#কাজললতা
লেখিকা: ইভা আক্তার
পর্ব: ৩
সামনে থাকা ব্যাক্তিটি আর কেউ নয় বরং আমার দু-চোখের বিষ ইফতি ভাইয়া। এতো মানুষ থাকতে ওরই বা কেনো আসতে হলো এই মাঝরাতে আমাদের বাড়িতে। অন্তত ওর বদলে অন্য মানুষ থাকলে অল্প হলেও আমার এই সাজ দেখে প্রশংসা করতো। ইফতি ভাই আমার দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে রয়েছে। আমি সালাম দিয়ে মুখ গম্ভীর করে দাড়িয়ে আছি। ইফতি ভাইয়া আমায় নিচ থেকে উপর পর্যন্ত একবার দেখে বললো,
” এই মাঝ রাতে শেওড়া গাছের পেতনির মতো চুল ছেড়ে সেজেছিস কেনো? বটগাছে ঝুলতে যাবি নাকি? ”
ইফতি ভাইয়ার কথা শুনে আমার কাজল দেওয়া চোখগুলো রক্ত বর্ণ আকার ধারণ করলো। সাধারণত ইফতি ভাইয়ার এই তাচ্ছিল্যসহকারে কথাবার্তার জন্যই আমি ওকে দু-চোখেও সহ্য করতে পারি না।
“হ্যা যাবো। তাতে তোমার কি? আর এই মাঝ রাতে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে-পুড়ে কোথা থেকে চুরি করে এসেছো হ্যা?” (আমি)
ইফতি ভাইয়া নিজের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ছোটো করে বলতে লাগলো,
“আমাকে দেখে তোর কোথা থেকে চোর মনে হচ্ছে হ্যা? সাহস কি বেশি বেড়ে গেছে নাকি? ” (ইফতি ভাইয়া)
কিছু বলতে যাবো তখনই দেখি আব্বু এসে বলতে লাগলো,
“আহা! কি শুরু করলি তোরা? আর ইফতি তুই এই মাঝ রাতে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে-পুড়ে কোথা থেকে এসেছিস? তাড়াতাড়ি ভিতরে আয় তারপর জামা কাপড় চেন্জ কর নাহলে জ্বর এসে পড়বে তো। আর ইভা (আমার দিকে তাকিয়ে) তোমার কি এতোটুকু মেনার্স নেই? তোমার ইফতি ভাই বৃষ্টিতে ভিজে এতো রাতে এসেছে আর তুমি ওকে ভিতরে ঢুকতে না দিয়ে ঝগড়া করছো?”
বাবার কথায় মাথা নিচু করে দাড়িয়ে ছিলাম। ইফতি ভাইয়া ভিতরে ঢুকতেই দরজা আটকে রুমে চলে গেলাম। চুলটা বাধতেই মা ডাকাডাকি শুরু করলো ইফতি ভাইয়াকে যেনো খাবার বেড়ে দিতে সাহায্য করি। কি আর করার। গেলাম সাহায্য করতে। সামনের চেয়ারে বাবা বসে চা খাচ্ছিলো আর ইফতি ভাইয়াকে আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছিলাম। মা ইফতি ভাইয়ার রুমটা গুছিয়ে দিচ্ছিল। ইতিমধ্যে ইফতি ভাইয়া জামাকাপড় পাল্টে বাবার একটা গেন্জি আর ট্রাউজার পড়েছিল।
“তো ইফতি? তুই এতো রাতে কোথা থেকে এসেছিস? তোর বাবা মা কি জানে? “(বাবা)
” আসলে মেঝো চাচ্চু এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে আসতে আসতেই বৃষ্টি শুরু হলো। তাছাড়া ওখানে থেকে তোমার বাড়ি কাছে ছিলো তাই ভাবলাম এখানেই আজকের রাতটা থাকি। আর মাকে আমি জানিয়ে দিয়েছি।”(ইফতি ভাইয়া)
” তো ভালোই করেছিস। তুই তো এখন আর আসিসও না আমাদের বাড়িতে। শেষ কবে এসেছিলি মনে আছে?”(মা)
“আরে মেঝো কাকি বলো না আর। বাবার ব্যবসা আর পড়ালেখা করতে গিয়েই আসার সময় পাই না ( ইফতি ভাইয়া)
” হুম বুঝেছি আর বলতে হবে না (মা)
বাবা আর ইফতি ভাই কথা বলছিলো। আর আমি আম্মুকে প্লেট ধুতে সাহায্য করছিলাম।
“হয়েছে। এখন আর গল্প করতে হবে না। দেখেছো তোমরা কয়টা বাজে ঘড়িতে?যাও ঘুমাতে যাও। ইফতি বাবা তুইও ঘুমাতে যা। বিছানা ঠিক করে দিয়েছি (আম্মু)
” আরে মেঝো কাকি তুমি এতো কষ্ট করতে গেলে কেনো বলো তো? তোমার এতো বড় মেয়ে থাকতে তুমি কেনো এতো কাজ করো? অবশ্য তোমার মেয়ে যা। দেখো না মাঝরাতে সেজেগুজে বসে আছে। “(ইফতি ভাই)
” হ্যা তাই তো। আগে বলতো সামনে পরীক্ষা এখন পড়া আছে তাই কাজ করতে পারবো না। আর এখন তো পরীক্ষা শেষ তাও কাজকাম কেনো করে না জিজ্ঞেস করতো? আর তুই এতো রাতে শাড়ি পড়ে কোথায় যাচ্ছিস?
