#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৩
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
আধবোজা চোখে ইনান দেখল জেহফিল টেবিলে বসে কিছু একটা করছে, ঘোলা চোখে ভালো করে দেখতে পারল না, শুধু টেবিল ল্যাম্পের আলোর সামনে খালি শরীরে বসে থাকা জেহফিলের থেকে কাগজে খসখসানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বারান্দা থেকে আসা ঠান্ডা বাতাসে ঘুম আরও জেঁকে বসলে গায়ে থাকা জেহফিলের শার্ট শরীরে জড়িয়ে ঘুমে ডুব দিলো আবার।
.
গলায় আর বুকে ঠাণ্ডা পানির ফোঁটা পড়তেই ইনানের ঘুম ভেঙে গেল। আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরতেই দেখল শুধু তোয়ালে জড়ানো জেহফিল ইনানের উপর ঝুঁকে বসে আছে। তার ভেজা চুল থেকে টুপটুপ করে পানির ফোঁটা ইনানের উষ্ণ শরীরকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। ইনানকে চোখ খুলতে দেখে জেহফিল স্মিত হাসে। ইনান মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে থাকে জেহফিলের নজর কাড়া হাসিতে। জেহফিল ইনানের নাকা নাক ঘষে আলতো গলায় বলে,
‘বেবি, এগারোটা বাজে, ঘুম থেকে উঠবে না?’
এত সময় ইনান ঘুমিয়েছে ভাবতেই হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে। আজ আর ভার্সিটি যাওয়া হলো না।
জেহফিল ইনানকে কোলে তুলে নিলো। লজ্জায় ইনানের মরি মরি অবস্থা। তার পরনে শুধু জেহফিলের শার্ট। সেটাও কোলে তোলার কারণে বার বার উরু থেকে পিছলে পড়ে যাচ্ছে। ইনানকে ওয়াশরুমে দাঁড় করিয়ে কোমর চেপে ঘাড়ে চুমু খেল জেহফিল। শীতল ঠোঁটের পরশ ঘাড় ছুঁতেই মৃদু কেঁপে উঠল ইনান। কপালে চুমু দিয়ে বলল,
‘যাও, গোসল সেরে আসো। তোমার প্রিয় ব্রেকফাস্ট রেডি করছি।’
.
চুল মুছতে মুছতে ইনান কিচেনে আসলো। দেখল জেহফিল তোয়ালে জড়িয়েই প্যানকেক বানাচ্ছে। শুধু পরনে অ্যাপ্রোন। অ্যাপ্রোনটা জেহফিলের শরীরকে পুরোপুরি আয়ত্ব করতে পারছে না। জেহফিলের পেশিবহুল বাহু, শক্ত কাঁধ, অ্যাডামস অ্যাপল ইনানকে চুম্বকের ন্যায় টানছে। জেহফিল নিজেও জানে না খালি গায়ে অ্যাপ্রোন পরনে জেহফিলকে কতটা আবেদনময় লাগছে।
‘হ্যালো বেবিগার্ল!’
ইনানের ধ্যান ছুটে জেহফিলের গাঢ় কণ্ঠে। ডাইনিংএ গিয়ে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,
‘এমন উদোম হয়ে রান্না করছেন কেন? কেমন দেখায়?’
‘হট লাগছে তাই না?’ মিটিমিটি হেসে উত্তর দেয়।
পানি খেতে গিয়ে বিষম খায় ইনান, তোতলিয়ে বলে,
‘কীসব আজেবাজে কথা!’
‘আজেবাজে কাজ করতে ভালো লাগে অথচ কথা বললেই দোষ?’ নিষ্পাপ গলা জেহফিলের।
ইনানের কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে থাকে। জেহফিলের মুখ এত লাগামহীন কেন? জেহফিল ইনানের লাজুক, অস্বস্তিকর চেহারা দেখে কাছে এসে বাঁকা হেসে বলল,
‘তুমি কাল রাতে এত ওয়াইল্ড…’
জেহফিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইনান জেহফিলের মুখে প্যানকেক ঢুকিয়ে দিলো, শাসানোর স্বরে বলল,
‘আরেকটা কথা যদি মুখ দিয়ে বের করেছেন তো.. তো আপনার একদিন আর আমার দশদিন।’
জেহফিল আরামে প্যানকেক খেতে খেতে ভাবুক গলায় বলল,
‘হুমম, তোমার দশদিনই লাগবে আমাকে ক্লান্ত করতে, আর আমার মাত্র একদি..আউচ বাটারফ্লাই!’
