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। ইদানীং চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় ইনানকে। চাকরিসূত্রে ইফাজ সাহেবের সাথে বেশ ভাব হলেও ইনানকে নিয়ে ওনার সাথে একটা কথাও বলতে পারে না সে। গত এক সপ্তাহের মতো ইনান লাপাত্তা। না ফোন না মেসেজ কোনো কিছু করেও ইনানের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ইফাজ খানকে সে বলতে পারছে না ইনান কোথায়। একবার শুধু ইফাজ খান বলেছিল ইনান পড়াশোনার জন্য কোথাও থাকছে। কিন্তু কোথায় সেটা বলার সাহস হয়নি পলকের। পাছে ইফাজ সন্দেহ করেন। পলক ইনানের বাড়িতে একবার যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল, গিয়ে ইনানকে দেখতে না পাওয়ায় সে কথাটি বলতে পেরেছিল, তবে ইফাজের থেকে ইনানের আরও খোঁজ নেওয়ার স্পর্ধা করল না।
এমন না যে পলক ইফাজ খানকে ভয় পায় বা কিছু। ইনানকে বিয়ের কথা বলতে তার কোনো সঙ্কোচ নেই। তবে ইফাজ খানের সাথে যতদিন কাজ করেছে তাতে এটুকু বুঝেছে তিনি মেয়ের সাথে কোনো পুলিশের বিয়ে দিবেন না। অবশ্য যৌক্তিক কারণ আছে। বিয়ের পর ছেলে যদি সারাদিন ডিউটি নিয়েই পড়ে থাকে তবে তার মেয়েকে দেখবে কখন? ইফাজ তার মেয়েকে কোনোদিন তেমন একটা সময় দিতে পারেননি তার চাকরির জন্য, এখন যদি তার স্বামীও একই রকম হয় তবে মেয়েটা সময়ের জন্য কার কাছে যাবে? পলক বুঝে ইফাজ খানের মনে কী চলে। কিন্তু সেও যে নিরুপায়। ইনান প্রথম দেখাতেই তার মনে জায়গা করে নিয়েছে, জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো কাউকে ভালোবাসার সুযোগ পেয়েছে, আর তা সহজেই হারিয়ে যাবে- এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে।
কোনো অযুহাতে সে ইনানের বাড়িতে যেতেও পারেনি যে ইনান কেমন আছে দেখবে। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে কয়েকবার ইনানের বাসার রাস্তার সামনে থেকে ইনানের বেলকনিতে চেয়ে থাকে। তাও পায় না ইনানের দেখা। বারান্দায় থাকা গাছগুলো শুকিয়ে মা’রা গেছে তাও মেয়েটির খবর নেই?
গত সপ্তাহের প্রতিটাদিন সে কাজের ফাঁকে এসে ইনানের ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। ইনানকে একটু দেখবে এই আশায়। কিন্তু সেখানেও পলককে হতাশ করে দিয়ে ইনানের দেখা পেল না। এভাবে কতক্ষন সে ইনানকে না দেখে থাকতে পারে? ইনান কি বুঝে না? বুঝে তো, অবশ্যই বুঝে, বুঝে বলেই তো পলককে প্রতিবার ইগ্নোর করে।
পলক শুষ্ক ঢোক গিলে আকাশের দিকে তাকায়। ইনানের ডাকা পাখির পালক ডাকটা খুব মিস করছে সে। তাকে দেখলেই ইনানের ভেংচি কাটাও মিস করছে, ইনানের চোখ, ঠোঁট, গাল, চোখের বড় বড় পাপড়ি, চুল সব.. সব মিস করছে সে।
‘আহ ইনান, আমার দিলরুবা, এতটা কেন পোড়াও আমাকে? এই শাস্তি কি আমার প্রাপ্য?’
ধরা গলায় অস্ফুটে আর্তনাদ করে উঠল পলক। ছেলে মানুষ হওয়ায় সহজে কান্না করতে পারছে না সে। বুকের গহীনে যে অসহ্য দহন, এত যন্ত্রণা সহ্য করবে কীভাবে সে?
.
সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছিল ইনান। ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কদম গাছের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিল। গাছটা বারান্দার সাথে লাগোয়া হওয়ায় হাত বাড়িয়ে একটা কদম ছিঁড়ে নেয়। কদম ফুলের গায়ে লেগে থাকা ফোঁটা ফোঁটা পানিগুলো হীরকের মতো জ্বলজ্বল করছে। ফুলটা নিয়ে গালে ছোঁয়ায় সে, কী শীতল পরশ!
