#কাজললতা
পর্ব:৬
লেখিকা: ইভা আক্তার
🍁🍁🍁
যতই যাচ্ছে ইফতি ভাইয়ার হাবভাব আমাকে ততই অবাক করছে। কি হলো এর। আগে তো আমায় দুচোখে দেখতে পারতে না। তাহলে আজ এতো কেয়ারিংয়ের মানে কি। না না এসব হতে পারে না। শিয়াল যেমন শিকারের আগে ক্ষুধার্থ থাকে তেমনি হয়তো ইফতি ভাইয়াও আমাকে শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
– কি হলো খাচ্ছিস না কেনো? (ইফতি ভাইয়া)
– এ-এই তো ইফতি ভাইয়া খাচ্ছি। (আমি)
ইফতি ভাইয়ার এতো কেয়ারিং আমার কাছে ভয়ানক লাগছিলো তাই ভুল করে মুখ ফোসকে বলে দিলাম,,
– দেখো ইফতি ভাইয়া, কালকে আমি ভুল করে ইলমাকে ননদিনী বলে ফেলেছিলাম। তাই বলে শাস্তি দেওয়ারতো কোনো মানে হয় না তাই না? আমি জানি না তুমি কি পরিকল্পনা করছো কিন্তু ভুল করেও রেস্টুরেন্টের বিল আমায় দিয়ে পরিশোধ করানোর চিন্তা মাথায়ও আনবে না। ( আমি)
আমার কথায় ইফতি ভাইয়ার হাবভাবের কোনো পরিবর্তনই দেখলাম না। ভেবেছিলাম আমার কথায় হয়তো ইফতি ভাইয়া চোখ রাঙাবে কিন্তু এমন কিছুই হলো না। আমি নীরবে খাচ্ছিলাম হঠাৎই ইফতি ভাইয়া খাওয়া শেষ করে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে উঠে যাচ্ছিল।
– এই ইফতি ভাইয়া এমন করো না প্লিজ। আর কখনো আমি ইলমাকে ননদিনী তো দূরের কথা কথাই বলবো না ওর সাথে আর। প্লিজ প্লিজ। আমি পেটুকের মতো যে এতো কিছু অর্ডার করলাম আমার কাছে তো কানাকড়িও নেই। একটু দয়া করো ইফতি ভাইয়া । (আমি)
এবারও ইফতি ভাইয়ার হাবভাবের কোনো পরিবর্তন দেখলাম না। ইফতি ভাইয়া আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে চলে গেলো। এবার মনে হচ্ছে আমার রুহু সত্যিই উড়ে যাবে। হায় হায় হায় কি করবো এখন। কোনো উপায় না পেয়ে চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। যতই হোক খাবারটা না হয় খেয়ে তারপর অন্য কিছু ভাবা যাবে। কিন্তু বিল পরিশোধের চিন্তায় যেনো আমার গলা দিয়ে খাবারই নামছিলো না। খালি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হই শালার ইফতি তোরে মাটিতে পুতে রাখব। একশোবার বলবো ননদিনী ননদিনী ননদিনী। আমার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে দেখলাম ইফতি ভাইয়া আসছে । ইফতি ভাইয়াকে দেখে যেনো আমার প্রাণ ফিরে এলো। ইফতি ভাইয়া আমার সামনের চেয়ারে বসে বললো,,
-তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠ। বাসায় যাবি না নাকি রেস্টুরেন্টে বসে থাকবি?(ইফতি ভাইয়া)
আমি তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার আগে বললাম,
– ইফতি ভাইয়া তুমি মনে হয় বিল দিতে ভুলে গেছো (আমি)
– বিল আমি দিয়ে দিয়েছি। এটা নিয়ে তোর টেনশন করতে হবে না। (ইফতি ভাইয়া)
বিল দেওয়ার কথা শুনে যেনো আমি নতুম প্রাণ ফিরে এলাম। তারমানে আমার আর বিল পরিশোধ করা লাগবে না। ইয়াহুহ 𑅁 ইশশ বেচারাকে কতই না গালিগালাজ করলাম।
🍁🍁🍁
ইফতি ভাইয়া গাড়ি চালাচ্ছে। আর পাশেই আমি বাইরের দৃশ্য দেখছি। গাড়িতে উঠার পর থেকে একটা কথাও বলি নি আমরা। হঠাৎই ইফতি ভাইয়া গান ছাড়লো,
“Phir agar mujhe tu kabhi na mile
Humsafar mera tu bane na bane
Faaslo se mera pyaar hoga na kam
Tu hoga na kabhi ab judaa..
