রোদরঞ্জন #পর্ব_১৪ #আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

0
212

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_১৪
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

রোদের মিষ্টি আলো ইনানের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। ধীর গতিতে চোখ খুলে ইনান। চোখের পাতা কেমন ভারী ভারী লাগছে, শরীরও অচলাবস্থা। হেডবোর্ড ধরে উঠে বসে সে। কাল সারারাত কান্নার ফলে এখন মাথা ধরে গেছে। ঘড়িতে এখন সকাল সাড়ে নয়টা। সাদা কালো মেঘ আকাশে বিদ্যমান, তার মাঝে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। ধরণীতে ধেয়ে আসা হলুদ আলো কিছুক্ষণ পর কালো মেঘেদের কারণে রূপ নিবে বারিধারায়।

ইনান আজ ভার্সিটি যাবে। ফ্রেন্ডদের মুখোমুখি হবে, শরৎএর মুখোশও খুলবে সেই সাথে। ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে চলে আসল। জেহফিলকে কোথাও দেখতে পারছে না সে, তার পায়ের কাছেও আজ ঘুমোয়নি। সচরাচর জেহফিল এত দেরিতে ঘুম থেকে উঠে না। জেহফিল একজন মর্নিং বার্ড, তবে আজ কোথায়?

ইনান জেহফিলের রুমে কয়েকবার নক করল, সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খুলে দেখল রুমটা ফাঁকা। জেহফিলের থাকার জায়গা আর একটাই, তা হচ্ছে তার আর্ট রুম। রুমটা সবার শেষে। লম্বা করিডোর পেরিয়ে যেতে হয়। করিডোরে রুম দুইটা, ইনান কখনোই কোনো রুমে প্রবেশ করেনি অবশ্য, তাই বলতে পারবে না রুমের অবস্থা। আর এই করিডোর‌ রাত হোক দিন হোক সবসময় অন্ধকার লেগে থাকবেই।

ইনান যখন রুমের দরজাটা খুলতে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই ওপাশ থেকে দরজাটা খুলে জেহফিল ইনানের সামনে চলে আসল। আচমকা ঘটনায় ইনান প্রায় ভয় পেয়ে পিছু হটে গিয়েছিল। বুকে থুতু দিয়ে জেহফিলের দিকে তাকাল।‌ চুল উস্কখুস্ক, ধূসর চোখজোড়া সবসময়ের মতোই শুন্য। গত রাতের শার্ট এখনো পরনে, কয়েকটা বোতাম খোলা। না চাইতেও ইনানের অবাধ্য চোখ জেহফিলের ব্যায়াম করা শরীরের ভাঁজে গিয়ে পড়ছে।

‘মর্নিং বাটারফ্লাই।’ জেহফিল হেসে বলল, তবে ইনানের মনে হলো সেই হাসিটা জেহফিলের চোখ ছুঁতে পায়নি।‌

‘মর্নিং। ডিস্টার্ব করলাম?’

‘আমি কখনোই তোমার ডাকে ডিস্টার্ব হই না বাটারফ্লাই, আর না কখনো হবো‌।’ জেহফিল স্মিত হাসল, এবারও তার হাসি চোখে পৌঁছাল না, চোখ দুটো নির্লিপ্ত।

ইনান জেহফিলের নিরাবেগ চোখে কিছু একটা খুঁজতে লাগল, কিন্তু জেহফিলের চোখের অতলে ব্লাক হোল ছাড়া কিছুই দেখল না। জেহফিলের চোখের ভাষাটাকে সবচেয়ে কঠিন ভাষা মনে হলো।‌

জেহফিল ইনানের হাত ধরে করিডোর থেকে বেরিয়ে আসল।

‘সরি বেবি, ব্রেকফাস্ট রেডি করতে পারলাম না বলে, তুমি দশ মিনিট ওয়েট করো, কুইক কিছু বানাচ্ছি।’

ইনান রুমে গেল না, জেহফিলের সাথেই রান্নাঘরে চলে আসল জোর করে। জেহফিল অনেকবার বারণ করল কিন্তু ইনান কানেই তুলল না।

ইনান যখন ব্রেড টোস্টারে দিচ্ছিল জেহফিল তখন দক্ষ হাতে অ্যাভোকাডো কাটছিল। স্কিল্ড শেফদের মতো সেকেন্ডের মাঝেই অ্যাভোকাডোটি চিকন চিকন পিসে পরিণত হলো। ইনান আড়চোখে জেহফিলের কাজ দেখছিল‌। একটা সত্যি কথা যা সে নিজেও অস্বীকার করতে পারবে না, তা হলো সে জেহফিলের কাজকে মনে মনে হিংসে করে। সে মেয়ে হয়েও ঘর ঝাড়ু দিয়েই টায়ার্ড হয়ে যায় আর সেখানে জেহফিলের ছোট থেকেই পড়াশোনা, আর্নিং, রান্নাবান্না, ঘরের কাজ সামলানো দেখে ইনানের হিংসেই হচ্ছে বৈকি। সারাদিন তিড়িং বিড়িং করা ছাড়া তো তার আর কোনো কাজ নেই।

নাহ! এসব হিংসে করে লাভ নেই। সে এখন আর বাচ্চা নেই। জেহফিলকে তার সাহায্য করা প্রয়োজন। একা একটা ছেলে আর কত করবে? এখন সংসারটা তারও। সে পায়ের উপর পা তুলে আদেশ করবে আর জেহফিল খেটে মরবে তা তো হয় না। বাহিরের মানুষ শুনলে ছি ছি করবে।

হুট করে সে জেহফিলের হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নিলো। দ্রুত গলায় বলল,

‘আমি‌ কাটছি, আপনি গিয়ে রেস্ট নিন।’

‘পারবে না তুমি। দাও আমাকে।’

জেহফিলকে ঠেলে সরিয়ে দিলো ইনান, ‘পারব, দুই মিনিট লাগবে। সরুন আপনি।’

‘জেদ করো না সোনা, হাত কাটবে।’

‘আমি বাচ্চা না।’

ইনান আনাড়ি হাতে অ্যাভোকাডো কাটতে লাগল আর জেহফিল বুকের উপর হাত ভাঁজ করে ইনানের কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগল। অ্যাভোকাডোর অর্ধেক কাটতে গিয়ে ইনান চার মিনিট ব্যয় করল, তাও সাইজের কোনো ছিড়ি নেই, একটা মোটা সাইজ আরেকটা চিকন, যেইখানে জেহফিলের সবগুলো সমান। তাও ইনান হাল ছাড়ল না।

ইনানের জেদ দেখে জেহফিল ছোট্ট শ্বাস ফেলে তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। ইনানের ঘাড়ে চিবুক রেখে দুহাতে ছুরি সমেত ইনানের হাত ধরে। ইনানের হাত থমকে গেল। জেহফিলের হুট করে এত কাছে আসাতে হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে তার। জেহফিল ইনানের হাত ধরে নির্দেশনা দিচ্ছে কীভাবে কাটতে হয়, কিন্তু ইনানের কি সেই খেয়াল আছে? জেহফিলের বুকে ইনানের পিঠ ঠেকানো, তার পারফিউমের ঘ্রাণে মাতাল হয়ে পড়ে যাবে যাবে অবস্থা ইনানের। জেহফিলের উষ্ণ নিঃশ্বাস, শরীরের ঘ্রাণ তাকে পাগল করে দিচ্ছে যেন। ইনানকে আর মাতোয়ারা হতে না দিয়ে জেহফিল ইনানকে ছেড়ে সরে গেল। এটা ইনানের ভালো লাগলো না মোটেই, সে জেহফিলের বাহুডোরে আরো কিছুক্ষণ বন্দী থাকতে চেয়েছিল। তাকিয়ে দেখল কাটাকুটি শেষ, তাই জেহফিল চলে গিয়েছে। ইনানের ইচ্ছে করছিল জেহফিলকে ডেকে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ওর ঘ্রাণ নেয়।

জেহফিল ইনানকে উস্কে দিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে হেসে ডাইনিংএ চলে আসলো। ইনান দৌঁড়ে আসল জেহফিলের পেছন পেছন। জেহফিলের হাত ধরে থামাল। জেহফিল ভনিতা করে বলল,

‘কিছু বলবে?’

জেহফিলকে এবার সত্যিই সত্যি অবাক করে দিয়ে ইনান বলল, ‘সরি।’

‘ফর হোয়াট?’

ইনান প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল, ‘আপনাকে নিয়ে আমার মজা করা উচিত হয়নি। আমি আমার এবং ফ্রেন্ডদের তরফ থেকে ক্ষমা চাইছি।’

জেহফিল বিরক্ত হলো কিছুটা। ইনানের কাছ থেকে অন্যকিছু আশা করেছিল, কিন্তু তার ফ্রেন্ডদের হয়ে সরি বলাটা জেহফিলের মেজাজ গরম করে দিলো। মেজাজ সংযত রেখে বলল,

‘আমি এসব ছোটোখাটো ব্যাপারে মাথা ঘামাই না। তুমি কি এতক্ষণ এসবই চিন্তা করেছিলে?’

ইনান মাথা উপর নিচ দুলিয়ে বলল, ‘আসলে কালকে আপনি ওভাবে কথাটা বললেন তাই ভেবেছি রাগ করে আছেন আমার উপর।’

জেহফিল গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। ইনানের গাল হাতের আঁজলায় নিয়ে সফ্ট কণ্ঠে বলল,

‘আমি তোমাকে না, তোমার ফ্রেন্ডদের বলেছি। তোমার কোনো ফ্রেন্ডকেই আমি বিশ্বাস করিনা। ইভেন আশেপাশের কাউকেই না।’

‘আমাকেও না?’

জেহফিল ঝুঁকে এসে ইনানের মুখে ফু দিয়ে ছোট ছোট চুল সরাল, ক্ষীণ গলায় বলল,

‘তুমি যদি আমাকে বিষ দিয়ে বলো এটা চকলেট, আমি চোখ বন্ধ করে খেয়ে ফেলব- এতটা বিশ্বাস করি তোমাকে বাটারফ্লাই।’

জেহফিলের এই কথায় ইনানের শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। হৃদকম্পন সৃষ্টি হয়। অপলক চেয়ে থাকে জেহফিলের চোখের দিকে। জেহফিল তাকে এতটা বিশ্বাস করে, এতটা ভালোবাসে, তার বিনিময়ে কি জেহফিলের কিছু পাওয়ার কথা না? সেটা না দিলে যে ইনান দায়গ্রস্ত থেকে যাবে সারাজীবন।

জেহফিলকে দ্বিতীয়বারের মতো অবাক করে দিয়ে ইনান জড়িয়ে ধরল তাকে। শক্ত করে। জেহফিলের প্রথমে বিশ্বাস হলো না ইনান তাকে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরেছে কিনা, যখন ইনানের কোমল হাত জেহফিলের পিঠকে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করল তখন তার বিশ্বাস হলো যে এটা আসলেই সত্য, কল্পনা না। জেহফিল ইনানকে ধরল না প্রথমে। যখন ইনান জেহফিলের বুকে মিশে শক্ত করে ধরল, জেহফিল বুঝে গেল ইনান চাইছে তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য। দেরি না করে জেহফিল জড়িয়ে ধরল ইনানকে। ইনানের থেকেও দ্বিগুণ জোরে চেপে ধরে।

ইনানের দম বন্ধ হয়ে আসছিল, কিন্তু জেহফিলকে সরাল না। জেহফিল এই খুশিটুকু উপভোগ করুক। জেহফিলের বুকে মাথা রেখে শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল ইনান।

প্রায় অনেকক্ষণ কেটে গেল এভাবে। জেহফিলকে ছাড়ার জন্য ইনান যখন হাত আলগা করল তখন জেহফিল ফিসফিস করে বলল,

‘বাটারফ্লাই।’

‘হুম?’

‘আমাকে কেউ কখনো জড়িয়ে ধরেনি। কয়েক মিনিট আগেও ওয়ার্ম হাগ কী সেটা আমি জানতাম না।’

ইনান বিস্মিত চোখে চায়। জেহফিলের এই পঁচিশ ছাব্বিশ বছরেও কেউ তাকে জড়িয়ে ধরেনি এটা আসলেই অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার।

‘সিরিয়াসলি?’

‘হ্যাঁ। আমার জীবনে এত গভীর স্নেহে জড়িয়ে ধরা মানুষ তুমিই প্রথম এবং তুমিই শেষ। আমার জীবনে আর কেউ না আসুক, লাগবে না কাউকে আর, শুধু তুমি থাকলেই চলবে।’

জেহফিলের কথাটা শুনে ইনানের যতটা মায়া লাগল ততটা কষ্টও লাগল। ঘাড় উঁচু করে জেহফিলের দিকে চেয়ে বলল,

‘একা বসবাস করাটা অনেক টাফ তাই না?’

‘ছিল, এখন আর নেই। এখন তুমি আছো না? তুমি থাকতে একাকীত্ব কিসের?’ ইনানের গালে আঙ্গুল বুলিয়ে বলল জেহফিল।

জেহফিলের হৃদয়স্পর্শী কথায় ইনানের চোখ টলমল করতে লাগল। আবারও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল জেহফিলকে, উষ্ণ বাঁধনে। এই মানুষটা এখন তার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। তার একটু কাছে থাকাটা জেহফিলকে সবচেয়ে বেশি খুশি রাখে। এই সামান্য কাজটা ইনান করতে না পারলে তো আসলেই সে সেলফিশ হয়ে যাবে।

.

.

খাবার শেষ করে ইনান রেডি হতে লাগল ভার্সিটির জন্য। জেহফিলকে কিচেনে দেখে সে বলল,

‘ভার্সিটি যাবেন না?’

‘নাহ, ছেড়ে দিয়েছি।’ প্লেটগুলো তাকে রেখে বলল।

‘কীহ! কেন?’ ইনান ব্যাগ রেখে জেহফিলের কাছে আসল।

টিস্যু দিয়ে হাত মুছে জেহফিল ইনানের দিকে ফিরল,

‘আমার যেটুকু পড়ার দরকার ছিল সেটুকুর চাইতেও বেশি পড়েছি। আর লাগবে না পড়ালেখা। এখন আমি ফুল টাইম আর্টিস্ট।’

‘কিন্তু সার্টিফিকেট তো অর্জন করা লাগবে তাই না?’

কিচেন কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়াল জেহফিল, ইনানের চোখে চোখ রেখে বলল,

‘কিসের জন্য? আমি তো আর কোনো চাকরি বা বিজনেসে ঢুকছি না যে সার্টিফিকেট দরকার হবে। যেটা আমার কখনো কোনো কাজে লাগবে না সেটা অর্জন করে কী লাভ? নরমালি একজন চাকরিজীবীর বাৎসরিক যা বেতন তা আমি আমার দুইটা পেইন্টিংয়েই আর্ন করে ফেলতে পারি। যেটা করতে আমার ইচ্ছে নেই তারচেয়ে ভালো নয় কি যেটায় আমার লাভ এবং ইচ্ছে দুটোই আছে, সেটা করার?’

জেহফিলের যুক্তিসঙ্গত কথার কাছে ইনান কোনো কথা খুঁজে পেল না। জেহফিল যা বলছে তা জেহফিলের দিক থেকে আসলেই সঠিক। তার অলরেডি একটা ক্যারিয়ার আছে, তাহলে অবশ্যই তার উচিত সেটায় বেশি ফোকাস করা। ইনান মাথা নাড়াল। জেহফিলের সাথে সে একমত।

‘তুমি ভার্সিটি যাবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘দুই মিনিট অপেক্ষা করো, রেডি হয়ে আসছি।’

‘আমি যেতে পারব।’

‘তোমাকে একা ছাড়ছি না আমি।’

জেহফিল চট করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল ইনানকে নিয়ে।

.

ইনান ক্লাসে যেতে যেতে বারবার ফোন দেখতে লাগল।‌ ফারা বা মুগ্ধর কোনো কল এসেছে কিনা দেখতে। গ্রুপেও কোনো ম্যাসেজ আসল না, ব্যাপারটা কী?

ক্লাসে যেতেই দেখল পুরো ক্লাসে কোলাহল। তারা সবাই কিছু একটা নিয়ে দলে দলে ভাগ হয়ে আলোচনা করছে। কারো চোখে আতঙ্ক, কারো চোখে উত্তেজনা।

ইনান ক্লাসের একজনকে বলল, ‘কী হয়েছে রে? কী নিয়ে এত গসিপ চলছে?’

‘তুই জানিস না?’ আশ্চার্যান্বিত গলায় বলল মেয়েটি। যেন ইনান না জেনে খুব বড় একটা ভুল করেছে।

‘কী জানব?’

‘ফারার আর মুগ্ধর খবর?’

ইনান ভ্রুকুটি করে তাকাল, ‘কী খবর?’

‘ভাই অনেক লম্বা কাহিনী।’ খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ভঙ্গিতে মেয়েটা নড়েচড়ে বসে।

‘ফারা আর মুগ্ধর সাথে ভৌতিক কাহিনী ঘটে গেছে। ফারারটা বলি আগে। ওই মেয়ে রাতের বেলা ঠিকঠাকভাবেই ঘুমাতে গেছে, সকালে উঠে দেখে ওর চুল নেই, পুরাই টাক মাথা, সব চুল খাটের পাশে পড়ে আছে, শুধু তাই না, ওর ভ্রুও নেই, এমনকি চোখের পাপড়িও নেই। কী ভৌতিক কাহিনী তাই না? না কারো কোনো চিহ্ন পাওয়া গেছে আশেপাশে, কে করেছে না করেছে কিছুরই হদিস পাওয়া যায়নি। বেচারির লম্বা চুলগুলো সব কেটে ফেলা। ফারা মেয়েটার অবস্থা ভালো না নাকি। মিনিটে মিনিটে অজ্ঞান হয়ে যায় কান্না করতে করতে, আয়নায় চেহারা দেখে আর অজ্ঞান হয়।’

ইনান হা করে মেয়েটির কথা শুনছিল। কী যা তা বলছে? কী ভৌতিক এবং অদ্ভুত! ফারার চুলগুলো পা অবধি লম্বা, এই একটা জিনিসই ছিল যেটা দিয়ে ফারা অহংকার করতে পারত। তার এই লম্বা চুলের জন্য সে প্রপোজাল পেয়েছিল তেল এবং শ্যাম্পুর অ্যাড করার। যার শুটিং শুরু হওয়ার কথা সামনের মাসে। আর এখন কিনা তার সেই চুলই নেই? আবার ভ্রু, আইল্যাশও নেই? এ আবার কেমন ঘটনা? ভুতের যদি চুল পছন্দ হতো চুল নিলো না কেন? পাশে ফেলে রেখে গেল কেন?

‘তারপর শুন মুগ্ধর কাহিনী।’ চোখ বড় বড় করে বলল মেয়েটি, ‘মুগ্ধ সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনি, ও যখন চোখ খুলল ও দেখে ওর দুইটাশে দুই হাতে তিনটা করে রড বাঁধা, হাত নাড়াতে পারেনাই। আর ওর গলার আর বুকের উপর মোট পাঁচটা মোটা রড দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। ভাবতে পারিস?’

‘কী?’ প্রায় চিৎকারের স্বরে বলে উঠল ইনান, ‘ও শ্বাস নিয়েছে কীভাবে?’

