#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৩৭
#আশফি_শেহরীন_চিত্রা
[কপি করা নিষিদ্ধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজে এবং অন্য কোনো সাইটেও কপি করা যাবে না।]
.
.
ইনান ফোনে বাবাকে সব বলে দিলো। আগের অবস্থা হলে বলতো না, কারণ তখন জেহফিল থাকতো সব সামলানোর জন্য। কিন্তু এখন তো কেউ নেই। তাই রিস্ক নিলো না সে। বাবাকে শরৎ এর কথা বলে দেয়। সব শুনে তো ইফাজ খানের মাথার তালু গরম হয়ে যায়। তিনি পারে না এখনই চলে যায় ইনানের কাছে। কিন্তু আর্জেন্ট ডিউটির কারণে তিনি আজ শহরের বাইরে। কালকে ফিরবে।
ইনানকে সান্ত্বনা দিয়ে কল রেখে দেন তিনি। সীটে হেলান দিয়ে হাত দিয়ে মুখ মুছে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মোবাইল হাতে নিয়ে একবার পলকের নাম্বার ডায়াল করতে নিয়েও করলেন না। পলক ইফাজ খানের কাছে কখনো কোনো কথা লুকায়নি। জেহফিলের হিংস্র রূপের কবলে পড়ে পলকের যেই হাল হয়েছিল তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছিল সে ইফাজের কাছে। ইফাজ খান চিন্তাও করতে পারেননি তার মেয়ের জামাই যে এত ভয়ানক হবে। পলকের অবস্থা এত খারাপ ছিল বেচারা কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালের বেড থেকে উঠতে পারছিল না। পলক ইফাজ সাহেবকে এর বিহিত করার জন্য অনুরোধ করেছিল। জেহফিলের কাছে ইনান ভালো নেই সেইটাও বুঝিয়েছে।
ইফাজ খান কয়েকবার জেহফিলের সাথে কথা বলেছিল। কৈফিয়ত চেয়েছিল সবকিছুর। প্রথমে জেহফিলকে যতটা শান্ত দেখেছিল ঠিক ততটাই অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে যখন তিনি বললেন ইনানকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন। কম চেষ্টা করেননি জেহফিলকে বুঝানোর, হুমকি ধামকি, ভয় দেখিয়েও লাভ হয়নি। জেহফিল তার জায়গায় অটল ছিল। ইফাজ খানের অতিরিক্ত পাওয়ার দেখানোর কারণে জেহফিল রেগে ইনানের সাথে ইফাজের ফোনে কথা বলাও বন্ধ করে দেন। এক দুই মিনিট যা-ই একটু কথা বলত তাও জেহফিল সাথে সাথে থাকতো। বুঝে গেছেন তিনি যে মেয়েকে হারিয়েছেন চিরতরে। তবে এখানে তার ভুলও ছিল। জেহফিল ছিল ঘুমন্ত সিংহ, তাকে ঘুম থেকে উঠিয়েই তিনি বড্ড ভুল করেছিলেন।
পলক চেয়েছিল ইনানকে ছাড়িয়ে এনে জেহফিলকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে। কিন্তু ইফাজ খান যখন পিছু হটলেন, আর পলককেও অনুরোধ করলেন এগুলো নিজেদের মধ্যে রাখতে। তারপর থেকেই পলকের চাপা ক্ষোভ ইফাজের উপর। ইনানকে নিজের করে পাওয়ার রাস্তাটা যা-ই একটু খোলা ছিল, ইফাজ খানের জন্য তাও হলো না। এরপর থেকে পলক ছুটিতে। যেই ছেলে দিনে কয়েকবার ইফাজ খানের খোঁজ নিত সেই ছেলে মাসের পর মাস কল অবধিও দেয় না। ইফাজ বুঝেন পলকের রাগ। পলক সঠিক বিচার পায়নি, সেই রাগ থেকেই ইফাজ খানের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে, খোঁজও নেয় না। আজ পলক পাশে থাকলে এত কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো তার জন্য সহজ হয়ে যেত। পলক মেয়ে জামাই হিসেবে খারাপ হতো না…
তার মেয়ের কপালে এত দুঃখ কেন? শুরু থেকেই তার মেয়েটা ভালো ছিলো না, তিনি কেন জানলেন না! তার বাচ্চা মেয়েটা সুখের জীবন পেল না। যা ডিজার্ভ করতো তাও পেল না। এত কষ্টের ভার কীভাবে সইছে তার মেয়ে? এত ছোট আদুরে মেয়ে তার! অ্যাক্সিডেন্টের পরও তার মেয়ে ভালো নেই। এসব কেন হচ্ছে? ভাবলেন তিনি, তার অতীতে করা কর্মকান্ডের জন্য? নিজের ভাবনায় নিজেই চমকালেন। তবে কি তার অতীতের করা পাপের শাস্তি তার মেয়ে ভোগ করছে?
