রোদরঞ্জন #পর্ব_২২ [অতিরিক্ত] #আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

0
388

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২২ [অতিরিক্ত]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

________

আমি একজন এতিম। বুঝ হবার পর এই শব্দটার সাথেই বেশিরভাগ পরিচিত হয়েছি। শুধু আমি না, এই আশ্রমের নব্বই ভাগ ছেলেমেয়েই এতিম। তাদের বাবা-মা ছাড়াও অন্যান্য কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। বাকি দশভাগের কারো মা নেই, বাবা নতুন জীবনের আশায় সন্তানকে দিয়ে গেছে, কিংবা তাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় আছে, মাঝে মাঝে এসে দেখে যায়।

আমার নাম ছিল না। এতিমের স্যার-আঙ্কেলরা নাম দিয়েছিল, কী নাম দিয়েছিল আমার খেয়াল নেই। না থাকারই কথা। কেননা তারা যদি আমাকে ঐ নামে ডাকত আমি কোনোদিন সাড়া দেইনি। ‘এই ছেলে’ বলে ডাকলেই আমি সাড়া দিতাম। ফলস্বরূপ আমার ডাক নাম ছিল ‘এই ছেলে’

দীর্ঘশ্বাস….

আমার মা নেই বাবা নেই, তারা কোথায় আমি জানি না। কোনদিন জানতেও চাইনি। এই নিয়ে আশ্রমের হেড আঙ্কেল আমাকে একবার ডেকেছিল। তখন বয়সটা পনেরো বছর (নট শিওর)। আঙ্কেলের ভাষ্যমতে আমি একজন অদ্ভুত। তার মতে আর পাঁচটা ছেলের মতো নই। হওয়ার কথাও না। ম্যাচিওরিটি শব্দটা জানার আগেই এর গুণ আমার মধ্যে প্রবেশ করেছিল। নিজেকে অতিরঞ্জিত করছি না, যা সত্যি তাই বলছি, নিজ সম্পর্কে বাজনা বাজানো আমার ধাতে নেই।

আমি কখনো খেলাধুলা করিনি, আমার বয়সী ছেলে মেয়েরা কত খেলা খেলে, কিন্তু আমার ভাল্লাগতো না। কারণ এসব ছেলেমেয়েরা আমার সমান হলেও তাদেরকে হাঁটুর বয়সী মনে হতো। বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা, হাসি ঠাট্টা করা খুবই বিরক্তিকর এবং অসহ্যকর একটা কাজ। ওরা যে এসব খেলাধুলায় কী আনন্দ খুঁজে পায় আমি জানি না। জানতেও চাই না। ওদের জীবন, ওরা যা ইচ্ছে করুক।

আমার ভাল্লাগতো বই পড়া, না, ফিকশনাল না, নন- ফিকশনাল বই। যেসব বই পড়ে আমি কিছু জানতে পারব, শিখতে পারব সেসব বইয়ে আমার ঝোঁক ছিল বেশি। হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে বই ছিল আমার প্রিয় জনরা। যেখানে অন্যরা মাঠে হৈ হুল্লোড় করত সেখানে আমি লাইব্রেরীর এক কোণায় বই নিয়ে বসে পড়তাম।

ছেলেমেয়েরা আমাকে ভয় পেত। কারণটাও আমি জানি। আমি বড়দের মতো মুখ গম্ভীর করে রাখতাম। কথা বলতাম গুণে গুণে। প্রয়োজন ছাড়া কারো কথার উত্তর দিতাম না।

যা বলছিলাম, আঙ্কেল আমাকে ডেকে নিলো একদিন। তিনি অবাক হয়েছিলেন আমি এপর্যন্ত কেন আমার ফ্যামিলিকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন করিনি। তিনি আরও অবাক হলেন যখন আমি উত্তর দিলাম এসব জানার আগ্রহ আমার নেই। আরেকটা কথা বলে নেই, তিনি কিন্তু আমাকে ব্রিটিশ বলে ডাকতেন। কেন ডাকতেন পরে বলছি।

