#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৩ [অতিরিক্ত]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
সুন্দর একটা দিন কাটানোর পর ইনান একাডেমি থেকে বাসায় ফিরছিল। জেহফিলের সাথে নরমাল কনভারসেশন করছিল সে। সেই টাইমে ইনানের বাবার কল আসে। ইনান ফুরফুরে মনে বাবার সাথে কথা বলায় খেয়াল করল না জেহফিলের অগ্নি চোখের লাভা।
‘কল ধরছিলে না কেন আম্মু?’
‘চার্জ ছিলো না বাবা। এখন অন হয়েছে।’
‘জেহফিলের ফোনে কল ঢুকছে না কেন? সকাল থেকে কল করছিলাম।’
‘কিজানি, বলতে পারছি না। আচ্ছা আমি দেখব।’
বাবার সাথে কথা বলা শেষ করে। জেহফিলের মোবাইল ইনানের সামনেই ছিল। সে মোবাইলটা নিয়ে কন্টাক্ট লিস্ট চেক করে। জেহফিলের মোবাইলে নাম্বারের সংখ্যা নিতান্তই কম। তাও সেগুলো কাজের ক্ষেত্রের।
ইনান তার বাবার নাম্বার খুঁজে পেল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই বলল,
‘বাবার নাম্বার আপনি সেভ করেননি?’
এই বলে জেহফিলের দিকে তাকায়। দেখল এতক্ষণ হাসিখুশি থাকা জেহফিলের চোয়াল শক্ত। তীক্ষ্ণ চোখে আগুনের হলকা।
‘জে..’
‘সেভ করার কোনো প্রয়োজন আছে?’
জেহফিলের কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্র হঠাৎ করেই জেহফিলের সেইদিন মোবাইল ছিনিয়ে নেয়ার কথাটা মনে পড়ে, মনে পড়ে তার বাবাকে নিয়ে ভৎর্সনা করাটা, সিরিয়ালি তার মনে পড়ে যায় ভোরের কথা। কপালে হাত চলে যায় ইনানের। সে এতো মনভুলো কেন? ধাতস্থ করে নিজেকে। গভীর শ্বাস ফেলে জেহফিলের দিকে চায়।
‘এক্সপ্লেইন।’
‘এক্সপ্লেইন হোয়াট?’
‘ফুল গাছ কেটে ফেলার কথা।’
জেহফিল ইনানের কথা শুনে বাঁকা হাসে। কটাক্ষ করে বলে,
‘এতক্ষণ পর মনে পড়ল?’
‘কথা প্যাঁচাবেন না।’ তীক্ষ্ম গলা ইনানের।
ইনানের জোরে জোরে কথা বলা শুনে জেহফিল বলল,
‘লাভ, আমি তোমাকে এখনো ম্যানারস শিখাতে পারিনি। এটা কি আমার ব্যর্থতা নাকি তোমার অমনোযোগিতা?’ অসন্তোষ প্রকাশ পেল জেহফিলের কথায়।
‘একদম কথা ঘুরাবেন না।’
ততক্ষণে তারা বাসায় এসে পড়েছে। জেহফিল গাড়ির দরজা খুলে ইনানকে কোলে তুলতে নিলে ইনান জেহফিলের বুকে ধাক্কা মারে।
‘বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাটারফ্লাই।’ হীম শীতল গলা জেহফিলের।
‘আপনি বেশি করছেন, কথার জবাবা দেন না কেন? গাছগুলো কেন কেটেছিলেন? বিহেভিয়ার চেঞ্জ কেন আপনার? আপনিই না আমার পছন্দে গাছ লাগিয়েছেন তাহলে কেন আপনি আবার সেগুলো তুলে ফেলেছিলেন? তাও এত কষ্ট দিয়ে?’
‘গাছের কষ্ট নিয়েও ভাবো, আমার কষ্ট চোখে পড়ে না?’
‘আপনার কীসের কষ্ট?’ ভ্রু কুঁচকে আসে ইনানের।
‘ভেতরে যাই?’
