#রোদরঞ্জন
#অন্তিম_পর্ব [অর্ধেক]
#আশফি_শেহরীন_চিত্রা
[কপি করা নিষিদ্ধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজে এবং অন্য কোনো সাইটেও কপি করা যাবে না।]
.
.
সময় কত দ্রুত বয়ে যায়! মনে হয়, এইতো সেদিনই না শীত শেষ হলো..অথচ শীতের শেষ হওয়ার আজ পাঁচ মাস। সম্মুখে শান্ত, নির্মল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে গভীর শ্বাস নেয় পলক। হীরে খচিত তারা ঝিকিমিকি করছে গাঢ় নীল আকাশে। বড় চাঁদ সমুদ্রের বুকে হেলে গেছে। যেন সমুদ্রের অতলে এখনি ডুব মারবে। সমুদ্রের শো শো আওয়াজে মৃদু গর্জন তুলে তীরে আছড়ে পড়ছে। পায়ের দিকে তাকায় পলক। সফেদ ফেনারা গাঢ় হয়ে আবার মিলিয়ে নিজের অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। হিম বাতাস, বাতাসে ভেসে আসা বেলী ফুলের সুবাস- সবমিলিয়ে মনমোহনের পরিবেশ।
পলক এক পা সমুদ্রের ফেনা তুলা পানিতে রাখলে অনুভব করে তার পাশে কারো উপস্থিতি। মাথা তুলে দেখল তার স্বপ্নের রমণী আনমনা হয়ে চাঁদের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। পলকের ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা দেখা দেয়। বেলী ফুলের সুবাস তাহলে ইনানের কাছ থেকেই আসছে। আড় চোখে ইনানকে পর্যবেক্ষণ করে। সাদা লং গাউনে আবৃত ইনানের ছোট্ট দেহ, বাতাসে খোলা চুল এলোমেলো উড়ছে। চাহনি নির্বিকার। ইদানীং ইনানের চোখের ভাষা বোঝা দায় হয়ে পড়েছে পলকের জন্য। কেন যেন সে বুঝতেই পারছে না ইনানের মনে কী চলছে কিংবা তার আবেগ কী!
পলক ঠাণ্ডা হাত ইনানের সরু হাতের দিকে বাড়িয়ে দিতে গিয়েও থমকে যায়। মনের মধ্যে এক অদৃশ্য শিকল তাকে অচেনা অজানা বন্ধনে আবদ্ধ রাখছে। ইনানের দিকে এগোতে গিয়েও পারছে না কেন যেন…
আড়ষ্ট হয়ে হাত জোড়া পকেটে পুরে নেয়। তার উচিত ইনানের পাশে থাকা এই সময়টাতে। যদিও সে জানে না ইনান ভেতর থেকে আদৌ স্বাভাবিক আছে নাকি চিৎকার করে কাঁদছে। কয়েক মাসের মধ্যেই কত ধাক্কা সামলাতে হয়েছে মেয়েটাকে…
ইফাজ খান মা’রা গিয়েছেন। ইফাজ খানের যেই অবস্থা হয়েছিল তাতে উনি বিদায় না নিলেই বরং অবাক হতৌ পলক। কিছু ঘৃণ্য সত্যের মুখোমুখি হওয়ার পর, সত্যি বলতে, আগের মতো সম্মানটা ইফাজ খানের জন্য একবিন্দুও আসেনি পলকের। মুখোশের আড়ালে থাকা জন্তুমানবকে বৃথা মান্য করে এসেছিল…এত শার্প মস্তিষ্কের অধিকারী হয়েও পলক কখনো বুঝতেই পারেনি ইফাজের খোলসের আড়ালে যে কত জঘন্য একজন জানোয়ার আছে।
তাজবীরের মুখ থেকেই সবটা শুনেছিল সে। বেচারা এতগুলো বছর মনের মাঝে ক্ষোভ নিয়েই বেড়ে উঠেছিল। পুষে রেখেছিল মনের অভ্যন্তরে বিধ্বংসী প্রতিশোধের আগুন। তাও কত চতুরভাবে হ্যান্ডেল করলো! একটা আঙুল না তুলেও ইফাজ খানকে জনমের শাস্তি দিয়ে গেল সে।
