#রোদরঞ্জন
#পর্ব_১৯
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
বারান্দায় কাউচে হাঁটুর উপর মাথা রেখে বসে আছে ইনান। এখন গোধূলি। বিকেল থেকেই একই পোজে ইনানকে রোবটের মতো বসে থাকতে হয়েছে জেহফিলের কারণে। তিন হাত দূরত্বে জেহফিল রঙ তুলি হাতে বসে ইনানের ছবি আঁকছে। ইনানের কাছে মনে হয় জেহফিল ছবি আঁকা কম ইনানকে দেখছে বেশি। সেকেন্ডে সেকেন্ডে জেহফিল ইনানকে তীব্র চাহনিতে পরখ করছে, তার দৃষ্টি ঘোরা ফেরা করছে ইনানের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। লজ্জা, অস্বস্তি দুটোর সংমিশ্রণে ইনান কুঁকড়ে যাচ্ছে। শেষে না পেরে বিরক্ত নিয়ে বলল,
‘আর কতক্ষণ লাগবে?’
জেহফিল জবাব দেয় না। ইনানের কলারবোনের খাদে জেহফিল পলকহীন চেয়ে আছে। ইনান খেয়াল করে জেহফিলের হাতে থাকা তুলি ক্যানভাস থেকে দূরে স্থির হয়ে আছে। অধৈর্য হয়ে ইনান কাউচ ছেড়ে উঠে যায়। জেহফিলের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায় তার ভ্রু বেঁকে যায়। মুখে হালকা রাগের আভা পরিলক্ষিত হয়।
ইনান জেহফিলের কাছে এসে দেখে আর্ট আরো আগেই কমপ্লিট। তার মানে জেহফিল এতক্ষণ তাকে শুধু শুধু বসিয়ে রেখেছে। কিছুটা বিরক্ত হয় ইনান। যদিও তার পোর্ট্রেট আঁকাটা নিঃসন্দেহে সুন্দর হয়েছে, চিত্রতে সাদা ড্রেসে হাঁটুর উপর মাথা দিয়ে বসে থাকা ইনানকে ড্রিমি লাগছে, নিচে সুন্দর করে ছবির নাম লেখা ‘mi alma’। ইনানের উচিত মুগ্ধ হওয়া, হয়েছেও, তবে মুগ্ধর চেয়ে বিরক্তিটা বেশি প্রশ্রয় পেয়ে ইনানের মন বিষিয়ে দিয়েছে।
ক্লাসের কতগুলো পড়া বাকি, প্রজেক্ট বাকি, পড়া শেষে আবার ক্লে নিয়ে বসতে হবে। তাই শুধু শুধু এত সময় নষ্ট করায় ইনান কিছুটা মনঃক্ষুব্ধ হয়। সে তো সারাদিনই তাকে দেখে, চব্বিশ ঘন্টাই জেহফিলের চোখের সামনে থাকে, তাও জেহফিল ইনানের কাজ আছে জেনেও বসিয়ে রাখাটা ভালো লাগছে না, আঁকা শেষে বলতে পারত অন্তত! জেহফিলকে বকা দেয়ার আগেই তার মুখ বন্ধ হয়ে যায় জেহফিলের চেহারা দেখে, জেহফিল কী কারণে ঠিক রেগে আছে বুঝতে পারে না। ইদানীং জেহফিল কেমন হুটহাট মুখের ভঙ্গিমা পরিবর্তন করে, এই রাগ, এই ভালো, এই বিরক্ত। তবে ইনানের উপর কখনো রাগ ঝাড়েনি বা বিরক্তি নিয়ে কথাও বলেনি, তবুও ইনান জেহফিলের মাঝে কিছু পরিবর্তন টের পেয়েছে।
ইনান জেহফিলের কপালের ভাঁজ হাত দিয়ে সোজা করে দিয়ে বলল,
‘আর্ট সুন্দর হয়েছে। রুমে আসুন, অন্ধকার নেমে যাবে এখন।’
ইনান নিজেই ক্যানভাস আর রং গুছাতে লাগল, আড়চোখে জেহফিলকেও দেখে নিল, সে এখনো পাথর হয়েই বসে আছে।
ইনান রুমে চলে আসার আগে জেহফিলের চুলে হালকা করে হাত বুলিয়ে আসে।
.