‘এখানেই বলবেন।’ হুকুমের সুরে বলল ইনান।
জেহফিলের ভালো লাগল না তার উপর ইনানের হুকুম জারি করা। সিরিয়াস কথাবার্তায় তার উপর কেউ রুড হয়ে কথা বলবে, চিৎকার করবে, আদেশ দিবে- এসব জেহফিলের সবচেয়ে অপছন্দ। তাও আবার তার বাটারফ্লাই সুরেলা গলায় তাকে অর্ডার করবে কেন? বাটারফ্লাইয়ের মিহি কণ্ঠস্বর শুধুমাত্র ভালোবাসাময় কথা বলার জন্য তৈরি হয়েছে, রিনরিনে হাসির জন্য, সুখে…
‘চুপ করে থাকবেন না, আপনিই না বলেন প্রশ্নের জবাব না দেয়া অভদ্রতা? তাহলে এখন আপনি নিজেই তো অভদ্র হয়ে গেলেন।’
জেহফিলের হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। রাগ হলে তার মাথা ঠিক থাকে না। কিন্তু বাটারফ্লাইয়ের সামনে লাগ দেখানো যাবে না। বাটারফ্লাই যদি কষ্ট পায়?
ইনান আবারও কিছু বলতে নেয়, তখন জেহফিল ইনানের হাত ধরে হেঁচকা টান মারল, কথা গলায় আটকে কাশি উঠে যায় তার। গিয়ে পড়ল জেহফিলের কাঁধে। হুট করে টান মারায় গাড়ির সাথে কপালে হালকা ব্যথাও পায়।
ইনানকে কাঁধে তুলে জেহফিল সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। ইনান ছোটার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করতে লাগল।
ইনানকে এনে খাটের উপর ফেলল জেহফিল। ইনানের উপর উঠে এসে দুই হাতের মাঝে বন্দী করল। ইনানের নাকের কাছে চুমু দিতে চাইলে ইনান সরে যায়। জেহফিলের অন্তঃকরণে আগুন জ্বলে উঠতে লাগল ধীরে ধীরে। রাগ কমানোর জন্য ইনানকে কাছে টানতে চাইছে আর ইনান কিনা উল্টো দূরে সরে গিয়ে তার রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে!!
‘বেবি, আমার দিকে ফিরো.. ফিরো না সোনা.. কপালে গভীর চুমু দাও।’ অস্থির গলায় বলল। যেন এখন ইনানের সান্নিধ্য পাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।
ইনান মুখ সরিয়ে নিলো,
‘এসবের মুডে নেই এখন, যা বলছি তার উত্তর দেন।’
‘নাহলে যে আমার রাগ কমবে না বাটারফ্লাই।’
ইনান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল,
‘রাগ যেখানে আমার হওয়ার কথা সেখানে আপনি রেগে আছেন? অদ্ভুত!’
জেহফিলের কানে কোনো কথা গেল না। সে ইনানকে কাছে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল।
ইনানের মাথায় কোনো একটা ভাবনা খেলে গেল। জেহফিলের মোবাইল তার হাতেই ছিল। সে ব্লকলিস্টে গেল। এবং যা ভেবেছিল ঠিক তাই। তার বাবার নাম্বার ব্লকে রাখা।
এদিকে জেহফিলের নিজের শার্ট খুলে ইনানের কটি খোলা শুরু করেছে। ইনান জেহফিলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল।
‘বাবাকে ব্লক করে রেখেছেন কেন?’
জেহফিল উন্মাদ হয়ে আছে ইনানেতে ডুব দেয়ার জন্য। তাই তার উন্মাদনার মাঝে ঐ বুড়োর কথা বলাতে তার মুড চলে গেল। সাথে রাগ হলো প্রচুর। ইনানের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে কাউচে ছুঁড়ে মারল।
‘কারণ ঐ বুড়োটা সারাদিন কল দিতো।’ ক্ষোভের সাথে বলল জেহফিল।
বাবাকে এমন বেয়াদবি সম্বোধনে ডাকায় ইনান ফুঁসে উঠে।
‘যে বয়সে বড় কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে জানে না সে আবার আমাকে ম্যানারস শিখাবে? আগে নিজে বেয়াদবি বাদ দেন।’
‘হয়েছে? শেষ জ্ঞান দেয়া?’