তাজবীর ইফাজের অবৈধ সন্তান। তিনি ইনানের মাকে বিয়ে করার আগে তাজবীরের মায়ের সাথে প্রেম করে তাজবীরকে জন্ম দিয়েছিলেন। তাজবীর ছোট থেকেই একটা অচেনা জায়গায় বড় হয়েছিল। বুঝ হওয়ার বয়স থেকে দেখল সে এমন একটা জায়গায় যেখানে তার সমান, ছোট, বড় অনেক ছেলেমেয়েই রয়েছে। তথাকথিত ‘এতিমখানা’ নামে যে জায়গা পরিচিত। একজন স্যুটবুট পরনের ভদ্রলোক এসে তাকে প্রায়শই দেখে যেত। আদর করত, খেলনা কিনে দিতো। লোকটি তাকে বলেছিল তাকে বাবা বলে ডাকতে। অবুঝ তাজবীর তা-ই ডাকত। সাথে একজন ভদ্রমহিলাও ছিল অবশ্য। লোকটি সেই মহিলাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা তোমার মা।’
মা- শব্দটির সাথে নতুন পরিচয় কিশোর তাজবীরের সাথে। ছোটো থেকেই তার বুঝ বয়সের তুলনায় কম ছিল বিধায় তার মাথায় অনেক কিছুই ঢুকত না। কোনো ছেলেমেয়েদের মুখে কখনো ‘মা’ ডাক শোনেনি তাই সম্পূর্ণ অচেনা-ই ঠেকল তার কাছে। শুধু সে এটুকু জানত, যাদের কেউ নেই তারাই এই আশ্রমে থাকে। তখন তাজবীরের মনে শুধু এই একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খেত ‘তার তো বাবা আছে, মা আছে, তাহলে তাকে কেন এখানে থাকতে হয়?’ কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারত না।
চুপচাপ উপভোগ করত নামেমাত্র বাবার আদর। কিন্তু মায়ের আদর… সেটা সে কখনো পায়নি। মহিলাটি ছিল চমৎকার দেখতে, যথেষ্ট সুন্দরী। লম্বা ঘন চুল, মাথায় থাকত সানগ্লাস। একেক দিন একেক সাজে দেখা যেত তাকে। আশ্রমের ছেলেমেয়েদের মাঝে গুঞ্জন ছুটত, ‘পরী’ এসেছে। মহিলাটি তাজবীরকে কেন যেন হেলায় ফেলায় দেখত। তাজবীরের দিকে তাকাত যেন কোনো কুৎসিত জীবের দিকে তাকিয়ে আছেন। অন্যান্য ছেলেমেয়েরা তার কাছে আসলে তিনি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলতেন, অথচ তাজবীরের বেলাতেই ছিল তার নাক ছিটকে তাকানো… মা ডাকলে সাড়াও দিতেন না তিনি…
তাজবীরের যখন আরেকটু বয়স বাড়লো, একটু একটু বুঝ হলো, তখন দেখল ঐ বাবা নামের লোকটি একদম আসতেন না বললেই চলে। খুব..খুব কমই আসতো। দাড়োয়ান কাকাকে দিয়ে, স্যারদের মোবাইল দিয়ে কত চেষ্টা করত সে বাবাকে কল দেয়ার.. শুধু ওপাশ থেকে শোনা যেত ‘আপনি যেই নাম্বারে তা এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে, কিছুক্ষণ পর আবার কল করুন’। কিন্তু কিছুক্ষণ পর কল দিলেও একই কথা বারবার শোনা যেত।
কেমন যে কাটছিল বাবার খোঁজ ছাড়া, সেটা শুধুমাত্র তাজবীরই ভালো জানে। প্রতিদিন গেটের দিকে তাকিয়ে থাকত এই বুঝি তার বাবা কালো গাড়ি নিয়ে তাকে দেখতে আসবে। কিন্তু আসতো না…। যখন একেবারেই আশা ছেড়ে দিলো তখন তাজবীরকে ডাকা হলো আশ্রমের হেডস্যারের রুমে। তাজবীর বাবা এসেছে ভেবেই ছুটে যায়।
কিন্তু গিয়ে দেখল সেখানে শুধু ঐ মহিলাটি বসে আছেন। তার পরনে ঝলমলে থ্রিপিস এবং চুলে আটকানো বড় সানগ্লাস। চেহারায় ছিল মেকাপের আস্তর।
