#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৪
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
‘আগামী মাসে ট্যুরের প্ল্যান করেছি। কেউ যাতে স্পাউজ নিয়ে না আসে, এটা ফ্রেন্ডসদের জার্নি কেবল।’
মুগ্ধ বলল কর্কশ গলায়। ইনান ফোন হাতে চুপ করে আছে। সে এবং তার ফ্রেন্ডরা মিলে গ্রুপ কলে কথা বলছে এখন। সবাই এতক্ষণ তাকে ইচ্ছেমতো ধুয়ে দিয়েছিল তার বিয়ের খবর লুকানোতে। ইনান নিশ্চুপে সব হছম করে গিয়েছে।
ফারার বেল মাথায় আর্মি ছাঁটের চুল দেখা দিয়েছে। সে মাথায় ঘোমটা টেনে ফোনের সামনে বসে আছে, ভার মুখে বলে,
‘তুই খবরটা লুকিয়েছিলি আমাদের পঁচানির ভয়ে না, তুই লুকেয়েছিস মূলত হ্যান্ডসাম হাজব্যান্ড পাওয়ায়, ভেবেছিলি আমরা যদি নজর দেই, এতে তোদের সংসার লাইফে আবার আগুন লাগবে কিনা।’
ইনান তাও চুপ করে রইল। তার কিছু ভাল্লাগছে না। ফ্রেন্ডদের জবাব দিতেও না।
‘আচ্ছা তোরা কথা বল, আমি যাই।’
‘কেন? জেহফিল, সরি, দুলাভাই কি বারণ করেছে নাকি আমাদের কথা বলতে?’
বিরক্ত হয় ইনান, ‘সেরকম কিছু না, পটারি ক্লাসের কিছু হোমওয়ার্ক বাকি আছে।’
‘আমাদের না বলে তুই আর্ট একাডেমিতে ভর্তি হলি? বাহ!’ ভর্ৎসনা করল ফারা।
‘জেহফিল সেখানে টিচার হিসেবে আছে, ও-ই আমাকে ভর্তি করিয়েছে।’
আকাশ তাদের কথার মাঝে বাঁধা দিলো, ‘এসব আজাইরা কথা বাদ দিয়ে বল, তুই কি ট্যুরে যাবি? তোর জামাইকে নিতে পারবি না কিন্তু।’
‘সময় আছে, এখনই তো আর যাচ্ছিস না। পরে জানাব, বায়।’
ইনান ফোন কেটে দিয়ে যেই পিছু ফিরতে নিবে অমনি শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খায়। দেখল জেহফিল এতক্ষণ তার কানের কাছে আড়ি পেতে ছিল।
‘কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করছ নাকি বাটারফ্লাই?’ জেহফিল হেসে বলল।
ইনান ভয়াতুর চোখে জেহফিলের হাসির দিকে চেয়ে আছে। মিথ্যে হাসির আড়ালে থাকা রাগকে সে সহজে ধরতে পারল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘আমি যাব না, ওরা যাবে।’
‘কেন তুমি যাবে না? আমাকে যেতে বারণ করেছে বলে? আমাকে ছেড়ে তুমি যেতে চাও না তাই?’
ইনান উপর নিচ মাথা দুলায়। জেহফিল ইনানকে জড়িয়ে ধরে, ‘তুমি এত অ্যাডোরেবল কেন বলো তো? এত ভালোবাসো আমায়?’
ইনানের কানের পিঠে চুল গুঁজে দিলো জেহফিল।
‘আমার দিকে তাকাও।’
ইনান অস্বস্তি নিয়ে তাকায়। জেহফিল ইনানের গাল, গলা, ঠোঁটে অধর স্পর্শে ছুঁয়ে দিতে থাকে। ইনান হাত দুটো শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে আছে। গতকালের জেহফিলের আচরণে সে ভয় পেয়েছিল সে অনেক। সেই ভয় এখনো কাটেনি। গতকাল তাকে শাস্তি দেয়ার পর জেহফিল ইনানকে এমনভাবে কাছে টেনে নিলো, এত আদর করে কথা বলল যেন কিছুই হয়নি।
চুমুতে চুমুতে ইনানের গাল, গলা ভিজে গেল। তাও জেহফিল থামছে না, এদিকে ইনানের অস্বস্তির মাত্রা বেড়েই চলছে,
‘একটা কথা ছিল।’
নিজের কাজ না থামিয়ে বলল জেহফিল, ‘উম, বলো সোনা।’
‘আপনি..কালকে রাতে এত রিয়েক্ট করেছিলেন কেন?’
