#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৭ [বোনাস]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
ইনান খাটে বসামাত্র হাতে ঠাণ্ডা অনুভব করল। নিরুদ্বেগ চাহনিতে হাতে তাকাতেই পিলে চমকায়। রক্ত! তার হাতে রক্ত। দেখল তার জামাতেও রক্ত লেগে আছে। ইনান হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে চেক করে। কোথাও কেটে গেল কিনা। কিন্তু কেটে গেলে তো সে ব্যথা পেত। ইনান তন্নতন্ন করে খুঁজেও শরীরের কোনো অংশে আঘাতের চিহ্ন পায়নি। হঠাৎ মাথায় আসে জেহফিলের হাত যেখানে যেখানে স্পর্শ করেছে সেখানেই রক্ত। মানে জেহফিলের রক্ত!
জেহফিল ইনানকে রুমে দিয়ে আর্ট রুমে চলে গেছে। জেহফিলের প্রতি ইনানের ভালোবাসা পাহাড়সম অভিমানে ঢাকা পড়লেও স্বামীর প্রতি কর্তব্য তাকে টেনে নিলো জেহফিলের কাছে। রুমের দরজা খুললে বিদঘুটে এক দৃশ্যে চোখ আটকে যায় ইনানের। জেহফিল ইনানের পোর্ট্রেট আঁকছে ক্যানভাসে, তুলির বদলে তর্জনী, রঙের বদলে রক্ত, আর প্যালেটের জায়গায় জেহফিলের হাত। ইনানের হাত মুখে চলে যায়। জেহফিলের হাত কাটা। পরপর কতগুলো আঘাতের চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে। ইম্যাচিওর কাপলের প্রেমে ঝড় আসলে প্রেমিক প্রেমিকারা যেমন ব্লেড দিয়ে হাত কাটে, তেমন কতগুলো পোঁচ কারি জেহফিলের হাতে। এখনো তাজা রক্ত গলগল করে হাত বেয়ে ফ্লোরে পড়ছে টুপটুপ করে।
ইনান রক্ত দেখতে পারে না। তার উপর সেই রক্ত দিয়েই জেহফিল তার ছবি আঁকছে দৃশ্যটা হজম হলো না ইনানের। সে তেড়ে গিয়ে ক্যানভাসটা উল্টে ফেলল। কালো রঙের কৌটা থেকে সবগুলো রঙ ঢালল নিজের রক্তিম ছবির উপর। হাত দিয়ে লেপ্টে পুরো ক্যানভাস কালো করে তবেই থামল ইনান। ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে জেহফিলের দিকে চায় সে,
‘এসব কী ধরনের পাগলামো?’
জেহফিল অট্টহাসি হাসল। হাত ভর্তি রক্ত, সেদিকে খেয়াল নেই তার। হুট করে তার হাসি থামিয়ে বিষণ্ন মুখে চাইল ইনানের দিকে। তার চেহারায় অসহায়ত্ব, নিগুঢ় হতাশা দেখে ইনানের বুক ধক করে উঠল। জেহফিলকে সে সবসময় স্ট্রং দেখে আসছে। এভাবে ভেঙে পড়তে দেখেনি।
জেহফিল ম্লান গলায় বলল,
‘এক ঘন্টা ছাব্বিশ মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড তুমি আমার চোখের আড়ালে ছিলে বাটারফ্লাই। ঐ বদ্ধ গোডাউনে চিৎকার করছিলে সাহায্যের জন্য। আমি নিজেকে কত কষ্টে তোমার কাছে যাওয়া থেকে সামলেছি জানো? তোমাকে কষ্ট দিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম আমি। তাই নিজের হাত কাটলাম তোমাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তিস্বরূপ।’
ইনান মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। এতদিন ধরে যেই মানসিক কষ্ট দিয়েছে জেহফিল সেই শাস্তি নিজেকে দিলো না কেন? শুধু শরীরের কষ্টটাই চোখে পড়ছে? মনের না?