” বুঝলাম না। সামান্য একটু শাড়ি পরে সেজেছি তাতেই তোমাদের এতো সমস্যা। ধুর আর কখনো শাড়িও পরবো না আর সাজবোও না। খুশি তো? “(আমি)
” আরে বাবা। তা তো কেউ বলে নি। তুই সাজবি আর শাড়িও পরবি। কিন্তু এই নীল রঙের শাড়িটা তুই কোথায় পেলি। কোনোদিন তো দেখলাম না। আর কেউ তো উপহারও দেয় নি। “( বাবা)
বাবার কথা শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম।এই রে এবার কি বলি।
” আসলে বাবা। সন্ধ্যার দিকে আমার এক বান্ধবী এই শাড়িটা আর চুড়িগুলো কুরিয়ারে পাঠিয়েছে। ও তো ওর মামা বাড়ি বেড়াতে গেছে। তাই উপহার দিতে পারে নি। এর জন্য সেখান থেকে কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিয়েছে “(আমি)
” এগুলো যে সত্যি তোর বান্ধবী দিয়েছে নাকি অন্য কেউ দিয়েছে তার প্রমাণ কি? (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ের কথা শুনে মাথার রক্ত গরম হয়ে গিয়েছিল। রাগী চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই আম্মুর দিকে আমার চোখ পড়লো। আম্মু চোখ গরম করে আমার দিকে তাকিয়ে রুমে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো।
“হ্যা এখন আর আমাকে দিয়ে কি করবে। তাদের আদুরে ছেলে যে বাড়িতে এসেছে। আমার কোনো ভাই নেই বলে কি ইফতি ভাইয়াকে নিজের ছেলে ভাবা লাগবে এমন কোনো কথা আছে। যত্তসব ঢঙ। ” (মনে মনে)
ড্রয়িং রুম থেকে এসেই শাড়ি চেন্জ করে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার পাশের রুমটাই ছিলো ইফতি ভাইয়ের। এজন্য খুব সহজেই বারান্দা দিয়ে রুমের টেবিল পর্যন্ত কিছুটা দেখা যেতো। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম ইফতি ভাইয়ার রুমের লাইট এখোনো জ্বালানো। তাই বুদ্ধি করে আমার রুমের লাইট অফ করে চুপি চুপি বারান্দায় গিয়ে দেখি ইফতি ভাইয়া টেবিলে বসে কি যেনো লিখছিলো আর মুচকি মুচকি হাসছিলো। আমি ভ্রু কুঁচকে ইফতি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অবাক হয়ে ইফতি ভাইয়ার মুখের পানে চেয়ে রইলাম। সত্যিই ইফতি ভাইয়াকে হাসলে দারুণ লাগে। এত বছর পর আজ ইফতি ভাইয়ার হাসির সৌন্দর্য নজরে পরলো। এজন্যই হয়তো ইফতি ভাইয়ার মেডিকেলের মেয়ে হতে শুরু করে কাজিনরাও প্রেমে হাবুডুবু খায়। ইসস! ছেলেটা কি এমন হেসেহেসে কথা বলতে পারে না? সবসময় কেনো গম্ভীর হয়ে কথা বলতে হবে? আমি মুগ্ধ হয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ইফতি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎই ভুল বশত বারান্দায় থাকা ফুলের টবটা হাত লেগে পড়ে যায় ফলে আমি একটা চিৎকার দিয়ে ফেলি।
সাথেসাথে ভয় পেয়ে তাড়াহুড়ো করে দরজা ঠেলে দৌড়ে এসে বিছানায় শুয়ে পরলাম। আল্লাহ জানে ইফতি ভাইয়া দেখেছে নাকি।
শুয়ে শুয়ে ইফতি ভাইয়ার ওই হাসির কথাই বারবার মনে পড়ছিলো।
“একটা ছেলের হাসি সত্যিই এতো সুন্দর হয় ভাবা যায়? এতোদিন কেনো নজরে পড়লো না ধুর। হায় আল্লাহ আমি এসব কি ভাবছি আর কাকে নিয়েই বা ভাবছি। আমার চরম শত্রু ইফতি ভাইকে নিয়ে? ছি ছি ছি। ও তো আমার চুলেরও যোগ্য না হু। আমাকে শেওড়া গাছের পেতনি বলা তাই না? তোর বউ হবে শেওড়া গাছের পেতনি। শালা নাইজেরিয়ান এনাকন্ডা।”
একা একা বকবক করতে করতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আল্লাহ মাবুদ জানে। ঘুম থেকে উঠেই আম্মু বললো ইফতি ভাইয়া নাকি সকাল সকাল চলে গেছে। ইফতি ভাইয়ার যাওয়ার কথা শুনেই কাল রাতে ভাইয়ার হাসির কথা মনে পড়ে গেলো। ধুর কি যে ভাবছি না আমি। গেছে ভালোই হয়েছে। নইলে সকাল সকাল কিছু না কিছু নিয়ে ঝগড়া করতো।
*****************
বিকেলের দিকে আরেক দফা বৃষ্টির দেখা মিললো। চারিদিক বৃষ্টির পানিতে টইটুম্বুর হয়ে গেছে । মাঝেমধ্যে বৃষ্টির বাতাস জানালার সামনে দাড়িয়ে থাকা কাজললতার মনকে ঠান্ডা করে দিচ্ছিল। কাজললতা ভাবছে তার সেই অচেনা প্রেমিক পুরুষের কথা। কে সে? দেখা হবে কি কখনো তার সাথে? দেখা হলে কি সে আমায় কাজললতা বলে ডাকবে? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো কাজললতার নিজের কাছেই নেই। তবে আছে ঠোঁটের কোণে থাকা মুচকি হাসি।
চলবে…….🍁