ইনান জেহফিলের নাক বরাবর ঘুষি দিলো, জোরেই, রাগত স্বরে বলল,
‘বেশরমা, অসভ্য, মুখে বন্ধ হয় না কেন আপনার?’
জেহফিল নাক ডলতে ডলতে বলল, ‘এভাবে বন্ধ না করে কিস দিয়ে তো বন্ধ করতে পারতে, এত আনরোমান্টিক কেন তুমি? যত রোমান্টিকতা সব খালি আমিই করি।’
সকালটা কেটে গেল দুজনের খুনসুটিতে। জেহফিলকে আগের মতো দুষ্টুমি করতে দেখে ইনান সম্পূর্ণ ভুলে গেল গতকাল ভোরের জেহফিলের ভয়ানক রূপের কথা।
.
অ্যাকাডেমীর দোতলার ভবনটা মাঠের একদম কোণায়। গাছ পালা ঘিরে আছে ভবনটাকে। এইখানের সিঁড়িঘরটা কেউ ব্যবহার করে না। অন্ধকার সিঁড়ির মধ্যে তাজবীর বসে আছে। কয়েক সেকেন্ড পরপর তার দু ঠোঁটের ফাঁক থেকে ঘোলাটে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হচ্ছে। তাজবীর চোখ ছোটো ছোটো করে সামনের ভবনের নিচ তলায় তাকিয়ে আছে। তার টিমের সদস্যরা প্রজেক্টের স্ট্যাচু ঠিক করছে। আর তাদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে জেহফিল। জেহফিল থাকার কারণেই তাজবীর আর জয়েন করেনি ওদের সাথে।
জেহফিলের প্রতি মনে মনে রাগ পুষে রেখেছে তাজবীর। তার এই রাগকে ফ্রেন্ডরা বলে হিংসা। আসলেই কি হিংসা নাকি?
জেহফিলকে দেখতে না পারার কারণ ছিল একটি। তাকে ক্লাসের মধ্যে কঠিন অপমান করাটা। তবে পরবর্তীতে আরও কারণ খুঁজে বের করেছে, যদিও জেহফিল তাজবীরকে ততটা পাত্তাও দিত না। ক্লাসের অপমানটা ধীরে ধীরে রূপ নেয় ভয়ঙ্কর আকারে। জেহফিলের সব কাজ তার বিরক্ত লাগত এরপর থেকে, ইভেন জেহফিলকেই বিরক্ত লাগত। জেহফিলের সাকসেস, বিভিন্ন এক্সিবিশনে জেহফিলের আর্টওয়ার্ক প্রেজেন্টেশন, দেশে বিদেশে ওর সুনাম, এগুলো তাজবীরকে ভেতরে ভেতরে দাবানলে জ্বালায়। জেহফিল তাজবীরের প্রায় সমবয়সীই, সে যতটুকু জানে জেহফিল মাস্টার্সে বর্তমানে পড়ত যদি না পড়ালেখা ছাড়ত। আর তাজবীর মাস্টার্স ফাইনাল দিয়েছে। সেই হিসেবে জেহফিল তাজবীরের কিছুটা ছোটো হবে বোধহয়।
তাই তার ছোটো কেউ তাকে ক্লাসের মাঝে অপমান করে, তাও আবার রাগ দেখিয়ে, ধমক দিয়ে, কঠিন গলায়- এই ব্যাপারটা খুব ইগোতে লেগেছে তাজবীরের। তার উপর জেহফিলের সাফল্য তাজবীরের জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে। এসব ভাবতে ভাবতে কপালের রগ ফুলে উঠেছে তার। আধ খাওয়া সিগারেটটা পায়ে পিষে উঠে দাঁড়ায়।