Maine tera naam dil rakh diya
Maine tera naam dil rakh diya
Dhadhkega mujhme sada
Maine tera naam dil rakh diya”
ইফতি ভাইয়ার দিকে অবাক চোখে এক নজরে তাকিয়ে আছি আমি। জানি না কেনো গানটা শুনার পর ইফতি ভাইয়ার দিকে আমার নজর আটকে গেলো। আজ ইফতি ভাইয়াকে সত্যি অনেক সুন্দর লাগছিলে। ব্লু শার্টের সাথে ব্ল্যাক জিন্স। হোয়াইট কালারের শু। চুলে জেল দেওয়া। অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো। যে কোনো মেয়ের ক্রাশ হওয়ার জন্য এটা একটু বেশিই হয়ে গেলো। খেয়ার করলাম ইফতি ভাইয়া গাড়ির সামনের আয়না দিয়ে আমায় দেখছে। আমি তাড়াতাড়ি করে চোখ সরিয়ে নিলাম। ইশশশ কি হলো আমার। ইফতি ভাইয়ার মতো কি আমারও মাথা নষ্ট হয়ে গেলো নাকি। আচ্ছা? ইফতি ভাইয়া কি দেখেছে নাকি যে আমি তাকে দেখছিলাম। কি লজ্জা! কি লজ্জা। লজ্জায় আমার গাল লাল হয়ে গেছে।
বাড়ির সামনে এসে ইফতি ভাইয়া গাড়ি থামালো। আমি আর ইফতি ভাইয়া দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে ইফতি ভাইয়াকে বললাম,,,
-এসো ইফতি ভাইয়া ভেতরে এসো (আমি)
– না এখন যাবো না। বাবার অফিসে যাবো কাজ আছে। (ইফতি ভাইয়া)
– ওহ আচ্ছা। এসো কিন্তু পড়ে। (আমি)
ইফতি ভাইয়াকে বিদায় জানিয়ে আসার সময় পিছন থেকে ইফতি ভাইয়া ডাক দিলো,,
– শোন (ইফতি ভাইয়া)
– হু বলো (ইফতি ভাইয়ার দিকে এগিয়ে এসে)
ইফতি ভাইয়া কিছুটা ইতস্তত বোধ করে গম্ভীরভাবে বললো,
– তোকে যেনো আর ওই ছেলের সাথে না দেখি (ইফতি ভাইয়া)
– ছেলে? কোন ছেলে? কার কথা বলছো?(আমি)
– নাটক করছিস আমার সাথে? ওই যে কলেজে ঢুকে যার সাথে তোকে দেখলাম। (ইফতি ভাইয়া)
আমি একটু গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বললাম,
– তাতে তোমার কি হ্যা? আমি কি কখনো তোমাকে বলেছি যে কোনো মেয়ের সাথে যেনো তোমায় না দেখি? (আমি)
কথাটি বলে চলে আসতেই ইফতি ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে একদম তার মুখের সামনে নিয়ে আসলো। আমার দুই হাত ইফতি ভাইয়া নিজের এক হাত নিয়ে আমার পিছন দিয়ে ধরলো। তার শ্বাস-প্রশ্বাস আমার মুখে এসে পড়ছিলো। আজ পর্যন্ত কখনো কোনো ছেলের এতো কাছাকাছি আসি নি যার ফলে আমার হৃৎস্পন্দন বেড়েই চলছিলো।
– অনেক সাহস হয়ে গেছে তোর তাই না? আমি বলেছি ওই ছেলের সাথে কথা বলবি না মানে বলবি না। শুধু ওই ছেলে কেনো। কোনো ছেলের আশেপাশেও যেনো তোকে না দেখি। নাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার কথায় যেনো আমি অবাকের শেষ সিমানায় পৌঁছে গেলাম। এসব কি বলছে ইফতি ভাইয়া। ইফতি ভাইয়া আমায় কেনো কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে বারণ করছে? ইলমার তো অনেক ছেলে বন্ধু আছে তাহলে আমার থাকলে কি দোষ। সবই যেনো আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