হতাশ তাজবীরকে দেখে মহিলাটি মনে হয় কিছু একটা বিড়বিড় করে বললেন। তখনি তাজবীর একটা বাচ্চা মেয়ের খিলখিল হাসার শব্দ শুনতে পায়। দেখে মহিলাটির চেয়ারের পেছন থেকে একটা ছোট্ট মেয়ে খেলনা তোতাপাখি হাতে বেরিয়ে আসলো। মেয়েটি দেখতে অসম্ভব সুন্দর। যেন পুতুল। গাল গুলো ফুলো ফুলো, গোলাপী ঠোঁট, দুপাশে ঝুঁটি বাঁধা- তাজবীরের ইচ্ছা করল গাল টেনে ছিঁড়ে ফেলে। মেয়েটা দেখতে একদম মহিলাটির মতো। বড় বড় চোখে তাজবীরের দিকে তাকিয়ে হাসছে। তাজবীর জানতো না তার যে এত কিউট ছোট একটা বোন আছে…।
‘মা..’ মুখ থেকে শব্দটি নিঃসৃত হতে না হতেই সপাটে চড় পড়ল তাজবীরের গালে।
‘একদম মা ডাকবে না আমাকে বেয়াদব বেজন্মা…’
চড়ের তোড়ে তাজবীরের ঘাড় সামান্য হেলে গেল। আকস্মিক চড় খেয়ে স্তব্দ হয়ে গেল তাজবীর। বুঝতে পারল না তার কী অপরাধ ছিল।
ছোট মেয়েটা অবাক চোখে চেয়ে বলল,
‘তুমি কি আমার ভাইয়া…’
মহিলাটি ধমকে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে, ‘ই…।’
নামটা তাজবীরের স্মৃতির পাতায় অস্পষ্ট। কারণ তখন সে তার করা অপরাধ খুঁজতে ব্যস্ত ছিল।
‘যাও, বাইরে যাও।’ কড়া স্বরে আদেশ করলেন মেয়েটাকে।
মেয়েটা মুখ ফুলিয়ে চলে গেল বাইরে। মহিলাটি তখন হাত ভাঁজ করে তাজবীরের সামনে দাঁড়ায়।
‘শুনো ছেলে, এতদিন ইফাজ সামনে থাকায় তোমাকে কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু এখন সময় এসেছে তাই বলছি। বড় হয়েছ, মাথায় ঢুকিয়ে নাও। তোমার মা-বাবা কেউ নেই। ইফাজ তোমাকে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিল সেই অজুহাতে তোমাকে এসে দেখে যায়। বুঝলে? সারাদিন কল করা বন্ধ করো। ইফাজ এতে বিরক্ত হয় সাথে আমিও। একটু আদর করে দেখে একদম মাথায় চড়ে গেছ দেখছি। অসভ্য ছেলে…’
আরো অনেক কড়া কথা শুনিয়েছিল মহিলাটা। তাজবীর খালি মাথা নিচু করে হজম করেছিল সবটা। তার কানে বাজছিল ‘তোমার মা-বাবা কেউ নেই’
তারপর থেকে তাজবীর কেমন যেন হয়ে গেল। ছটফটে দুরন্ত ছেলে চুপচাপ থাকতো। ইফাজ তাকে করুণা করেছে এতদিন- ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হতো অনেক।
তারপর অনেকদিন পর তাজবীর একবার গেটে বই খাতা হাতে ঢুকছিল আর সেই সময়ই একজন বয়স্ক মহিলা তার হাত ধরে থামায়। ভড়কে যায় তাজবীর। কারণ এই মহিলাকে গত কয়েকদিন গেটের কাছে ঘুরঘুর করতে দেখেছিল সে, আর তাকিয়ে থাকত তাজবীরের দিকে, অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে। সে পাগলনি মনে করে এড়িয়ে যেত। কিন্তু আজ হঠাৎ সসেই পাগলনির খপ্পরে পড়ে ভয় পেয়ে গেল সে। মহিলার এক হাত নেই, জামাকাপড় নোংড়া, চুলে জট পেকে আছে। মহিলাটি তাজবীরকে টেনে নিয়ে যায় এক সাইডে।
তাজবীরের গাল, চুল, এলোমেলো হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে, তার মুখে তৃপ্তির হাসি।
‘আব্বারে আব্বা।’
প্রথমবার…জীবনে প্রথমবার কারো মুখে এত স্নেহের ডাক শুনল তাজবীর।
‘কেমন আছিস আব্বা? কী করিস তুই? কোথায় ছিলি এতদিন?’
