#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৪৩
#আশফি_শেহরীন_চিত্রা
[কপি করা নিষিদ্ধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজে এবং অন্য কোনো সাইটেও কপি করা যাবে না।]
.
.
‘বাবা! তুমি এখানে?’
ইনানের চোখে বিস্ময়। তার বাবা তার মাথা হাতে নিয়ে বসে কাঁদছে। ইনান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে বসতে নিলো। কিন্তু শরীরটা এত ভারি লাগছিল যে সামান্য নড়তেও পারছিল না। পিঠে, হাতে চাপ অনুভব করলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তাজবীর এবং পলক তার হাত পিঠের সাথে চেপে ধরে আছে। কাওসার আঙ্কেল পায়ের কাছ। ইনানের বোধদয় হলো না কিছুই। যেন সে কোনো অপরাধী। তাকে জিম্মি করার প্রচেষ্টায় তারা তাকে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। কী আশ্চর্য!
ইনানের স্বাভাবিক রূপ দেখে তাজবীর হাত ছেড়ে দেয়। বাহু দিয়ে পলকের হাতে ধাক্কা মেরে বলে ছেড়ে দিতে। পলক যেন স্ট্যাচু। বোঝাই যাচ্ছে বেচারা অনেক বড় শক খেয়েছে। কাওসার ইনানের পা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ইনান মুক্ত হলে ইফাজ তড়িঘড়ি করে ইনানকে দাঁড় করিয়ে নিয়ে চলে যেতে লাগল। যেন পালাচ্ছেন। পলক বাঁধা দেয় ইনানের হাত ধরে। ইফাজকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ও’কে?’
‘দেখো পলক, ইনান এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই দেখতেই তো পারছো। ও একটু রেস্ট নিক। কাল না হয়…’
পলক হেঁচকা টানে ইনানকে ছাড়িয়ে নেয় ইফাজের বাহুবন্ধন থেকে। ইফাজের প্রতি তার ঘৃণার মাত্রা তরতরিয়ে বাড়ছে। কখন না জানি সীমা অতিক্রম করে ফেলে।
‘যা হবে তা এখনই হবে। চলো ইনান।’
পলক ইনানকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে যায়। সবাই পিছু পিছু যায়। ইনান হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে। পলক খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে। জেহফিল যদি দেখে…জেহফিল! জেহফিল কোথায়? ইনান আশেপাশে দেখল, তার ঘরে এত কিছু চলছে অথচ জেহফিল কিছু টের পাচ্ছে না?
‘জেহফিল? জেহফিল?’ পলকের হাতের সাথে ধস্তাধস্তি করতে করতে হাঁক ছাড়ে ইনান। মনে মাঝে ভয় জেঁকে ধরে, পলক জেহফিলকে কিছু করেনি তো? ধরে নিয়ে যায়নি তো?
‘জেহফিল কোথায়? আমার জেহফিলকে কোথায় রেখেছেন?’
পলক ইনানকে সোফায় বসায়। নরম সুরে বলল,
‘আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করব ইনান। সত্যি কথা বলবে।’
ইফাজ কথার মাঝে বলে উঠেন, ‘ও-কে বলার কী দরকার? আমাকে বলো, কাওসারকে বলো। আমরা তোমাকে সব বলছি। তুমি এক সাইডে আসো।’
পলক না চাইতেও কঠিন চোখে তাকায় ইফাজের দিকে। পলকের কাঠিন্য চাহনির তোপে পড়ে কথার খেঁই হারিয়ে ফেলেন ইফাজ। জানে না কেন, তার সন্তানের বয়সী পলককে হঠাৎ তার ভয় লাগা শুরু করল। যেই ছেলে চোখ নিচু করে নম্র গলায় কথা বলত সেই ছেলের গম্ভীর ভাবভঙ্গি দেখে বেকায়দায় পড়ে গেলেন তিনি। তার এত ভয় লাগছে কেন? হাত পা কাঁপছে। একজন সৎ পুলিশ অফিসারের ঘৃণ্য কাজ বুঝে ফেলেছে কি পলক? তার জন্যই ইফাজকে সেই আগের মতো সম্মানের চোখে দেখতে পারছে না!!
