#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৩৪
#আশফি_শেহরীন_চিত্রা
[কপি করা নিষিদ্ধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজে এবং অন্য কোনো সাইটেও কপি করা যাবে না।]
.
.
ভোরের আলো তখনো ফুটেনি। চারিদিক ছেয়ে আছে হালকা কুয়াশায়। এই অসময়ে জানালার ধারে বসে হলদে রঙা পাখিটি একাধারে সুর মিলিয়ে ডাকছে। মিষ্টি সুরের গান কানে যেতেই ইনানের ঘুম হালকা হয়ে যায়। আড়মোড়া ভেঙে দুহাত ছড়িয়ে দেয়। হাই তুলে উঠে বসে। ঘুম ঘুম চোখেই হাতড়ে হাতড়ে জেহফিলকে জাগানোর জন্য হাত বাড়ায় সে। ফাঁকা খাটে হাত পড়তেই পিলে চমকায় ইনানের। ঘুম উবে যায় মুহূর্তেই। জেহফিল নেই। কোথায় গেল সে? ইনানের বুক কেঁপে উঠে। অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে জেহফিলের ঘুম বেড়েছে। যেখানে ইনানের আগে ঘুম থেকে উঠত এখন সেখানে দেরি করে ঘুম ভাঙে তার।
ইনান কয়েকবার জেহফিল বলে ডাকল। সাড়া পাওয়া গেল না। জেহফিলের ক্রাচও নেই কোথাও। রুম থেকে বের হওয়ার আগে কী মনে করে বারান্দায় যায় সে। দেখল জেহফিল বারান্দার কাউচে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। সাদা শার্টের বোতাম সবগুলো খোলা, বলিষ্ঠ শরীর চোখে লাগার মতো। বুকের উপর পড়ে আছে ছোট ক্যানভাস, পাশে রঙ তুলি। এ যেন ফিকশনাল কোনো ক্যারেক্টার! ইনানের আগমন জেহফিল যেন চোখ বন্ধ করেই টের পায়, চোখ খুলে মাথা কাত করে ইনানের দিকে চায় শান্ত নয়নে। এক মুহুর্তের জন্য হৃদস্পন্দন থমকে যায় ইনানের। এই যে ইনানের উপস্থিতি চোখ বন্ধ করেও টের পাওয়া, এ যেন সেই আগের জেহফিল! ইনান ঢোক গিলে তড়িৎ পায়ে জেহফিলের কাছে এসে বলল,
‘এতবার ডাকলাম আপনাকে, সাড়া দেওয়া গেল না?’
জবাব এলো না অপরপক্ষ থেকে। বরং সে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ইনানের দিকে। তার চোখে মুগ্ধতা। ধীর গলায় বলল,
‘তোমাকে খুব প্রীটি লাগছে বাটারফ্লাই।’
অপ্রত্যাশিত প্রশংসায় ইনান অপ্রস্তুত হয়ে গেল। লজ্জাও পেল সে। বারান্দার গ্লাসে নিজেকে চেয়ে দেখল, তার চুল এলোমেলো, পরনের নাইটির হাতা ঠিক নেই। তাও জেহফিলের চোখে সবসময়ের জন্য সুন্দর! ভালো লাগল এই ভেবে যে জেহফিল আগের মতো স্বাভাবিক হচ্ছে ধীরে ধীরে।
ইনান গিয়ে জেহফিলের পাশে বসল। জেহফিলের শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘সত্যি করে বলুন তো জেহফিল, আমাকে কী সবসময়ই সুন্দর লাগে? নাকি মন যোগানোর জন্য বলেন?’