স্বভাবেও আমার আলাদা বৈশিষ্ট্য আমার ছেলেবেলা থেকেই তিনি খেয়ালে রেখেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, আমাকে তিনি পেয়েছিলেনও আলাদা ভাবে। অন্য বাচ্চাদের পেয়েছিল রাস্তায়, নয়তো ডাস্টবিন। আমাকে পেয়েছিলেন জঙ্গলে। একদম গভীর জঙ্গলে। যেই জঙ্গলে মানুষের যাওয়া আসার সম্ভাবনা এক পার্সেন্ট। তিনি নাকি একদিন ধাওয়া খেয়েছিলেন কোনো এক কারণে। লোকের ধাওয়া খেয়ে গভীর জঙ্গলের মাঝে দৌড়াতে লাগলেন। ওনার মতে লোকের দৌড়ানি খাওয়াটা ওনার ভাগ্যে লিখা ছিল, তাইতো তিনি বট গাছের নিচে ময়লা তোয়ালে জড়ানো আমাকে পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বলেন, আমাকে যখন দেখেন আমি নাকি কান্নাও করিনি, হাসিওনি। একদম চুপচাপ চেয়েছিলাম ওনার দিকে। আমার শ্যামলা গায়ের রঙও নাকি জঙ্গলের গাঢ় সবুজ পাতার থেকেও উজ্জ্বল লাগছিল বিধায় আমাকে তার নজরে পড়ে। আসলে কি তা বিশ্বাসযোগ্য?? উনি নিজেকেই প্রশ্ন করেন। আবার নিজেই উত্তর দেন, বিধাতার ইচ্ছে ছিল আমাকে বাঁচানোর। আমার ধূসর চোখ, শ্যামলা গায়ের রঙেও আমাকে নাকি বাঙালির মতো লাগছিল না। আমার শারীরিক পরিবর্তন নাকি হলিউড মুভিতে অ্যাক্টিং করা টিনেজ ছেলেদের মতো ছিল। তাই তিনি আমাকে ব্রিটিশ বলে ডাকতেন।

জেহফিল নামের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত করে বলি। বই পড়তে পড়তেই এই নামটা মাথায় গেঁথে যায়। নিজের নতুন নাম দেই জেহফিল এহসান। যদিও এই নামে কেউই আমাকে চিনত না, জানাই-ই তো না কাউকে, চিনবে কীভাবে? আমি শুধু হেড অফিসে গিয়ে বললাম আমি নাম চেঞ্জ করব। আঙ্কেল বিনা বাক্যে আমার কথা মেনে নেন।

আমার আর্টের প্রতি আগে কিন্তু ঝোঁক ছিল না। আমাদের সবাইকে প্যাস্টেল, পেন্সিল রং দিতো আঁকাআঁকি করার জন্য। সবাই আঁকত, ফুল, ফল পাখি কত কিছু। কিন্তু আমার খাতা সাদা থাকত। কী আঁকতাম? ফুল আমার পছন্দ না। প্রিয় ফুল বলে কিছুই নেই আমার। যেটা মনে ধরে না সেটা আঁকব কীভাবে? কোনোকিছুই আঁকার মনমানসিকতা থাকত না। তাও সাদা খাতাকে ভরাট করার জন্য রঙ নিয়ে সরলরেখা আঁকতাম। সবাই হাসাহাসি করত কীসব রেখা টেখা এঁকেছি বলে। আমি পাত্তা দিতাম না। দিয়ে লাভ আছে? তারা আমার জীবনে কোনো ভূমিকা রেখেছিল? রেখেছে? না রাখবে? যে তাদের পাত্তা দিব?

আমি নির্বিকার থাকতাম।

আমার অন্ধকার ভালো লাগে, শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ আমার। তাই এতিমখানায় শত শত বাচ্চাদের মাঝে থেকে আমি হাঁপিয়ে যাচ্ছিলাম। মন টিকতো না। আশেপাশে এত মানুষ থেকেও আমি সম্পূর্ণ একা ছিলাম। বোধহয় সেই সময়টাতে প্রিয় মানুষদের [বাবা-মা] সাহচর্যের তাগিদ অনুভব করতাম। শান্ত মন ছটফটে হতো। একটু আদর-যত্ন পাবার আশায়। কেয়ারটেকাররা সবাই-ই যত্ন করত। কিন্তু এসব তো মিথ্যে, তারা বেতনের জন্য যত্নের নাটক করত। আমি তো চাইতাম বিনিময় ছাড়া যত্ন। যেই যত্ন আসবে মন থেকে। এই যত্নের জন্য ছটফটে হলাম একটা ঘটনা দেখার পর।