জেহফিল হঠাৎ উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ইনানের কাছে ছুটে আসল। রক্তমাখা হাতে ইনানের গাল ধরে অস্থির হয়ে বলল,
‘একটু হেল্প করবে আমায় বাটারফ্লাই?’ স্কাল্পচারের ধারালো ছু’রিটা নিয়ে ইনানের হাতে দিলো, ‘আমার হাতটা একটু কা’টবে? আমি যখন নিজের হাত কেটেছি তখন একটুও ব্যথা পাইনি। তাহলে তো আমার কোনো শাস্তি পাওয়াই হলো না! তুমি…তুমি একটু সাহায্য করো না সোনা! ছু’রিটা দিয়ে হাতটা কা’টো আমার। তোমার দেয়া আঘাত যদি একটু গায়ে লাগে আমার! প্লিজ…’
জেহফিল ইনানের হাত ধরে ছু’রিটা নিজের হাতে ছোঁয়ায়। ইনান তড়িঘড়ি করে হাত সরিয়ে ফেলতে চায় তবে পারে না। জেহফিল জোর করে হাত আঘাত করতে চাইছে। ইনানের এমনিতেই মাথা ঘুরছে এত রক্ত দেখে, ধস্তাধস্তি করার পর ইনান ছু’রিটা ফেলে দিয়ে অনুরোধ করে জেহফিলকে,
‘পাগলামি করবেন না, হাতটা ব্যান্ডেজ করুন জেহফিল। প্লিজ। রক্ত সহ্য করতে পারছি না। মাথা ঘুরাচ্ছে।’
ইনানের মাথা ঘুরানোর কথা শুনে থামে জেহফিল। ইনান উঠতে নেয় এইড বক্স আনার জন্য। জেহফিল তার হাত ধরে থামিয়ে দেয়।
‘আমি যাচ্ছি। তোমার কিছু করতে হবে না। শুধু আমার সামনে বসে থেকো। চোখ বন্ধ করে হলেও।’
জেহফিল রুমে গিয়ে হাত ব্যান্ডেজ করে নেয়। ইনান বারবার বলছিল হাত গভীর করে কেটেছে কিনা, হাসপাতালে নেয়া লাগবে কিনা। জেহফিল বলল এসব কিছুই করতে হবে না, এমনি ঠিক হয়ে যাবে।
ডিনারের জন্য ইনান নিজেই রান্না করল। জেহফিল কিচেন কাউন্টারে বসে আছে। একটু আগেও ইনানের সাথে রাগারাগি করেছে ইনানের রান্না করা নিয়ে। ইনান শুনেনি। মানবিকতার বিচারে সে কখনো অসুস্থ একজন মানুষকে রান্না করতে দিতে পারে না।
জেহফিল নিষ্পলক ইনানকে দেখছে। তার বাটারফ্লাই এত স্নিগ্ধ! কান্নার পর চোখমুখ ফুলোফুলো হয়ে আছে। চোখজোড়া আর গাল দুটো গোলাপী। কী মিষ্টি লাগছে দেখতে! তার বাটারফ্লাইকে কি সে আরো কাঁদাবে? এই কোমল চেহারা দেখার জন্য?
জেহফিলকে খাইয়েও দিতে হলো। যদিও জেহফিলের বাম হাত আঘাতপ্রাপ্ত, তাও সে নিজের দুই হাতকে অক্ষম বলে দাবি করল ইনানের নিকট। অগত্যা ইনান খাইয়ে দিলো জেহফিলকে।
.
পরদিন থেকে সেই একই রুটিন। যেন কাহিনী একই বৃত্তে চক্রাকারে ঘুরছে। খাও,দাও, ঘুমাও, চোখের সামনে থাকো, ভালোবাসো, যাবে না কোথাও, রাগারাগি। আবারও খাও, দাও, ঘুমাও… লুপ!
দীর্ঘশ্বাস!!
সারাদিন নিরব জঙ্গলের মাঝে থাকতে ভালো লাগছে না ইনানের। একটু নিজের বাড়িতে যেতে মন চাইছে। শহরে যেতে, চেনা জায়গায় গিয়ে আনন্দ করতে। এমনকি তার ফ্রেন্ডদেরও মিস করছে সে। যতই স্বার্থপর হোক তারা, ইনানের ফ্রেন্ড তো!!
বাড়ির বাইরেও বের হতে পারে না জেহফিলের অনুমতি ছাড়া। ইনান কথার অবাধ্য হলে জিনিসপত্র ভাঙচুর করে জেহফিল। আবার নিজেই সব পরিষ্কার করে। ইনানের দমবন্ধ হয়ে আসছে। যেন সে সোনার খাঁচায় আটকে আছে। যেই খাঁচা বাইরে থেকে দেখতে চাকচিক্যময় মনে হলেও ভেতরে থাকা পাখি ছটফট করছে খোলা আকাশে ডানা ঝাপটানোর জন্য।
.