‘বাটারফ্লাই!’
ইনান পেছন ফিরে তাকায়। জেহফিল ইনানের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
‘বৃষ্টিতে ভিজছো কেন? ঠাণ্ডা লাগবে।’
এই বলে ইনানের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসে, কিন্তু ইনান জেহফিলের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে যায়।
‘বৃষ্টি পছন্দ আমার।’ এই বলে রেলিংয়ে হাত রেখে অন্ধকার জঙ্গলে দৃষ্টিপাত করল ইনান।
হাত খুব স্বাভাবিকভাবেই ইনান ছাড়িয়েছে, না ঝাটকা মেরে আর না রাগ করে, একদম নরমাল ভাবেই জেহফিলের হাত সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা জেহফিলের গায়ে লাগল খুব। ইনানের অবহেলা সে মেনে নিতে পারে না, সে ভালোবেসে ইনানের হাত ধরেছে আর ইনান হাত ছাড়িয়ে নিলো! এই সামান্য ঘটনায় জেহফিলের রক্ত ছলকে উঠল। জেহফিল নিজ থেকে না ছাড়লে ইনান হাত ছাড়ালো কোন সাহসে? সে ইনানের পেছনে গিয়ে দুইহাতের মাঝেখানে ইনানকে আটকে দিলো। রেলিংয়ে রাখা ইনানের হাতের উপর হাত রাখল শক্ত করে।
‘কী করছেন? ব্যথা পাচ্ছি।’
জেহফিল ইনানের কানের কাছে মুখ এনে গভীর গলায় বলল,
‘তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে বাটারফ্লাই।’
জেহফিলের উষ্ণ নিঃশ্বাস ইনানের ঘাড়ে এসে পড়ছে। ইনান কিছু না বললেও তার গাল লাল হয়ে গেছে মুহুর্তেই। জেহফিলের বিপরীতে ফিরে থাকায় ভেবেছিল সে দেখবে না, কিন্তু জেহফিলের চোখ এড়াল না ইনানের রাঙা মুখ।
জেহফিল গাঢ় স্বরে বলল, ‘লুক লাইক আ রেড লিটল চেরী। আই ওয়ানা বাইট ইউ সো ব্যাড।’
সাথে ইনানের হাতের উপর রাখা হাত শক্ত হলো। ইনানের ব্যথা লাগল, তবে জেহফিলের বলা কথাগুলোয় ব্যথা ছাপিয়ে লজ্জাটাই মুখ্য হয়ে উঠল। ইনান তার লাজুক হাসি ঠোঁট কামড়ে চেপে চোখ স্থির করল তাদের বাড়ির পাশে থাকা পুকুরের অপর প্রান্তে কাজ চলা নতুন বাড়িটার দিকে।
‘ঐখানে কে বাড়ি করছে আবার?’ ইনান স্বগোতক্তি করল।
এই জঙ্গলের মাঝে কার বাড়ি করার শখ জেগেছে? জেহফিলের বাড়ির এবং ঐ বাড়িটার মধ্যে একটা ছোট পুকুরের ব্যবধান শুধু। যদিও এখনো বাড়ি হয়নি, মাত্র পিলার বসানো হয়েছে।
ইনানের কানে গুঁজা সতেজ ফুলের দিকে জেহফিলের চোখ গেল। জীবন্ত এক ফুলের কানে রাখা আরেকটা ফুল। ইনানকে সুন্দর লাগছিল, সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া ফুলের মতো স্নিগ্ধ। জেহফিলের হিংসে হলো খুব, ফুলটাকে। যেখানে জেহফিল এখনো ইনানকে গভীর করে ছোঁয়ার অনুমতি পায়নি সেখানে কয়েকদিনের ফুল এসে ইনানের চুলে-গালে লেপ্টে ইনানকে চুমু খাচ্ছে – এটা হাজব্যান্ড হয়ে কীভাবে সহ্য করবে?
জেহফিল ইনানের পেটে হাত রাখল আচমকা। দুজনেই তখন বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে গেছে। ইনানের কানে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে জেহফিল তপ্ত গলায় বলল,
‘এখানে নাকি রুমে?’
ইনানের পিলে চমকায়। শরীর শিরশির করে উঠে। এই ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও তার শরীর উষ্ণ হয়ে উঠল। জেহফিলের আবেশিত কণ্ঠে চোখ বন্ধ হয়ে গেল তার। শরীরের শক্তি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে লাগল। হাঁটু ভেঙে আসতে লাগল। এমন কেন হচ্ছে তার? জেহফিল কী এমন জাদু করল? এই তিন অক্ষরের বাক্যে কি নেশা ছিল?