আশ্রমের এক ছেলের বাবা এসেছিল একদিন। হাতে কত রকমের গিফট। সাথে আরেক মহিলাও এসেছিল। জানি না কে। তবে তারা দুইজন ছেলেটাকে কাছে পেয়ে কপালে, গালে চুমু দেয়, মাথায় হাত বুলায়, গাল টেনে দেয়।

আমি জানালায় দাঁড়িয়ে সবটা দেখেছি। ঐ বাবার চোখে কিন্তু মিথ্যে অভিনয় ছিল না। মহিলাটার আপাদমস্তক মিথ্যায় ঢাকা থাকলেও বাবার ভালোবাসাটা পবিত্র এবং সত্যি ছিল। আমি অনুভব করতে পেরেছি, ঠিক সেই সময়ই আমার কঠিন সত্ত্বা, গম্ভীর মন, খাঁচায় বন্দী পাখির মতো ছটফট করতে থাকে। আমি..জেহফিল, অস্থির হয়ে যাই কারো যত্ন পাওয়ার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, যার চোখেই তাকাই তার চোখেই করুণা, নয়তো ভাণ। যার ফলে প্রত্যেকটা মানুষের প্রতি ঘৃণা জন্মে যায়, মানবজাতির প্রতি।

একাকীত্বে ভুগতে থাকি সারাটা সময়। যত্নের অভাবে আমার কঠিন মনটা কুঁকড়ে যেত। তীব্র যন্ত্রণা হতো বুকের ভেতর। মানবজাতি এত অদ্ভুত কেন? আমি তো কারো থেকে টাকা পয়সা, সম্পদ কিছুই চাইছি না। চাইছি শুধু একটু যত্ন, মমতা। স্নিগ্ধ পরশে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে, মিষ্টি হেসে বলবে, কেমন আছো জেহফিল? ব্যস, এইটুকুই তো চাওয়া। তাও দিতে এত কৃপণতা??

আমার মনে হতে থাকে এই দুনিয়ায় আমার জন্ম হয়েছেই একা থাকার জন্য। কোটি কোটি মানুষের মাঝে থেকেও আমি একা, নিঃস্ব। আমি… আমি যে এতিম..

মনে হলো, বেঁচে থাকার মানে কী? যেই জীবনে শান্তি নেই সেই অশান্তিময় জীবন বাঁচিয়ে রাখার কী দরকার। কাটার থেকে ধারালো ব্লেড খুলে প্রথমবারের মতো হাতে আঘাত করলাম। রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল, হাত বেয়ে ফ্লোরে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে আমার কোনো অনুভূতি হলো না। আবার দিলাম, নাহ, কোনোকিছু ফিল হলো না। তাহলে আমি ম’রব কীভাবে?

মাথায় মৃ’ত্যুর চিন্তা ঘুরতে থাকত সবসময়। এর মাঝে একবার ঐ ছেলেটার সাথে দেখা হয়েছিল। আশ্রমের পেছনে দোল খাচ্ছিল। ছেলে হয়ে মেয়েদের মতো দোল খেতে দেখে আমার খুব রাগ হলো। এতে আনন্দের কী আছে যে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে দোল খেতে হবে?

আমি সেই প্রথমবার আশ্রমের ছেলেদের কারো সাথে নিজ থেকে কথা বললাম। আমি ওর সামনে দাঁড়াতেই ও দোল খাওয়া থামায়, চোখে স্পষ্ট ভয় ছিল। আমার ভালো লাগল ওর ভয় দেখে। জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার বাবা যখন তোমার কপালে চুমু দিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল তখন অনুভুতি কী ছিল?”

ছেলেটা আমার কথার উত্তর না দিয়ে দোলনা থেকে নেমে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল। আমার ভালো লাগে না যখন কেউ কথার উত্তর দেয় না। অভদ্র মনে হয়! এই ছেলেটা একটা অভদ্র! পড়ালেখা করে কী শিখল তাহলে? অভদ্রতামি?

