রোদরঞ্জন #পর্ব_৮ #আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

0
211

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৮
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

ইফাজ সাহেব বাসায় ফিরে ইনানকে আহত অবস্থায় দেখে ভেঙে পড়েন। জঙ্গলের কাহিনী বলার মতো পরিস্থিতি না থাকায় ইনান অবশ্য সত্য মিথ্যা বানিয়ে একটা কাহিনী বলে দিয়েছে। দুইটা শক একসাথে নিতে পারবেন না ইফাজ তাই ইনান ব্যাপারটা চেপে গেল।

ভোর ছয়টা। আকাশে মেঘ না থাকলেও গুড়ুম গুড়ুম ডাকছে। বারান্দায় থাকা বিভিন্ন জাতের ফুলগুলো ইনানের সাহচার্যের অভাবে অভিমানে পাতা নেতিয়ে রেখেছে। ইনানের কি সেই খেয়াল আছে? তার বিচরণ যে এখন চিন্তার জগতে।

ইনান বারান্দায় চেয়ারে দ আকৃতিতে মাথা হাঁটুতে রেখে বসে আছে। চিন্তায় মাথার তার সব ছিঁড়ে আসছে যেন। বাবাকে কী বলবে? বাবা যদি মেনে না নেয় তাহলে কি জেহফিল ভিডিওটা‌ সত্যি…? নাহ!‌ ইনান মাথা চেপে ধরে বসে থাকে। যে করেই হোক বাবাকে মানাতে হবে। না মানালে তার সম্মান তার বাবার সম্মান দুটোই ধূলোয় মিশে যাবে। ইনানের ভাবনার মাঝেই তারস্বরে মোবাইল বেজে উঠে। আসার সময় জেহফিল ইনানকে নিউ মোবাইল কিনে দিয়েছিল। ইনান ফোন কানে নেয়। বিধ্বস্ত কণ্ঠে বলে,

‘কেন‌ ফোন করেছেন?’

‘আমার বউকে ফোন করতে কারণ লাগবে নাকি?’

জেহফিলের জবাবে চুপ থাকে ইনান।

‘বাই দ্য ওয়ে, বাবাকে মানানোর চেষ্টা কত দূর?’

বাব্বাহ!! জেহফিল তো দেখি এক পা এগিয়ে। এখনই ইনানের বাবাকে বাবা ডাকা শুরু করেছে! ম্লান গলায় বলল,

‘এইতো, চলছে..’

‘চলছে…’ জেহফিলের অট্টহাসি শোনা গেল অপর প্রান্ত হতে, ‘বাসায় গিয়েছ পর্যন্ত তো বারান্দাতেই বসে আছো। বাবাকে মানিয়েছো কখন আবার?’

ইনান কিছুটা চমকায়। ইনানকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই জেহফিল আলতো সুরে বলে,

‘তোমার চমক লাগা দৃষ্টি‌ খুবই লোভনীয়, বাটারফ্লাই।’

ইনান এক মুহুর্ত কী যেন ভেবে চকিতেই রাস্তায় দৃষ্টিপাত করে। জেহফিল গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ইনানকে দেখছে। চোখে চোখ পড়া মাত্রই জেহফিল চোখ টিপে ঠোঁট গোল করে চুমু ছুঁড়ে দেয় ইনানকে।

‘আপনি এখানে কী করছেন?’

‘আমার বউকে নিতে এসেছি।’

ইনান চোখ বন্ধ করে কপালে হাত রাখে হতাশায়। চ কারান্ত বিরক্তির শব্দ তুলে বলে,

‘বিকেল তো এখনো হয়নি তাই না? আপনি চলে যান এখন। বাবা আরেকটু পর বের হলে আপনাকে দেখলে সমস্যা হবে।’

‘কী সমস্যা হবে? বাবাকে দেখলে ভালো মন্দ কথা বলব। যতই হোক, তার একমাত্র জামাই। ইগ্নোর করতে পারবেন না।’

‘প্লিজ জেহফিল। আপনার দুটো পায়ে পড়ি। সময় দিন না আমাকে জেহফিল! দুটো দিন সময় দিন আমাকে? প্লিজ।’ কণ্ঠে অনুনয় ইনানের।

এবার জেহফিলের ঠাট্টা ভরা কণ্ঠ শক্ত হলো, ‘কোনো সময় দেওয়া যাবে না। আজকের মধ্যেই যদি তুমি কথা না বলেছো…বাকিটা আর বলতে হবে না তোমাকে নিশ্চয়ই?’