ইনানের গলায় শেষ চুমু দিয়ে মাথা তুলে জেহফিল, ‘কজ ইউ রিজেক্টেড মি।’
‘তাই বলে এই ধরনের আচরণ করবেন?’
‘আই ডিডন্ট হার্ট ইউ বাটারফ্লাই। এই জন্যই তো মাথার নিচে বালিশ দিয়েছি যাতে তুমি আঘাত না পাও।’
ইনান বিমূঢ় চেয়ে থাকে। শান্ত গলায় বলল,
‘আপনি কী চান জেহফিল?’
‘তোমাকে।’ ইনানের বিভ্রান্ত চোখে চেয়ে বলল জেহফিল।
‘ক্লিয়ার করে বলুন।’
জেহফিল মৃদু হাসে, ইনানের গলার ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে বলল,
‘তোমার ভালোবাসা, তোমার সময়, তোমার অনুভূতি, তোমার সুখ -দুঃখ, হাসি- কান্না, তোমার ধ্যান-জ্ঞান, চিন্তা ভাবনা, এমনকি তোমার অস্তিত্ব সব… সব কিছুর মালিক হতে চাই আমি বাটারফ্লাই। ঘুম থেকে উঠে আমাকে নিয়ে ভাবা শুরু করে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার চিন্তা তোমার মাথায় গেঁথে দিতে চাই। ইউ বিলং টু মি সেনোরিটা। ইউর এভ্রিথিং বিলংস টু মি…এভ্রিথিং।’
ইনানের গলায় কান্নার দলা পাকিয়ে গেল, চোখ দিয়ে নোনা জলের ফোয়ারা বইতে আরম্ভ করল,
‘আপনি জানেন তা অসম্ভব..’
‘শশহ, সম্ভব, তুমি চাইলে সব সম্ভব।’
‘আমি চাই না জেহফিল।’ কম্পিত কণ্ঠস্বর তার।
জেহফিলের চোখ জ্বলে উঠল। ইনানের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে গলায় চুমুর বদলে কামড়ে দিলো।
‘তোমার আর কোনো অপশন নেই বাটারফ্লাই। ইউ আর অল অ্যালোন। কেউ নেই তোমার পাশে, শুধু আমি আছি, তোমার ভালোবাসার স্বামী। তুমি বাধ্য আমার হতে। না চাইলেও তোমাকে আমার হতে হবে। আর আমার হওয়ার জন্য যে তোমার অস্তিত্বকে আমার কাছে হস্তান্তর করতে হবে সোনা, তুমি চাও কিংবা না চাও। যদি দিতে না চাও, তাহলে আমি তা ছিনিয়ে নিবো।’
হিসহিসিয়ে বলে উঠল জেহফিল।
‘সোজা কথা বলুন, আপনি যে আমাকে হাতের পুতুল বানাতে চান।’ রোবোটিক গলায় বলল ইনান।
‘ওয়াও!! আমার বাটারফ্লাইটা কত ব্রিলিয়ান্ট!’ জেহফিল মেকি অবাক হওয়ার ভান করল।
‘চলো, তোমার বুদ্ধিমত্তার জন্য তোমাকে পুরস্কৃত করব।’
এই বলে জেহফিল ইনানকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে গেল।
.
.
ভার্সিটির জন্য রেডি হচ্ছিল ইনান। কোথা থেকে জেহফিল চলে এসে ইনানের হাত চেপে ধরে। ভ্রুকুটি করে ইনান তাকিয়ে থাকলে জেহফিল বলল,
‘আই গেস তোমার পড়াশোনার প্রয়োজন নেই।’
কথাটা বুঝতে ইনানের সময় লাগল, ‘কেন?’