আমি ছেলেটার গেঞ্জির কলার টেনে ধরলাম। ভয় পেল ও। ওর ভয় ভয় চোখের দিকে তাকিয়ে আমি পুনরায় একই প্রশ্ন করলাম। যখন সে উত্তর দিলো না, আমি শরীরে আগুনের আস্ফালন টের পেলাম। মুষ্টাঘাত করলাম ওর নাক বরাবর। ও চিৎকারের সুযোগ পেল না, তার আগেই ওর মাথার মধ্যে মারতে থাকলাম ক্রমাগত। ওকে মে’রে কেন যেন খুব শান্তি পাচ্ছিলাম। সেই শান্তির আশায় আরো মারতে লাগলাম..

ওর রক্তে আমার হাত রঞ্জিত হয়ে গেল। নিজের রক্ত ছাড়া প্রথম অন্য কারো রক্ত দেখেছি। সেই রক্ত দিয়ে মাটিতে ফুল আঁকলাম।‌ আমার মন পুলকিত হলো ফুলটা দেখে। কী চমৎকার ফুল.. কী চমৎকার ফুলের রঙ.. রক্তিম রঙা। ছেলেটা পরে কমপ্লেইন দিলো আমার নামে। কেউই বিশ্বাস করল না, কারণ সবাই জানে আমি শান্ত, এসব মারামা’রির আশেপাশেও নেই।

সেই থেকেই আমার আর্টের প্রতি টান বাড়ল। সুই’সাইডের চিন্তা বাদ দিয়ে আর্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দিন নেই রাত নেই খালি আঁকাআঁকি করতাম। ঠোঁটে হাসি ফোটার প্রথম কারণ হয়ে উঠে পেইন্টিং।

দ্বিতীয় কারণ আমার বাটারফ্লাই। আমি যখন আমার নিজ টাকায় কেনা বাড়িতে শিফ্ট হলাম তখন বয়স কতোই বা? খেয়াল নেই তবে টিনেজ ছিলাম। বাড়িটা পরিত্যক্ত। আমি এর চেয়েও লাক্সারিয়াস বাড়ি অ্যাফোর্ড করতে পারতাম, কিন্তু এই বাড়িটার পেছনে জঙ্গল আর নিরিবিলি হওয়ায় আমি কিনে নিলাম। নিচের তলায় পরিত্যক্ত গোডাউন। পুরো বাড়িটাকে ভূতের বাড়ি বললে ভুল হবে না। আর একটা কথা, পেছনের এই জঙ্গলটা অনেক বিস্তৃত। এর শেষ নেই আমার জানামতে। এই গভীর জঙ্গলের মাঝেই আমাকে পাওয়া গিয়েছিল, তাই এই বাড়িটা আর জঙ্গলের প্রতি টানটাও বেশি।

বছরের পর বছর যেতে থাকে, প্রাপ্তবয়স্ক হই, ছেলে থেকে পুরুষ হয়ে উঠি, আর্টিস্ট হিসেবে পরিচিত হই ন্যাশনালি প্লাস ইন্টারন্যাশনালি। মোটা অঙ্কের টাকা ইনকাম করতে থাকি প্রতিটা আর্টে। ব্যাংক ব্যালেন্স বেড়ে যায়। গাড়ি হয়, কিন্তু বাড়ি আর কেনার ইচ্ছে জাগেনি। ঘরের জন্য আসবাবপত্র বানাই, আর্ট করি। কিন্তু সাজাই না ঘর। অযত্নে ফেলে রাখি। আমার আর্ট রুমটাই সবচেয়ে সুন্দর করে সাজাই। সব সরঞ্জামের জন্য আলাদা শেল্ফ কিনে তাকে তাকে রাখি।

পড়ালেখার করি নামে মাত্র। যেটুকু জানা দরকার সেটুকু জানার পর পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ আসে না। হিসাববিজ্ঞানের রেওয়ামিল, আর্থিক অবস্থার বিবরণী, ফিন্যান্সের আদর্শ বিচ্যুতি- এসব জেনে আমার কোনো লাভ আছে?? আমি তো এসব কাজে লাগাব না।

