রোদরঞ্জন #পর্ব_৩৫ #আশফি_শেহরীন_চিত্রা

0
145

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৩৫
#আশফি_শেহরীন_চিত্রা

[কপি করা নিষিদ্ধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজে এবং অন্য কোনো সাইটেও কপি করা যাবে না।]
.
.

অসময়ে বৃষ্টি নামাটা ইনান সবসময় পছন্দ করলেও আজকে ভালো লাগছে না। খুব দরকারে শহরে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি তাকে আটকে দিলো। শীত প্রায় শেষ হবে হবে ভাব। হয়তো শীতের শেষটা জানান দিতেই বর্ষার আগমন। ইনান হতাশ শ্বাস ফেলে রুমের দিকে পা বাড়ায়। কারেন্ট নেই। বিকেল হলেও ঢালা বৃষ্টির কারণে মনে হয় এখন মাঝরাত।

মোম হাতে রুমে ঢুকে দেখল জেহফিল অন্ধকারে টুলে বসে হাতে কিছু একটা নিয়ে গভীর মনোযোগে কিছু একটা দেখছে। ইনান এগিয়ে যায় কাছে। জেহফিলের ঘাড় অবধি সিল্কি চুলগুলো বাহির থেকে আসা হিমশীতল বাতাসে কপালে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে, ঠোঁট হালকা চেপে মনোযোগী চাহনিতে হাতের দিকে তাকিয়ে আছে, বিজলি চমকানো আলোয় দেখার চেষ্টা করছে কিছু একটা। ইনানের মন চাইল সারাজীবন যদি জেহফিলকে এভাবে তাকিয়ে দেখা যেত। জেহফিলের অতুলনীয় সৌন্দর্য এত মনকাড়া, যে ইনানের মাঝে মাঝে ভয় হয় জেহফিলকে বাইরে নিয়ে যেতে। যদিও সে জানে, জেহফিল তাকে ছাড়া কখনো দ্বিতীয় নারীর দিকে চোখ তুলে চাইবে না, কিন্তু অন্যান্য নারী তো ঠিকই তাকাবে। নিজের এমন অচিন্তনীয় ভাবনায় নিজেই চমকালো ইনান। সে কবে থেকে জেহফিলের মতো এত পজেসিভ হওয়া শুরু করেছে? এত জ্বেলাস হলো কবে থেকে? সে তো দেখছি এখন জেহফিলের ফিমেল ভার্সন হওয়া শুরু করে দিয়েছে!!

ইনান মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল তার এই আজগুবি ভাবনা। মোম হাতে জেহফিলের কাছে গিয়ে হালকা কেশে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল।

হাত থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে দাঁড়ানো ইনানের দিকে তাকালো জেহফিল। ইনানকে দেখে স্নিগ্ধ হাসলো জেহফিল।

বিনিময়ে হাসি প্রদান করে ইনান বলল, ‘কী করছেন?’

হাতে থাকা মোমবাতি জেহফিলের হাতের কাছে নিয়ে দেখল একটা চিকন তুলি। ইনান ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘স্পেশাল কিছু আছে নাকি তুলিতে?’

‘অভিশাপ।’ শীতল গলায় বলল জেহফিল। তুলির দিকে নজর নিবদ্ধ।

‘বুঝলাম না?’

দীর্ঘ সময় নিয়ে শ্বাস টেনে সটান হয়ে বসল জেহফিল। চোখের চশমাটা টেবিলের উপর রেখে একহাতে ইনানের কোমর জড়িয়ে তার বুকে মাথা রাখল। কম্পিত ইনান জেহফিলের চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে লাগল।

‘মনে আছে বাটারফ্লাই…’

থামল জেহফিল। ইনানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে চিবুক ইনানের বুকে ঠেকিয়ে চোখে চোখ রাখল জেহফিল। এই মুহূর্তে জেহফিলকে কতটা আদুরে দেখাচ্ছিল ইনান যদি বর্ণনা করতে পারতো! ক্যামেরা সাথে থাকলে সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাপচার করে নিতো দৃশ্যটা।

‘আমি তোমাকে একটা শাস্তি দিয়েছিলাম।’

সম্বিৎ ফিরল ইনানের, ‘কী শাস্তি?’