কাওসার ইফাজের কাঁধ ধরে বিড়বিড় করে বললেন,
‘বলতে দে ও-কে। ওর মনের কিউরিওসিটি দূর করুক। সময় আছে তো, আমি বুঝাবো সব। ও কি জানতে চায় জানুক।’
ইফাজ হতাশ হয়ে তাকালেন কাওসারের দিকে, আস্তে করে বললেন,
‘আমার উচিত হয়নি রে ইনানের পাগলামিকে প্রশ্রয় দেয়া। তখন যদি তোর কথা শুনে ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করতাম তাহলে আজকের দিনটা আসতো না। আমি নিজের হাতে নিজের মেয়ের জীবনটা নষ্ট করেছি।’ গলা ধরে এলো ইফাজের। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, বুক জ্বালা করছে।
কাওসার বুঝলেন ইফাজের অনুতাপ। তিনি কম চেষ্টা করেননি ইফাজকে বুঝানোর। ইনানকে ট্রিটমেন্ট করার জন্য অনেক জোর করেছিলেন তিনি। কিন্তু ইফাজ ভেবেছে তাকে তার মেয়ের থেকে দূর করিয়ে অবশেষে কোনো পাগলা গারদে দিয়ে দিবে। মেন্টাল হসপিটালে ইনানের চিকিৎসা করাবে। সেই ভয়ে ইফাজ ইনানকে বুক ছাড়া করেননি। কাওসার অবাক হয়েছিলেন ইফাজের মতো শিক্ষিত ডিগ্রীধারী একজনকে এই ধরনের বাচ্চামো চিন্তাভাবনা করতে দেখে। তিনি বুঝিয়েছেন ট্রিটমেন্টের প্রত্যেকটা স্টেপ। বিদেশেও নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইফাজ গোঁ ধরে রইলেন, তিনি ভেবেছেন মেয়েকে মেয়ের মতো ছেড়ে দিলে মেয়ে সুখী থাকবে। এটা ভাবার অবশ্য কারণ আছে। ইনানের অ্যাক্সিডেন্টের দেড়মাস পর যখন দেখলেন ইনান তার কল্পনার জেহফিলকে নিয়ে হাসিখুশি জীবনযাপন করছে তখন ইফাজ ভেবেছিল এভাবেই হয়তো মেয়েটা সারাজীবন কল্পনা করে ভালো থাকবে, কাছে থাকবে। কিন্তু তার ফলাফল যে এত ভয়ানক হবে তা কল্পনায়ও আনেননি তিনি। তাই তো আজ তার এত আফসোস…
ইনান অস্থির হয়ে ছটফট করছে। ‘জেহফিল কোথায়? প্লিজ জেহফিলকে কিছু করবেন না। প্লিজ…জেহফিল…’ ইনান পাগলের মতো একাধারে কথাগুলো জপছে।
পলক ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। একদিকে যেমন আশার আলো দেখা যাচ্ছে, তেমন অন্যদিকে হিংস্র থাবার মতো এগিয়ে আসা অন্ধকার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বার্তা নিয়ে দোরগোড়ায় ঠকঠক করছে। পলক নিজেকে শক্ত করল।
‘ইনান, তোমার মনে আছে তোমার আর জেহফিলের অ্যাক্সিডেন্টের কথা?’
ইনান চট করে তাকায়। হঠাৎ সেই দূর্ঘটনার কথা উঠল কেন এখানে?
‘আগে বলুন জেহফিল কোথায়?’
‘তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দিলে বলব।’ মিথ্যে আশ্বাস দিলো সে।
ইনান ঠোঁট দুটো চেপে একবার পলকের দিকে তাকায়, আরেকবার বাবার দিকে। বাবা যখন চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করল তখন ইনান বলল,
‘মনে আছে।’
‘তখন কোথায় যাচ্ছিলে তোমরা?
‘জেহফিলের প্রিয় একটা জায়গায়।’
‘জেহফিল বলেছিল?’