তাজবীর বুঝতে পারে না মহিলার বলা কথার মানে। কিন্তু সে এতটা স্নেহের ডাকে মজে গিয়েছিল যে হঠাৎ তার ইচ্ছে করছিল মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে।
‘ইফাজ তোর কিছু করেনি তো? তোকে কোনো কষ্ট দেয়নি তো?’
আগন্তুকের মুখে ইফাজ খানের নাম শুনে বিস্মিত হয় সে। তার মুখ দিয়ে এটুকু বের হয়,
‘কে আপনি?’
তারপর..তারপর ঘটে যায় অনেক কিছু। তাজবীর তার জীবনের কালো অধ্যায় জানতে পারে। মহিলাটি তাজবীরের জন্মদাত্রী। মহিলাটির সাথে ইফাজের দুইটা ছবিই তার প্রমাণ, আরেকটা প্রমাণ ছিল মহিলার চেহারা হুবহু তাজবীরের মতো। জানতে পারে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে সম্পর্ক করে ইফাজ তার সাথে। সম্পর্কের মাঝেই একজন বড়লোক বাবার মেয়ের সাথে পরিচয় হয় ইফাজের। প্রেমে পড়ে যান আরেক মেয়ের। তাজবীরের মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে গেলেই জানতে পারে সে গর্ভবতী। ইফাজ তখন নতুন প্রেমিকার প্রেমে এতই মাতোয়ারা যে প্রাক্তন এবং প্রাক্তনের বাচ্চাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তাজবীরের জন্মের পর তার মা তাকে এই খানেই রেখে যান। এটাও জানতে পারে ইফাজের নতুন প্রেমিকা তার সম্পর্কে জানেন এবং এতে একটুও বিচলিত না বরং ইফাজকে আদেশ করেন তাজবীরের মাকে মেরে ফেললেই তার শান্তি হবে। অন্ধ ইফাজ তাই করার জন্য হন্যে হয়ে তাজবীরের মাকে মা’রার চেষ্টা করেন। এত অত্যাচার করেন যে এক হাত হারাতে হয় তাজবীরের মাকে। ভাগ্যক্রমে পালিয়ে নিজের জীবনটাই বাঁচাতে পারেন তিনি।
তারপর তাজবীরের খোঁজ জানার পর ইফাজ প্রায়ই আশ্রমে এসে দেখে যেতেন, যদিও পিতৃ প্রেম তার মনে জেগে উঠেছিল তবে তার মূল লক্ষ্য ছিল তাজবীরের মাকে খোঁজা। এইজন্যই এখানে আসা প্রতিদিন, ভাবতেন তাজবীর থেকেই তাজবীরের মায়ের খোঁজ পেতে পারবেন।
তাজবীরের মা শুনেছেন তার সাথে সম্পর্ক ছিন্নের কয়েকবছর পর ইফাজ আর তার প্রেমিকার বিয়ে হয়, এবং তাদের ঘরে ফুটফুটে মেয়েও হয়। ভেবেছিলেন এই বুঝি তার রক্ষা, কিন্তু ইফাজের বউ এতটাই হিংস্র এবং ঈর্ষান্বিত ছিলেন যে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন তাজবীরের মাকে মেরে ফেলার জন্য। এতটা বছর লুকিয়ে ছিলেন তিনি। তাজবীরের মা কান্না করতে করতে তাজবীরের কাছে মিনতি করেন,
‘আব্বা তুই ঐ জানোয়ারটাকে ছাড়িস না আব্বা। আমার জীবনটা নষ্ট তো করছেই সাথে তোরটাও করছে। ঐ জানোয়ার যদি আমার খোঁজ পায় তাইলে আমারে মাইরাই ফেলবোরে বাপ। আমি এখন আর ম’রার চিন্তা করি না। আমি জানি ঐ জানোয়ার এখনো নজর রাখে তোর উপর, যদি আমার দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু আমার মনে হইলো তোরে সত্যি কথা না বললে তুই ঐ জানোয়াররে সারাজীবন ভালো মানুষই ভাইবা যাইতি। তাই আমি জীবন বাজি রাইখা আসছি তোরে বলতে। তুই ওগোরে ছাড়িস না। আমারে যেই কষ্ট দিছে ঐ কষ্টটা তুই ফিরায়া দিস।’