ভাবতে ভাবতেই জেহফিলের উপর সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিলো সে। ইনানকে নিজের বুকে মাথা রাখতে দেখে জেহফিল পাঁজকোলা করে কোলে তুলে নিলো। ইনানের শক্তি এতটাই কমে গেছে যে জেহফিলের গলা জড়িয়ে ধরার জন্য হাতটাও উঠাতে পারল না সে। শুধু পিটপিট করে জেহফিলের শান্ত মুখশ্রীতে চোখ স্থির রাখল। জেহফিলের কপালে থাকা চুল থেকে টুপটুপ করে বৃষ্টির জল ঠোঁট গিয়ে চিবুক বেয়ে পড়ছে। যা দেখে তৃষ্ণা বেড়ে গেল ইনানের। ইচ্ছে করছিল জেহফিলের ঠোঁট থেকে সমস্ত জল শুষে নিয়ে পিপাসা মেটায়।
জেহফিল ইনানকে এনে ভেজা অবস্থায়ই ডিভানে বসায়। রুমের লাইট বন্ধ ছিলো। অন্ধকারেও জেহফিল ইনানের চোখের ভাষা খুব সহজেই বুঝতে পারছে। ইনান সম্মোহিতের ন্যায় জেহফিলের চোখে চেয়ে আছে। জেহফিল ইনানের টপের উপরের কটিতে হাত রাখে। ইনানের চোখে চোখ রেখেই একটা একটা করে কটির বোতাম খুলে। ইনান বাঁধা দেয় না। তার চোখে জেহফিলকে কাছে পাওয়ার কামনা ভেসে উঠছে। কতদিন আর এত সুদর্শন স্বামীর থেকে দূরে দূরে থাকবে? ইনানের কটি খুলে জেহফিল ছুঁরে ফেলে দেয় ফ্লোরে। ইনানের দুইপাশে হাত রেখে ধীরে ধীরে ইনানের তিরতির করে কাঁপতে থাকা ওষ্ঠের দিকে ধাবিত হয় সে। ইনান শক্ত করে জামা চেপে ধরে হাতের মুঠোয়। জেহফিলকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে ক্রমশ।
ঘোর লাগা চোখে জেহফিলের দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে নেয় ইনান। অপেক্ষা করে কাঙ্ক্ষিত মুহুর্তের জন্য। কিছুক্ষণের মাঝেই কাঙ্ক্ষিত জিনিসের ছোঁয়ার বদলে নরম তুলতুলে তোয়ালের ছোঁয়া পেতেই চমকে তাকায় ইনান। জেহফিল ইনানের চুল মুছে দিচ্ছে যত্ন সহকারে। তার চোখে দুশ্চিন্তা। ইনানকে বকা দেয়ার সুরে বলল,
‘এইজন্যই বলেছি বৃষ্টিতে ভিজবে না। দুষ্টু মেয়ে আমার কথা না শুনে না একদম। এখন তো ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছো না। আর যদি কোনোদিন বৃষ্টিতে ভিজেছো!’
ইনানকে বকতে বকতে জেহফিল ইনানের চুল মুছে দিতে লাগল। এদিকে জেহফিলের কথা শুনে ইনানের ঘোর ভেঙে গেল। সাথে রাগে দুঃখে কান্না পেল। জেহফিল এত অবুঝ কেন? সে কি বুঝেনি ইনানের কেন সব শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে? সে কি বুঝেনি ইনানের চোখে ভাষা? তার চোখের ভাষা কি এতটাই কঠিন?
জেহফিলের হাত থেকে তোয়ালেটা টান দিয়ে ছুঁড়ে মারল ফ্লোরে। জেহফিলের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে পা আছড়ে আছড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। অসভ্য লোকটা সারাদিন ইনানকে টিজ করবে আর এখন ইনানের ইঙ্গিত বুঝতে পারছে না?