‘না, সারপ্রাইজ ছিলো। তবে আঁচ করতে পেরেছিলাম, উনি ডেটে নিতে চেয়েছিলো। আমাদের প্রথম ডেট।’ ইনানের ওষ্ঠাধরে স্নিগ্ধ হাসি ফুটল। পলকের কেন যেন সহ্য হচ্ছিল না। তাও নিজের কষ্টকে খাঁচায় বন্দী করে বলল,
‘পরে কখনো জানতে চাওনি? আই মিন, অ্যাক্সিডেন্টের পরে?’
‘চেয়েছিলাম। কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি। উনি কিছুই বলেননি। দুর্ঘটনার কথা মনে করাতে চাইনি তাই আমিও আর ঘাটাইনি।’
‘জেহফিলের কী অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল?’
‘পা ভেঙে গিয়েছিল।’
‘ট্রিটমেন্ট করায়নি জেহফিল?’
‘করিয়েছি। কাওসার আঙ্কেল তো প্রতিবারই এসে চেকাপ করে যায়।’
‘ঠিক হবে পা?’
ইনানের মন খারাপ হলো কিছুটা, ‘জেহফিল বলে ঠিক হবে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস উনি ঠিক হয়ে যাবেন। ক্রাচ ছাড়া উনি ধরে ধরে হাঁটতে পারেন।’
‘আচ্ছা। কী কী ঔষধ লিখে দিয়েছিল কাওসার আঙ্কেল? একটু স্লিপটা আর ঔষধগুলো দেখাতে পারবে?’
‘কেন?’ ইনানের মনে কৌতুহল। পলকের এসব প্রশ্ন তার কাছে আজগুবি ঠেকছে।
‘আনোই না। একটু দেখব।’
বিরক্ত হওয়া স্বত্ত্বেও ইনান উঠল। ভেতরে ভেতরে রাগে গজগজ করছে সে। কিন্তু জেহফিলকে ছুটানোর জন্য পলকের সাথে একটু ভালো ব্যবহার করতে হবে।
ইনান একটা বক্স নিয়ে আসলো। পলক বক্স খুলে দেখল সিভিট, ভিটমিন, সিরাপ নামক নাপা, কিংবা কোমল পানীয়। আর একটা স্লিপ। স্লিপে এগুলোর নাম বিভিন্ন মেডিসেনের প্যাকেটের নাম লিখে পাশে দিয়ে খাওয়ার নিয়ম লেখা আছে। বোঝাই যাচ্ছে যেসব খেলে ক্ষতি হবে না সেগুলো ঔষধ নামে ইনানের কাছে চালিয়ে দিচ্ছে কাওসার।
‘ইনান। অ্যাক্সিডেন্টের পর জেহফিলকে নিয়ে কোথাও বের হও না? ওর তো এক্সিবিশন থাকতো। টিচারও ছিল।’
‘উনি তেমন কিছুতেই আগ্রহ দেখাননি। আর্ট করতেন নিজের জন্য। ব্যস।’
‘ওর আচরণে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখতে পেয়েছ?’
‘অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার পর চুপচাপ থাকত। কথা বলত না। জবাব দিতো না ঠিক মতো। তারপর আস্তেধীরে স্বাভাবিক হন। তবে যথেষ্ট ভদ্র হয়ে যান তিনি। আগে যেমন অ্যাগ্রেসিভ ছিলেন, রাগী ছিলেন, ডমিনেট করতেন তার কিছুই ছিল না। বরং আমি যা বলতাম তাই করত, আমি যা পছন্দ করতাম তাই পছন্দ করতো, একদম ভালো স্বামীর মতো হয়ে যান। যেমনটা আমি বিয়ের আগে কল্পনা করতাম যে আমার একজন ভদ্র সুপুরুষের সাথে বিয়ে হবে। আমি ভাবিনি উনি যে আমার কল্পনার ভালো হাজব্যান্ড হয়ে যাবেন। মেবি অ্যাক্সিডেন্টের রিয়্যাকশান, অথবা আমাকে হারানোর ভয়ে ভালো হয়ে যান। কিন্তু…’
‘কিন্তু?’