কোমরে এক হাত আর মাথায় এক হাত দিয়ে চুল চেপে ধরে। তাজবীরের সারা জীবনেও তাকে কেউ ফুলের টোকাও পর্যন্ত দেয়নি, ধমক দিয়ে কথা বলা তো দূরে থাক। এমনকি তার বাবা মাও কখনো তার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেনি। সব সময় আদরের মাঝে বড় হওয়া তাজবীরের সবার সামনে অপমানিত হওয়াটা; তাও আবার ছোটো কারো কাছে; ব্যাপারটা সহজে হজমযোগ্য নয়। জেহফিলকে কোনো শাস্তি দিতে পারলে তার মন শান্ত হতো। কিন্তু জেহফিলকে শাস্তি দেয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সে।
ভাবনায় মশগুল থাকা তাজবীর এলোমেলো পায়ের করিডোরে হাঁটছিল। তখন ইনান সিঁড়ি থেকে দৌঁড়ে উপরে উঠে মোড় ঘুরতেই কাউকে সামনে দেখে। আচমকা কেউ সামনে আসায় তাজবীর দুইহাত সামনে বাড়ায় মানুষটি যাতে পড়ে না যায়। কিন্তু ইনান নিজেকে রক্ষার জন্য ফাস্ট ছিল, তাজবীর ধরার আগেই সে নিজের গতির ব্রেক কষে। তাজবীরের আর তার মাঝের ব্যবধান পাঁচ ইঞ্চি মাত্র।
‘পাগলের মতো ঘুরাঘুরি করে রাস্তা আটকে রেখেছেন কেন? এক্ষুনি তো পড়ে যেতাম।’
ত্যক্ত বিরক্ত ইনান তাজবীরকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যায় আবার। তাজবীর হতভম্ব চোখে ইনানের চলে যাওয়া দেখে। আজব মেয়ে একটা।
ইনান নিচে জেহফিলের কাছে যায়। তার ক্লাস শেষ। বসে থাকতে ভালো লাগছিল না বিধায় জেহফিলের কাজ দেখার চলে এসেছে।
জেহফিল গম্ভীর গলায় সবাইকে ডিরেকশন দিচ্ছে। আর ইনান জেহফিলের পেছনে এসে তার কাজ পর্যবেক্ষণ করছে। জেহফিল খেয়াল করেনি যে ইনান তার পেছনে দাঁড়িয়ে। স্ট্যাচুটা দেখতে এত সুন্দর লাগছিল যে ইনানের ঠোঁট দুটো বিস্ময়ে ফাঁকা হয়ে গেছে। এক রমণীর শরীর দুই টুকরো কাপড় দিয়ে ঢাকা, পা শিকল দিয়ে বাঁধা, তার চোখে অশ্রু, ঠোঁট দুটো যেন এখনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করে উঠবে। এতটা করুণ দৃশ্য!
ইনান বেখেয়ালি পায়ে হেঁটে গেল মূর্তির কাছে। মূর্তির শিকল বাঁধা পায়ে হাত দেয়া মাত্রই কারো কর্কশ কণ্ঠের চিৎকার শুনে চমকে উঠে সে।
সবার নজর যায় ইনানের দিকে। ইনান তাকায় তার উপর চিৎকার করা মেয়েলী কণ্ঠের মালকিনের দিকে। টিয়া ধমকে বলল,
‘এই মেয়ে, এটা ধরলে কেন? চোখ কি আকাশে রেখে হাঁটো নাকি? দেখোনা মাটি এখনো শুকা…’
‘জাস্ট শাট ইউর মাউথ মিস টিয়া।’
টিয়া চুপসে যায় জেহফিলের ধমকে, চুপসানো গলায় বলল,
‘স্যার মেয়েটা স্ট্যাচুর পায়ের দিকটা টাচ করেছে, এতে শেপ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’
‘হয়েছে?’
টিয়া বুঝলো না। বিভ্রান্ত নিয়ে চাইল জেহফিলের দিকে, ‘সরি স্যার?’
‘শেপ কি নষ্ট হয়েছে?’ গাম্ভীর্য নিয়ে বলল।
টিয়া মূর্তিটার যেদিক ইনান ছুঁয়েছে, সেখানে দৃষ্টিপাত করল। ইনান হালকা করে ছুঁয়েছে যার কারণে কোনো দাগই পড়েনি, টিয়া মাথা দুদিক নেড়ে নিচু গলায় বলল,
‘না স্যার। বাট হতো যদি..’