ইনানকে চলে যেতে দেখে জেহফিলের অধরে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। ফ্লোর থেকে ইনানের কটি উঠিয়ে নাকের কাছে নিয়ে ইনানের ঘ্রাণ নিতে লাগল। বিড়বিড় করে বলল,
‘নিজ মুখে যেদিন আমাকে কাছে টানার কথা বলবে সেদিনই এই জেহফিল এহসান ধরা দেবে তোমার নিকট। একটাবার শুধু বলে দেখো বাটারফ্লাই…’ কটি থেকে গভীর শ্বাস টেনে নিল জেহফিল,
‘শুধু একটাবার… তারপর দেখবে এই জেহফিল তোমাকে প্রতিটা মুহুর্ত কীভাবে বেঁধে রাখে নিজের সাথে, প্রতিটা মুহুর্ত, অ্যান্ড ইটস আ প্রমিস।’
জেহফিলকে মনে মনে বকতে বকতে ইনান ওয়াশরুম থেকে বেরোলো। ফাজিল লোক, বদ লোক, বোকা লোক, গাধা.. ইনানের ভাণ্ডারে যত যত গালি আছে সব জেহফিলকে দিতে লাগল। শালার শালা, এত হাদা কেন হতে হবে একটা মানুষকে? হুহ! ইনান বেরোতেই তার পায়ের কাছে দেখে পিষে যাওয়া একটা কদমফুল। দলে মুচড়ে পিষে ভর্তা হয়ে দুই তিন ভাগ হয়ে পড়ে আছে বেচারা। রুমে ফুল আসলো কীভাবে? বোধহয় তার চুল থেকে পড়ে গেছে! ইনান ফুলটা ফেলে দিয়ে রুমে আসে।
জেহফিল মুচকি হেসে ইনানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইনানের ইচ্ছে করল দুইটা ঘুষি মেরে দেয় ঐ হাসি মুখটায়। হাদার ঘরের হাদা! ইনান ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায়।
‘এসো ঔষধ খেয়ে নাও।’
ইনান ঝাড়ি মেরে বলে, ‘আমার কিছু হয়নি যে ঔষধ খাওয়া লাগবে।’
‘হয়নি কে বলেছে? একটু আগেই তো শরীর গরম হয়ে জ্বর এসে গিয়েছিল।’
‘ওরে মাথামোটা। ওটা শরীরের জ্বরে না, মনের জ্বরে শরীর গরম হয়েছিল।’ ইনান মনে মনেই বলল। মুখে বলল, ‘ঔষধ খেতে ইচ্ছে করছে না, কিছু বানিয়ে খাওয়ান।’
‘কী খাবে?’
জেহফিলকে শায়েস্তা করার জন্য ইনানের যা যা খাবারের নাম মাথায় আসল সব বলে দিলো, ‘চিকেন ফ্রাই, চিংড়ি ভর্তা, চিংড়ির কাটলেট, মার্শম্যালো, খিচুড়ি, হট কফি, পাস্তা, ছানার সন্দেশ।’
ইনান থামল।
‘আর কিছু?’ জেহফিলের স্বাভাবিক গলা।
‘না, আপাতত এগুলোই, আর সবগুলো হোমমেড হতে হবে।’ ইনান আদেশের সুরে বলল। সে ভেবেছিল জেহফিল হয়তো প্রশ্ন করবে এই অসময়ে এত কিছু কেন খাবে। এসব তো বললোই না বরং সম্মান জানানোর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বলল,
‘জো হুকুম মাই প্রিন্সেস।’
এই বলে জেহফিল চলে গেল। ইনান মনে মনে ভাবল লোকটা কি সত্যিই এসব বানাবে নাকি? যাই হোক, এটা জেহফিলের শাস্তি ইনানকে বুঝতে না পারার। দেড় সপ্তাহের মতো ইনানের সাথে থাকছে আর সে ইনানকে বুঝতে পারল না? এবার ঠেলা সামলাও। হুহ!
ইনান বই নিয়ে বসে পড়ল। আপাতত বইয়ের মাঝে ডুব দেয়া যাক। তার মধ্যে টয়ার সাথে ফোনে কথা হলো একবার। টয়া শুধু রোবটের মতো বলল মুগ্ধ ভালো আছে শুধু কথা বলতে একটু সমস্যা হচ্ছে, আর ফারার রুমের দরজা এখনো বন্ধ। ব্যস এই খবর দিয়েই টয়া ফোন কেটে দিলো। ইনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবার সাথে কথা বলে ফোন অফ করে রেখে দিলো। কিচেন থেকে রান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে শুধু।
বই পড়তে পড়তে কখন রাত এগারোটা বেজে গেল খেয়াল নেই ইনানের। কিছু একটার আওয়াজে বই থেকে মুখ তুলে। তখন জেহফিলের কথা মনে পড়ল তার। এখন কী করছে দেখার উদ্দেশ্যে দরজা ফাঁকা করে উঁকি দিলো। কই জেহফিল? কোথাও তো নেই! ইনান দরজা খুলে ডাইনিংএ আসতেই দেখল টেবিলের উপরে সব খাবার সাজানো শুধু চিংড়ির আইটেমগুলো ছাড়া। বিস্ময়ে ইনানের মুখ হা হয়ে গেল। জেহফিল এসব বানিয়েছে? বিনা বাক্য ব্যয়ে?
