#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৬
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
ইনান বিধ্বস্ত। তার আর পুতুলের মাঝে কোনো পার্থক্য খুঁজে পায় না সে। এই পুতুলের জীবন ইনান দমবন্ধ করে দিয়েছে। সে খুব ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জেহফিল থেকে কিছুদিন দূরে থাকার। এমনি এমনি তো এই ধরনের সিদ্ধান্ত কোনো স্ত্রী নেয় না তাই না? ইনানও এমনি এমনি নেয়নি। তার লাইফ হেল জেহফিল নামক বিষাক্ত পুরুষটা।
কাল যখন একাডেমি থেকে ফিরছিল তখন ইনান গাড়ির জানালা খুলে আনমনেই বাইরে দৃষ্টিপাত করেছিল। শীতল আবহাওয়া উপভোগে ব্যাঘাত ঘটায় জেহফিল। কথা নেই বার্তা নেই জানালার কালো কাঁচ উঠিয়ে দেয়। ইনান জেহফিলের দিকে তাকানো মাত্রই ভড়কে গেল। ক্ষুব্ধ চোখে জেহফিল তাকে দেখছে।
‘খুব ভালো লাগে তাই না?’
ইনান বোকা বনে গেল। জেহফিলের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না।
‘কী ভালো লাগবে?’
‘পরপুরুষকে দেখতে? ঐ ছেলের দিকে এভাবে তাকিয়েছিলে কেন? আমার থেকেও বেশি সুদর্শন তাই?’
ইনান স্তম্ভিত। কীসের ছেলে, কোন ছেলে, আল্লাহই ভালো জানে!! ইনান সেই উদ্দেশ্যে আবারো বাইরে নজর দেয়। মাথা ঘুরানোর আগেই জেহফিল ইনানের ঘাড় ধরে ফেলে। শক্ত করে ধরে ইনানকে নিজের দিকে ফেরায়।
‘আবারও ঐ ছেলের দিকে নজর দিচ্ছ কেন? আমাকে এখন আর ভালো লাগে না?’
‘আজব কথাবার্তা! কোন ছেলেকে আমি দেখছিলাম? আমার চোখ, আমিই জানি না?’
‘মিথ্যে বলবে না বাটারফ্লাই। আমি স্পষ্ট দেখেছি তুমি ঐ ছেলেটার দিকে তাকিয়েছিলে।’
জেহফিলের বারবার এক কথা বলায় ইনান এতই বিরক্ত হলো যে বলল,
‘ভালো হয়েছে দেখেছি, তো কী হয়েছে? ঐ ছেলেকে গিয়ে কি আমি চুমু খেয়েছি? না ও’কে হাত দিয়ে কাছে ডেকেছি? সামান্য চোখ যেতেই পারে পথচারীদের উপর! এতে রিয়েক্ট করার কী আছে?’
জেহফিলের শরীর রাগে কাঁপতে লাগল যখন তার মস্তিষ্কে এক কুৎসিত দৃশ্য ভেসে উঠল। তার বাটারফ্লাই ঐ ছেলেটাকে চুমু দেয়ার দৃশ্য। ইনান কীভাবে এই কথাটা বলতে পারল? বলার সময় নিশ্চয়ই ঐ ছেলের কথা ইনানের মাথায় ঘুরছিল! ঐ ছেলেটাকে চুমু… নাহ! জেহফিল আর ভাবতে পারল না। রাগে কম্পিত হাতে ইনানের ঘাড় ছেড়ে দিলো ঝাড়ি মেরে। তারপর গাড়ি চালাল হাইস্পিডে যে ইনানের আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। হাজার বারণ সত্ত্বেও জেহফিল স্পিড কমায়নি। পুরোটা সময় ইনান জান হাতের মুঠোয় রেখে এসেছিল।
বাড়ির সামনে আসতেই জেহফিল ক্ষিপ্রবেগে ইনানের হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে উপরের তলায় নিয়ে আসে। ইনানের আকুতি তার কানে যায়নি। ইনানকে নিয়ে খাটের উপর বসায়,
‘ছাড়ুন, হাতে লাগছে।’