বুকে থাকা ইনানের হাত শক্ত করে চেপে ধরল জেহফিল। গভীর চোখে চেয়ে ইনানের হাতে ঠোঁট ছোঁয়ালো। এই মৃদুমন্দ শীতের বাতাসেও ইনান তার শরীরে বয়ে চলা উষ্ণতা টের পেল। জেহফিল ইনানের হাত ঠোঁটে রেখেই বলল,
‘তুমি আমার কাছে সবসময়ই সুন্দর বাটারফ্লাই। তুমি যেমনই থাকো, যেই অবস্থাতেই থাকো না কেন, আমার চোখে তোমাকে স্বর্গীয় পরীর মতো লাগে।’
একটু থেমে জেহফিল ইনানের গালে হাত রাখে। মোহাবিষ্টের ন্যায় গাঢ় স্বরে বলল,
‘You’re like a dream that became reality, even the universe pales to your beauty.’
বসন্তের স্নিগ্ধ বাতাস যেন ইনানের মনে দোলা দেয়। গাল কৃষ্ণচূড়ার ন্যায় রক্তিম হয়ে যায়। তার অন্তঃকরণে রঙ বেরঙের প্রজাপতি উড়তে থাকে। জেহফিল জানে না যে তার এই ছোটো ছোটো কিছু কমপ্লিমেন্ট ইনানের কাছে ঠিক কতটা মিন করে। জেহফিলের সামান্য একটা ভালোবাসাময় কথাতেও ইনানের সব খারাপ লাগা, দুশ্চিন্তা কর্পূরের মতো উড়ে যায়, সারাটা দিন হৃদমাঝারে অচেনা ভালো লাগার সুর গুণগুণ করে গান গাইতে থাকে।
ইনান মুচকি হেসে জেহফিলের বুকের সাথে মিশে গেল। আগে যেখানে শান্তি পেত না, যার থেকে ছোটার জন্য মন সারাদিন ছটফট করত, আজ তার বুকে মাথা না রাখলে ঘুম আসে না, তার সাথে না মিশলে শান্তি লাগে না। ভালোবাসা কী অদ্ভুত! যাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত, আজ তাকেই মনেপ্রাণে আগলে রাখতে মন চায়।
.
.
‘বাবা, তোমাকে আমি বারবার বলেছি, আমার পক্ষে সম্ভব না জেহফিলকে ছেড়ে থাকা। এমন তো না যে উনি প্যারালাইজ হয়ে গেছে বা অন্য কিছু। সামান্য ভেঙেছে। আল্লাহ না করুক এখন যদি আমারও সেইম অবস্থা হতো তখন কি তুমি চাইতে জেহফিল আমাকে ছেড়ে চলে যাক?’
‘মামনি এসব কথা বলে না।’
‘বাবা তোমার কী হয়েছে বলো তো? যেই তুমি জেহফিলকে এত পছন্দ করতে সেই তুমি এখন জেহফিলকে আমার থেকে দূরে সরাতে চাচ্ছ!’
ইনানের অসন্তোষ গলা। ইফাজ খান চিন্তিত মুখে ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন। তিনি ভালো করেই বুঝতে পারছেন তার মেয়ে কথা শুনবে না। নাছোড়বান্দা মেয়ে, তার জানা আছে। কিন্তু এভাবে তো আর চলে না।
‘দেখো ইনান, আমি বলছি না জেহফিলকে ছেড়ে দিতে, তুমি আমার কথা বোঝার চেষ্টা করছো না। অ্যাক্সিডেন্ট শুধু জেহফিলেরই হয়নি। তোমারও হয়েছে, তোমারও রেস্টের প্রয়োজন। তুমি যদি সবসময় জেহফিলের সেবাই করে যাও তাহলে তোমার সেবা করবে কে? এইখানে তোমার কিংবা জেহফিলের কারোই ভালো ট্রিটমেন্ট হচ্ছে না। শহর থেকে এত দূরে বাড়ি, কখন কী হয়ে যায়, বলা তো যায় না! তার উপর জেহফিলও এখন ঠিক অবস্থায় নেই যে কিছু হলে এগিয়ে আসবে। এই নির্জন বাড়িতে থাকাটা অনেক রিস্কের ব্যাপার। আমি শুধু বলছি তুমি নাহয় জেহফিলকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসো। আমাদের বাড়ি তো এই বাড়ির চেয়েও দ্বিগুণ বড়ো। কেউ থাকেও না বাড়িতে। তার চেয়ে ভালো হয় না জেহফিলকে ওখানে রেখে চিকিৎসা করানো?’