‘আমাদের তো বিয়ে হয়ে গেছে তাই না? তাহলে এখন কেন এত ইনসিকিওরিটি? আমি তো চলে যাচ্ছি না কোথাও! একটু রয়েসয়ে বাবাকে বুঝাই?’

‘তুমি আমার বাহুডোরে আবদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই বাটারফ্লাই। তোমার বাবা সহজ সরল মানুষ, ওনাকে বোঝাতে হাইস্ট দুই ঘন্টা লাগবে, দুই দিন নয়। আর কোনো কথা না জান। তুমি এক্ষুনি বাবার সাথে কথা বলবে। রাখছি।’

জেহফিল ফোন‌ রেখে দিলো। ইনানের দিকে ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে গাড়ি রেখেই কোথায় যেন চলে গেল।

.
ইফাজ খান আজ ডিউটিতে একটু দেরিতেই যাবেন। কেননা তিনি কেস পলকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। ছেলেটা তাকে আইডল হিসেবে মানে। পলক একটা জেম! বুদ্ধিমান ছেলেটা এভাবেই কাজ চালাতে থাকলে বহুদূর যেতে পারবে।

ইনান গত এক ঘন্টা ধরে বাবার রুমে বসে আছে। ইফাজ খান বারবার বলেছিল কিছু বলতে চায় কিনা। কিন্তু ইনান বলবে বলবে করেই এক ঘন্টা কাটিয়ে দিয়েছে।

স্নেহপূর্ণ গলায় তিনি বললেন,’আম্মু, তোমাকে কেন এত টেন্সড দেখাচ্ছে? এমন কোনো কথা বলতে চাও যেটাতে তুমি হেজিটেট ফিল করছো?’

ইনান হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল।

‘টেইক ইওর টাইম দ্যান। তবে একটা কথা মনে রাখবে, আমি তোমার বাবা হওয়ার আগে তোমার বেস্টফ্রেন্ড। যা বলবে নির্দ্বিধায় বলবে।’

ইনান সোফা থেকে উঠে পা টেনে টেনে সোফায় গিয়ে বসল, ইফাজ খানের পাশে। ইফাজ খান ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,

‘তুমি কেন কষ্ট করে আসতে গেলে বাচ্চাপরী? বাবাকে বললে বাবা কি যেতাম না? বাবা কি বুড়ো হয়ে গেছি যে হাঁটতে পারবো না?’

ইফাজ খানের আদুরে ডাক শুনে ইনানের কান্না চলে আসলো। তার এত ভালো বাবাকে কীভাবে সে মিথ্যে বলবে? ইনান বাবাকে জড়িয়ে ধরল। ইফাজ হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন ইনানের চুলে। ইনান রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,

‘আমি…আমি অনেক খারাপ বাবা..আমি অনেক খারাপ!’

ইফাজ খানের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল মেয়ের এমন কথা শুনে। মেয়েকে তিনি কখনোই ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। ছুটির দিনেও তাকে ডিউটিতে থাকতে হয়। সারাদিনে তিন চারঘন্টা কিংবা তারও কম সময় মেয়ের সাথে থাকতে পারেন। বলতে গেলে গত তিন বছরে ইনান একা একাই বড় হয়েছে। তিনি কি কোনোভাবে মেয়েকে কষ্ট দিয়ে ফেললেন?