ধোঁয়াটে কুয়াশা পরিবেশ জুড়ে। আবহাওয়া শীতের জানান দিচ্ছে। এই মাসেই বোধহয় শীত শুরু হবে।
আকাশে থালার মতো চাঁদ। জোৎস্নার আলোয় স্নানের উদ্দেশ্যে ইনান মিনি ছাদে এসে দাঁড়ায়। কতদিন এভাবে চাঁদের আলো গায়ে মাখা হয় না!!
ইনান প্রাণভরে শীতল বাতাস টেনে নিয়ে নিজের অন্তরাত্মাকে শীতল করল। এই আবহাওয়ায় এক কাপ কফি হলে মন্দ হতো না।
ইনান পারল না আর চাঁদের আলো উপভোগ করতে। জেহফিল এসে তাকে টেনে নিয়ে গেল রুমে। দরজা জানালা আটকে পর্দাও টেনে দিলো। ইনানের তৃষ্ণার্ত মন হাহাকার করে উঠল চাঁদের আলো থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য।
জেহফিল ইনানকে শুইয়ে নিজেও ইনানের বুকে মাথা রাখল। ইনান জেহফিলের মাথা সরিয়ে দিয়ে উঠে বসল। জেহফিল বিরক্ত হয়।
‘তুমি চাঁদের জন্য আমাকে সরিয়ে দিচ্ছ?’
‘দিচ্ছি। কী করবেন এখন? চাঁদকে গিয়ে খু’ন করবেন?’
‘সেই ক্ষমতা থাকলে তো কবেই চাঁদকে ধ্বংস করে দিতাম?’
‘জেহফিল!’
‘ইয়েস প্রিন্সেস?’
‘আপনি বদ্ধ উন্মাদ।’
‘শুধু তোমার জন্য।’
‘কেন এমন করছেন আমার সাথে? আমি কি পুতুল?’
‘নাহ, তুমি আমার বাটারফ্লাই।’
‘তাহলে কেন বাটারফ্লাইকে উড়তে দিচ্ছেন না? কেন গলায় সুতো বেঁধে রেখেছেন?’
‘তোমার ভুলেই যে তুমি আমার কাছে বন্দী বাটারফ্লাই। রোদরঞ্জনের বি’ষ পান করেছ তুমি। বি’ষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তোমার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। পড়ে আছো শুধু রোদরঞ্জন ফুলের উপরে। এর দায়ভার কি আমার? বেবি বাটারফ্লাই?’
ইনানের কণ্ঠ জড়িয়ে আসলো। জেহফিল ঘুরেফিরে দোষটা ঠিক তার উপরেই দিচ্ছে।
ইনানের কান্না দেখে জেহফিল তর্জনী দিয়ে চোখের পানি মুছে দিলো।
‘কাঁদবে না বাটারফ্লাই। অকারণে কান্নার অধিকার নেই তোমার। তুমি তো হাসবে। আমার মতো ভাগ্যবান স্বামী পাওয়ায় তোমার তো খুশি হওয়ার কথা। তাহলে কেন এই কান্না?’
জেহফিল ইনানের গালে হাত বুলিয়ে হঠাৎ করে ঘাড় চেপে ধরে,
‘কাঁদবে আমার কষ্টে। তোমার নয়। তোমার তো কোনো কষ্ট নেই। আমি তো তোমাকে কষ্টে রাখছি না! তুমি সুখে আছো। কাঁদবে সুখের কান্না। ঐ কান্নার অধিকার আছে তোমার। বুঝলে?’
ইনান সাথে সাথেই জেহফিলের পা জড়িয়ে ধরে বসে পড়ল। হেঁচকি তুলে কাঁদতে আরম্ভ করল সে। মিনতি করে বলল,
‘প্লিজ… জেহফিল… আমি একটু শান্তি চাই। একটু শান্তি দিন আমায়। একটু ভালো থাকতে দিন। এখনো ভাবার সময় আছে..’