‘বাবা, আমি তোমার মেয়ে, তোমার ইন্টেনশন ভালো করেই বুঝি। তুমি ভাবছো জেহফিলের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, তাহলে আমাকে দেখবে কীভাবে! কিন্তু বাবা এটা একদমই ভুল। ওনার আর্টের একেকটার দাম সারাবছরের ইনকামের সমান। আর্ট করতে তো আর পা লাগে না তাই না? কিন্তু তোমার মন মানে না। তোমার একটা স্ট্রং ক্যারিয়ারের ছেলে দরকার ছিল।’
ইফাজ খান বুঝানোর ভঙ্গিতে বললেন, ‘ইনান, মামনি আমার, আমাকে ভুল বুঝো না। আমি…’
ইফাজের কথা কেটে ইনান বলল, ‘তুমি আমাকে ঐ পাখির পালকের সাথে বিয়ে দিতে চাইছো তাই তো?’
ইফাজ থতমত খেয়ে গেলেন, ‘মোটেই না। আমি আরো যোগ্য পাত্র খুঁজব তোমার জন্য।’
ইনান তাচ্ছিল্য করে হাসল, ‘এই না বললে আমি তোমাকে ভুল বুঝলাম, কিন্তু এখন তো সত্যিটা বলেই দিলে যে তুমি আমাকে জেহফিল থেকে দূরে সরাতে চাও।
ইফাজ খানের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মতো ইতিউতি করতে লাগল।
‘অনেক হয়েছে বাবা। তুমি এবার যেতে পারো। রাত হয়ে আসছে। জেহফিল উপরে অপেক্ষা করছেন। ওনার ঔষধের টাইম হয়ে গেছে।’
‘তুমিও ঔষধ ঠিক মতো নিচ্ছো তো মা?’ স্নেহের গলায় বললেন ইফাজ।
‘নিচ্ছি।’
এই বলে ইনান গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো। এতক্ষণ তারা গাড়ির ভেতরেই বসে কথা বলছিল। জানালায় মাথা নিয়ে ইনান বলল,
‘তুমি কি শিওর তুমি উপরে যাবে না?’
ইফাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘হাঁটু ব্যথা করছে।’
‘জেহফিলকে দেখবেও না?’
‘আবার তো আসছিই।’
ইনান ছোট্ট করে শ্বাস নিলো, ‘এসো, দেখে যেও তোমার জামাইকে। কিন্তু বাবা প্লিজ, বারবার বাড়ি যাওয়ার কথা বলবে না। জেহফিল এসবে আনকম্ফোর্টেবল ফিল করে, কোথাও এতদিন থেকে চিকিৎসা নেয়া, তাও যদি হয় শ্বশুরবাড়ি, এসব ওনার পছন্দ না।’
ইফাজ খান মাথা নাড়ালেন শুধু। তারপর ইনানকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।
ইনান খোলা আকাশের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। জীবনটা কখন কোন দিকে মোড় নেয় কেউই বলতে পারে না। ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে কাঁপন ধরালে হাত দুটো দিয়ে নিজেকে আলিঙ্গন করে নেয়। বাড়ির গেটে ঢুকতে নিলেই হঠাৎ চোখ যায় বারান্দার দিকে। বারান্দার পর্দা উড়ছে, মনে হচ্ছে কেউ একজন মাত্র ভিতরে গেল। জেহফিল কি তবে তার জন্য অপেক্ষা করছিল?