জেহফিল ছাড়ল না। ইনানকে খাটে রেখেই সে হঠাৎ ক্লজেট থেকে কিছু জামা কাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকল। ওয়াশরুমের দরজা আটকানোর সময় কী মনে করে আবার বেরিয়ে আসলো। এসে ইনানের কোমর ধরে নরম খাটের উপর ছুঁড়ে মারে। ইনানের উপর উঠে বসে তার গা থেকে ওড়নাটা টান দিয়ে নিয়ে ইনানের দুই হাত মাথার কাছে নিয়ে হেডবোর্ডের সাথে বেঁধে দেয়। ইনান ভয় পেয়ে যায়। জেহফিল যদিও তার স্বামী, তাও জেহফিলের জোরজবরদস্তি তার ভালো লাগে না। পূর্বের নম্র, নিষ্পাপ, দুষ্টু জেহফিলকে সে ভালোবেসেছিল, এই ক্রোধান্বিত, উন্মাদ, পাগল জেহফিলকে নয়।
কিন্তু ইনানের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে জেহফিল ইনানের উপর থেকে সরে গেল। সোজা চলে গেল ওয়াশরুমে। বেরিয়ে আসলো বর্তমান পরিহিত জামাকাপড় বদলে। এখন পরনে তার গ্রে শার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স। হাতে দামী ঘড়িটা পরল। ঘাড় অবধি লম্বা চুলগুলোর উপরিভাগ পেছনে নিয়ে ঝুঁটি করল। শার্টের উপরের তিনটা বোতাম খুলে, শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে ইনানের কাছে এসে দাঁড়াল।
জেহফিলকে এত গরম লাগছিল যে ইনান সত্যিই বিমুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। বিশেষ করে চুলগুলো পেছনের দিকে ঝুঁটি করায় আর শার্টের হাতা গুটানোয় তাকে হট চকলেট বয় বললেও ভুল হবে না। পুরাই মাখন! উষ্ণ বালক!
‘লুক অ্যাট মি বেবিগার্ল।’ জেহফিল প্রগাঢ় শ্বাস নিয়ে বলল।
ইনান তো হা করে চেয়েই ছিল। প্রায় দুর্বল হয়ে পড়েছিল, কিন্তু সেই দুর্বলতা কেটে গেল যখন জেহফিল চকলেট বয় থেকে ব্যাড বয়ে রূপান্তর হলো।
‘এখন ভালো করে দেখে বলো, সেই ছেলেটার থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে না আমাকে?’
ইনান মুখ থুবড়ে পড়ল যেন। জেহফিলের উপর ক্ষণ সময়ের জন্য জন্ম নেওয়া মুগ্ধতা কেটে গেল নিমিষেই।
‘মানে?’
‘ঐ ছেলেটাও গ্রে শার্ট আর ব্ল্যাক প্যান্ট পরেছিল। উপরের তিনটা বোতাম খোলা ছিল। আমিও তেমনভাবে পরেছি। এখন বলো, কে বেশি হট? আমি না ঐ জানোয়ার?’
ইনান নির্বাক। কর্কশ গলায় বলল,
‘হাতের বাঁধন খুলুন।’
‘ডোন্ট অর্ডার মি।’ জেহফিলের কড়া কণ্ঠ।
‘আপনাকে অর্ডার করছি না, বলছি এসব পাগলামি বাদ দিয়ে আমার হাতের বাঁধন খুলুন।’
‘আমার এসব পাগলামি মনে হয় তাই না?’ জেহফিল কেমন অদ্ভুত গলায় বলল, ‘তাহলে পাগলামির চূড়ান্ত ধাপটা অতিক্রম করি না হয়?’
ইনান নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে রইল। কিছু একটা ঠিক লাগছে না। মনে হচ্ছে জেহফিল কোনো অঘটন ঘটাবে। ইনানের ভাবনা শেষ হতে দেরি জেহফিলের অঘটন ঘটাতে দেরি নেই। সে এসে ইনানের হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে বেঁধে দিলো। তারপর ক্লজেট থেকে সবকয়টি জামা কাপড় বের করল।
সেই রাতে ইনান ঘুমাতে পারল না। জেহফিল প্রতিটা ড্রেসে নতুন লুকে ইনানের সামনে আসলো। যত শার্ট, প্যান্ট, কোট, টিশার্ট, স্যুট টাই, যা ছিল সব পরে পরে ইনানের সামনে র্যাম্পওয়াক করতে লাগল। আর বারবার এক কথা জপ করতে লাগল, “আমাকে সুন্দর লাগছে?” “হ্যান্ডসাম লাগছে?” “ঐ ছেলের থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম আমি?” “এটা কেমন?” “বাটারফ্লাই?”