‘এভাবে বলবে না মা। তুমি দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো বাচ্চা।’

ইনান মাথা তুলল। কান্না চেপে ভেজা গলায় বলল,

‘বাবা..আমি..আমি একটা বড় কাজ করে ফেলেছি।’

‘কাজটা কি অনেক খারাপ?’

ইনান মাথা নাড়ালো উপর নিচ।

‘কাজটা কি আমাকে কষ্ট দেওয়ার মতো?’

ইনান আবারও মাথা নাড়ল।

‘কাজটা তোমাকে হ্যাপি করেছে?’

ইনান এবার স্থির। তারপর সময় নিয়ে নিজের সাথে যুদ্ধ করে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল।

‘তাহলে আমাকে বলতে পারো বাচ্চাপরী। যেই কাজটা আমার মেয়েকে হ্যাপি রাখে সেটা অবশ্যই ভালো কাজ। শুনো আম্মু, কে তোমার করা কাজে হ্যাপি থাকলো নাকি না সেটা ভাববে না একদম, তোমার সুখটাই মেইন।’

বাবার মন শান্ত করা কথাতে ইনান নিজেকে স্বাভাবিক করল। মাথা নিচু করে ধীর গলায় বলল,

‘আমি একজনকে পছন্দ করি।’

ইফাজ খানের বুক থেকে যেন ভারী কোনো পাথর নেমে গেল। তিনি তো ভেবেছিল বড় কোনো অঘটন ঘটেছে।

‘কাউকে ভালো লাগাটা কোনো খারাপ কাজ নয়। তুমি কাউকে পছন্দ করো এটা অবশ্যই ভালো খবর। তবে দেখার বিষয় হচ্ছে যাকে পছন্দ করো সে কি সঠিক মানুষ কিনা।’

ইফাজ খান থামলেন। আবার বললেন, ‘তবে তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে। তুমি সবসময় বেস্টটাই চুজ করবে। কারণ তুমি ইফাজ খানের মেয়ে ইনান খান।’

গর্বিত গলায় বলল ইফাজ। ইনান কান্নার মাঝেও হেসে দিলো।

‘তোমাকে হাসিতেই মানায় আম্মু। যেই পরিস্থিতিই হোক না কেন, সবসময় হাসবে। ইওর স্মাইল ইজ দ্য বিগেস্ট ম্যাজিক।’

ইনানকে হালকা দেখে ইফাজ এবার বললেন,

‘এবার কি জানতে পারি সেই লাকি মানুষটা কে?’

‘বাবা..’ ইনান দোনোমনা করে বলল, ‘উনি আমার ভার্সিটিতেই পড়েন। পাঁচ ইয়ারের সিনিয়র। আমাদের সম্পর্কের বেশ কয়েক মাস হয়েছে। সরি বাবা এতদিন লুকানোর জন্য, আমি খুব ভয়ে ছিলাম।’

শেষে দিয়ে ইনান মিথ্যে বলল।

‘নাম কী তার?’

‘জেহফিল। মাস্টার্সের স্টুডেন্ট তিনি।’

‘তাকে বলো আমার সাথে দেখা করতে।’

‘আচ্ছা।’

ইনান আরেকটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল,

‘আমি যদি তোমার থেকে কিছু একটা চাই তুমি কি দিবে?’

‘সেটা কি ঐ প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে?’

‘হুম।’

‘তুমি কি তাকে হালালভাবে পেতে চাও?’

ইনান এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে তাকালো। বাবা তার মনের কথা এক চুটকিতেই কীভাবে ধরে ফেলেছে! ইনান মাথা নিচু করেই রাখল, জবাব দিলো না।

ইফাজ মেয়ের হাত ধরলেন, ‘তোমার পছন্দের উপর আমার ভরসা আছে সবসময়। কিন্তু মা, বিয়েটা জানো, একটা বড় ব্যাপার। আমি আমার রাজকন্যাকে অন্যের হাতে তুলে দিবো, আর সে যদি তোমার মতো প্রিন্সেসের যোগ্য না হয়,‌বাবা হয়ে আমি তা কীভাবে মানব? আগে তাকে আনো, কথা বলি, খোঁজ খবর নেই। যদি দেখি সে তোমার যোগ্য, তাহলে আমার আপত্তি থাকবে না।’

ইনান উঠে দাঁড়ায়।

‘বাবার কি তোমাকে ধরে দিয়ে আসতে হবে?’