‘তুমি তো চাকরি-বাকরি করবে না। তো পড়াশোনা করে তো লাভ নেই।’
জেহফিল ইনানের ব্যাগ নিয়ে বই খাতা বের করতে লাগল।
‘এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।’
‘কম কমই করছি।’
ইনান জেহফিলের হাত থেকে বইগুলো টেনে নিলো,
‘আপনার ইচ্ছে নেই পড়াশোনার, তাই বলে কি আমার থাকতে পারে না? চাকরি করি বা না করি, সার্টিফিকেট অর্জন করতে চাই আমি।’
জেহফিল কথা না বলে ইনানের হাত থেকে আবারও ছিনিয়ে নিলো বইখাতা। আগুন ঝরা চোখে ইনানের দিকে চেয়ে একটা খাতা নিয়ে দু টুকরো করে ফেলল। ইনান হতবাক চেয়ে থেকে চিৎকার করল। জেহফিল বইয়ে হাত দিতে নিলে ইনান জেহফিলের হাত চেপে ধরে। দুজনের মাঝে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। ইনান কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘প্লিজ জেহফিল, পায়ে ধরি আপনার, পড়ালেখাটা এভাবে মাঝ পথে বন্ধ করিয়েন না, আমার অনেক স্বপ্ন পড়ালেখা নিয়ে।’
জেহফিল ইনানের গাল চেপে ধরল, ‘ইউ নো বাটারফ্লাই, আমি কেন তোমাকে পড়ালেখা করাতে চাচ্ছি না? কারণ তুমি সকলের মধ্যমণি। সবাই তোমাকে ভালোবাসে, কেয়ার করে যা আমি চাই না। তোমাকে ভালোবাসার অধিকার আমার। তোমার ছেলে ক্লাসমেটদের সাথে মেলামেশা আমি পছন্দ করি না। ইভেন মেয়েদের সাথেও না। আর্ট একাডেমিতে তোমাকে চোখের সামনে রাখা যায় যা তোমার ভার্সিটিতে পারা যায় না। সবাই তোমাকে দেখবে, কথা বলবে, তোমার সাথে হাসাহাসি করবে, আমি সহ্য করব না এটা।’
এটা শুনে ইনান তড়িৎ গতিতে বলল, ‘তাহলে আমি ক্লাস করব না। শুধু পরীক্ষা দিবো। প্লিজ জেহফিল, হাম্বল রিকুয়েস্ট করছি..প্লিজ।’
বহু কষ্টে জেহফিলকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ইনান তার পড়ালেখা বাঁচালো। শর্ত একটাই, সে ক্লাস করবে না, শুধু পরীক্ষা দিবে। এই সুযোগে জেহফিল ইনানের মোবাইলও নিয়ে নিলো,
‘পরীক্ষার সব আপডেট আমি দিবো। মোবাইল লাগবে না।’
স্তিমিত কণ্ঠে বলে ইনান, ‘বাবার সাথে…’
‘রাতের বেলায় নির্দিষ্ট একটা টাইমের মধ্যে তোমার বাবার সাথে কথা বলতে পারবে।’
ইনান পরাস্ত যোদ্ধার ন্যায় হার মেনে নিলো, মেনে নিতে বাধ্য হলো। শুধুমাত্র পড়ালেখার জন্য।
‘আপনি খারাপ জেহফিল…অনেক খারাপ।’
‘আমি জঘন্য।’ ফিসফিস করে বলে ইনানের গালে হাত বুলিয়ে চুমু খেল জেহফিল ।
ইনান জেহফিলকে সরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। টিভি ছেড়ে সোফায় এসে বসে থাকে। শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে টিভির দিকে। কেন যেন মনটা কু গাইছে তার। মনে হচ্ছে তার আশা ভরসা ধীরে ধীরে ধূলিসাৎ হতে যাচ্ছে।
.
.