ইনানকে ঘুমাতে দিলো না জেহফিল। ইনান চোখ বন্ধ করলেই তার বাঁধন আরো টাইট করত জেহফিল। যার কারণে ঘুমাতে ভয় পেত ইনান। না জেহফিল নিজে ঘুমালো সারা রাত, না ইনানকে ঘুমাতে দিলো। জেহফিলের প্রত্যেকটা লুকে ইনান ফিদা হতো যদি না তার সাথে জেহফিলের নরমাল সম্পর্ক থাকত, কিন্তু জেহফিল যে নিজ হাতে ঐ রিলেশনটা শেষ করেছে…
.
.
তারপর থেকে আরো বেশি চেঞ্জড জেহফিল। আগে যেখানে রোজ বাবার সাথে ফোনে কথা বলতো, সেখানে সপ্তাহে তিনদিন চারমিনিট করে কথা বলার সুযোগ পায়। তাও জেহফিলের সামনে, লাউড স্পিকারে। আর কিছুদিন পর দেখা যাবে সপ্তাহে একদিন একমিনিট করে কথা বলতে দিবে। ইনান কীভাবে থাকতে পারবে বাবার সাথে কথা না বলে?
ইনান ছটফট করত জেহফিলের হাতের মুঠোয় থেকে। সারাক্ষণ জেহফিলের চোখের সামনে থাকতে হতো। গোসলও করতে হতো জেহফিলের সাথে, কিংবা দরজা খুলে। একাডেমিতে যাওয়া হতো সপ্তাহে একদিন। কলেজে তো যাওয়া হতোই না। বাকি দিনগুলো জেহফিল ইনানের সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। ঘুমের থেকে উঠে জেহফিল ইনানকে পাশে না পেলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলত। অস্থির হয়ে ইনানকে ডাকতে থাকবে যতক্ষণ না ইনান সামনে এসে ধরা দেয়। বলতে গেলে একটা সেকেন্ডও ইনান নিজেকে দেয়ার সময় পায় না। একটু নিজে একা থেকে কিছু ভাববে সেই স্বাধীনতাও তার নেই। বারান্দায় গেলে জেহফিলও তার পিছু পিছু চলে আসে। রান্নাঘরে গেলেও সুরসুর করে চলে আসে। ইনান দম ফেলার সুযোগ পায় না। দম নিতে না নিতেই জেহফিল হাজির। ইনানের মনে হয় জেহফিল মুখে না বললেও মনে মনে বলে,
“আমাকে না বলে শ্বাস নিয়েছ কেন সোনা?”
ইনান আতঙ্কে থাকে পুরোটা সময়। কখন না জানি সত্যি সত্যি জেহফিল তার নাক চেপে ধরে শ্বাস নেয়ার জন্য।
ইনান আর্টরুমে বসে পটারির কাজ করে আর জেহফিল তাকে দেখিয়ে দেয়। কাজের সময় জেহফিল একদম প্রফেশনাল। কোনো ফাঁকি দেয় না, ইনানকেও দিতে দেয় না। ইনানের সামনে বসে কড়ায় গন্ডায় কাজ উসুল করে। এই দিকটা ভালো দেখে তো বাকি খারাপ দিকগুলো এড়িয়ে যাওয়া যায় না, তাই না?
কাজের সময়টুকু ছাড়া ইনান যখন নিজের বানানো কোনো জিনিসকে খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করে, কিংবা সারাদিন মুগ্ধ হয়ে সেই জিনিসটার প্রতি চেয়ে থাকে, জেহফিল সেটাকে টুকরো টুকরো করে দেয়। যেমন, জেহফিল একটা মগ বানিয়েছিল, খুব সুন্দর, লতানো ফুলের। ইনানের মগটা এত ভালো লেগেছিল যে সে সারাটাক্ষণ হাতে নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। সেটা জেহফিল সহ্য করতে পারেনি। মগটা নিয়ে বারান্দা থেকে নিচে এমন জোরে আছাড় মারল যে মগের টুকরো অংশগুলোও দেখা গেল না।
জেহফিল তখন ইনানের কাঁধ ঝাঁকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘আমি বলেছি না কোনো কিছুতে অতিরিক্ত আকৃষ্ট হবে না আমি ছাড়া? কথা কানে যায় না কেন?’
.