‘আমি পারবো বাবা।’

ইনান দরজার কাছে গিয়ে পেছন ফিরল, ইফাজ সাহেব মেয়ের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। ইনান ধরা গলায় বলল,

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি বাবা।’

‘তোমার থেকেও তোমাকে ভালোবাসি বাচ্চাপরী।’

.

.

ইনান ড্রয়িংরুমে বসে আছে। তার সামনে জেহফিল। জেহফিলকে এত ভদ্র দেখাচ্ছে যে ইনান তাজ্জব বনে গেল। গুড বয়দের মতো ফর্মাল শার্ট প্যান্ট পরে আছে, মাথার চুল পরিপাটি করে সাজানো। তার মুখটাও হাসি হাসি, সাথে হাসছে তার ধূসর চোখজোড়া। কোনো নার্ভাসনেসের চিহ্নটুকুও নেই। যেন সে তার বহুদিনের রেখে যাওয়া স্ত্রীকে নিতে এসেছে।

ইফাজ সাহেব রুম থেকে বের হওয়া মাত্রই জেহফিলকে দেখে চমকে গেলেন। জেহফিল নিজেও যেন অনেক চমকালো এমন ভান করে তাকালো সে। ভদ্র ছেলেদের মতো দাঁড়িয়ে ইফাজ খানের কাছে এসে সালাম দিলো হ্যান্ডশেইক করে।

অবাক চোখে চেয়ে ইফাজ বললেন, ‘তোমাকে আমি চিনি। তুমি না সে যে আমাকে ঐদিন রাতে সাহায্য করেছিলে?’

জেহফিল অমায়িক হাসে, ‘জি আঙ্কেল।’

কয়েকদিন আগে, রাতে ইফাজ সাহেব একটা কেস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। কেসটা নিয়ে এত টেনশন করছিলেন তিনি যে গাড়ি চালানোর মাঝেই তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো গাড়িও খারাপ হয়ে যায়। মাঝ রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা বোধহয় দ্বিতীয়টা নেই। তখন এত বৃষ্টি হচ্ছিল!! ঠিক সেই সময় দেবদূতের মতো উদয় হয় জেহফিলের। জেহফিল ঐ রাস্তা দিয়েই ছাতা মাথায় হেঁটে যাচ্ছিল। ইফাজ খানকে গাড়িতে অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখে ছুটে এসে সিপিআর দেয়।

ইফাজ খান স্বাভাবিক হলে এই ঝুম বৃষ্টির মাঝেও ছেলেটা নিজে টইটুম্বুর ভিজে ইফাজ খানের গাড়ি ঠিক করে দিয়েছিল। তারপর তাকে প্যাসেনজার সিটে বসিয়ে ইফাজ খানের বাড়িতে এসে পৌঁছে দেয়। রাস্তার মাঝে জেহফিল যখন জিজ্ঞেস করেছিল তার এত টেনশনের কারণ ইফাজ তখন‌ সব ঘটনা খুলে বলে। জেহফিল সবটা শুনে ইফাজকে শান্তনামূলক বাক্য শোনায়। ইফাজ খানকে আগে কেস থেকে সরিয়ে অন্যান্য বিনোদনমূলক কথায় ব্যস্ত রাখে। কথার মাঝে সে এমন চমৎকারভাবে ইফাজকে কেসের ব্যাপারে উৎসাহ দিল যে ইফাজ খান সেই মুহূর্তেই ম্যাজিকের মতো কেসটা সল্ভ করে ফেললেন। টেনশন মুক্ত হন তিনি। ভেতরটা তুলার মতো হালকা লাগছিল জেহফিলের সাথে কথা বলে। ইফাজ খানের এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল জেহফিল কোনো ম্যাজিশিয়ান সাইকিয়াট্রিস্ট। কী সুন্দর তার বলার ধরণ! প্রতিটা কথা কী সাজানো! কী বিনয়ী!