‘আজাইরা, আপনাকে জ্ঞান দেয়া মানে কলা গাছের সাথে কথা বলা। বাবা কল দিতো বলেই আপনাকে ব্লক দিতে হবে কেন?’
‘কারণ তিনি তোমার মতোই জ্ঞান দিতো। তোমার কী কী পছন্দ, তরকারিতে ঝাল কেমন খাও, কীভাবে চালালে তুমি কম্ফোর্টেবল হবে এসব আলতু ফালতু কথা বলে কান পঁচিয়ে ফেলত। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেয়ায় বাবার চিন্তা থাকবেই। তাই বলে সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করবে কেন এসব নিয়ে?’
‘আমার বাবা ঘ্যানঘ্যান করে? এগুলা বলা কি পাপ নাকি? বাবা শুধুমাত্র আপনাকে আমার ভালো খারাপ লাগা সম্পর্কে অবগত করছে।’
‘তোমার পছন্দ অপছন্দ তোমার বাবার চেয়েও ভালো জানি আমি। কোন রেস্টুরেন্টের কোন আইটেম পছন্দ, রাস্তার কোন স্টলের ফুচকা পছন্দ, কী টাইপের ড্রেস ইভেন তোমার কোন ডিজাইনের ইনার পছন্দ সবই জানি আমি।’
‘এগুলো সব বিয়ের পরই জেনেছেন।’
তীর্যক হাসে জেহফিল, ‘বিয়ের আগে থেকেই সব জানি।’
থম মেরে যায় ইনান, সন্দেহী গলায় বলল,
‘কীভাবে?’
‘ফলো করলে সবই জানা যায়।’
‘মানেহ!!’
‘তুমি কি বোকা? বাংলা কথা বুঝো না?’
‘তারমানে আপনি আমাকে স্টক করতেন?’
‘সব জায়গাতেই। শুধু রিয়েলেই না, সোশ্যাল মিডিয়াতেও।’
‘আপনি না বলেছিলেন আপনি এসব ইউজ করেন না?’
জেহফিল হাসে। তার হাসিতেই ইনান বুঝে যায় জেহফিলের মিথ্যে বলা।
‘কেন করেছেন আপনি এসব?’
‘তোমাকে পাওয়ার জন্য।’ গাঢ় স্বরে বলল জেহফিল।
‘পেয়ে তো গিয়েছেনই। তাও কেন থামছেন না?’
‘তোমাকে পুরোপুরি পাওয়া বাকি।’
‘মানে?’
জেহফিল ইনানের দুই পাশে দুই হাঁটুতে ভর করে বসেছিল। ইনানের মুখের কাছে মুখ এনে বলল,
‘তোমার প্রায়োরিটির লিস্টে প্রথম হওয়া বাকি এখনো।’
ইনান জেহফিলের কথা বুঝল না। জেহফিল তো অলরেডি ইনানের প্রায়োরিটিতে আছেই, এখানে প্রথম হওয়ার কথা আসছে কেন?
জেহফিল বলেই চলছে, ‘তুমি আমার থেকে ফুল গাছগুলোকে বেশি ভালোবাসতে, সকাল- বিকাল ফুল গুলোকে মুগ্ধ চোখে দেখতে, বারান্দায় গেলেই ফুল নিয়ে কথা বলতে, এসব আমার ভালো লাগত না। তোমার মুগ্ধ চোখের চাহনি শুধুমাত্র আমার জন্য বরাদ্দ থাকবে বাটারফ্লাই। এমনকি তোমার মিষ্টি কণ্ঠ শুধুমাত্র আমারই গুণগান গাইবে, আর কারো না। তাই..’
ইনান জেহফিলের কথা শেষ করল,
‘তাই আপনি গাছগুলো কেটে ফেলেছেন?’
জেহফিল মাথা নাড়ায়।
ইনানের মুখ তেঁতো হয়ে গেল ঘৃণায়। নিষ্পাপ গাছগুলোকে পাষাণের মতো পায়ে পিষেছিল জেহফিল, কতটা হিংস্র ছিল সে!