ইনান অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, ‘কিন্তু আমার না কেমন জানি লাগতো ওনার এই ভালো হয়ে যাওয়াটা। জানি না আমার মানসিক সমস্যা আছে নাকি আমি পাগল, কিচ্ছু জানি না, কিন্তু আমি মনে মনে ওনার সেই রাগী, কঠোর, আগ্রেসিভনেস মিস করতাম। মুখ ফুটে বলিনি অবশ্য। উনি আগে যেভাবে পজেসিভনেস দেখাতেন আমাকে নিয়ে, এটা পরো না, এটা করো না, এভাবে না, সেভাবে না- তখন আমার প্রতি ওনার কেয়ার দেখতাম, ভালোবাসা দেখতাম। অ্যাক্সিডেন্টের পরে তার কিছুই দেখাননি তিনি, আমি যেটা করতাম সেটাতেই সায় জানাতো। আমার খুব বোরিং লাগছিল ঐ জেহফিলকে। আমি তখনই বুঝতে পারলাম আমি আসলে জেহফিলের ডমিনেটিং সাইডকে ভালোবেসেছি। আমার মন শান্ত জেহফিলকে নয়, বরং অশান্ত, অস্থির, ডমিন্যান্ট জেহফিলকে ভালোবেসেছে। মনে মনে আমি খুব করে চাইতাম জেহফিল আগের মতো হয়ে যাক। আগের মতো কঠোর শাসন করুক। আটকে রাখুক।’ বলতে বলতে হেসে ফেলল ইনান। পলকের দিকে চেয়ে বলল,
‘আমার কথা শুনে আমাকে পাগল মনে হচ্ছে আপনার তাই না? ভাবছেন কোন মেয়ে চায় তার স্বামী তাকে শাসনে রাখুক, আটকে রাখুক? সব মেয়েই তো চায় শান্তশিষ্ট স্বামী, যে তাকে স্বাধীনতা দিবে। কিন্তু আমি মনে হয় অন্যরকম। বুঝতে পারি না, এটা ডার্ক রোম্যান্স বই পড়ার প্রভাব নাকি আমার মনের ডার্ক ফ্যান্টাসি!! কিন্তু আমি জেহফিলের শাসনকে প্রচুর মিস করছিলাম। আমিতো ভেবেছি জেহফিল যদি আগের মতো হয়ে যায় আমি আর কখনো ওনাকে আগের মতো প্যারা দিবো না, বরং ওনার শাসন এনজয় করব। বিরক্ত না হয়ে ওনার ভালোবাসা অনুভব করব।’
‘তারপর? শান্ত জেহফিলকে অশান্ত হয়েছিল?’
‘হুম।’
‘কীভাবে?’
‘আকারে ইঙ্গিতে বুঝাতাম। দুয়েকবার সরাসরিও বলেছি। শরৎ আর উনি’ তাজবীরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওনারা বিরক্ত করা শুরু করলে আমি জেহফিলকে সব বলি, আর বলি উনি আগের অবস্থায় থাকলে সবাইকে শাস্তি দিতো, আরো অনেক কিছু বলে বলে জেহফিলকে আগের রূপে নিতে সক্ষম হই। পুরোপুরি হয়নি যদিও, তবে আমার ধারণা পা-টা একটু ঠিক হলে পুরোপুরি হয়ে যাবে।’
ইনানের থেকে পলকের আর কিছুই জানার নেই। ইনান যা বলছে সব তার অবচেতন মনের চিন্তা। ইনান এখন যা বলবে সবই কল্পনা। তাই এবার পুরো ঘটনা জানতে হবে।
‘তুমি রুমে যাও।’
‘মানে? বললেন সব প্রশ্নের জবাব দিলে জেহফিলকে আনবেন।’ ইনান তেতে উঠল।
ইফাজ ইনানকে ডাক দিলেন, ‘যাও ইনান। কথা শুনো বাবার।’
বাবার উপর ভরসা করে গোমড়া মুখে ইনান রুমে যায়। পলক এবার কাওসারের দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বলল,
‘আপনি কি এবার এক্সপ্লেইন করবেন?’