রান্না বসিয়েছে জেহফিল। গোল গোল করে কাটা বেগুন তেলে ছেড়ে ইনানের দিকে বাঁকা চোখে চাইল, ইনান সোফায় বসে মোবাইল দেখছে আর হাসছে। জেহফিল মুখ কঠিন করে নিলো, সন্ধ্যায় কলেজের কিছু কাজ করার পরই মোবাইল নিয়ে বসে গেছে। জেহফিলের সামনে বসার জন্য ইনানের সময় হয় না অথচ সারাদিন মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকার সময় অনেক! সে কী করছিল? খালি একটু ইনানকে গভীরভাবে দেখছিল! ইনানের চোখের, ঠোঁটের, দেহের, নড়াচড়াই তো দেখছিল! তাতেই ইনানের বিরক্ত লেগে গেছে? এক মাসও হয়নি এতেই ইনান তার প্রতি ইন্টারেস্ট হারিয়েছে? আরো কয়েকদিন পর ইনানের কি জেহফিলকে ভালো লাগবে না? জেহফিলের থেকে দূরে সরতে চাইবে? এসব ভাবনা আসতেই কপালের রগ ফুলে উঠে। ভেতরটা দপদপ করে জ্বলতে থাকে।
জেহফিল ধীর পায়ে সোফার পেছনে এসে দাঁড়ায়। দেখতে চাইল ইনান কী দেখছে। ইনান মোবাইলে ফানি ভিডিও দেখে হাসছে, এমন টাইমে নোটিফিকেশন টুং করে বেজে উঠল। চোখ ছোট হয়ে গেল জেহফিলের, দেখল টয়া মেসেজ দিয়েছে। ইনান মেসেজে ক্লিক করবে এই সময়ে জেহফিল রুক্ষ গলায় ডেকে উঠল ইনানকে,
‘খেতে আসো।’
জেহফিলের আচমকা আওয়াজে ভয় পেয়ে যায় ইনান। ভয়ের চোটে হাত থেকে মোবাইল পড়ে যেতে যেতে বেঁচে যায়। বুকে হাত দিয়ে ইনান পেছন ফিরে, জেহফিল গম্ভীর গলায় বলে,
‘খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। উঠো!’
‘সুন্দর করে ডাকলেই তো হতো, এমন করার কী আছে? আজিব!’ ইনান বিড়বিড়িয়ে উঠে পড়ে।
খাবার টেবিলে গুছিয়ে ইনানের পাশে বসল জেহফিল। তাদের খাওয়ার মাঝখানে ইনানের ফোন বেজে উঠল তারস্বরে। ইনান মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল টয়া কল করেছে, কল ধরার জন্য সবুজ বাটনে আঙ্গুল রাখতেই জেহফিল ছোঁ মেরে মোবাইল নিয়ে যায়।
‘আরে…!!’
মোবাইলটা সাইলেন্ট করে নিজের পকেটে পুরে জেহফিল খাবারে মনোযোই দিলো,
‘খাওয়ার সময় কথা বলাটা ভদ্রতার কাতারে পড়ে না। ডোন্ট ইউ নো?’
ইনান কপাল কুঁচকে বলে, ‘আপনার কাছে এত ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে হবে কেন? আপনি তো বাইরের কেউ না! মোবাইলটা দিন। হয়তো জরুরী কল।’
জেহফিল এমন ভান করে খেতে লাগল যেন ইনানের কথা শুনেইনি।
‘আপনি কি আমার হাজব্যান্ড নাকি বাইরের মানুষ বলুন তো?’