আবার জেহফিল ইনানকে কোথাও কোলাহলপূর্ণ জায়গায় নিয়ে যায় না। মেলা হয়, মেলাতেও না। তার মানুষজন বিরক্ত লাগে। জেহফিল মানুষ দেখলেই কেমন নাক সিঁটকায়। ইনানকে নিয়ে যাবে নদীর কাছে, তাও অসময়ে। আবার রাস্তার পাশের ফুচকা, চটপটির দোকান থেকে কিছুই খেতে দেয় না। বলে, এগুলো অস্বাস্থ্যকর। তাই জেহফিল নিজেই ঘরে বানিয়ে দেয়। তবুও, ঘরের আর বাইরের ফুচকার মধ্যে তফাৎ আছে অনেক।
জেহফিল ঘোরার জন্য যেই জায়গাটা সবচেয়ে বেশি প্রেফার করে তা হচ্ছে জঙ্গল। তার নাকি জঙ্গল সবচেয়ে শান্তির জায়গা মনে হয়। নিরিবিলি, নির্জন। বাড়ির পেছনের জঙ্গলে একবার নিয়ে গিয়েছিল। ইনান এত ভয় পেয়েছিল যে সারাটা সময় জেহফিলের হাত জড়িয়ে ধরেছিল। অথচ জেহফিলের চোখের তারায় ঝিকমিক করছিল আনন্দ, যেটা দেখে ইনান আরও বেশি ভয় পেয়েছিল।
.
.
‘আই নিড স্পেস জেহফিল।’
জেহফিল তার নিউ স্কাল্পচারের জন্য পেস্ট তৈরি করছিল।গভীর মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে ইনানের বলা বাক্যটি কর্ণকুহরে প্রবেশ করায়। মসৃণ কপালে ভাঁজ ফেলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইনানের দিকে তাকায়,
‘হোয়াট ডিড ইউ সে?’ হাতের কাজ ফেলে উঠে দাঁড়ায়।
ইনান জেহফিলের চোখে চোখ রাখে। দৃঢ় গলায় বলে,
‘আই নিড স্পেস জেহফি..’
ইনানের কথা শেষ হবার আগেই জেহফিল ইনানের গাল চেপে ধরে পেস্ট হাতেই। গরম চোখে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
‘শুনিনি, আবার বলো কী বললে?’
ইনান ঢের বুঝতে পারল জেহফিলের হুমকি। ইনান বুকে সাহস সঞ্চয় করল। জেহফিলের শক্ত আঙুল তার গাল চেপে ধরায় মুখ নাড়াতে কষ্ট হচ্ছিল। ইনানের কাছে স্পষ্ট যে জেহফিল তাকে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে না।
ইনান জেহফিলের হাত সরালো।
‘যদি কথাটা আবার না শুনতে চান তাহলে আমাকে ফ্রিডম দিন।’
‘আমি তোমাকে ফ্রিডম দেই না?’ জেহফিল অবাক গলায় বলল, ‘কোন ব্যাপারে ফ্রিডম দেই না?’
‘অনেক ব্যাপারেই। তবে আমার আপাতত বাবার সাথে কথা বলার ফ্রিডম লাগবে।’
‘ইউ অলরেডি হ্যাভ দ্যাট।’
‘না, কথা বলার সময় আপনি কাছে থাকবেন না।’
‘সরি। পারব না।’ জেহফিলের তৎক্ষণাৎ জবাব।
‘তাহলে আমাকে স্পেস দিন।’
‘তাও পারব না।’
ইনান চোখ বন্ধ করে ম্লান গলায় বলল, ‘আমি ক্লান্ত আপনার আচরণে, আপনার ব্যাবহারে, আপনার ভালোবাসায়। আমি আর এই লাইফ লিড করতে পারছি না। এই জীবন আমার জন্য নয়। আমি এভাবে বন্দী থাকতে পারছি না। আই নিড ফ্রিডম। সোজা কথায় বলতে গেলে, আমার ডিভোর্স চাই।’
ইনান চোখ খুলল। জেহফিলের দিকে চাইতেই আঁতকে উঠল সে। জেহফিল রাগে গর্জন করছে, ঘাড় কাত করে তার দিকে হিংস্র চোখে চেয়ে আছে।
.
.
চলবে…
(কী শাস্তি চান ইনানের জন্য?)
গল্প একদিন পরপর দেই আমি।