‘ইউ আর সিক জেহফিল।’
‘ইউ মেড মি সিক বাটারফ্লাই।’
জেহফিল বদলায়নি… ইনান আসলেই পাগল যে কিনা জেহফিলের গত কালকের মুখোশ পরা ভালো রূপে মুগ্ধ হয়ে মুখোশের আড়ালের জেহফিলকে ভুলেই গিয়েছিল। সারাদিনেও জেহফিলের ধ্বংসাত্মক রূপের কথা মনে পড়েনি তার। অথচ কয়েক ঘণ্টা পেরোতেই জেহফিলের আগের রূপ ফিরে এসেছে।
জেহফিল ইনানের কাছে আসার চেষ্টা করে। ইনান জেহফিলের হাত সরিয়ে জোরে ধাক্কা দেয়। হঠাৎ ধাক্কায় জেহফিল বিছানায় পড়ে যায়। ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে ইনানের প্রত্যাখ্যানে রাগ এবার আকাশচুম্বী হলো তার। খুব কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল, পারেনি, তার বাটারফ্লাই তাকে শান্ত থাকতে দেয়নি। এর শাস্তি তো পেতেই হবে তার।
ইনানকে শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে শান্তি দিবে তার বাটারফ্লাইকে, তবে কষ্ট দিয়ে না..
ইনান উঠে যেতে নিলে জেহফিল হাত ধরে বিছানায় উল্টো করে ফেলে। ইনানের পিঠের উপর উঠে এসে ইনানের মাথার নিচে বালিশ দুটো রাখে। তারপর ইনানের চুলের মুঠি চেপে ধরে একের পর এক আছাড় মারতে থাকে বালিশের উপর। তার বাটারফ্লাই ব্যথাও পাবে না, আবার তার শাস্তিও দেয়া হবে।
আকস্মিক আক্রমণে ইনান নিজেকে বাঁচানোর সুযোগ পায় না। জেহফিল ইনানের চুল চেপে ধরেছে। ইনান হাত দিয়ে জেহফিলের হাত ধরল, ছাড়ানোর আশায়। তার আগেই জেহফিল বালিশের উপর ধড়াম করে আঘাত করতে লাগল। নরম বালিশের কারণে যদিও ইনান ব্যথা পায়নি তবে বালিশের উপর কিছুক্ষণ বাদে বাদে মুখ চেপে ধরায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। মাথা দুদিক নাড়িয়ে ইনান জেহফিলের হাতের শক্ত বাঁধন থেকে চুল ছাড়াতে চায়। হিতে বিপরীত হয়ে যায়। ক্রোধান্বিত জেহফিল গর্জন করে ইনানের চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে, এক হাতে ইনানের দুই হাত পিঠের কাছে এনে চেপে ধরে।
ব্যথায় ডুকরে কেঁদে উঠল ইনান। খুব কষ্টে শ্বাস নিয়ে বলল,
‘ছেড়ে দিন জ..জেহফিল।’
জেহফিল ইনানের কথা শুনে থামে। ইনানের চুলের মুঠি ধরে নিজের দিকে ঘুরায়। চোখের জল পুরো মুখে লেপ্টে আছে। ব্যথায় চোখমুখ খিঁচে রেখেছে ইনান। জেহফিল ইনানের গাল চেপে ধরে, বাধ্য করে ইনানকে চোখ খুলতে। তার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
‘ছাড়ব? মাই লিটল বেবিগার্ল… এত প্ল্যান করে বিয়ে করেছি কি ছাড়ার জন্য? ছাড়ার কথা তোমার এই ছোট্ট মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো সারাজীবের জন্য।’
তারপর ইনানের আরো কাছে এসে প্রমত্ত গলায় বলল,
‘এটা আমাদের ভাগ্য ছিল বাটারফ্লাই। তাইতো তুমি স্বপ্নে রোদরঞ্জন হাতে ধরা দিয়েছিলে আমার কাছে। নিজেকে বন্দীর শিকল নিজ হাতে করেই নিয়ে এসেছিলে… এই ভাগ্য খণ্ডাবে কীভাবে? আমি…জেহফিল… বেঁচে থাকতে এই ভাগ্য খণ্ডানোর উপায় কোনোদিন খুঁজে পাবে না..খোঁজার সময়টুকুই যে আমি তোমাকে দিবো না সোনা… আমার মৃ’ত্যুর পরেও না.. ‘This is called FATE. OUR FATE’
.
.
চলবে..