দিন রাত আর্ট করি। এটা সেটা আঁকি। যা মনে আসে তাই আঁকি। কিন্তু ঐ যে একাকীত্ব, সাময়িক সময়ের জন্য আড়াল হলেও আমার পিছু ছাড়েনি। আঠার মতো লেগে ছিল। সম্মান, টাকা, ঐশ্বর্য সবই আছে আমার, কিন্তু ভালোবাসা? ঐ একটা জিনিসের জন্য আমি ভেঙে পড়ি। আঁকতে আঁকতে একসময় হতাশ হয়ে পড়তাম। আমার দরকার ছিল ভালোবাসার। দরকার ছিল একটু জড়িয়ে ধরার অনুভূতির। কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন মানুষদের জড়িয়ে ধরতে হয় প্রথম দেখায়, তবে সেই জড়িয়ে ধরাটা ছিল ফর্মাল, কেউ আমাকে মন থেকে জড়িয়ে ধরেনি, এগুলো ছিল সব ফর্মাল হাগ, যা খালি লোক দেখানো, যেখানে ভালোবাসাময় উষ্ণতা ছিল না..

প্রতি মুহূর্তে ভালোবাসার অভাব বোধ করতাম প্রচণ্ড। আমি যখন অসুস্থ হতাম নিজেই নিজের সেবা করতাম। জ্বরে গা কাঁপুনি দিয়ে উঠলে অসুস্থ শরীর নিয়ে নিজের কপালে নিজেই ভেজা কাপড় দিতাম‌, অসুস্থতা নিয়েও রান্না করতাম। জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে ম’রে থাকলেও কেউ ছিল না আমাকে দেখার। আমি চাইতাম কেউ একজন থাকুক, আমার সাথে, বাবা মা না, নিজের একান্ত একজন মানুষ থাকুক। যে আমি ঘরে ফেরার সাথে সাথে হাসিমুখে ওয়েলকাম জানাবে, আমার ক্লান্ত মুখ দেখে জিজ্ঞেস করবে আজকের দিনটা কি বেশি খারাপ কেটেছে? খারাপ লাগার কারণ জানতে চাইবে। আমি যখন অসুস্থ থাকব, সেই মানুষটা আমার পাশে বসে যত্ন করবে। এইখানে যত্ন বলতে আমি কিন্তু রান্নাবান্নার কথা বলছি না। দরকার হলে জ্বর থাকা অবস্থাতেই আমি রান্না করব, সব কাজ করব, শুধু সেই মানুষটা পাশে বসে ভালোবাসার সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিক। কপালে ছোট্ট করে চুমু দিক, শক্ত করে জড়িয়ে ধরুক। আমার নাম ধরে আদর করে ডাকুক। আর কিচ্ছু না।

এই ভালোবাসার মানুষ আমি খুঁজে পাইনি। যেখানে সমস্ত মনুষ্যজাতের প্রতি ঘৃণা জন্মেছে সেখানে কীভাবে আমি ভালোবাসার মানুষ খুঁজতে বেরোতাম? “আমার একান্ত মানুষ নেই” এই কথাটা আমার তৈরি, অথচ আমার তৈরি কথা-ই আমাকে মুষড়ে দিতে লাগল প্রতিনিয়ত। আবারও সুইসাই’ডের চিন্তা মাথায়া ভর করল। ব্লেড দিয়ে হাতে পোঁচ দিলাম। কিছুই অনুভুত হলো না। ভাবলাম ব্লেড হয়তো আমার শরীরের অনুভূতি জাগাতে অক্ষম। তাই স্কাল্পচার বানানোর ধারালো ছুরি দিয়েও হাত কাটলাম। দুই হাতে পর পর অনেকগুলো পোঁচ দিলাম। অনুভূতি যেন কঠিন শিকলে আবদ্ধ ছিল, কোনো কিছুই ফিল হতো না। বুঝলাম না, আমার ভেতরে কি কোনো অনুভূতি নেই? বিরক্ত হলাম নিজের প্রতি। ম’রে যাওয়ার সহজ উপায় খুঁজতে লাগলাম।

