আমি জন্মের পর থেকেই আমার চরম লেভেলের শত্রু হিসেবে চাচাতো ভাইকে দেখতে পেয়েছিলাম। ছোটো থেকেই আমাদের সম্পর্ক ছিলো বাংলাদেশ আর ভারতের বর্ডারের মতো।ভাইয়া ছিলো আমার থেকে ৩ বছরের বড়। ওর নাম ইফতি। মেডিকেলের ২য় বর্ষের স্টুডেন্ট। আর আমি ইভা। এবার ক্লাস 11 । ভাইয়া ছিলো আমার বড় চাচ্চুর ছেলে এবং বংশের বড় নাতি যার ফলে সবার ছিলো খুবই আদরের। আমার বাবারা তিন ভাই আর দুই বোন। বড় ভাই আদনান চৌধুরী (ইফতি ভাইয়া আর ইলমার বাবা),মেজো ভাই আদৃত চৌধুরী (আমার বাবা), আর ছোটো ভাই আহসান চৌধুরী। বড় ফুপি নাবিরা চৌধুরী আর ছোটো ফুপি নিশাত চৌধুরী। ছোটো চাচ্চুর কথা অনুযায়ী আমার আর ইফতি ভাইয়ার শত্রুতা নাকি মুক্তিযুদ্ধাকেও হার মানাবে। তবুও আমাদের ফুপ্পিরা তাচ্ছিল্যের সাথে বলতো “ঝগড়া কিন্তু আজীবন থাকে না। তাই বলে রাখছি, এই শত্রুতা যেনো ভিন্ন সম্পর্কে না যায়। ” এসব বলতো আর তারা একেক জন অট্ট হাসিতে ফেটে পড়তো। সে যাক গে, শত্রুদের মধ্যে আবার কিসের সম্পর্ক?
তো এবার আসা যাক আমাদের শত্রু কাহিনীর মধ্যে।
তো একদিন ইফতি ভাইয়া আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলো।তখন আমি কলেজের হোম ওয়ার্ক লিখছিলাম। ইফতি ভাইয়া আমার রুমে এসে বলতে লাগলো “গোবর ভরা মাথা নিয়ে কিভাবে যে পড়ালেখা করিস বুঝি না। এতো টাকা খরচ করে তোকে না পড়িয়ে তোর বাবাকে বলা উচিত তোকে যেনো রেস্টুরেন্টে হাড়ি পাতিল মাজার কাজে লাগিয়ে দেয় (হাসতে হাসতে)”
ইফতি ভাইয়ার কথায় কোনো জবাব দিলাম না কারণ মাত্র লেখা শেষ করেছি। এখন আর ঝগড়া করার মুড ছিলো না। তাই একটা ভেংচি দিয়ে উঠে পড়লাম বড় কাকির সাথে গিয়ে গল্প করতে। আর এই ফাঁকে ইফতি ভাইয়া আমার H.W খাতায় বড় বড় করে লিখে দিয়েছিলো,
“কলেজ টা কোনো রকম ঠেলেঠুলে পাশ করেই পড়ালেখা ছেড়ে বিয়ের পিরিতে বসবো। এসব পড়ালেখার থেকে সংসার আর বাচ্চা গাচ্চা সামলানো অনেক সহজ ”
মানে inter 1st year এর মেয়ের H.W খাতা থেকে সংসার আর বিয়ের মতো কথা যদি ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজেও শুনতো তাহলে এতোক্ষণে হয়তো তার চোখ খুলে বেরিয়ে আসার উপক্রম হতো। ক্লাসে সবার সামনে সেদিন অসম্ভব লজ্জায় পড়তে হয়েছিলো। আর মনে মনে ইফতি ভাইয়ার শশুর বাড়ির চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছিলাম। কারণ বাবার বাড়ির চৌদ্দ গুষ্টির মধ্যে আমিও ছিলাম। বাসায় এসে দেখলাম গন্ডার টা পালিয়েছে। আমিও মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম ওই উগান্ডার বাচ্চাকে আচ্ছা মতো শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো। তো যেই ভাবা সেই কাজ। আমার একটা ফেইক আইডি ছিলো যেটার মাধ্যমে ইফতি ভাইয়ার ফেসবুকের সকল আকাম-কুকাম জানতে পারতাম। তাছাড়া ইফতি ভাইয়া নয়তো কখনো আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিতো, নয়তো আমি দিতাম। তারপর ফেক আইডি দিয়ে ইফতি ভাইয়ার সাথে রিলেশন স্ট্যাটাস দিলাম আর ক্যাপশনে লিখলাম,