জেহফিলের মাথা দপ করে জ্বলে উঠল। ইনানের টুঁটি চেপে দাঁড় করায়। গর্জন করে বলে,
‘আমি তোমাকে শান্তি দেই না? হ্যাঁ? তোমাকে ভালো থাকতে দেই না? কীভাবে এই কথা বলতে পারলে তুমি? কীভাবে এই কথা তোমার ভাবনাতে এলো? বুক কাঁপল না একবারও? কী না করেছি তোমার জন্য! তোমার পছন্দের সবকিছু তোমার পায়ে এনে ফেলেছি। যা যা আবদার করতে সব। পুরো পৃথিবীটাকে তোমার হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছি। নিজের থাকা, খাওয়া, ঘুম সব স্যাক্রিফাইস করে তোমাকে মাথায় তুলে রেখেছি। মাটিতে পা ফেলতে দেইনি নোংরা লাগবে বলে, ফুলের টোকাও লাগতে দেইনি। তাও বলছ আমি তোমাকে ভালো রাখি না? সুখে থাকতে দেই না?’
ইনানের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দেখে জেহফিল ছেড়ে দিলো। বার কয়েক কেশে ইনান নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। অঝোর ধারায় কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। সে তো এই সুখ চায়নি! সে তো চেয়েছে একটু স্বাভাবিক কাপলের মতো বেঁচে থাকার সুখ!
ইনান ফুঁপিয়ে কাদতে লাগল। জেহফিল তীব্র গলায় বলল,
‘কান্না থামাও। এক মিনিটের মধ্যে কান্না না থামালে খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলব।’
মুহুর্তের মাঝেই ইনান মুখ চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করল। এর চেয়ে খারাপ কিছু সহ্য করার ক্ষমতা নেই তার।
জেহফিল ইনানকে খাটের উপর ফেলে ইনানের শরীরের উপর ভার ছেড়ে দেয়, ইনানের গলায় চুমু দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘সরি তোমাকে ব্যথা দেয়ার জন্য। কিন্তু আমি যা বলেছি তার একটা কথাও মিথ্যে নয়। এটা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না বাটারফ্লাই। সময় আছে হাতে, তুমিই তো বললে, তাই তোমার উচিত হাতে থাকা সময়ের মাঝেই এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া, ভাগ্য কে মেনে নেওয়ার।’
ইনান সিলিংয়ের দিকে চেয়ে আছে। আসলেই কি সে ভাগ্যকে মেনে নিতে পারবে?
.
.
গভীর রাত। হাড় হিম নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারিদিকে। অন্ধকারে ইনান খুব সাবধানে ক্লজেটের দরজাটা খুলল। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে খাটে ঘুমানো জেহফিলের দিকে তাকালো। কফির সাথে ঘুমের ঔষধ মিক্স করে দেয়ায় জেহফিলের ঘুম এত সহজে ভাঙবে না মনে হচ্ছে। ঘুমের ঔষধ পেয়েছিল জেহফিলের বক্স থেকেই, আগে ঘুম না আসলে জেহফিল ঘুমের ঔষধ খেত।
ইনান পা টিপে টিপে হেঁটে জেহফিলের কাছে যায় আবার। চেক করে নেয় আসলেই ঘুমাচ্ছে কিনা। যখন নিশ্চিত হলো জেহফিল গভীর ঘুমে মগ্ন তখন ফিরে আসলো ক্লজেটের কাছে। খুঁজতে লাগল হ্যান্ডকাফ। পেল না। খুঁজে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। তাই ইনান একটা ওড়না নিয়ে জেহফিলের কাছে গেল। হেডবোর্ডের সাথে সাবধানে জেহফিলের দুইহাত বাঁধল, টাইট করে। খুব সতর্ক হয়ে। তারপর নিজের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস হ্যান্ডব্যাগে ভরে নিলো। পালানোর জন্য যা যা লাগবে সবই নিলো। মোবাইল পেল না নিজের। জেহফিলের মোবাইলটা জেহফিলের পিঠের নিচে। জেহফিলকে সরানো মুখের কথা না। তাই ইনান জেহফিলের মোবাইল খুঁজতে গেল না আর।
দরজার কাছে এসে একবার পিছু ফিরে দেখল ঘুমন্ত জেহফিলকে। কী নিষ্পাপ মুখশ্রী! ঘুমের সময় নিষ্পাপ লাগলেও আদতে এই মানুষটি নিষ্ঠুরতায় কলুষিত।
ইনান ফিসফিস করে বলল,
‘ক্ষমা করবেন জেহফিল। আমি এই জীবনে অভ্যস্ত হতে পারব না। পারব না ভাগ্যকে মেনে নিতে। আমার ঠিকানা আপনি নন। আমার ঠিকানা মুক্ত আকাশে, সেখানে আপনি আমার জন্য জেলখানা…’
.
.
চলবে…
(মন্তব্য করবেন সকলে)