‘খাবার শেষ করে কথা বলো।’ আদেশ করে জেহফিল।
এরপর আর একটা কথাও বলল না জেহফিল। ইনান ক্ষুব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। জেহফিল এই ধরনের আচরণ কেন করছে তার সাথে? যেন একজন কড়া টিচার পড়া না পারার জন্য স্টুডেন্টকে বকা দিচ্ছে।
ইনানের ফোন বেজে উঠল আবার, ইনানকে আড়াল করে জেহফিল দেখল ইনানের বাবা কল করেছে, এবার সে ফোন অফ করে দিলো।
জেহফিলের খাওয়া শেষ। ইনানকে একটু একটু করে খেতে দেখে জেহফিল বলল,
‘খাবার শেষ করলেই মোবাইল পাবে তার আগে না।’
এটা শুনে ইনান খাবারের প্লেট সরিয়ে দিলো।
‘খিদে নেই, খাবো না আর।’ ইনান চেয়ার ছেড়ে উঠতে নিলে জেহফিল ইনানের হাত চেপে বসিয়ে রাখে। থেমে থেমে বলল,
‘খাবারটা শেষ করতে বলেছি বাটারফ্লাই।’
জেহফিলের চোখের দিকে চায় ইনান। এখনকার বলা ‘বাটারফ্লাই’ শব্দে ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও পায়নি, পেয়েছে হুমকি এবং আদেশ। জেহফিলের চোখে কোনো ইমোশন খুঁজে পায়নি সে, অন্ধকার ছাড়া। ইনান ঢোক গিলে,
‘সত্যি ভালো লাগছে না খেতে।’
ছোট্ট শ্বাস ফেলে জেহফিল ইনানের প্লেট নিজের কাছে টেনে ইনানকে মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিলো,
‘খাবার নষ্ট করা আমি পছন্দ করি না।’
‘আপনি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছেন।’
জেহফিলের হাত থামে, ‘কেমন?’
‘কেমন গম্ভীর আর একটু রাগী।’
জেহফিল মনে মনে হাসে, সে তো আগে থেকেই গম্ভীর, রাগী… ছোটো থেকেই এমন। তার চরিত্রের সাথে হাসি ঠাট্টা, মনখোলা স্বভাব কোনোভাবেই যায় না। শুধু ইনানকে নিজের বশে আনতেই না একটু অ্যাক্টিং করেছে সে..
“মানিয়ে নিয়েই সংসার করতে হবে তোমার এই গম্ভীর জেহফিলের সাথেই, সারাজীবনের জন্য।” মনে মনে বলল সে।
.
খাবার শেষে ইনানকে মোবাইল দিয়ে দেয় জেহফিল। মোবাইল অন করতেই দেখল বাবার কল সাতটা। ইনান তা দেখে হন্তদন্ত হয়ে কল করে, ফোন ধরে তার বাড়ির পাশের মোহাম্মদ আঙ্কেল। ইনান হ্যালো বলতেই আঙ্কেলের কথা শুনে থমকে যায়। মুখের রং সরে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়। দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর হয়ে যায়। তার বাবা হসপিটালে!! জেহফিলকে ডেকে উঠল ইনান,
ফ্যাসফ্যাসে গলায়। জেহফিল তখন থালাবাসন পরিষ্কার করছিল। ইনানের অস্বাভাবিক ডাক শুনে কাজ রেখে তার কাছে চলে আসে।
ইনানের গালে হাত রেখে চিন্তিত হয়ে বলল,
‘এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?’
ইনান কিছুই বলতে পারল না, তার হাতে থাকা মোবাইল কাঁপছে। জেহফিল মোবাইল হাতে নিয়ে কথা বলে। ইনানের বাবা হঠাৎই হার্ট অ্যাটাক করেছে। এখন তাকে হসপিটালাইজ করা হয়েছে।
জেহফিল ফোন কেটে ইনানের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নির্দিষ্ট ঠিকানায় চলে যায়।
.
ইনানের কান্না থামছে না। এসেছে ধরে এক নাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে। ইফাজ খানের অবস্থা এখন ঠিকঠাক। ওনার আগে থেকেই হার্ট প্রবলেম ছিল।
ইনান মাথায় হাত রেখে শব্দ করে কাঁদছে। ইনানের চোখের পানি দেখতে জেহফিলের অসহ্য লাগছে। তার বাবার জন্য কান্না করাটা ভালো লাগছে না একদম। ইনান কাঁদবে তার জন্য, ইনানের জীবন এখন জেহফিলকে নিয়ে, চোখের পানি ফেলবেও তার জন্য, অন্য কারো জন্য ইনানের চোখের পানি জেহফিলের রাগ বাড়িয়ে দেয়। ইফাজ তো আর ম’রে যায়নি! এত কান্নার কী আছে?