ইফাজ আর পলক বসল সোফায়। তাজবীর দেয়ালে হেলান দিয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন সে তার পর্বের অপেক্ষায় আছে।
ইফাজ শুরু করলেন, ‘আমি বলি। ইনান আর জেহফিলের অ্যাক্সিডেন্টে হয় যেখানে সেখানের রাস্তা ভালো না। পাহাড়ি রাস্তা। একপাশে পাহাড় অপর পাশে খাদ, খাদের নিচে রাস্তা, আর তার পাশে নদী। এই ধরনের রাস্তায় গাড়ি চালানো রিস্ক, তার উপর রাতে। আমি খবর পেয়েছি ঐখানেরই কোনো এক হসপিটাল থেকে। সেখানের মানুষের থেকে শুনেছি, বাঁক নেওয়ার সময় বিপরীত দিক থেকে জোরে চালিয়ে আসা একটা গাড়ির সাথে জেহফিলের গাড়ির ধাক্কা লেগেছে। ঐ গাড়িটি এবং জেহফিলের গাড়ি দুটোই নিচে পড়ে যায়। তবে ভাগ্যক্রমে ইনান গাড়ির সাথে নিচে পড়েনি। ও-কে রাস্তার কোণায় পাওয়া গিয়েছিল রক্তাক্ত অবস্থায়। গাড়ি দুটো নিচে ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। ঐ রাস্তায় গাড়ি চলাচল কম। তাই তৎক্ষণাৎ কোনো সাহায্যও পাওয়া যায়নি। ইনানকে পাওয়া গিয়েছিল গভীর রাতে-যারা পেয়েছে তাদের মতে। গভীর রাতে গাড়িগুলো যে নিচে পড়েছে তাও দেখা যায়নি। পরদিন সকালে দুইটা গাড়িকে নদীতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। কিন্তু গাড়ির মালিককে কিংবা জেহফিলকে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় তারা দুজনেই খরস্রোতা নদীতে মা’রা গিয়েছে।’
পলক কথার মাঝে বলল, ‘মা’রা গিয়েছে? লাশ কোথায়?’
‘পাওয়া যায়নি। ডুবুরি দিয়ে খোঁজা হয়েছিল।’
‘পাওয়া না গেলে তাদের মৃত ঘোষণা করা হলো কেন?’
‘সম্ভবত মা’রা গেছে। আহত অবস্থায় এত নিচ থেকে পড়লে তাদের হুশ থাকবে না, আবার নদীতেও পড়লে নিজেকে বাঁচানো তো সহজ না, কোনো সাহায্য ছাড়া।’
‘আপনি জানেন আমাদের ডিকশনারিতে সম্ভবত বলে কিছু হয় না। হয় আছে, নয়তো নেই। তল্লাশি করেও যতক্ষণ পাওয়া না যায় ততক্ষণ তো আমরা তাদের মৃত বলে চালিয়ে দিতে পারি না।’
কাওসার বললেন,
‘পলক, থিংক লজিক্যালি। ইফাজের বলা ভুল কিছু না। নদীর ঢেউয়ে কারো আহত বডি টিকে থাকতে পারে না। বেঁচে থাকা পসিবল হতো যদি নদীতে পার থাকতো। আহত ব্যক্তিরা হয়তো সাঁতার কেটে পারে আসতো, তারপর কেউ তাদের বাঁচাতো, তখন চিন্তা করে দেখা যেত। কিন্তু নদীতে বাঁধ দেয়া। কয়েক ফুট উঁচু বাঁধ অতিক্রম করবে কীভাবে কেউ? ইটস টোটালি ইম্পসিবল।’
‘বুঝলাম। ঐ জায়গায় কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না?’