তারপর আমার অগোছালো, ভালোবাসাহীন, উদ্দেশ্যহীন জীবনের একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি এক রমণীকে। জীবনে এই প্রথমবারের মতো কোনো রূপসী কন্যা আমার স্বপ্নে এসেছিল। তার হাতে রোদরঞ্জন ফুল, লম্বা হালকা গোলাপি গাউন পরনে, ঘন পল্লববিশিষ্ট চোখে আবেদন, ঠোঁটে দুষ্টু হাসি, পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ড ড্রিমি… স্বপ্নটা স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর ছিল। আমার মনে হয়েছিল এক টুকরো হ্যাভেন আমার স্বপ্নে উঁকি দিয়ে গেল।

ঘুম ভাঙার পর আমি অস্থির হয়ে যাই। আমার ভুতুড়ে ঘরের মাঝেই মেয়েটাকে খুঁজতে থাকি। কী পাগল আমি তাই না? আসলেই পাগল। মেয়েটাকে স্বপ্নে যেমন দেখেছিলাম ঠিক সেভাবেই তুলে ধরি ক্যানভাসে।

আমার মনে হতো আমার স্বপ্নে দেখা মেয়েটির কোন অস্তিত্ব ছিল না, কেননা এরকম কোনো মেয়েকে আমি বাস্তবে দেখেনি, আমার ব্রেইন শার্প। পরপর তিনদিন আমি একই রমণীকে বিভিন্ন আঙ্গিকে স্বপ্নে দেখি। প্রত্যেকটা স্বপ্নকে আমি তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে আঁকি। এত চমৎকার দেখতে এই মেয়েটা, যে আমি নিজের আঁকা ছবি থেকে নিজেই চোখ সরাতে পারি না। মেয়েটাকে দেখার পর আমার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠে, পাগল হয়ে যাই মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য। আমার মনে হতে থাকে, এই মেয়েটাই আমার ভালো থাকার ঔষধ, আমার একাকীত্ব ঘুঁচানোর জন্য এই মেয়েটাকেই লাগবে। আমার একান্ত মানুষ এই মেয়েটাই। কতবার চুমু খেয়েছি ক্যানভাসে হিসাব নেই। ছবি আঁকার সাথে সাথে চুমু দিতাম, রঙে ঠোঁট ভরে যেত, আমি কেয়ার করতাম না, মন না ভরা অবধি ছবিতে চুমু দিয়েই যেতাম..এতটাই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি।

কিন্তু এই বৃহৎ পৃথিবীতে কোথায় খুঁজব আমার স্বপ্নের হৃদয়হরণীকে?

যেদিন বুঝেছিলাম আমি আমার প্রাণপ্রিয়াকে খুঁজে পাব না সেদিনই এই অর্থহীন প্রাণটাকে নাশ করার সিন্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি জানি না এটা আসলে অলৌকিক কিনা, তবে সেদিনই আমার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। কী মনে করে সেদিন ভার্সিটি যাই। এবং আমার হৃদয় থমকে দিয়ে আমি আমার হৃদয়হরণীর দেখা পাই। ভার্সিটির গেটের সামনে, কতগুলো কেকের ব্যাগ হাতে, ঠোঁটে সেই দুষ্টু হাসি। আমার পা থমকে যায়, শরীর অসাড় হয়ে যায়‌। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি যে আমার ভালোবাসা আমার কাছে এসে ধরা দিয়েছে, তাও আবার সেদিন যেদিন আমি দুনিয়াকে চিরতরে বিদায় জানানোর প্ল্যান করেছিলাম। নিজের উপর রাগ হতে লাগল, কেন এর আগে ভার্সিটি এলাম না।