তার পরদিন তাজবীর তার মাকে দেখতে পায় তাদের পাশের নদীতে ভাসমান অবস্থায়, গলায় দড়ির ছাপ। মানুষ ভাবে, পাগলনি নিজেই আত্মহত্যা করেছে, কিন্তু তাজবীর জানে এই অবস্থা কে করতে পারে। তারপর থেকে তাজবীরের মন আক্রোশে ফুঁসতে থাকে, বাবার জন্য জমে থাকা এক বিন্দু ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়। আশ্রম থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ইফাজের ঠিকানায় গেলেও তাদের দেখা পায় না। শুধু জানে অন্যত্র চলে গেছে তারা। নাম্বারও বদলে ফেলেছে।
ব্যস, পলক এটুকুই জানে। তাজবীর এটুকুই বলেছিল। ইফাজ খানের খোঁজ পাওয়ার পরও তাজবীরকে কিচ্ছু করতে হয়নি। কারণ ততদিনে ইনান মেন্টাল ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ছিল, এটাই ইফাজকে শাস্তি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
ইনানকে তাজবীর বলেও দিয়েছিল সবটা, প্রমাণসহ। ইনান ভেঙে পড়ে বাবাকে দূরে ঠেলে দেয়, চোখের সামনে আসতে বারণ করে দেয় ইফাজকে। বাবার এবং মৃত মায়ের করা অপরাধ মনে দাগ কাটে গভীরভাবে। মাকে এতটা নিষ্পাপ ভেবেছিল, এতটা ভালোবেসেছিল, তার মাও তাকে কত আদর করতেন, কখনো মনেই হয়নি তার মন যে কতটা কালো। হয়তো এই পাপের শাস্তিই ছিল তার অকাল মৃত্যু।
আদরের মেয়ের অবহেলা সইতে না পেরে ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যান ইফাজ, সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। ইনানের কাছে ক্ষমাও চান, কিন্তু মেয়ের মন গলে না। এত বড় একটা অপরাধের পর তাকে মেনে নেওয়া আসলেই সহজ নয়। দুইটা মাসেই পাগলের মতো হয়ে যান ইফাজ, হাত পা নাড়াতে পারতেন না ঠিকমতো, কথা বলতে পারতেন না, হসপিটালাইজ করার পরেও তার অবস্থার অবনতি ছাড়া কিছুই হচ্ছিল না। নিজের করা পাপকর্মের জন্য সারাদিন আফসোস করেন। আর একা একা পাগলের মতো কান্না করতে থাকেন। এরপর একদিন হুট করেই স্ট্রোক করে বিদায় নেন।
ইফাজের মৃত্যুর সময় তাজবীর এবং ইনান দুজনেই গিয়েছিল। তাজবীরের ঠোঁটে ছিল প্রতিশোধ নিতে পারার তৃপ্ত হাসি। আর ইনানের মুখ ছিল কঠোর, শুধু তার দুচোখ বেয়ে অঝোরে নোনা পানির ধারা বয়ে পড়ছিল।
তারপর সবাই সবার রাস্তায়। পলক ইনানকে সুস্থ করার জন্য যা লাগে সব করে। ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হয়। এরমধ্যে তাজবীর মাঝে মাঝে এসে ইনানকে দেখে যেত। তাজবীর ইনানের খরচ বহন করতে চাইলে পলক বাঁধা দেয়। কিন্তু তাজবীরের কথা, সে একজন ভাই হিসেবে ইনানের জন্য কিছুই করতে পারেনি, তাই অন্তত এইটুকু করে যাতে ভ্রাতৃত্বের মান রাখতে পারে। পলক তা শুনে আর বারণ করেনি।