টেবিলের উপর হলুদ রঙের একটা চিরকুট পাওয়া গেল। তাতে লেখা ‘বাজারে যাচ্ছি চিংড়ি আনতে। হট কফি খেয়ে ফেলো, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’ ইনান মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। লোকটা কি পাগল? এই রাত এগারোটায় চিংড়ি আনতে যাচ্ছে? বাইরে এখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। এই ঝড়ের মধ্যে জেহফিল বেরিয়ে পড়ল? ইনানকে একবার জানানো গেল না? জানালে তো ইনান জেহফিলকে বেরোতে দিত না। জেহফিলকে ফোন দিলো সে। ফোন বেজে উঠল ড্রয়িং রুমের কাউচে। মোবাইল রেখে গেছে সে। ইনান হতাশ ভঙ্গিতে মাথা পেছনে এলিয়ে দিলো,
‘ওহ গড। এই পাগল লোকটাকে আমার কপালে রাখলে কেন?’
জেহফিলের টেনশন করতে করতে ইনান টেবিলের উপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। গরম তেলের ছলকে ওঠার আওয়াজে ইনানের ঘুম ভাঙে। ধড়ফড় করে উঠে জেহফিলের খোঁজে। ঘড়িতে তখন রাত দুইটা। দেখতে পায় কিচেনে অ্যাপ্রোন পরনে জেহফিল তেলের মধ্যে চিংড়ির কাটলেট ছাড়ছে।
ইনান হন্তদন্ত হয়ে জেহফিলের কাছে যায়। চেঁচিয়ে উঠে বলে,
‘মাথা কি হাফ নষ্ট নাকি ফুল নষ্ট হয়েছে? এই ঝড়ের মধ্যে বেরিয়ে গেলেন কেন? যাওয়ার আগে একবার বলা যেত না আমাকে? বাজে লোক, খালি আমাকে টেনশন দেওয়া।’
জেহফিল ইনানের দিকে ফিরে ঠোঁট চোখা করে চুমু ছুঁড়ে দিলো। এই অসময়ে জেহফিলের মজা করাটা ইনানের রাগ বাড়িয়ে দিলো। জেহফিলের হাত থেকে খুন্তি কেড়ে নিতে চাইল সে,
‘রাখুন রান্নাবান্না। আর শেফ সাজা লাগবে না।’
‘আরে আরে, এটাই বাকি.. বেবি ওয়েট..’
জেহফিল খুন্তি না দিয়ে তেল থেকে কাটলেট উঠিয়ে বাটিতে রাখল। ইনানকে এক হাতে জড়িয়ে বাটি নিয়ে টেবিলে আসল।
ইনানকে চেয়ারে বসিয়ে সে টেবিলে এবং রুমের চারিধারে কতগুলো মোম জ্বালিয়ে লাইট নিভিয়ে দিলো। নরম আলোয় ছেয়ে গেল রুম। পাশের চেয়ার টেনে ইনানের পাশে এসে বসল জেহফিল। সাথে আনা কতগুলো গোলাপ টেবিলের উপর ফুলদানিতে রাখল। এখন একদম ডিনার ডেটের মতো লাগছে পুরোটা।
‘নাও, তোমার পছন্দের সব বানানো শেষ। কোনটা খাবে?’
ইনান হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে। জেহফিলের থেকে নিজের উপর বেশি রাগ লাগছে। জেহফিল ক্লান্ত চেহারাতেও কী সুন্দর হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। সব তার জন্য, সে কেন জেহফিলকে এই রাতের মধ্যে শাস্তি দিতে গেল। আর জেহফিল কেন সব মাথা পেতে নিলো? কেন বাঁধা দিলো না? এসব ভেবেই ইনান হুট করে জেহফিলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।
‘বাটারফ্লাই, কাঁদছো কেন? রান্না পছন্দ হয়নি?’
ইনান কান্না করতে করতে জবাব দিলো, ‘আপনি খুব খারাপ জেহফিল। চিংড়ি মাছ নেই বলে বাজার থেকে আনতে কে বলেছে? বৃষ্টির মধ্যে কেন বেরিয়ে গেলেন? গেলেন তো গেলেন মোবাইল নেননি কেন?’