‘কান্না করো না সোনা। সব তো ঠিক হয়ে গেছে এখন। তোমার বাবা ঠিক আছেন।’ জেহফিল ইনানের পিঠে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে।
ইনানকে সান্ত্বনা দিতে মন চাইছে না। মন চাইছে ইনানের গাল চেপে চোখের পানি মুছে দিয়ে ধমক দিতে।
ইফাজ খান মেয়েকে কাছে ডাকলেন,
‘মামনি খুব ভয় পেয়েছ? কাঁদছ কেন? বাবা ঠিক আছি আম্মু।’
ইনান বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ইফাজ মেয়েকে বুঝিয়ে শান্ত করলেন এক ঘন্টা পর।
জেহফিল এবং ইফাজ খান পরামর্শ করেছে ইফাজকে ইউএসএ পাঠিয়ে দেয়া হবে ইনানের ফুফির বাসায়। ইনানের ফুফিও ভাইয়ের খবর শুনে ইফাজকে যাওয়ার তাড়া দিচ্ছেন। যেহেতু তিনি জানেন ইনানের বিয়ে হয়েছে এবং বরও ভালো সেহেতু ইফাজকে তার কাছে নিয়ে আসতে সমস্যা হবে না।
জেহফিলই বেশি তোড়জোড় করে সব কাজ করল ইফাজকে পাঠানোর। এতে তার অবশ্যই সুবিধা আছে। ইনান এবার আর ‘বাবার কাছে যাবো’ বলে ঘ্যানঘ্যান করতে পারবে না, এখন থেকে চোখের সামনে থাকবে সবসময়।
ইফাজকে ইউএসএ পাঠিয়ে ইনান স্বস্তি পেল। এখন আর তার বাবা একা নেই। ফুফির পরিবারের কাছে থেকে একটু একাকিত্ব ঘুঁচবে।
.
এই কয়েকদিনের ব্যস্ততায় ইনানের ভার্সিটিতেও যাওয়া হয়নি, জেহফিলের সাথে একাডেমিতেও যাওয়া হয়নি। এবার ফ্রি ইনান। বাবাও সুস্থ কিছুটা। এবার কাজে মন দিতে পারবে।
ইনান আজ যাবে শরৎএর বাসায়। হুট করেই ঠিক হয়েছে। মুগ্ধ আর টয়া এসেছে কলেজে। ওরাই ইনানকে জোর করল যাওয়ার। ইনানও শরৎএর সাথে কিছু কথা বলবে বলে রাজি হলো। তাই ক্লাস বাঙ্ক দিয়েই তারা রওনা হলো শরৎএর বাড়ি। জেহফিল ইনানকে নিতে আসবে দুপুরে, কলেজ থেকে আবার যাবে অ্যাকাডেমিতে। ইনান দুপুরে জেহফিল আসার আগেই কলেজে চলে আসবে। যেহেতু জেহফিল আগেই বারণ করেছে শরৎএর সাথে কথা না বলতে তাই ইনান শরৎএর বাড়ি যাওয়াটা জেহফিলের কাছে চেপে যাবে। সে অবশ্য শরৎএর সাথে বন্ধুত্ব গড়তে যাচ্ছে না। যাবে শরৎএর থেকে সত্যিটা জানতে, আর একটা চড় মেরে আসতে।
শরৎএর রুমে সবাই বসে আছে। শরৎ খাটে, সে এখন হাঁটতে পারে, বাম পায়ে একটু টেনে টেনে হাঁটা লাগে। বাকি সবাই চেয়ারে, সোফায়। মুগ্ধ কথা বলতে পারে এখন, যদিও হাত আর গলার রডের ছাপ যায়নি। এখনো কালচে দাগ রয়ে গেছে। ফারা আসেনি, সে কারো সাথেই যোগাযোগ করে না। বন্ধুরাও তাকে আর ঘাটায়নি। বেচারি চুল, ভ্রু, আইল্যাশ হারিয়ে কতটা দুঃখে দিন কাটাচ্ছে তা মেয়েরা আন্দাজ করতে পারছে।
টয়ার মনটাও একটু খারাপ, যেহেতু তার বোন তোয়াও অসুস্থ। সবার জীবন হঠাৎ ঝড় এসে ওলোটপালোট করে দিলো যে হোঁচট খেয়ে উঠতেও সময় লাগছে।
‘তুই অবশেষে আসলি ইনান! আমাকে কি দেখতে ইচ্ছে করেনি তোর একবারও?’ কণ্ঠে তীব্র অভিমান প্রকাশ পেল শরৎএর।
ইনান বিরক্ত হয়, ‘কথা ক্লিয়ার করতে এসেছি। তোর সাথে আন্ডার আলাপ করতে আসিনি আমি।’
কিছুটা ব্যথিত হয় শরৎ, ‘ওহ, তো কী কথা বল।’
‘পরে, আগে তোরা বাকিরা নিজেদের শোকের কথা বলে উঠ এখান থেকে, তারপর আলাদা কথা বলব তোর সাথে।’
শরৎ পারে না এক্ষুনি সবাইকে উঠিয়ে দেয়। শুধু টয়ার মন খারাপ দেখে কিছু বলল না। কিন্তু মুগ্ধ কথা বাড়ানোর আগে বলে উঠল,
‘এভাবে কথা বলা যায় না। তোরা আগে ক্লিয়ার হ, তারপর সব কথা হবে।’
শরৎ আর ইনান বারান্দায় চলে যায়। শরৎএর বারান্দায় বাহারী ফুলের সমারোহ। বেশিভাগই বিদেশী জাতের। ইনানের সাথে যদি শরৎএর ফ্রেন্ডশিপ সুন্দর থাকলে ইনান কিছু গাছ নিজের জন্য নিয়ে যেত।
‘বল কী বলবি?’
ইনান ভণিতা না করে সরাসরি পয়েন্টে চলে গেল, ‘তুই ঐদিন আমাকে ধাক্কা দিয়েছিস কেন?’
শরৎ অবাক হয়, ‘কবে? কোনদিন? কীসের ধাক্কা দেয়ার কথা বলছিস?’
‘নাটক করবি না শরৎ। সাইক্লিং যেদিন করেছি সেদিনের কথা বলি।’
শরৎএর মনে পড়ে, ‘ওহ, ঐদিন? আমি কেন তোকে ধাক্কা দিতে যাব?’
‘তুই আমার পিছনে ছিলি না? আমাকে নিতে আসার জন্য তুই সব ফ্রেন্ডদের ভাগিয়ে আমার পিছু নিয়েছিলি না?’
শরৎ স্বীকার করে, ‘হ্যাঁ। তারপর তুই জলাশয়ে পড়ে যাস।’
‘তুই আমাকে ধাক্কা দিয়েছিলি।’
‘তোর মাথা, আমি তোকে ভয় দেখানোর জন্য তোর পেছনে ছিলাম, তার আগেই তুই পা পিছলে পড়ে যাস।’
‘তাহলে তুই আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলি না কেন?’
‘শোন, তুই পড়ে যাওয়ার পর তোকে উঠানোর চেষ্টা করি। কিন্তু জলাশয়টা এত গভীরে ছিল যে আমিই পড়ে যেতে নিচ্ছিলাম। তারপর বাকিদের কল দেই বাট নেট ছিল না। তাই আবার ফিরে যাই রাস্তায়, পরে কাউকেই পাই না, রাস্তায় র্যান্ডম দুজন মানুষকে নিয়ে আসি, বাট তখন তোকে আর দেখতে পাইনি।’
‘তাহলে পরে আর খোঁজ নেসনি কেন? একবারও তো ফোন দিয়ে খোঁজ নিলি না? ইভেন বাকিরাও জানে না যে আমি খাদে পড়ে গেছি।’
‘কারণ তারপর আমি নিজেই কিছু ঝামেলায় পড়ি আর আমার এই অবস্থা হয়। পরে যখন শুনি তুই বাড়িতে আছিস, সুস্থ আছিস তাই আর কাউকে এই কথা বলিনি টেনশন করবে বলে।’
ইনান চুপ থাকে, শরৎএর কথা বিশ্বাস হচ্ছে না কেন যেন। তবে আর ঘাটালোও না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। ইনান শুধু শরৎএর মুখ থেকে শুনতে চেয়েছে কাহিনী। আর এখন থেকে শরৎকে এড়িয়ে চলবে, ফ্রেন্ডরা সবাই কেমন বদলে গেছে। তাই এদের সঙ্গ ছেড়ে দেয়াই শ্রেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘যাই হোক, আমি আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত, তাই এখন আর তোদের সাথে আড্ডা দিতে পারছি না।’
‘আঙ্কেলের অসুস্থতা নিয়ে টেনশন করছিস?’
‘হুম।’ ইনান ঘড়ি দেখল, ‘আচ্ছা আমি গেলাম, আমি আবার ক্লে নিয়ে কাজ করছি। যেতে হবে, বায়।’
ইনান চলে গেল। শরৎ শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এতক্ষণ বুকের মধ্যে যেন ভারী পাথর চাপা ছিল। ভাগ্যিস মিথ্যে কথা বলতে গিয়ে গলা কাঁপেনি। শরৎএর উদ্দেশ্য ছিল ইনানের সম্ভ্রমহানি করার, কিন্তু ইনান পড়ে যাওয়ার পর সে ভয় পায়, আবার খুশিও হয় প্রতিশোধ নেয়ার আগেই ইনানের মরণাপন্ন অবস্থা দেখে। তাই ইনানকে ফেলে রেখেই চলে আসে। আর এতক্ষণ ইনানের সামনে ভদ্র সাজার অ্যাক্টিংটাও দারুণ হয়েছে, ইনান ধরতেও পারেনি। শরৎ নিজেকে বাহবা দিলো, বোনের অভিনয়ের যোগ্যতা নিজের মধ্যে ধারণ করতে পেরেছে বলে।
ড্রয়িং রুমে এসে ইনানের পা থেমে যায় রুহির ডাকে। ফিরে তাকায় ইনান, রুহি মাত্র শুটিং থেকে এসেছে। এখনো জামা ছাড়েনি। ইনান হাসার চেষ্টা করল,
‘কিছু বলবে আপু?’
রুহি ইনানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল। মেয়েটা খারাপ না, সুন্দরই আছে। শরৎ কয়েকবার ইনানের ছবি দেখিয়েছিল, ভেবেছিল শরৎ ইনানকে পছন্দ করে। কিন্তু এখন আর মনে হয় না শরৎ আসলেই ইনানকে পছন্দ করে, ইনানের বাবা শরৎকে মা’রার পর ইনানের প্রতি শরৎএর ঘৃণা জন্মেছে।
‘পলককে চিনো?’
অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে ইনান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়।
‘সরি?’
‘পলক, ইন্সপেক্টর পলক মাহমুদ।’
ইনান মাথা ঝাঁকায়, ‘চিনি, বাবার সাথে কয়েকবার দেখেছি।’
‘তোমাদের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে?’