________
ইনান রাতের রান্না করে জেহফিলের কাছে যায়। জেহফিল চাদর গায়ে ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল।
ইনানের বাবা যাওয়ার পর থেকে জেহফিল কোনো রিয়েক্ট করেনি। এমনকি ইনানের বাবা কী জিজ্ঞেস করেছে বা কিছুই জানতে চায়নি সে। এখন যদি আগের সাইকো জেহফিল হতো তাহলে হাজারটা প্রশ্ন করে ভাসিয়ে দিতো। ইনানকে একা নিচে যেতে দিতো কিনা তাও সন্দেহ।
ইনান গিয়ে তার পাশে বসে হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরে। জেহফিলকে চোখে চশমা দেওয়ায় প্রফেসরের মতো লাগছে। মারাত্মক সুদর্শন! জেহফিলের গালে নাক ঘষে আহ্লাদী সুরে ইনান ডাকল,
‘জেহফিল!’
জেহফিলের হাত থমকে গেছে ল্যাপটপের উপর। ইনানের উষ্ণ শ্বাস তার গালে, গলায় আছড়ে পড়ছে। ইনানের চুলের স্নিগ্ধ ঘ্রাণ তার নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। হঠাৎ করে ইনানকে জড়িয়ে ধরল জেহফিল, শক্ত করে কিন্তু পরম যত্নে। যেন ইনানকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলবে। গালে গলায় হালকা চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগল ইনানকে। ইনান আদুরে বিড়ালের মতো জেহফিলের আদর নিতে লাগলো। তার গলা জড়িয়ে ইনান গভীর গলায় বলল,
‘আমি আপনাকে কখনো ছেড়ে যাবো না জেহফিল। পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, আপনার পাশে সবসময় থাকবো আমি।’
জেহফিল ইনানের চুলে বিলি কাটতে আরম্ভ করলো। ইনান জেহফিলের বুকের মাঝে ডুবে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আপনাকে ভালোবাসি জেহফিল…খুব..খুব ভালোবাসি।’
.
.
মাঝরাতে ইনানের ঘুম ভাঙে। জেহফিলের ঔষধের কারণে সে এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ইনান কফি বানিয়ে জেহফিলের মাথার কাছে এসে বসে। বারান্দার পর্দা বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। চাঁদের আলোয় চকচক করছে চারিদিক। ঠিক সেই মুহূর্তে ইনানের একটা জিনিস নজরে পড়ল। রুমের লাইট বন্ধ করে সে বারান্দার দরজার পিছনে এসে উঁকি দিলো। তার নজর তাদের বাড়ির সাথের পুকুরের পাশের দোতলা ঘরটায়। এই ঘরটা দুইমাসেই কমপ্লিট হয়ে গেছে। তাদের বারান্দার মুখোমুখি ঐ বাড়ির বারান্দা। ইনান ধারণা করেছিল বাড়িতে কেউই নেই হয়তো। কেননা বাড়ি হওয়া অবধি রুমে কোনো লাইট জ্বলতে দেখেনি। কিন্তু এখন একটা অস্বাভাবিক ঘটনা চোখে পড়ল তার।
তাদের মুখোমুখি সেই বারান্দায় চাঁদের আলোয় কারো ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। লম্বা-চওড়া এক অবয়ব। ইনান চোখ ছোখ ছোট করে দেখার চেষ্টা করল। গুটিগুটি পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো সে। তার বারান্দায় অন্ধকার। ইনান বারান্দায় এসে দাঁড়ানো মাত্রই ঐ ছায়ামূর্তিটিও ইনানের দিকে ঘুরল। এবং জ্যোৎস্নালোকিত আলোয় তাদের দুচোখ মিলিত হলো। যদিও কিছুই তেমন দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু ইনানের কেন যেন মনে হলো ঐ পাশের অবয়বটিকে সে চেনে…আর সেই অবয়বটিও তাকে চেনে…
.
.
চলবে…