তাজবীরের বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেছে। গত একঘন্টা ধরে সে করিডোরে ঘুরপাক খাচ্ছে। আশায় আছে জেহফিলের গার্লফ্রেন্ড বা ওয়াইফ যেটাই হোক, ওর সাথে কথা বলার। কিন্তু শালার জেহফিল আঠার মতো চিপকে আছে মেয়েটার সাথে। সরেইনা। মেয়েটার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় রেখে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে তাজবীরের মুখ বিকৃত হয়ে আসলো। ঢং।
ঘামে হাত চিটচিটে হয়ে আছে ইনানের। তাও জেহফিল তার হাত ছাড়ছে না। জেহফিল ইনানের পাশের চেয়ারে বসে ল্যাপটপে অফিশিয়াল কাজ করছে। ইনানের ক্লাস শেষ হওয়ায় জেহফিলের সামনে মূর্তির মতো বসে থাকতে হচ্ছে। জেহফিল থেকে ছাড়া পাবার আশায় বলল,
‘ক্ষিদে পেয়েছে প্রচুর।’
জেহফিল পাশ থেকে কেকের বক্স দিলো। ইনান তা সরিয়ে বলল,
‘এসব না, ভাত খেতে ইচ্ছে করছে, ছয় পদের ভর্তা দিয়ে, সাথে ডাল।’
‘এখন ভাত, ভর্তা কোথায় পাবো বাটারফ্লাই?’
‘কোনো রেস্টুরেন্টে চলুন।’
‘না।’
‘তাহলে বাড়ি চলুন।’
‘আর পাঁচ মিনিট।’
‘আমি আর পারছি না।’
ইনান পেট চেপে ধরে বলল। অগত্যা জেহফিলকে কাজ ফেলে উঠতে হয়। কয়েকটা ফাইল হাতে নিয়ে বলল,
‘তুমি ব্যাগ গুছাও। আমি যাবো আর আসবো।’
জেহফিল ইনানের হাত ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইনান তাড়াতাড়ি হাত পানিতে ভেজাল। গরমে আর ঘামে হাতের অবস্থা বেহাল, তার উপর কী টাইট করে ধরে রেখেছিল জেহফিল।
‘হ্যালো বাটারফ্লাই।’
অপরিচিত কারো কণ্ঠে জেহফিলের দেয়া নিকনেমে ডাকায় চমকে উঠে ইনান। পেছন ফিরে দেখে তাজবীর প্যান্টের পকেটে হাত পুরে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম জেহফিল ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের মুখে বাটারফ্লাই ডাক শোনায় ইনানের অদ্ভুত লাগল, সাথে বিরক্তিও।
‘কী চাই?’
‘তার মানে আপনার নাম বাটারফ্লাই?’ মিষ্টি হেসে বলল তাজবীর, হাসার কারণে টোল পড়ে ডান গাল দেবে গেল।
ইনান কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘আমার নাম ইনান। বাটারফ্লাই আমার হাজব্যান্ডের দেয়া নিকনেম।’
‘ইনান থেকে বাটারফ্লাইটাই বেশি স্যুট করে আপনাকে। বাই দ্য ওয়ে, আমাকে চিনেছেন? ওই যে ঐদিন হেল্প করেছিলাম..’
‘কী বলবেন সেটা বলুন।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাজবীর, নিচের ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘বলার তো আছে অনেক কিছুই। বাট আই ডোন্ট থিংক কথা বলার জন্য এই প্লেসটা উপযুক্ত।’
‘তাহলে আপনার সাথে আমার কোনো কথাই নেই। প্লিজ লিভ।’
‘হোয়াই সো রুড বাটারফ্লাই?’
‘ডোন্ট কল মি বাটারফ্লাই।’ কঠিন গলা ইনানের।
তাজবীর যেন মজা পেল, এক পা এগিয়ে বলল,
‘কেন বাটারফ্লাই? এই নামে ডাকা কি নিষিদ্ধ আমার জন্য বাটারফ্লাই?’
প্রতিটা লাইনে এই নামে ডাকায় ইনানের মাথা গরম হয়ে গেল। সে উদ্যত হলো কিছু বলার জন্য কিন্তু থেমে গেল দরজার নিকটা কারো ছায়াকে এগিয়ে আসতে দেখে। শিট! জেহফিল আসছে। এখন তাজবীরকে তার কাছাকাছি দেখলে আবার না জানি পড়ালেখা সত্যি সত্যি বন্ধ করে দেয়, সাথে আবার কোনো শর্ত আরোপ করে!!