ইনান থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। রুহির সাথে তার সম্পর্ক গভীর না একদমই। হাই হ্যালো, কেমন আছো, এটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই তার পার্সোনাল ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করাটা ঝটকা লাগার মতোই, পলক আর তার মধ্যে সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক।
ইনানকে চুপ থাকতে দেখে রুহি বলল, ‘না মানে, পলক ফোন করেছিল তোমার খবর জানতে।’
ইনান চমকায়। পলক আবার কী ঝামেলা পাকাবে কে জানে? বাবা বোধহয় বলেনি ইনানের বিয়ের কথা। নাহ! পলককে বলতে হবে তার বিয়ে হয়ে গেছে। শুধু পলক না, সবাইকেই বলে দিবে। ফ্রেন্ডদের মাঝে এই ধরনের বাজি ধরা হয়ই। তাই বলে তার জীবনে ঘটে যাওয়া বড় একটা ব্যাপার ধামাচাপা দেয়ার কারণ নেই। আসলেই ইনান বন্ধুদের পঁচানির ভয়ে চুপ থেকে ইম্যাচিওরিটির প্রমাণ দিয়েছে। তবে এখন আর সে এই বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিশবে না, সার্কেল থেকে বেরিয়ে যাবে। তাই এদের বলা আর না বলা দুটোই সমান। কিন্তু রুহিকে বলবে। রুহির থেকে নিশ্চয়ই পলক শুনবে। ইনান মুখ খুলল বলার জন্য। তার আগে তাকে থামিয়ে রুহি বলল,
‘আবার তুমি ভেবো না আমার আর পলকের মধ্যে সম্পর্ক আছে, আমি ওর এক্স ছিলাম, এখন আর নেই। এখন হয়তো তোমার…।’
‘আমি কি জানতে চেয়েছি?’ ইনান রুহির কথা মাঝপথে কেটে বলল।
রুহির মুখ ঝুলে গেল ভাবনাতীত অপমানে। ইনান তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটালো ঠোঁটের কোণায়,
‘পলকের সাথে আমার না কোনো সম্পর্ক আছে, আর না ভবিষ্যতে থাকবে। আমি হালাল বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছি ইতোমধ্যে। আমারই ভুল বিষয়টা গোপন রেখেছি বলে। জানিয়ে দিবেন আপনার এক্সকে।’
রুহি যেভাবে ইনানকে পা থেকে মাথা অবধি দেখেছিল, ঠিক সেভাবেই ইনান রুহিকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।
.
বাহিরে নিঝুম বর্ষণ। রুমের বাতি নেভানো। জেহফিল ইনানের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। একটু পর পর ইনানের পেটে নাক ঘষছে। ইনান জেহফিলের চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙ্গুল বুলাচ্ছে।
‘জান!’
‘হুম।’
‘আমাকে এখনো কোনো নিকনেম দিচ্ছ না কেন?’
ইনান জেহফিলের দিকে বিভ্রান্ত চাহনি নিয়ে তাকায়। জেহফিল মাথা উঠিয়ে ইনানের মুখের কাছে উঠে আসে। গলায় ছোট ছোট চুমু দিতে দিতে বলে,
‘আমি তোমাকে কত নামে ডাকছি, তুমিও আমাকে স্পেসিফিক কিছু নামে ডাকো।’
‘আপনাকে নাম ধরে ডাকতে বারণ করছেন?’
‘না, তা কেন হবে? নাম ধরে অবশ্যই ডাকবে, বাট যখন আমরা একা থাকি তখন আদর করে কিছু নামে ডাকতেও তো পারো।’
ইনান হাসল। জেহফিলের অন্য রূপ দেখছে সে। জেহফিল ইনানের হাসি দেখে টুপ করে হাসিটা বন্ধ করে দিলো। জেহফিলকে সরিয়ে দিয়ে ইনান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘আপনি একটা রাক্ষস। ঠোঁট ছিঁড়ে ফেলেছেন একদম। আপনার নিকনেম এখন থেকে রাক্ষস।’
জেহফিল আবারও হামলে পড়ল ইনানের ওষ্ঠাধরে। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘যতবার রাক্ষস বলবে ততবার এভাবেই ঠোঁট কামড়ে দিবো।’
ইনান চোখ বড় বড় করে তাকায়। জেহফিল ইনানের নাকে নাক ঘষে বলল,
‘বলো, রাক্ষস বলে ডাকবে আর?’
ইনান দুদিকে নেতিবাচক মাথা নাড়ায়।
‘দ্যাটস মাই গুড গার্ল।’
তাদের খুনসুটির মাঝে ইনানের ফোন বেজে উঠে। ইনান ফোন ধরার আগেই জেহফিল ফোন কেড়ে নেয়। কল কেটে দিয়ে মোবাইল ছুঁড়ে মারে ডিভানে। ইনানকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরল জেহফিল, ইনানের তনু দেহ দুইহাতে পেঁচিয়ে ধরে উন্মত্ত গলায় বলল,
‘রোমান্সে ডিস্টার্ব করাটা আমি পছন্দ করি না।’
.
.
চলবে…