🍁🍁🍁
বিকেলে আসরের নামাজ পড়া শেষে বই নিয়ে টেবিলে পড়তে বসলাম। সব পড়া যেনো আমার মাথায় দলা পাকিয়ে বসে আছে। মাথা ভনভন করছিলো। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে আমার ঘোর কাটলো। বাসায় আম্মু আর আমি একাই আছি। একবার ভেবেছিলাম টেবিল ছেড়ে উঠবো না কিন্তু আম্মুর ডাকে উঠে ড্রইং রুমে গেলাম। গিয়ে দেখলাম আম্মু সিরিয়ালে একেবারে মগ্ন হয়ে আছে। তাই আমি নিজেই গিয়ে দরজা খুললাম। দরজা খুলে চিঠিওয়ালার সেই লোকটাকে দেখলাম। ওনাকে দেখেই আমার মুখে হাসির ঝলক ফুটে উঠলো। যেই চিঠির জন্য আমি সারাটাদিন অপেক্ষার প্রহর গুনি সেই চিঠি অবশেষে পেলাম। চিঠিটিতে সাইন করার পর লোকটা যখনই হাটাঁ ধরছিলো তখনই বললাম,,,
– একটু শুনুন! (আমি)
– জ্বি মেডাম বলুন (লোকটি)
-আপনি কি বলতে পারবেন এই চিঠিগুলো কে দেয়? তাকে দেখতে কেমন? তার নাম কি? বা সে কেমন জামা কাপড় পড়েছিলো আজ?(আমি)
– মেডাম নাম তো জানি না কিন্তু উনি দেখতে শ্যামবর্ণের। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া ছিলো। আর আজকে পড়েছিলো হালকা সবুজ রঙের শার্ট আর নীল রঙের জিন্স। এই তো ২৩ বা ২৪ বছরের যুবক হবে। সব মিলিয়ে দেখতে মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর ছিলো। (লোকটি)
শ্যামবর্ণের ছেলে? মানে আমার সেই অচেনা প্রেমিক পুরুষটি হচ্ছে শ্যামসুন্দর? ইসসস!
– আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ (আমি)
দরজা লাগাতে যাবো তখনই লোকটা ডাক দিলো,
-মেডাম!(লোকটি)
– জ্বি বলেন (আমি)
– বলতেই হয়! আপনি অনেক ভাগ্যবান। আমাদের চিঠি দেওয়া বন্ধ হয়েছিলো আরো অনেক বছর আগে। আমরা শুধুমাত্র কুরিয়ারে জিনিস পাঠাতাম। কিন্তু এই বিশ শতাব্দীতে এসে একটা ছেলে আমাদেরকে অনুরোধ করলো যেনো আমরা আবার চিঠি দেওয়া শুরু করি। ওনার এই কান্ডে আমরা সবাই অনেক অবাক হয়েছিলাম। এখন শুধুমাত্র আমরা আপনার জন্যই চিঠি দেওয়া শুরু করেছি। সত্যি মেডাম আপনি অনেক ভাগ্যবান।(লোকটি)
ওনার কথায় আমি প্রচণ্ড লজ্জা পেলাম। তারপর ওনাকে বিদায় জানিয়ে চিঠি নিয়ে চলে আসতেই আম্মু বললো,,
– কিরে কে এসেছিলো? কার সাথে এতোখোন কথা বললি? (আম্মু)
আম্মুকে কোনো মতেই বলা যাবে না চিঠির কথা। নইলে হাজারটা প্রশ্ন করবে।
– আসলে আম্মু একজন আন্টি ভুল করে উপরের তলায় না গিয়ে আমাদের বাসায় কলিংবেল বাজিয়েছে। তাই একটু কথা বললাম। (আমি)
– ওহ আচ্ছা। এখন যা গিয়ে পড়তে বস (আম্মু)
রুমে এসেই দরজা বন্ধ করে খাটের উপর বসলাম চিঠি খুলতে। চিঠির খাম খুলতেই সেই চিরচেনা সুগন্ধি। এই সুগন্ধি পাওয়ার জন্যই তো সারাটাদিন কতো অপেক্ষার প্রহরই না গুণতে হয়। এবারও চিঠির ভিতরে পেলাম একটি কাজল। উফফ লোকটি কি বুঝে না? তার দেওয়া কাজল এখন আমার কাছে ভালোবাসার স্তূপ হয়ে গেছে। চিঠিটা খুলতেই ভিতরে লেখা ছিলো,,,
চলবে……🍁