ইনান তাজবীরকে দু হাতে জোরে ধাক্কা মেরে পাঁচ ফুট দূরত্বে চেয়ারে বসে পড়ল।
আচানক ধাক্কায় তাজবীর ‘আরে বাটারফ্লাই…’ বলে প্রায় পড়ে যেতে নিচ্ছিল।
মেঝেতে মাথা আঘাত করার আগেই বেঁচে গেল কারো কোলের মধ্যে পড়ায়। দেখল জেহফিল রাশভারী মুখে তাকে দুহাতে আগলে আছে। তবে সেই আগলিয়ে রাখাটা মাত্র এক সেকেন্ডের জন্য ছিল যখন জেহফিল তাজবীরের মুখে বাটারফ্লাই ডাকটা শুনল। সে হাত সরিয়ে নিলো তাজবীরের পিঠ থেকে, যার ফলে ধরাম করে ফ্লোরে বারি খেল তাজবীর।
জেহফিল কঠিন আকৃতির মুখাবয়ব ধারণ করে তাজবীরের নিকট চেয়ে ছিল। তার রাগের আগুন জ্বলে উঠল। সেই উত্তাপ টের পেল ইনান। ইনান আঁচ করল রাগ বাড়তে থাকলে জেহফিল ভয়াবহ কোনো কাণ্ড ঘটাতে পারে। জানে কেন তার এমন মনে হলো, তবে জেহফিলকে দেখে মনে হলো এক্ষুণি লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাবে। যদি জেহফিল ভাবে তাজবীরের সাথে ইনানের ভালো সম্পর্ক আছে? কিংবা ইনান তাজবীরের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে, এসব ভাবনা জেহফিলের মাথায় আসলে ইনান শেষ হয়ে যাবে।
তাই ইনান উঠে জেহফিলের হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসল। তাজবীরকে তিরস্কার করতে আরম্ভ করল যাতে জেহফিল ভাবে ইনানের সাথে তাজবীরের আসলেই কোনো সম্পর্ক নেই।
তাজবীর মাথা ধরে ফ্লোর থেকে উঠতে নিলে হঠাৎ জেহফিল এসে তার কলার চেপে ধরে উঠিয় দেয়। ইনান চমকে গেল জেহফিলের হঠাৎ কাজে, সে দৌড়ে যায় জেহফিলের কাছে।
জেহফিল তাজবীরের কলার ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ও’কে বাটারফ্লাই ডাকার অধিকার একমাত্র আমার। তোর মতো লো স্ট্যাটাসের কোনো রাইট নেই আমার জিনিসকে আমার দেয়া নামে ডাকার।’
এই বলে সে তাজবীরের গলা চেপে ধরল শক্ত করে, ‘আর একবার ও’কে বাটারফ্লাই বলে ডাকলে এই গলা আর তোর শরীর, দুটোই থাকবে দুই জায়গায়।’
তাজবীরে গলা ধরে রুম থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দিলো জেহফিল। জেহফিলের রাগ বেশিদূর গড়ানোর আগেই ইনান জেহফিলকে টেনে নিয়ে বের হয়ে আসলো।
তাজবীর ফ্লোর থেকে উঠে ওদের চলে যাওয়া দেখল। তবে জেহফিলের রূঢ় দৃষ্টি প্রতিটা মুহুর্ত তাজবীরকে হুমকি দিতে লাগল যতক্ষণ না তারা গাড়িতে উঠে চলে গেল। তাজবীর ঘাড় মটকে রেলিংয়ে হাত রাখল। এই প্রথম জেহফিলের অগ্নিমূর্তির সাথে পরিচিত হলো ও। তবে অপমানটা দ্বিতীয় ছিল। দ্বিতীয়বারের মতো তাকে আবার অপমান করল, তাও তুই তোকারি করে আর তার স্ট্যাটাসকে নীচু করে। তাজবীরের চোয়াল শক্ত হলো। একটা মেয়ের সামনে জেহফিলের করা বাজে অপমানটা মেনে নিতে পারল না সে।
তাজবীর ভাবল, জেহফিলের নিজস্ব জিনিস বলতে কিছু আছে তাহলে। যেটায় হাত বাড়ালে জেহফিল রেগে যায়। বোধহয় সেই জিনিসটাকে ব্যবহার করেই জেহফিলকে শাস্তি দেয়া যাবে! এতে তার রিভেঞ্জ নেওয়াও হবে। ভাবতেই তাজবীরের ঠোঁটে তীর্যক হাসির দেখা মিলল।
.
.