‘ওর পা দুইটা খোলা ছিল। যখন দম বন্ধ হয়ে আসছিল ও পা দিয়ে খাটে জোরে জোরে আঘাত করা শুরু করলে ওর বাবা আসে, আর দেখে ওর এই অবস্থা। ওর সারা মুখ, হাত লাল হয়ে গিয়েছিল। ও তো ঠিকমতো কিছুক্ষণ শ্বাসই নিতে পারে নাই। কথা বলা তো দূরের কথা। ওর বাবা যদি একটু লেট করে আসতো ও কিন্তু সত্যি মা’রা যেত রে।’

ইনানের মাথা চক্কর মারছে। তার মনে হচ্ছে যা শুনছে এগুলো সব গল্প। এসব সত্যি হতে পারে না! ইনান ক্লাস না করে বেরিয়ে গেল। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। মুগ্ধ আর ফারার সাথে হওয়া ঘটনা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। যতই হোক তার তার ফ্রেন্ড। ফারা শুটিং নিয়ে কত এক্সাইটেড ছিল আর এখন??

ইনান ফারার বাড়িতে গেল আগে। কিন্তু দেখা করতে পারল না। ও কিছুতেই রুমের দরজা খুলল না। তার বাবা মাকেও রুমে ঢুকতে দেয়নি। শুধু দরজার ওপাশ থেকে জোরে জোরে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। হতাশ হয়ে ইনান মুগ্ধর বাড়িতে গেল, তবে কাউকেই পেল না। শুধু পাশের বাড়ি থেকে শুনল হসপিটালে নিয়ে গেছে। ইনান টয়াকে ফোন লাগাল, অন্তত ও তো জানবে কোন হসপিটাল। কিন্তু টয়া ফোন তুলল না। কয়েকবার কল দিল ইনান তাও বারবার ব্যস্ত দেখাচ্ছে।

ইনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত শরীরে চলে গেল ভার্সিটিতে। ক্লাস শেষ হওয়া পর্যন্ত টয়াকে লাগাতার কল দিতেই লাগল, কোনো কাজে আসল না। সারাটা ক্লাস ইনান নিরবে কেঁদে গেল। সবকিছু কেমন উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে, তার ফ্রেন্ডরা সব কেন তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে?

ক্লাস শেষে ইনান রাস্তায় আসলে আরেক ঝামেলাকে চোখে পড়ে তার। পলক। গেটের পাশেই উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে, চোখের নিচে কালি পড়ে তার চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। যেন কয়দিন না খেয়ে আছে। ইনান জানে পলক এখানে তার খোঁজেই এসেছে। কিন্তু সে পলকের সামনে যাবে না। কেন যাবে? যাওয়ার কোনো কারণ আছে? এমনিতেই তার মন ভালো নেই।

তখন ইনান দেখল জেহফিলের গাড়ি। রাস্তার বিপরীত মাথায় জেহফিল গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইনান ওড়নাটা মুখে জড়িয়ে পলকের চোখের আড়াল হয়ে দ্রুত গাড়ির কাছে চলে গেল।

গাড়ির দরজার বন্ধের আওয়াজ শুনে জেহফিল গাড়ির ভেতরে তাকাল, দেখল ইনান বসে আছে। জেহফিল গাড়িতে ঢুকে ইনানের চোখ মুখের অবস্থা দেখে কিছুটা অস্থির হলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তাকে বলল,

‘চোখ মুখ এমন শুকনো কেন?’

ইনান সবটা খুলে বলল জেহফিলকে। যখন ইনানের কথা শেষ হলো, জেহফিল পানির বোতল হাতে ধরিয়ে দিলো তার। ইনানের কথাগুলোকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে বলল,

‘সামনেই নিউ একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছে, তোমাকে ট্রিট দিবো আজ।’

ইনান মুখ বেজার করে বলল, ‘মন চাইছে না। বাড়ি চলুন।’

জেহফিল ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘রেস্টুরেন্টটা তিন ঘন্টার জন্য ভাড়া করেছি, রেস্টুরেন্টের প্রথম কাস্টমার তুমি হবে বলে। তুমি কি চাইছো পুরো টাকাটা জলে যাক?’

অগত্যা ইনানকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জেহফিলের সাথে যেতে হলো।

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here