“আলহামদুলিল্লাহ। ৫ বছরের রিলেশন Done. সবাই দোয়া করবেন যেনো খুব শিগ্রই আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে সংসার করতে পারি “।
এদিকে পোস্ট করার সাথে সাথে সবাই বিভিন্ন রিয়েক্ট আর কমেন্ট করতে শুরু করলো।ইফতি ভাইয়ার বন্ধুরা কমেন্ট করলো,
” কিরে মামা তলে তলে ৫ টা বছর টেম্পু চালাইলি আর আমাদের জানাইলিও না ”
“মামা প্রেম করলি বললি না অন্তত বিয়ের সাক্ষী হিসেবে আমাদের ডাকিস ”
কিছুক্ষণ পর ছোটো চাচ্চু কমেন্ট করলো,
” ভাতিজা ৫ বছর হইলো প্রেম করছ আর আমি জানলামও না। ভালো কথা। কিন্তু মান সম্মান ডুবাইয়া যে পালাইয়া যাবি এটা কিন্তু মানা যাবে না। ”
আর এপাশ দিয়ে আমি হো হো করে হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে ধুম করে পড়ে গেলাম। নিচে বসেও পাগলের মতো হাসছি। এবার আমার কাজ শেষ। তাই আইডি লগ আউট করে শুয়ে শুয়ে আবারও হাসতে লাগলাম আর মনে মনে শয়তানি হাসি দিচ্ছিলাম। এরপর থেকে ইফতি ভাইয়ার সাথে যতবার দেখা হয়েছে ততবার আমরা সবাই মিলে ইফতি ভাইয়াকে পচাতাম। অবশ্য ইফতি ভাইয়া সবাইকেই বুঝিয়েছে যে আসলে এসব সম্ভব না। আবার হুমকিও দিয়েছিলো যে, যে এই পোস্ট করেছে তাকে নাকি দেখে নিবে। কিন্তু আমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই কারণ ইফতি ভাইয়া কখোনোই আমার ফেক আইডি খুঁজে পাবে না।
ইফতি ভাইয়ার একটা বোন আছে যে কিনা আমার থেকে ৫ মাসের ছোটো। ওর নাম ইলমা। প্রায়ই ও আমাকে মজা করে ভাবি বলে ডাকে আবার আমিও মজা করে ননদিনী বলে ডাকি। একদিম মেসেজে বলেছিলাম “কিরে ননদিনী কি খবর ”
কোথা থেকে যেনো ইফতি ভাইয়া এসে রিপলাই করেছে ” হ্যা বউ বলো। আমি তোমার হ্যান্ডসাম জামাই। তোমার ননদিনী ঝাড়ু দিচ্ছে ”
মেসেজটা পড়ার সাথে সাথে আমার পরাণ পাখিটা যায় যায় অবস্থা। জীবনে কোনোদিন কল্পনাও করি নি এমন ঘটনা ঘটবে। সরি ভাইয়া লিখার আগেই ইফতি ভাইয়া রিপলাই দিলো,
“আমি তোর কোন জনমের জামাই লাগি হ্যা? আর তোর সাহস তো কম না আমার বোনকে ননদিনী বলে ডাকিস। স্কুলে গিয়ে এসব শিখিস? আর আমার মতো একটা হ্যান্ডসাম ছেলে তোর মতো গাইয়া আর কুৎসিত মেয়ের জামাই হবে ভাবলিও বা কেমন করে?
ইফতি ভাইয়ার প্রথম মেসেজ দেখে ভয় লাগলেও শেষের মেসেজে কেনো জানি কষ্ট পেলাম খুব। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখলাম আসলেই কি আমাকে দেখতে কুৎসিত লাগে? পরক্ষণেই আয়নার সামনে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বলতে লাগলাম ” আমি কেনো ইফতি ভাইয়ার কথায় কষ্ট পাচ্ছি? আর আমার ঠেকা পড়েছে জলহস্তিটার বউ হব। আমি মোটেও কুৎসিত আর গাইয়া না কারণ আমি প্রিন্সেস।সবাই আমাকে প্রিন্সেস বলেই ডাকে। আর প্রিন্সেসরা দেখতে অনেক সুন্দর হয়। আসলে ওই এনাকন্ডাটাই আমার যোগ্য না “।
একা একাই এসব বলছিলাম হঠাৎই আমার চোখে পড়লো ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা কাজলটার উপরে…….
#কাজললতা
#পর্ব:১
#লেখিকা_ইভা_আক্তার