.
.
মাঝরাতে খট করে কিছু ধাক্কার আওয়াজে তাজবীরের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠে বিরক্ত হয়। সে এখন বারান্দায় বসেছিল। পাশে দূরবীণ। ইনানকে চোখে চোখে রাখতে গিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়ল!
আজ আকাশে চাঁদ থাকলে মেঘেদের কারণে আলোর তীব্রতা কম। ফের আওয়াজ হলো! সতর্ক হয়ে গেল তাজবীর। দূরবীণটা কাপড় দিয়ে ঢেকে ভেতরে চলে আসলো। দূর থেকে হালকা আওয়াজও তার কানে বারি খায়, এই একটা ফ্লেক্স তার। নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে আওয়াজটা শোনার চেষ্টা করল সে। যেন কিছু একটা ফ্লোরে টেনে টেনে আসছে, সাথে টুক টুক আওয়াজ, ভালো করে শুনতে পেয়ে বুঝল পা ছ্যাঁচড়ানোর আওয়াজ এবং তালে তাল মিলিয়ে লাঠি জাতীয় কোনো জিনিস ঠকঠক করছে।। কেউ মনে হয় খুব কষ্টে পা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গেই তাজবীরের মাথায় ক্যাঁচ করল ব্যাপারটা।
উপরে নিচে সবখানেই ডিম লাইট জ্বালানো। আবছা আবছা সব দেখা যাচ্ছে। পার্ফেক্ট। তাজবীর মোবাইল হাতে নিয়ে তার ক্যাবিনেটে ঢুকে গেল। হালকা ফাঁকা রেখে ক্যামেরা অন করে নিলো।
পা টানার আওয়াজ তীব্র হলো। তাজবীরের রুমের পাশের সবগুলো রুমের দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল। তাজবীরের বুক ধড়ফড় করছে, ভয়ে নাকি এক্সাইটমেন্টে বোঝা গেল না। কিছুক্ষণের মাঝেই ক্যাড়ক্যাড় আওয়াজে তাজবীরের রুমের দরজা খুলে যায়।
তাজবীরের জানালা এবং বারান্দা দিয়ে গভীর জঙ্গলের অর্ধেকাংশ দেখা যায়, এমনকি নাম না জানা কিছু গাছের ডাল তাজবীরের বারান্দায় এসে অবহেলায় ছড়িয়ে আছে। এই অন্ধকারে সেদিকে তাকালে মনে হয় বারান্দায় কেউ কালো রঙা আলখাল্লা পরে কুঁজো হয়ে বসে আছে। কাছে গেলেই বিভৎস চেহারা তুলে চমকে দেবে। আগন্তুক ধীর পায়ে আসার চেষ্টা করলেও আওয়াজের তীব্রতা কমাতে পারছে না। আগন্তুকের অবয়ব তাজবীরের দৃষ্টি সীমানার কাছে আসলে তাজবীর শকুনের মতো তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করল। আগন্তুক ঘাড় কাত করে কিছু একটা বিড়বিড় করছে, কালো জ্যাকেট পরনের জন্য পেছন থেকে তেমন বোঝা যাচ্ছে না সে কে।
যখনই সে ক্যাবিনেটের পাশে তথা বারান্দার দিকে সম্পূর্ণভাবে ফিরল এবং তার চেহারা স্পষ্ট হলো সাথে সাথেই বৈদ্যুতিক শক খেলে যায় তাজবীরের শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরায়। সাথে ভয় এবং অস্থিরতার একটা সূক্ষ্ম মিশ্রণ অল্প সময়ের জন্য ঝিলিক দিয়ে উঠে চোখের মণিতে যখন আগন্তুকের হাতে থাকা ধারালো মোটা, লম্বা ছু’রি চিকচিক করছিল চাঁদের আলোয়। মারাত্মক থ্রিলিং পরিবেশ। গা ছমছমে, ভয়ানক, তবে রোমাঞ্চকর। সে ক্যামেরা ঠিকভাবে তাক করে আগন্তুকের আগমন বন্দী করল।