পরে অবশ্য জেহফিলের জীবন সম্পর্কে সবটুকু জানলেন তিনি। জেহফিল একজন আর্টিস্ট, এবং অনাথ। বাবা মা ছাড়াই ছোটো থেকে বড় হয়েছে একা। তা শুনে এত মায়া লাগল ইফাজ খানের যে তার বলতে ইচ্ছা করছিল, ‘তুমি চাইলে আমাকে বাবা ডাকতে পারো।’

.
ইনান কিছুটা বিস্মিত হলো জেহফিল আর বাবা যে আগে থেকেই পরিচিত তা জেনে। আর জেহফিলের যে এতো ভালো সাইড আছে তা শুনে দ্বিগুণ চমকায় সে। ভালো শব্দটা যেন জেহফিলের সাথে যায়ই না।

ইফাজ খান সোফায় বসলে জেহফিল নিজ থেকে উঠে চায়ের কাপ তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। ইফাজ খান জেহফিলের আন্তরিকতায় তো আগেই মুগ্ধ ছিলেন, এখন যেন আরো গভীরভাবেই জেহফিলের মায়ায় পড়লেন তিনি। বাবা মা ছাড়া বড় হওয়া সন্তান সাধারণত বখে যায়, যার ঠিক সম্পূর্ণ উল্টো জেহফিল। তার প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে ডিসিপ্লিন।

‘আঙ্কেল, আগে যদি জানতাম আপনি আমার প্রিয়তমার বাবা তাহলে বোধহয় ঐদিন আপনার কেয়ার আরো বেশি করেই নিতাম। যদি সেদিনের যত্নে কোনো ভুল হয়ে থাকে মাফ করবেন।’ জেহফিলের নম্র সুর।

ইফাজ খানের মন‌ গলে গেল নিমিষেই। এত কোমল মন কারো হয়? তিনি মেয়ের স্বামী হিসেবে জেহফিলকে দেখলেন। ছেলেটার মধ্যে আন্তরিকতার কমতি নেই। যখন হ্যান্ডশেইক করছিল তখন হালকা নিচু হয়ে জেহফিল তার হাতটা শ্রদ্ধা জানিয়ে বুকেও রেখেছে। তারপর ইফাজ খানকে বসিয়ে নিজে বসল, ইনানের পা সাবধানে চেয়ারে রাখল। তারপর ইনানের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে নিজেই টেবিলে রাখল। আর সবচেয়ে মনকাড়া ব্যাপারটা হলো, জেহফিল একবারের জন্যও ইনানকে তার নাম ধরে ডাকেনি, ডেকেছে, ‘আমার প্রিয়তমা’ নামে। এই ছোটো ছোটো ব্যাপারগুলো ইফাজের নজর এড়ালো না। তিনি জেহফিলের চোখে তার মেয়ের জন্য যেন খাঁটি ভালোবাসা দেখতে পেয়েছেন!

আর এদিকে ইনানের মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। জেহফিলের এ কোন রূপ দেখছে সে? এ কি আদৌ জেহফিল নাকি তার কোনো জমজ ভাই? কী নিষ্পাপভাবে জেহফিল কথা বলছে তার বাবার সাথে! গতকালের রাগী, সাইকো জেহফিলের সাথে আজকের নম্র ভদ্র জেহফিলের তফাৎ অনেক।