জেহফিল ইনানের মুখ সামনে নিয়ে এসে চোখের জল আঙুল দিয়ে মুছে বলে, ‘মোবাইল নিলে তো তুমি আবার আদেশ করতে ফিরে আসার। তখন তো তোমার আদেশ ফেলে দিতে পারতাম না। আবার তোমার জন্য চিংড়ির ভর্তা, কাটলেটও বানাতে পারতাম না, তাই নেইনি।’
ইনান হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,
‘আপনি একটা পাগল।’
‘তোমার জন্যই তো!’ জেহফিল ইনানের নাক টেনে বলল।
‘এবার বলো কোনটা খাবে? কোনটা আগে সার্ভ করব প্রিন্সেস?’ জেহফিল নরম সুরে বলল।
ইনান টেবিলের দিকে তাকালো। সব কিছু সুন্দর করে সাজানো। সেই সন্ধ্যা থেকে জেহফিল এত কষ্ট করে এসব বানিয়েছে, শুধু তার জন্য। ভাবতেই ইনানের কান্না দ্বিগুণ হলো। সাথে জেহফিলের প্রতি সম্মান আর ভালোলাগাও দ্বিগুণ বেড়ে গেল।
জেহফিলের বানানো সবগুলো আইটেম ইনান খেল। সাথে জেহফিলকেও খাওয়ালো। নিজ হাতে। ইনান খাইয়ে দেওয়ার সময়ও জেহফিল বলল, ‘আমাকে কেউ কোনোদিন হাতে তুলে খাইয়ে দেয়নি বাটারফ্লাই।’
ইনানের কষ্ট লাগলো অনেক, কান্না আটকে বলল, ‘আপনার সাথে আর কী কী করা হয়নি বলুন তো! সব আমি করার চেষ্টা করবো।’
জেহফিল মৃদু হেসে বলল, ‘কেউ কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি।’
সাথে সাথেই ইনান জেহফিলের মসৃণ চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।
‘কেউ কখনো আমার অসুস্থতায় কাছে থাকেনি।’
‘এখন থেকে আমি থাকব।’
‘কেউ কখনো আমার সাথে মুভি দেখেনি।’
‘এখন থেকে আমি দেখব।’
‘কেউ কখনো পাশে থাকেনি।’
‘আমি থাকব।’
জেহফিল ইনানের কানের কাছে মুখ এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বলল,
‘আমাকে কেউ কখনো ভালোবাসেনি।’
মোমের ক্ষীণ আলোয় জেহফিলের হলুদ আভাযুক্ত ধূসর চোখে চোখ রেখে মোহগ্রস্তের ন্যায় ইনান বলল,
‘আমি বাসি তো।’
ইনানের জবাবে জেহফিল প্রশান্তির হাসি হাসল। আর ইনান নিজের জবাব কানে যেতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। সে নিজ থেকে কনফেস করেছে? জেহফিলের নিকট কনফেস করেছে? চোখ বড় বড় হয়ে হতবাক জেহফিলের দিকে চেয়ে থাকল ইনান। টনক নড়তেই হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। লজ্জায় ইনান কথা বলতেই ভুলে গেল। দৌঁড়ে নিজের রুমে এসে দরজা আটকে বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ল। কীভাবে কী হলো? সে কীভাবে নিজ থেকে জেহফিলের নিকট কনফেস করল? ইনান কান চেপে বসে রইল। নিজের কথাটা বার বার কানে বাজছে, “আমি বাসি তো।”
সে কখনো জেহফিলকে ভালোবাসার কথা মনে আনেনি, অথচ জেহফিল কী সুন্দর ইনানের মুখ থেকে ভালোবাসার কথাটা কৌশলে বের করে নিলো!! ইনান বুকে হাত দিয়েই ফ্লোরে শুয়ে পড়ল। বুক ধুকপুক করছে। যেন হার্ট বুক চিরে বেরিয়ে আসবে। কীভাবে কীভাবে এত কিছু হয়ে গেল? কীভাবে কীভাবে মনের ভেতর জেহফিল বসবাস করা আরম্ভ করল? ইনান লাজুক হাসতে হাসতে ফ্লোরেই গড়াগড়ি খেতে লাগল। হায়!! কী লজ্জা! আর কী সুন্দর কনফেশন!
.
.
চলবে…
[সবার মন্তব্য চাই।]