সন্ধ্যায় বাসায় আসার পর জেহফিলের মুড ভালো হলো কিছুটা। তার কারণ অবশ্য ইনান। ইনান জেহফিলকে সারা রাস্তা তাজবীরকে গালি দিতে দিতে এসেছে, যাতে জেহফিল আশ্বস্ত হয় ইনান তাজবীরের প্রতি ইন্ট্রেস্টেড না।
জেহফিল রান্নাঘরে কিছু একটা করছে, গায়ে অ্যাপ্রোন জড়িয়ে ছুরি দিয়ে কাটাকুটি করছে। ইনান রান্নাঘরে এসে সাবধানের সাথে কথা বলল,
‘মোবাইলটা দেয়া যাবে?’
‘কেন?’
‘বাবার সাথে কথা বলব..’
জেহফিল ঝট করে তাকাল ইনানের দেখে, তা দেখে ইনান দ্রুত হাত নাড়িয়ে বলল, ‘আপনি না বলেছিলেন নির্দিষ্ট টাইম দিবেন।’
জেহফিল বিনা বাক্যে মোবাইল দিলো ইনানকে। ইনান খুশি মনে বারান্দায় চলে আসলো। নাম্বারে ডায়াল করা মাত্র কারো গরম নিঃশ্বাস ইনানের ঘাড়ে পড়ল। ইনানের দুই পাশে দুটো হাতের দেখা মিলল। এক হাতে মসৃত বড় ছুরি। মাথা ঘুরিয়ে দেখে জেহফিল তার কাছে। হঠাৎ আসায় ইনান ভয় পেয়ে গেল, বুকে থুতু দিয়ে বলল,
‘কিছু বলবেন?’
এর মধ্যে ইনানের বাবা ফোন ধরেছে। জেহফিল ইশারা করল লাউড স্পিকার অন করতে। ইনান হেজিটেট হয়ে অন করে কথা বলল। বাবার সাথেই কথা বলার পুরোটা সময় জেহফিল ইনানের কাছ থেকে এক পাও নড়ল না। ইনান যদিও খুব ইতস্ততবোধ করে বাবার সাথে কথা বলেছিল। কথা শেষে জেহফিল মোবাইল নিয়ে নেয়।
‘এখন থেকে যা বলবে সব লাউড স্পিকার দিয়ে বলবে।’ গম্ভীর গলায় শুধায় জেহফিল।
বাড়াবাড়ি মনে হলো ইনানের। তবে কিছু বলতে পারল না জেহফিলের হাতের ছুরি দেখে।
রাতের বেলা ইনান পড়া শেষ করে ডাইনিং এ গেল ডিনারের জন্য। টেবিলে রাখা খাবার দেখে বিস্মিত হলো সে। জেহফিল ছয় পদের ভর্তা আর ডাল করেছে। তখন তো সে মিথ্যামিথ্যি বলেছিল। জেহফিল মনে রেখেছে?
জেহফিল কিচেন থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে আসলো। ইনানকে চেয়ারে বসিয়ে প্লেটে ভাত বেড়ে দিলো।
‘কোনটা দিয়ে শুরু করবে? মাছ ভর্তা, মরিচ ভর্তা, চিংড়ি…’
তারমানে সন্ধ্যা থেকে জেহফিল রান্নাঘরে তার জন্য, তার কথামতো খাবার তৈরিতে ব্যস্ত ছিল! শুধু ইনান একবার মুখ ফুটে বলেছিল তার কী খেতে ইচ্ছে করছে!! ইনান চোখ বন্ধ করল। এই ছোটো ছোটো কেয়ারগুলোর কারণেই জেহফিলের প্রেমে পড়েছে সে। জেহফিলের প্রতিদিনের অদ্ভুত আচরণের মাঝে এই যত্নগুলোই ইনানকে বেঁধে রেখেছে। যতবার জেহফিল ইনানের ছোটো ছোটো প্রতিটা ব্যাপারে খেয়াল রাখে, ততবারই ইনানের মনে হয় এটাই জেহফিলের আসল রূপ, অন্য যেই কঠিন, অ্যাগ্রেসিভ রূপ, সেটা ভ্রম। আর এই কেয়ারগুলোর কারণেই ইনান প্রতিবার ভুলে যায় জেহফিলের করা কাজ গুলো…ফের ভালোবাসা জন্মে তার প্রতি। মেয়েদের মন এত কোমল কেন?
.
.
চলবে…