ইনানের অবস্থার উন্নতির কথা উঠলে, পলক ঠিকঠাক কিছুই বলতে পারবে না। ইনানকে প্রথম প্রথম দুই রুমের বাসাতেই বন্দী রাখতো তারা।
কিছু মুহূর্ত পরপর ইনানের পার্সোনালিটি চেঞ্জ হয়ে যেত। সে জেহফিলের সাথে একা একা কথা বলতো। তাকে শত বুঝানোর পরেও সে কারো কথা মাথায় নিতো না। জেহফিল যে নেই, এটা কেউ বলতে গেলেই হিংস্র হয়ে যেত ইনান। যখন ইনানের মাঝে জেহফিল চলে আসতো তখন তাকে চেয়ারে বেঁধে রাখতে হতো। জেহফিল তখন পলককে আজেবাজে ভাষায় গালি দিতো ইনানের কাছে আসার জন্য। তখন সেগুলো পলক রেকর্ড করে ইনান স্বাভাবিক অবস্থায় আসলে তাকে দেখাত।
জেহফিলের পার্সোনালিটি যখন চলে আসতো তখন কাউসার এবং আরো দুই তিনজন সাইকিয়াট্রিস্ট খুব শান্তভাবে জেহফিলের সাথে কথা বলে বলে তার সাথে ভাব জমান। এবং যখন সে শান্ত হয়ে যেত তখন তারা ইনানের অবস্থা, শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা দুটোই করুণভাবে জেহফিলের কাছে বলতেন, এভাবে চললে ইনানকে সত্যি সত্যিই মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করাতে হবে আর এতে ইনান আরো অ্যাবনরমাল হয়ে কখন না কখন সুইসাইড করে ফেলে। জেহফিল ইনানের ব্যাপারে প্রচুর কনসার্ন। সেটাকে কাজে লাগিয়ে কাউন্সিলররা জেহফিলকে বুঝাতো সে যদি তার হঠাৎ চলে আসাটা কমিয়ে দেয় এবং তার অ্যাগ্রেসিভনেস দূর করে তবে ইনানের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তারা ইনানকে ব্রেইনওয়াশ করতে পারলেও জেহফিলকে করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে তাদের। বর্তমানে ইনান আগের থেকে অনেকটা শান্ত এবং জেহফিলের পার্সোনালিটি হুটহাট আর আসে না তার মধ্যে। দিনে একবার কিংবা দুইদিনে একবার করে আসে, নরমাল কথাবার্তা হয় আবার চলে যায়। ইনানের চিকিৎসা খুবই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার তবে আশা রাখা যায় ইনান ঠিক হবে…হয়তো।
‘জেহফিল।’
পলকের ভাবনার ইতি ঘটে। তার পাশে দাঁড়ানো ইনান বিষণ্ণ সুরে জেহফিলের নাম ধরে ডেকে উঠে। পলকের কষ্ট হয়। সত্যি অনেক কষ্ট হয়। ইনান মাঝেমাঝেই জেহফিলকে ডাক দেয়। ইনানকে পাওয়ার আশায় একসময় হাল ছেড়েই দিয়েছিল সে। কিন্তু এখন ইনানের কেউ নেই। না আছে বাবা না আছে জেহফিল। ইনানকে ভালো করে চেনার মতো তাজবীর না। তাই তার উপর ছেড়ে না দিয়ে পলক নিজেই সব ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয়। এখন তো ইনানকে সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট পাবেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা। পলক পকেটের মধ্যে রাখা ডায়মন্ড রিংটার দিকে তাকায়, হাতের মুঠোয় নিয়ে বিড়বিড় করে,
‘শুধু সময়ের অপেক্ষা।’
.
.
চলবে…
[এটাই অন্তিম পর্ব হতো। কিন্তু প্রায় চার হাজার শব্দের হয়েছিল অন্তিম পর্বটা। আমি অর্ধেক করে পোস্ট করব। কালকে শেষ ভাগ পেয়ে যাবেন।]