‘রক্ত দিয়ে আমার নাম লেখতে বাধ্য করেছিলাম তোমাকে।’

ইনানের মনে পড়ল সেই নিকৃষ্ট দিনের কথা। গা কেঁপে উঠল তার। শুকনো ঢোঁক গিলে বলল,

‘এখন এসব কথা কেন? বাদ দিন না!’

জেহফিল ইনানের বুকে মুখ গুঁজল,

‘আ’ম সরি বাটারফ্লাই, রিয়েলি রিয়েলি সরি। আমার…আমার এসব করা উচিত হয়নি…প্লিজ, মাফ করে দাও সোনা, প্লিজ পাখি…’

জেহফিলের কথা শ্রবণমাত্রই হতভম্ব হয়ে যায় ইনান। জেহফিল যে এসবের জন্য সরি বলবে সে কল্পনাতেও আনেনি। সত্যিই, সে কখনো জেহফিলের থেকে সরি আশা করেনি। জেহফিল সরি না বললে সে বুঝতেও পারত না যে মনের এক কোণে ঠিকই চাইছিল জেহফিল যাতে অনুতপ্ত হয়। বিয়ের আগে নিজের ভবিষ্যৎ পার্টনারকে নিয়ে যেসব আশা করতো তা যেন এই মুহূর্তে জেহফিলই পূরণ করছে। তার কল্প পুরুষের মতো হয়ে উঠছে জেহফিল, ধীরে ধীরে।

পরিতৃপ্ত মনে ইনান জেহফিলের কপালে ছোট্ট করে চুমু খেল,

‘আপনি যে অনুতপ্ত তাতেই আমি খুশি জেহফিল। এতবার সরি বলতে হবে না।’

জেহফিল হাতের তুলিটাকে দুমড়েমুচড়ে চুরমার করে দিলো। এই তুলি দিয়ে সে বাটারফ্লাইকে কষ্ট দিয়েছিল…

বৃষ্টির তোড়ে ইনানের ঠিকই নজরে আসলো ঐ পাশের বাড়ির বারান্দা থেকে তাকিয়ে থাকা সেই অবয়বটাকে।

ইনান বাঁকা চোখে চেয়ে রইল সেদিকে। তার মুখাবয়ব কঠোর। ঐ পাশের মানুষটির কোনো হেলদোল দেখা দিলো না তাতে। সে অদ্ভুত চোখে ইনানের দিকে চেয়ে রইল, কেমন যেন সেই অদ্ভুত দৃষ্টি! চাহনিটা ইনানের ভালো লাগলো না, গা ছমছম করে উঠল তার। সে দ্রুত বারান্দা আর রুমের মাঝের পর্দাটা টেনে দিলো। এতে অপরপক্ষ অপমানবোধ করলে করুন গে…

.

.

রাত আটটা। জেহফিলকে রেখে ইনান নিচে এসে অপেক্ষা করছিল তার বাবার জন্য। গেটের কাছে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। বাবার চলে আসার কথা এক্ষুনি। ছাতার মাথাটা ফ্লোরের সাথে ঠকঠক করে আওয়াজ তুলে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইনান, হাতে ফ্ল্যাশ লাইট। তার বাবা সপ্তাহে কমপক্ষে তিন চারদিন এসে দেখা করে তার সাথে। কখনো তার পছন্দের খাবার নিয়ে আসে, কখনো সাথে পরিচিত এক ডাক্তার আঙ্কেলকে নিয়ে এসে চেকাপ করায়। ইনানের বাবা কোনো কমতিই রাখতে চান না তার মেয়ের জীবনে।

বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে ইনানের গায়ে। শীত লাগছে অনেক। জ্যাকেট টেনে আরো ভালো করে পরে নিলো।আকাশ পাতাল এক করে দেয়ার মতো ঝড় বইছে। ইনান দোয়া করছে বাবা যাতে এই ঝড়ে না আসে। রাস্তাঘাট ভালো না। কখন কী হয়! ইনানের ভাবনাকে প্রমাণ করে দিয়ে তার সেল ফোন বেজে উঠল ক্রিং ক্রিং শব্দে।

‘সরি আম্মু, আজকে আসতে পারছি না। মন খারাপ করিও না কেমন?’

‘সমস্যা নেই বাবা। এই ঝড়ে আসার দরকার নেই। অবস্থা ভালো না।’

বাবার সাথে কথা বলে ইনান ভেতরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। ঠিক সেই সময়ে পুরুষালী গম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পায় সে,

‘কেমন আছো ইনান?’