আগন্তুকের আগমনের কারণ স্পষ্ট হয়ে যায় তাজবীরের কাছে। তবে সে যা ভেবেছিল তা-ই সঠিক।
‘হলি ফা’কিং শিট!! ইটস লিটরেলি ইম্পসিবল!’ মনে মনে আওড়ায় সে। বুদ্ধিদীপ্ত চোখে আগন্তুকের প্রতিটা পদক্ষেপে নজর রাখল। আগন্তুকের চোখে কঠিন অথচ কাউকে মে’রে ফেলার মতো দৃষ্টি। মুখ দিয়ে একটা শব্দ বারবার জপছে,
‘বা…’
তাজবীর এক অক্ষর শুনেই বুঝে ফেলল কী বলছে সেই চেনা অথচ অচেনা মানুষটা।
নিমন্ত্রণ ছাড়া চলে আসা মেহমান যখন তার কাঙ্ক্ষিত শিকার পেল না তখন আরো কয়েক মিনিট তাজবীরের পুরো বাড়িতে ভুতগ্রস্তের ন্যায় ঘুরপাক খেল। একট সময় চলে যাওয়ার আওয়াজ শুনল তাজবীর। কীভাবে সেই আগন্তুক ঘরে ঢুকেছে সেই কৌতুহল দমাতে না পেরে পিছু পিছু যায় সে। দেখল ড্রয়িংরুমের সোজা কাঁচের দরজার ফাঁক গলে চলে যাচ্ছে সে। আজ তাজবীর বিকেলে দরজা আটকাতে ভুলে গিয়েছিল। ভালোই হয়েছে ভুলে গিয়েছে। নাহলে এত ইন্ট্রেস্টিং একটা জিনিস চোখে পড়ত না। তবে অবাক হলো এই ভেবে, তাকে মা’রতে আসার কারণটা কী? সে তো ভুল কিছু করেনি তেমন!
তাজবীর বারান্দায় গিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল যেখানে আগন্তুক পা টেনে তার সামনে অবস্থিত বাড়ির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। সেই একইভাবে ঘাড় কাত করে। চলার পথে আগন্তুক থামল। তাজবীর ভ্রুকুটি করে চোখ ছোটো ছোটো করে চাইল। হঠাৎ করেই আগন্তুক ঘাড় ঘুরিয়ে তাজবীরের বারান্দার দিকে তাকায়। তাজবীর যেন জানত, তাই তাকানোর সাথে সাথেই নিচে বসে পড়ল। পাঁচ সেকেন্ড বাদ ঘাড় ঘুরিয়ে চলে গেল আগন্তুক। তাজবীর সেই মুহূর্তটাও ভিডিও করল।
যখন আর কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না মানুষটার তখন তাজবীর রুমে এসে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। মোবাইলের আলো কমিয়ে চোখের কাছে এনে হোয়াটসঅ্যাপে একটা নাম্বারে ভিডিওটা সেন্ড করল। লিখল,
‘লাইফে অনেক থ্রিলার মুভি দেখেছি। বাট বাস্তবেও যে আমার সাথে এমন একটা থ্রিলার ঘটনা ঘটবে, আই সয়্যার, কল্পনাতেও আনিনি। তবে আমি যা ধারণা করেছিলাম তা-ই সত্যি হয়েছে।’
মেসেজ সেন্ড করে দুহাত মাথার নিচে দিয়ে গভীর শ্বাস ফেলল তাজবীর,
‘আর কত যে রঙ্গ দেখতে হবে এই দুনিয়ায়!’
.
.
চলবে…
[২৫% চার্জ দিতে পেরেছি। তাই তাড়াতাড়ি করে যেটুকু পেরেছি ভয়েস দিয়ে লিখে ফেলেছি। ছোট হয়েছে বলে কিছু মনে করবেন না আশা করি।]
গ্রুপে যুক্ত হয়ে নিন সবাই (◍•ᴗ•◍)♡
https://m.facebook.com/groups/1031660127365464/?ref=share&mibextid=NSMWBT