ইফাজ বলল, ‘না। পাহাড়ি এলাকা। জনমানবহীন, আনাগোনা নেই বললেই চলে।’
‘আচ্ছা। তারপর ইনানের অবস্থার কথা বলুন।’
‘ইনান ততটা আঘাত পায়নি। অতিরিক্ত ভয়ে ও জ্ঞান হারিয়েছিল। হাতে, পায়ে, মাথায় সামান্য চোট লেগেছিল।’
‘ডিসঅর্ডারের শুরু কখন থেকে?’
ইফাজের চোখ টলমল করে উঠল। যেন এক্ষুনি জল গড়িয়ে পড়বে, নাক টেনে বললেন,
‘ইনানের জ্ঞান ফেরার পর থেকে ও শুধু জেহফিলকে খুঁজছিল। ও-কে যখন বললাম জেহফিল নেই, তখন ও আরো বেশি পাগলামি করছিল। কেবিনের সবকিছু ভেঙে ফেলছিল। আমার শান্ত, কোমল মেয়েটা কেমন হিংস্র হয়ে গিয়েছিল। তারপর হুট করেই প্রায় এক সপ্তাহের মতো চুপ হয়ে যায়। আমি প্রতিদিন ভিজিট করতাম। তারপর ও-কে বাড়িতে নিয়ে আসি। আমি ভেবেছি জেহফিলকে হারানোর শোকে ও চুপ হয়ে গিয়েছিল। তারপর একদিন…একদিন ঘরে ফেরার পর ওর রুমে আওয়াজ শুনি। ইনানের হাসির আওয়াজ। ইনানের সাথে কেউ ছিল রুমে। ওর কোনো ফ্রেন্ড হয়তো। কিন্তু রুমে যাওয়ার আগে ওর দরজার বাইরে থেকে অন্যকরম কিছু দেখতে পাই আমি। দরজা ভিজিয়ে দেখি, ও একা একা হাসছে, কথা বলছে, হাসির মাঝে হঠাৎ চুপ হয়ে যাচ্ছে, তখন গম্ভীর শোনায় ওর কণ্ঠ, এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হয়ে যায়, বসার ভঙ্গি অন্যরকম হয়। আমি ততটা আমলে নেইনি ব্যাপারটা। ইনানের একা একা কথা বলার অভ্যাস আছে।
কিন্তু সেম ব্যাপারটা কয়েকদিন টানা চলতে থাকে। একদিন দেখি ও কেমন খুঁড়িয়ে হাঁটছে। ওর কথার ভাব, চাহনি অন্যরকম ছিল। তারপর আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নরম সুরে বলছিল, ‘জেহফিল আপনি ঠিক হয়ে যাবেন।’ তারপর আবার খুঁড়িয়ে নরম চেহারা বদলে গিয়ে কিছু বলল। সেদিন সন্ধ্যায় ইনান কান্না করতে করতে রুমে আসলো। বলল জেহফিলকে হসপিটালে ভর্তি করাতে, ওর পা ভেঙে গেছে অ্যাক্সিডেন্টে। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। ইনানের কিছু হয়েছে কিনা সেইজন্য আমার সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধু কাওসারকে নিয়ে আসলাম। কাওসারকে নিয়ে আসার দিন ইনান হঠাৎ আমাকে এসে বলল সে এখানে থাকবে না। জেহফিলের ট্রিটমেন্ট করিয়ে চলে যাবে জেহফিলের বাড়িতে। আরো অনেক কিছু। কাওসার ইনানকে পরিচয় দিলো ডাক্তার নামে। ইনানকে পর্যবেক্ষণ করল…’
‘তারপর আমি বলি।’ কাওসার বলেন।
‘ইনানকে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম জেহফিলের অবস্থা নিয়ে। ওর কথাবার্তায় বুঝলাম ও মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। আমি এক্সপ্লেইন করি সেটা কি। তুমি অবশ্য জানবে এসব নিয়ে, তাও বলি। হয়না মাঝে মাঝে, আমরা কথা বলতে বলতে কিংবা হঠাৎ জোন আউট হয়ে যাই বা হারিয়ে যাই অন্য দুনিয়ায়, যাকে বলে দিবাস্বপ্ন। কিন্তু মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার দিবাস্বপ্নের থেকে অতিমাত্রায় প্রকট। একজন ব্যক্তির মধ্যে সর্বাপেক্ষা একশোটি সত্তার দেখা দিতে পারে এই রোগে। এটা বিভিন্ন কারণে হয় এবং এই কারণগুলোর জন্যই বিভিন্নভাবে তার ভিতর সত্তাগুলোর আবির্ভাব ঘটে। বিভিন্ন ব্যাক্তিত্বের প্রবেশ ঘটে তার মধ্যে। হয়তো তার কাল্পনিক চরিত্রের কেউ, কিংবা জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রিয় কেউ। এটা বিশেষত হয় কেউ যদি কোনো ট্রমায় গিয়ে থাকে। আবার অনেকে নিজেদের জীবন নিয়ে হ্যাপি না, সে যেমন আছে সেটা তার পছন্দ না। তাই নিজেকে খুশি রাখতে বিভিন্ন চরিত্র বানায় এবং নিজেদের জীবন থেকে মুক্তির জন্য অন্য ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়। এই রোগের কারণ আরো বর্ণনামূলক। কিন্তু আমি ওগুলোয় যাব না এখন। ইনানকে নিয়ে বলি, ওর মধ্যেও এই রোগটা দেখা দিয়েছে যখন সে বুঝল জেহফিল তার সব কিংবা জেহফিলকে ছাড়া সে থাকতে পারছে না। একা একা কথা বলতো জেহফিলের সাথে। কিন্তু ইনান জেহফিলকে তীব্রভাবে উপলব্ধি করার জন্য জেহফিলের ভাবভঙ্গি, কথা বলার স্টাইল, এমনকি ও নিজের মনে ভেবেছে জেহফিলের পা ভেঙে গেছে, সেটাও নকল করছিল ধীরে ধীরে। ওর মনে হয়েছে জেহফিল ম’রেনি। ও ইনানের সাথেই আছে। তারপর নিজ মনের কল্পনা ছিল জেহফিল ভালো স্বামী হবে, সেই অনুযায়ী অ্যাক্টিং করতো। এবং পরে যখন আবার নিজ মনে নিষ্ঠুর জেহফিলের কল্পনা করত তখন হিংস্র হয়ে অ্যাক্টিং করত। যখন ইনানকে চেকাপ করতে যেতাম তখন ওর মনে থাকা জেহফিল চাইতো না আমরা যাই। ও তখন জেহফিলের রূপ ধরে কঠোর হয়ে কথা বলে।
ট্রিটমেন্ট অবশ্যই আছে এই রোগের। তবে সময় ব্যাপী। ইফাজ রাজি হচ্ছিল না। ও-কে বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু বাবার মন তো। ওর ধারণা ছিল মেয়ে ভালো থাকবে জেহফিলকে কল্পনা করে। আমি ততটাও বাঁধা দেইনি। ইফাজ মেয়েকে চোখে চোখে রাখবে এই ভেবে আমি আগাইনি আর।’
‘আর এজন্যই তাজবীরকে মা’রার চেষ্টা করেছিল আর শরৎকে মে’রেছিল?’
ইফাজ চমকালেন। তিনি জানতেন না তাজবীরের ঘটনা। তাজবীর এতক্ষণ নীরব দর্শকের ন্যায় ছিল। এবার সে মোবাইল বের করে ভিডিও অন করল। যেখানে ইনান ক্রাচে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল, হাতে ছু’রি। চোখেমুখে জেহফিলের মতো হিংস্রতা।’
কাওসার নিজেও জানতেন না ইনানের ভেতরের জেহফিল যে এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে যাবে।
পলক বলল, ‘একটাবারও চিন্তা করেছেন ইফাজ স্যার, আপনার নেয়া সিদ্ধান্তের ফলাফল কতটা ভয়ানক?’
.
.
চলবে…
[কোন কোন বিষয়গুলো বাদ গিয়েছে কিংবা আর কী কী নিয়ে আপনাদের মনে প্রশ্ন আছে বলুন। পরের পর্বে বলব সেগুলো। আর একটু বড় বড় করে কমেন্ট করেন আজকে।]