তড়িৎ পেছনে ফিরে সে। এই নির্জন জায়গায় সে সে আর জেহফিল ছাড়াও যে অন্য একজন থাকে, তাই বুঝতে অসুবিধা হলো না কে সে।

মোবাইলের ফ্ল্যাশ সরাসরি ছাতা মাথায় ধরে থাকা ব্যক্তির দিকে তাক করলো। লোকটি হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে নিলো আচানক আলো চোখে লাগায়। তার পরনে কালো রঙের গলা ঢাকা লং কোট, চুলগুলো হালকা ভেজা। গালে সেই টোল পড়া হাসি।

ইনান মোবাইলটা সাইডে সরিয়ে নিয়ে বললো,

‘কী চাই?’

‘চিনেছো আমাকে?’

‘না চেনার কিছু নেই মিঃ তাজবীর।’

‘বাহ! নামটাও মনে আছে দেখছি! তা কেমন আছো?’

‘আপনি আমার ফ্রেন্ড? আপনাকে আমি ভালো করে চিনি?’ ইনানের দায়সারা কণ্ঠ।

‘সরি?’

‘যা বলছি তার উত্তর দিন।’

‘ওয়েল, নাহ, চিনো না।’

‘তাহলে কোন সাহসে আপনি আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন?’

তাজবীর হাসলো। বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। সে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল,

‘প্রথম আসলাম। ভেতরে আসার জন্য বলবে না? এভাবে গেস্টকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখছো বৃষ্টি দিয়ে, এই তোমার ম্যানার?’ কপট বিরক্তি সুরে বলল তাজবীর। যেন তাকে দাঁড় করিয়ে ইনান অনেক বড় অভদ্রতামি করেছে।

ইনান গেটের কাছে হাত পা ছড়িয়ে দাঁড়ালো এবার। যেন সে তাজবীরকে ভেতরে না ঢোকানোর পণ নিয়েছে।

তাজবীর উচ্চশব্দে হেসে ফেলল ইনানের কাণ্ড দেখে। বৃষ্টির পানিতে আছড়ে আছড়ে পা ফেলে ইনানের কাঁধে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল তাজবীর। তার এহেন দুঃসাহসিকতায় ইনানের মুখ হা হয়ে গেল।

‘উফফ, ভিজে গেলাম, ভেতরে ঢুকে চা খাওয়ার জন্য বলবে না?’

‘আশ্চর্য মানুষ আপনি!’

‘আই নো।’ বুক ফুলিয়ে বলল তাজবীর।

‘কী চাই সেটা বলেন।’

‘উপরে যাই চলো।’ তাজবীর সিঁড়িতে পা দেওয়া মাত্রই ইনান তার শার্ট টেনে আগের জায়গায় নিয়ে আসলো।

‘প্রবলেমটা কী আপনার? এত সেধে সেধে কথা বলতে আসার মানেটা কী?’

‘আমার প্রবলেম এই যে…’ কথায় বিরতি দিয়ে হঠাৎ বলল, ‘ আমার প্রবলেমটা পরে বলছি। আগে বলো তোমার মাথার কী স্ক্রু ঢিলা?’ তার কণ্ঠে কৌতুক।

‘কীহহ!’ তাজবীরের কথার আগামাথা বোধগম্য হলো না ইনানের। রাগ বেড়ে যাচ্ছে তার।

‘ওকে বাদ দাও, তোমার মানসিক সমস্যা জানা আমার জন্য এক সেকেন্ডের ব্যাপার। তোমারটা বাদ দেই। আমার প্রবলেমটা বলি।’

বলে সিরিয়াস ভঙ্গিতে ইনানের চোখের দিকে তাকালো সে, ‘প্রবলেমটা হচ্ছে, জেহফিলের সাথে তোমাকে দেখতে পারছি না আমি।’

‘আজব! দেখতে বলেছে কে আপনাকে? চোখ বন্ধ করে থাকেন, তাহলেই তো হয়!’

‘পারবো না, সিরিয়াসলি ইনান। তোমাকে একটা কথা বলি। জেহফিল ভালো ছেলে নয়। ওর..ওর মাথায় না, কোনো প্রবলেম আছে আই গেস। সিরিয়াস মেন্টাল প্রবলেম। ওর থেকে যত দূরে থাকবে ততই তোমার জন্য মঙ্গল।’

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here