.
বিশ মিনিটেই জেহফিল ইফাজ খানকে নিজের হাতের মুঠোয় করে ফেলল। ইনান চোখ বড় বড় করে দেখছিল কীভাবে জেহফিল মাত্র কয়েক মিনিটে তার বাবার ব্রেইনওয়াশ করিয়ে দিয়েছে!! স্মুথলি হ্যান্ডেল করেছে সব। ব্রেইনওয়াশ যে কতটা মারাত্মক তা ইনান হাড়ে হাড়ে টের পেল! এদিক দিয়ে অবশ্য ইনানের সুবিধা হলো যে তাকে বাবার কাছে মিথ্যা বলতে হলো না।

ইফাজ খান যেহেতু জেহফিলের ব্যাপারে এ টু জেড সবই জানেন সেহেতু তার আর কোনো অমত থাকলো না। আর এমন একজন দায়িত্ববানের হাতে মেয়ে দিয়ে ম’রলেও তিনি শান্তিতে থাকবেন।

ইফাজ সাহেব তাদের বিয়ে আরও এক সপ্তাহ বাদে দিতে চাইলে জেহফিল সেখানেও ব্রেইনওয়াশ করিয়ে দিলো তার। সে একা থাকে, ছোটো থেকেই একা থেকে এখন আর প্রিয় মানুষকে ছেড়ে থাকতে চায় না সে। তার নাকি কষ্ট হয়। ব্লা ব্লা ব্লা…

সন্ধ্যাতেই জেহফিল কাজী ডেকে এনে তাদের দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে সেরে ফেলল। এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা হয়ে গেল যে ইফাজ কাউকেই বলতে পারল না।‌ অবশ্য ইনানই বারণ করেছে, বিয়ের ব্যাপারে কাউকে জানাতে। ইফাজ কারণ জানতে চাইলে ইনান বলল সময় আসলে সে সবাইকে বলবে, তবে আপাতত যাতে এই বিয়ের খবর আর কারো কানে না যায়।

ইফাজ মেয়েকে এখনই দিতে চাইলেন না। কিন্তু সেখানেও জেহফিলের ব্রেইনওয়াশ। ইনানকে বিদায় জানানোর সময় বাবা মেয়ে এত কাঁদল! তবে ইফাজ খান সন্তষ্ট হলেন মেয়েকে সঠিক মানুষের হাতে তুলে দিয়ে। তার বিশ্বাস জেহফিল কখনো তার মেয়েকে ফুলের টোকাও লাগতে দেবে না।

.

.

গাড়িতে বসে ইনানের কান্না থামছেই না। এই দুইদিনে তার জীবনের মোড় বদলে গেল চোখের পলকে। আসলেই, সৃষ্টিকর্তা যে কার কপালে কী রেখেছে তা কেউই বলতে পারে না। এই না সেদিন ইনান প্ল্যান করল ফ্রেন্ডরা সবাই মিলে ট্যুরে যাবে। একা একা বিদেশ ঘুরবে। তারপর বিদেশি বড়লোক একটাকে ধরে বেঁধে বিয়ে করবে। অথচ এখন!! ইনানকেই ধরে বেঁধে বিয়ে করে ফেলল এক জেহফিল নামক বিষ!!

ইনান হঠাৎ জেহফিলের দিকে ফিরে থু মারল। জেহফিল রাগল না, বরং হাসল। জেহফিলের পার্সোনালিটি ইনানকে বারবার বিভ্রান্ত করে দেয়। সে ধরতে পারে না আসল জেহফিলকে।

জেহফিল ইনানকে জোর করে ধরে নিজের কোলে বসিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করল। এক হাত পেটে রেখে আরেক হাতে ড্রাইভ করতে করতে বলল,

‘আমাদের বাসর রাতে যদি গোলাপের বদলে বেলীফুল থাকে কেমন লাগবে? তোমার বেলীফুল সবচেয়ে বেশি পছন্দ তাই না বাটারফ্লাই?’

তারপর নিজ মনে বিড়বিড় করে বলে, ‘আমি আর একা নই দুনিয়াতে, আমি আর একা নই…’

.
.
চলবে…

[আমি হাজার হাজার লাইন লিখে গল্প দেই আপনার দু-তিন লাইনে মন্তব্য করতে পারেন না কেন?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here