ও যেই ক্লাসরুমে ঢুকল সেই ক্লাসরুমের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে একটা সিটে বসে পড়লাম। সারাক্ষণ ওর চঞ্চলতা মুগ্ধচোখে দেখতে লাগলাম। ও যখন আমার কাছে আসল, আমার বুকের মধ্যে চলা দ্রিম দ্রিম আওয়াজ বেড়ে যেতে লাগল, মনে হলো এই বুঝি পুরো ক্লাস আমার হৃদয়ের শব্দ শুনে ফেলল! ও কাছে আসল, আমার সামনে জার কেক সামনে রাখল। আমি আঁকার ভান করে আঁকিবুঁকি করতে লাগলাম, কিন্তু আমার মন ছিল সামনে দাঁড়ানোর আমার ভালোবাসার কাছে। ও নিজ থেকে পরিচিত হতে চাইল, আমিও হতে চাইলাম, কিন্তু যখন দেখলাম ওর সাথে আরও একটা ছেলে আছে তখন আমার প্রজাপতি উড়তে থাকা হৃদয়ে ক্রোধের আগুন জ্বলতে থাকল, যেই আগুনে সব প্রজাপতি পুড়ে ছাই হতে লাগল…

আমি গম্ভীর মুখে নিজের নাম বললাম, ওর নাম জানলাম, আমার পছন্দ হয়নি। ওকে দেখা মাত্রই আমার মনে যেই নামটা এসেছিল তা ছিল ‘বাটারফ্লাই’। যে কিনা আমার মৃ’ত হৃদয়ে হুট করে উড়ে এসে জীবিত করে তুলেছে‌।

আমি পুরোটা ক্লাস ও’কে দেখে যেতে লাগলাম। ছুটির শেষেও ওকে ফলো করলাম। শুধু ভার্সিটি না, সব জায়গাতেই ওকে ফলো করতে লাগলাম। যেই আমি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরৈ থাকতাম সেই আমি ওর জন্য ইন্সটা, টুইটার ডাউনলোড করে ওকে ফলো করতে লাগলাম, ওর প্রতিটা ছবি সেভ করে রুমে টানিয়ে রাখলাম। ও কোথায় যায় কী করে না করে সব স্টক করতে লাগলাম। আমি অবসেসড হয়ে গিয়েছিলাম ওর প্রতি। প্রত্যেকটা মুহুর্ত বাটারফ্লাইয়ের চিন্তায় বিভোর থাকতাম। নানা কূটকৌশলে ওর বাবার সাথে সম্পর্ক ভালো করি, ওকে নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করি।‌

বিয়ের চিন্তা এত দ্রুত ছিল না, কিন্তু ও’কে ওর ফ্রেন্ডদের সাথে মেলামেশা সহ্য হলো না আমার। আমি চাই সব মানুষের থেকে ওকে আলাদা রাখতে। সবার থেকে দূরে সরাতে, ওর শেষ এবং একমাত্র মানুষটা আমি হবো, শুধুই আমি। তাই ছক কষে ওকে বিয়ে করি। তাও ওর ফ্রেন্ডদের সাথে মেলামেশা কমল না। ওর সাথে ওর বন্ধু বান্ধবদের সখ্যতা দেখে আমার এত রাগ উঠল…পৃথিবী ধ্বংস করার মতো রাগ। যদি ও আমাকে কম গুরুত্ব দেয়! যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায়! যদি আবার একাকীত্বের মাঝে ফেলে দেয়!! আমি ও’কে ওদের থেকে আলাদা করার সব ধরনের চেষ্টা করি। আমার বাটারফ্লাইয়ের গলায় সুতো বেঁধে নিজের করার জন্য যা করার লাগে সব করব, সব।

আমার বাটারফ্লাই শুধুই আমার। আমার বাটারফ্লাইয়ের উড়ার ক্ষমতা থাকবে একটি নির্দিষ্ট জায়গায়, একটি নির্দিষ্ট ফুলের কাছে..রোদরঞ্জন ফুল..বিষাক্ত মধু যার। আমি হবো আমার বাটারফ্লাইয়ের রোদরঞ্জন। যেই বিষাক্ত মধুর একমাত্র ভাগীদার সেই কোমল ডানার প্রজাপতি। যা পান করে অন্যান্য ফুলের কাছে যাওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলবে সে… দুর্বল ও নত হয়ে পড়ে থাকবে জেহফিল নামক বিষাক্ত রোদরঞ্জনের কাছে…

.
.
চলবে…

নাইস‌ নেক্সট বাদে একটু গঠনমূলক মন্তব্য করবেন:)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here