জেহফিল হাত উঠিয়ে থামিয়ে দেয়, ‘হতো এবং হয়েছে- এর মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। সিক্সের বই দেখে পার্থক্যটা পড়ে নিবেন।’
টিয়াকে অপমান করার ধরণটা দেখে না চাইতেও বাকিদের হাসি চলে আসে। মুখ টিপে তারা হাসতে থাকে।
জেহফিল কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইনানের পানে চাইল। তার বাটারফ্লাইয়ের উপর টিয়ার গলা চড়িয়ে কথা বলার সাহস দেখে জেহফিলের রক্ত টগবগ করে উঠে। ইনানের সন্নিকটে গিয়ে তার হাত ধরে মূর্তির পা ছুঁয়িয়ে দেয়।
‘যেখানেই টাচ করতে মন চাইবে, ধরবে, কারো পারমিশনের প্রয়োজন নেই।’
ছোঁয়ার পর ইনানের হাত ধরে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। তার আগে পেছনে ফিরে টিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আগামীকাল আপনার হোমওয়ার্ক হচ্ছে ক্লাস সিক্সের বই জোগাড় করে টেন্সের স্ট্রাকচার মুখস্থ করবেন, সবার সামনে দাঁড়িয়ে টেন্সের ডেফিনেশন বলবেন, যদি না পারেন তাহলে পুরো স্ট্যাচুর দায়িত্ব আপনার নিতে হবে।’
অপমানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে টিয়া। তার ফ্রেন্ডরা মুখ চেপে হাসলে আকাশ যে কিনা নতুন জয়েন করেছে সে হো হো করে হেসে উঠল। দামড়া একটা মেয়েকে এই ধরনের শাস্তি দেয়ার চেয়ে অপমানজনক আর কিছু হয় না।
জেহফিল ইনানের হাত ধরে চলে গেল। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় ইনান বলল,
‘এই ধরনের শাস্তি না দিলেও পারতেন জেহফিল। মেয়েটা কত লজ্জা পেয়েছে।’
জেহফিল ইনানের ঠোঁট চেপে বলল,
‘তোমার উপর কেউ ঝারি মেরে কথা বলবে আর আমি চুপ করে থাকব?’
‘ঝারি মারল কোথায়? মেয়েটা চিন্তিত ছিল তাই এমন করে বলেছে, এটা স্বাভাবিক। আমিও হলে এভাবেই ডাক দিতাম।’
জেহফিল ইনানের গাল চেপে ধরে, হালকা করে,
‘সোনা, তোমার কাছে স্বাভাবিক হলেও এসব মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তোমার উপর চিৎকার করে কথা বলা হোক কিংবা আদর করে কথা বলা হোক, সবকিছুর অধিকার শুধু আমার।’
‘জেহফিল..’
‘শশশহ, কোনো কথা না। মাথা গরম আছে, কিস করো তো।’
ইনানের চোখ বড় বড় হয়ে যায়, ‘পারবো না।’
জেহফিল ইনানকে সেই অন্ধকার সিঁড়ি ঘরে টেনে ধরে, ‘বাটারফ্লাই, তোমাকে যখন যা করতে বলব সেটাই করবে, বিপরীতে একটা কথাও যেন তোমার এই সুন্দর মুখ দিয়ে না বের হয়।’
‘যদি না করি?’
‘ফল খারাপ হবে।’
ইনান জেহফিলের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে,
‘ছাড়ুন এখন, পাবলিক প্লেসে এসব কী?’
‘এখানে কেউ আসবে না, চুপ থাকো।’
এই বলে জেহফিল ইনানের ওষ্ঠাধর আয়ত্বে নিয়ে নেয়।
সিঁড়ি ঘরের উপরে থাকা তাজবীর সবটাই লক্ষ্য করল, দেয়ালে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আপনমনে স্বগোতক্তি করল,
‘ইন্টারেস্টিং।’
.
.
চলবে…
[অতিরিক্ত পর্বটা কাল দিবো, ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে]