#কাজললতা
#লেখিকা_ইভা_আক্তার
#পর্ব_১৬
🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁
মাগরিবের আজানের মধুস্বর কানে ভাসতেই নামাজ পড়ে পড়ার টেবিলে পড়তে বসলাম। এক মাস আগেই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরেছি। আর এক মাস পরই ইন্টার প্রথম বর্ষের শেষ পরীক্ষা। সারা বছর টই টই করে ঘুরে এক গাদা পড়া নিয়ে পড়তে বসেছি। এক একটা বইয়ের পাতা দেখেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে। সব দোষ ইফতি ঘোষ। ক্লাস 9 এ কারো পারমিশন ছাড়াই আর্টস নিয়েছিলাম। কেননা ওইসব বিজ্ঞান-টিজ্ঞানের জিনিস আমার মাথায় ঢুকে না। তারপর আছে গণিত যেই সাবজেক্টটা ভাবলেই মাথা গুলিয়ে আসে। একারণে আর্টস সাবজেক্টটাই বেছে নিয়েছিলাম। সকলের ইচ্ছে ছিলো ইলমা আর আমি একসাথে সাইন্স নিয়ে পড়বো বিশেষ করে ইফতি ভাইয়া সেই ক্লাস 8 এই সবাইকে বলে রেখেছিলো। আমি যে আর্টস সাবজেক্টটা বেছে নিয়েছি এটা সকলে জানার পর ভেবেছিলাম কেউ বলুক বা না বলুক ইফতি ভাইয়া নিশ্চিত ঠাস ঠাস করে দুটো চর বসিয়ে দিবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ইফতি ভাইয়া কিছুই বলে নি ইনফেক্ট আর্টস নিয়ে কোনো কথাই বলে নি। যাক ভালোই হলো। বেশ ভালো মতোই আর্টস সাবজেক্টটা নিয়ে এসএসসি পাশ করলাম কিন্তু বিপদ ঘটলো কলেজে ভর্তি হওয়ার পর। কলেজের প্রথম দিন ইলমা গিয়েছিলো সাইন্সের ক্লাসে আর আমি গিয়েছিলাম আর্টসের ক্লাসে। ক্লাসের ভেতর যখন টিচার প্রেজেন্ট ডাকছিলো তখন কোথাও আমার নাম না পেয়ে টিচার অধ্যক্ষের কাছে গিয়ে জানতে পারলো আমার ক্লাস আসলে সাইন্সে। এটা জানার পর যেনো আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আসলেই কি আর্টস থেকে কেউ ইন্টারে সাইন্সে যেতে পারে? পরবর্তীতে জানতে পারলাম আমাদের সবার প্রিয় ইফতি চৌধূরী এই আকামটা করেছে। ইফতি ভাইয়া নাকি প্রিন্সিপালের কাছে অনুরোধ করেছিলো। একারণেই বলি দুটো বছর আমার পড়ালেখা নিয়ো এতো শান্তশিষ্ট কেনো ছিলো। ইফতি ভাইয়া নিজেই আমার জন্য একটা কোচিং আর দুটো টিউটর রেখেছিলো। শেষে যখন দেখতে পেলো আমার অবস্থা একদম নাজেহাল। শুকিটে-টুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছি তখন ইফতি ভাইয়ার ইচ্ছায় বাসার সকল টিউটোর বাদ দিয়ে দিলাম। শুধুমাত্র কোচিংটাই করছিলাম তাও বাদ দিয়ে দিলাম মাঝখানের পরীক্ষায় যখন বেশ ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। সাইন্স নিয়ে যতটা খারাপ রেজাল্ট করবো ভেবেছিলাম আসলে ততটা খারাপ রেজাল্ট আমি করি নি। ইফতি ভাইয়ার কথা ভাবতেই ওর কথা মনে পড়ে গেলো । চট্টগ্রাম থেকে ফেরার পর থেকে আমার একটা খোঁজও ইফতি ভাইয়া নেয় নি। বুঝলাম ইফতি ভাইয়ারও পরীক্ষা শুরু হবে কিন্তু তাই বলে যে ফোন করে একটা খোঁজ নিতে পারবে না এটা কেমন নিয়ম? এতই ব্যস্ত সে? নাকি চট্টগ্রামে বসে আমাকে নিয়ে যা যা বলেছিলো তা সবই মিথ্যে ?নাকি ইফতি ভাইয়ার সেটা ফ্লার্ট ছিলো যা কাউকে নিয়ে করুক বা না করুক আমাকে নিয়ে সবসময় করে। ধুর যা ইচ্ছে তা করুক তাতে আমার কি?পড়ার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছি আর একটু পর পর মাথায় নাড়া দিচ্ছিলো ইফতি ভাইয়ার সেই সুন্দরী রমনীর কথা।সেই সুন্দরী রমনী কি আসলেই ইফতি ভাইয়ার পছন্দের কোনো নারী নাকি ইফতি ভাইয়ার ফ্লার্টের একটা অংশ?
—————————————————————————————
কলেজের ক্যান্টিনে বসে নোট লিখছি আমরা ফ্রেন্ড সার্কেলরা। এক একজনের অবস্থা পুরোই বেহাল। তবুও তারা নোট করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
– ওহ আল্লাহ। এখন তো মনে হচ্ছে তুহিনের মতো নোট না করে সব পড়ে মুখস্থ তটস্থ করা উচিত ছিলো (জিসান)
– তুই করবি মুখস্থ? স্বপ্ন স্বপ্নই দেখতে থাক। তোর দ্বারা কখনোই এটা পসিবল না (ইলমা)
– আরে বেটি তুই চুপ থাক। তোর ভাইকে কখনো দেখেছিস নোট করে করে পড়তে? ফুল বই মুখস্ত করে তারপর এক্সাম হলে পা দেয়। অথচ তুই এই গুণবতী ভাইয়ের বোন হয়েও নোট করে পড়ছিস। লজ্জা লাগছে না কথা বলতে? (জিসান)
জিসানের কথায় ইলমা রাগে ফুঁসতে থাকে।
– আচ্ছা সত্যি কি তুহিন নোট করছে না? শা/লায় এতোগুলো পড়বে কেমনে ভাই?(অনন্ত)
-ইফতি ভাইয়ের ভক্ত বলে কথা। নোট করে পড়ার মতো ছেলে কি আমাদের তুহিন নাকি? (জিসান)
– বাদ দিবি তোরা? তুহিন তুহিনের মতো আর আমরা আমাদের মতো। আর কথায় কথায় ইফতি ভাইয়ার নাম তুলা যেদিন তোদের বন্ধ হবে সেদিন আমার সাথে কথা বলতে আসিস (আমি)
কথাগুলো বলেই নোটসগুলো নিয়ে সেখান থেকে উঠে যেতেই পেছন থেকে কোনো মেয়ের কন্ঠস্বর শুনতে পারলাম। বোধহয় আমাকেই ডাকছিলো।
– এই যে একটু শুনবে?
পেছনে ফিরে মেয়েটাকে দেখেই হতভম্ব হয়ে গেলাম। মেয়েটা সুহাসিনী। চট্টগ্রামে বসে রেস্টুরেন্টে যে আপুটা ইফতি ভাইয়ার সাথে কথা বলতে এসেছিলো। মেয়েটা তো ইফতি ভাইয়ার মেডিকেলের প্রফেসরের মেয়ে। তাহলে এখানে কি করছে?আমার মতো ইলমাও হতভম্ব হয়ে গেছে ময়েেটাকে দেখে।
– আমাকে বলছেন আপু?
– জি তোমাকেই। তুমি ইভা তাই না?
আমার নাম মেয়েটার মুখে শুনে অবাক হয়ে গেলাম। আমার নাম কিভাবে জানতে পারলো মেয়েটা?
-জি। আপনি তো সুহাসিনী খান তাই না? ইফতি ভাইয়ার মেডিকেলের প্রফেসরের মেয়ে।
সুহাসিনী আপু আমার কথায় একটা মুচকি হেসে বললো,
– হ্যা তুমি ঠিক চিনতে পেরেছো। আমার এখানে আসা শুধুমাত্র তোমার জন্যই। তোমার সাথে কিছু একান্তভাবে কথা বলতে চাই যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে।
আমি সুহাসিনী আপুর কথায় সম্মতি জানাতেই সুহাসিনী আপু গিয়ে খানিকটা দূরের একটা টেবিলে গিয়ে বসলো। আমাকে ইশারা করতেই আমিও সুহাসিনী আপুর মুখোমুখি চেয়ারে গিয়ে বসলাম। সুহাসিনী আপু দেখতে মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর। সুহাসিনী আপুর কাছে যেনো আমি কিছুই না।
– কেমন আছো তুমি?
– জি আলহামদুলিল্লাহ আপু।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সুহাসিনী আপু হঠাৎ করে বললো,
– ইফতির সাথে তোমার চাচাতো ভাই বোন ছাড়া আর কিসের সম্পর্ক রয়েছে?
সুহাসিনী আপুর কথায় আমার মাথা হ্যাং হয়ে গেলো।
– মানে?আপনার কি মনে হয় ইফতি ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে? কেনো এটা ভাবছেন আপনি?
-একদমই আমার সাথে নাটক করার চেষ্টাও করবে না। যেদিন তুমি আমার উপর চিৎকার চেচামেচি করেছিলে সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম তুমি ইফতিকে ভালোবাসো।
– আপনি কি এইসব কথা জানার জন্যই আমার কলেজে এসেছেন?
সুহাসিনী আপু কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার কিছুটা সামনে এসে বললো,
– আমার বিএফ নিয়ে টানাটানি শুরু করবে আর আমি চুপ থাকবো? এতটাও সরল মেয়ে আমাকে ভেবো না।
সুহাসিনী আপুর কথায় আমার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। ইফতি ভাইয়া তারমানে রিলেশনে আছে? তাহলে কি সেই সুন্দরী রমনী মেয়েটাই সুহাসিনী আপু? এতোদিন কি তাহলে ইফতি ভাইয়া আমার সাথে সত্যি সত্যি মজা করেছে?
– তুমি হচ্ছো ইফতির থেকে বয়সে অনেক ছোটো। একারণেই ও মাঝে মাঝে তোমার সাথে মজা করে। তাই বলে যে এটাকে সিরিয়াসলি নিবে এমন কিন্তু কোনো কথা নেই।
– আপনি ভুল বুঝছেন আপু। ইফতি ভাইয়ার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি এসব নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না।
– যাক তাহলে তো বেশ ভালোই। সেদিন চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম ইফতির সাথে দেখা করতে। আর হুট করে দেখা হয়েও গিয়েছিলো। কিন্তু ওর সাথে তোমরা থাকায় সেখানে ও আমায় নিজের গার্লফ্রেন্ড বলে স্বীকার করতে পারে নি। তোমাদের সামনে ও আমায় অপরিচিত মেয়ে বলে দাবি করেছে।
-তারমানে আপু আপনাদের রিলেশন অনেক আগে থেকেই?
– হ্যা। মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই। আমি আর ইফতি মেডেকেলের টপ স্টুডেন্ট এবং সকলের ক্রাশ। একারনে আমাদের প্রেম হওয়াটা অবাকের কোনো বিষয় না। তোমার বিশ্বাস না হলে তুমি আমাদের মেডিকেলে গিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারো।
– না আপু থ্যান্কস। তার প্রয়োজন নেই। এবার তাহলে আমি আসি। ভালো থাকবেন।
কথাটা বলে উঠে যাচ্ছিলাম। বুকের ভেতর হালকা চিনচিন ব্যথা হচ্ছে। মানুষ ধোঁকাবাজির এতো চরম পর্যায়ে যেতে পারে তা কল্পনাও করতে পারি নি।
– একটু দাঁড়াও।
– জি আপু?
– তোমার কোনো প্রিয় মানুষ নেই?
না বলতে গিয়েও যেনো থেমে গেলাম। আসলেই কি আমার কোনো প্রিয় মানুষ আছে? আচ্ছা ওই চিঠি দেওয়া প্রেমিক পুরুষটা। সে কি আমার প্রিয় পুরুষ? সে কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসে? ইফতি ভাইয়া আমাকে ধোঁকা দিয়ে নিজে প্রেম করবে আর আমি অসহায় হয়ে থাকবো এটা কি করে সম্ভব? কি মনে করে যেনো পিছনে ঘুরে বলে দিলাম।
-হ্যা আছে। আমার শ্যামপুরুষ আছে। অন্তত সে অন্য পুরুষদের মতো নারীদের ঠকাতে পারে না।
কথাগুলো বলে হনহন করে কলেজ থেকে বের হলাম। পেছনে জিসান আর বাকি সবাই অনেকে বার ডাকলেও তাদের কথায় কান দিলাম না। একটা রিক্সা নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ঠিক তত দ্রুতই বাসায় চলে এলাম।
বাসায় এসে ঠাস করে রুমের দরজা লাগিয়ে ঘরের সব জিনিসপত্র এলোমেলো করতে শুরু করলাম। সম্পূর্ণ মাথা গরম হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে যাকে সামনে পাই তার ঘাড়েই কোপ বসিয়ে দেই। অবশেষে ঘরের সকল জিনিস এদিক ওদিক ফালিয়ে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়লাম তখন ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চোখের কার্নিস বেয়ে পানি পড়ছে। মানুষ কি আসলেই এতোটা প্রতারণা করতে পারে? ইফতি ভাইয়ার থেকে বয়সে কম বলে কি আমার মন নেই? আমি কি এখনো বাচ্চা? আমি এই জীবনে কখনোই আর ইফতি ভাইয়াকে ক্ষমা করতে পারবো না। ঘৃণা করি তোমাকে ইফতি ভাইয়া। প্রচুর ঘৃণা করি।
———————————————————————————–
ফ্রেশ হয়ে শুয়ে ফেসবুক স্ক্রল করছিলাম। মেসেন্জারে গিয়ে দেখলাম যাদের সাথে চেটিং করেছি তাদের একজনের আইডির কনভারসনও নেই। অটোমেটিকলি কনভারসন গুলো ডিলেট হয়ে যাচ্ছে। একটা ছেলের সাথে চেটিং করেছিলাম তার আইডিতে গিয়ে দেখি আইডি ব্লক করা। সাথে সাথে কিভাবে যেনো সেই কনভারসন টাও ডিলেট হয়ে গেলো। একে একে সকল ছেলেদের কনভারসন ডিলেট হয়ে যাচ্ছে। এরকমটা দেখে আমার চোখ কপালে উঠে গেলো।শুধুমাত্র তাই না আইডিতে ১০০০ ফ্রেন্ডদের মধ্যে এখন ১০০ টাও নেই। পরক্ষণেই মনে পড়লো আমার আইডির পাসওয়ার্ড ইফতি ভাইয়ার কাছে রয়েছে। তাহলে কি এইসব কিছু ইফতি ভাইয়া করছে? রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল। নিজের গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্বেও আমার পিছে কেনো পড়ে আছে এই ইফতি ভাইয়া? আর সহ্য করতে না পেরে ডাইরেক্ট ইফতি ভাইয়াকে কল করলাম। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর কল ধরে বললো,
– কি হলো কল করেছিস কেনো তুই? আর তুই মোবাইল নিয়ে বসে আছিস কেনো? এবার যদি পরীক্ষায় এক নম্বরও কম পেয়েছিস তাহলে তোর পড়ালেখা বাদ দিয়ে রিক্সাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবো ইডিয়ট। যা পড়তে বস।
কথাগুলো বলেই ইফতি ভাইয়া কল কেটে দিলো। আমি ছাগলের মতো ফোন কানে ধরে বসে আছি। কিছু না ভেবে রাগের মাথায় আবারও কল করলাম। একবার রিং হতেই ইফতি ভাইয়া কল রিসিভ করলো৷।
– কি সমস্যা তোর আবারো কল কেনো করছিস? তোকে না পড়তে যেতে বলেছি?
রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
– সমস্যা আমার না সমস্যা তোমার। প্রথমত আমার ফেসবুক আইডি হ্যাক করেছো। আর এখন আমার আইডির সবাইকে ব্লক করে আনফ্রেন্ড করেছো কোন সাহসে হ্যা?
– এসব অশ্লীল ছেলেদের নিজের ফেসবুক আইডিতে রেখে তোর বাবার জামাইকে ছেড়ে দেওয়ার প্ল্যান করছিস এটা কি তোর বাবার জামাই সহ্য করবে? এখন চুপচাপ গিয়ে পড়তে বস।
– একদম আজেবাজে কথা বলবে না বলে দিচ্ছি। নিজের গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্বেও নিজেকে অন্যের জামাই বলতে লজ্জা করে না? আমাকে ছোটো পেয়ে আমার সাথে যা খুশি তা করতে পারবে এটা ভাবলে অনেক বড় ভুল করবে। আমার ব্যাপারে কোনো ধরণের নাক গলানোর চেষ্টা করবে না তুমি। একদমই না। কারণ অল্প হলেও তুমি আমার মনে আঘাত দিয়েছো। তুমি আমার এই ছোট্ট মনটাকে ছিন্নবিন্ন করে দিয়েছো। চট্টগ্রাম থেকে এসে এই একটা মাসে একবারো কল করেছিলে আমায়? যখন রাতে রাতে সেদিনের কথা মনে পড়লে চিৎকার করে উঠতাম তখন কি একবারও আমাকে দেখতে এসেছিলে তুমি? না আসো না। কেননা ঢাকায় তো তোমার সেই সুহাসিনী রমনী আছে। এখন আমাকে দিয়ে কি করবে? তোমার আমাকে শুধুমাত্র কাজে লাগে ফ্লার্ট করার জন্য আর মজা করার জন্য। আর কখনোই যেনো তোমাকে আমার সামনে না দেখি। কথাটা মনে রেখো।
কথাগুলো বলেই ফোনটা কেটে বন্ধ করে দিলাম। ওপাশের মানুষটা আমার কথাগুলো শুনে হয়তো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। চোখ থেকে অশ্রু পড়ছে। নিজের অশ্রুগুলো কে হাতের তালু দিয়ে মুছেও আটকাতে পারছি না। কেনো কষ্ট হচ্ছে আমার? ইফতি ভাইয়া তো কখনোই বলে নি সে আমাকে ভালোবাসে? তাহলে কেনো আমি মনে মনে এতোকিছু ভেবে নিয়েছিলাম? ইফতি ভাইয়া আগেও যেমন আমার শত্রু ছিলো এখনো আছে আর আজীবনই থাকবে।
————————————————————————————-
দেখতে দেখতে আরও একটা মাস চলে গেলো। এই একটা মাসে ইফতি ভাইয়ার সাথে কোনো ধরণের যোগাযোগ ছিলো না। রাগের মাথায় সবজায়গা থেকে ইফতি ভাইয়াকে ব্লক করে দিয়েছিলাম। ইলমার কাছে থেকে শুনেছিলাম পুরো পরিক্ষার মাসটায় নাকি ইফতি ভাইয়া রুমের দরজা আটকে পড়াশোনা করেছে। গতকালকেই ইফতি ভাইয়ার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আর এক সপ্তাহ আগে আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার খুশিতে আমরা বন্ধু আর বান্ধবীরা বিভিন্ন ছোটোখাটো জায়গায় টুর দিয়েছিলাম। সময়টা শীতকাল হওয়ায় বেশি জায়গায় ঘুরতে যেতেও পারি নি। ড্রয়ইং রুমের সোফায় বসে টিভি দেখছিলাম তখনই আম্মু ছুটতে ছুটতে আসলো।
– ইভা টিভি বন্ধ করে আমাকে সাহায্য করতে আয়। তোর বড় চাচা আর ছোটো চাচারা আসছে। সাথে তোর সব ফুপুরাও। এখন রান্নাঘরে এসে তাড়াতাড়ি আমার কাজে হাত লাগা।
আম্মুর কথায় টিভি বন্ধ করে বললাম,
– হঠাৎ এতো মানুষ আসছে? বাড়িতে কি কোনো অনুষ্ঠান হবে নাকি?
– অনুষ্ঠান? কিসের অনুষ্ঠান? নওশিন আর ওর জামাই বিদেশে যাওয়ার আগে একবার সবার সাথে দেখা করে যাবে একারণেই আমাদের বাড়িতে আসছে।
নওশিন আপুর কথায় সোফা থেকে লাফিয়ে উঠলাম।
– নওশিন আপু মানে? নওশিন আপু আর দুলাভাইও আসবে?
– হ্যা ওরা সবাই আসবে। এখন আয় তাড়াতাড়ি।
আম্মু রান্নাঘরের দিকে চলে যেতেই হুট করে কিছু একটা মনে পড়তেই বললাম,
– আম্মু ইফতি ভাইয়াও কি আসবে?
– তোর মাথায় কি বুদ্ধি – সুদ্ধি সব গেছে নাকি? সবাই আসলে অবশ্যই ইফতি আসবে তাছাড়া ইফতির তো পরীক্ষাও শেষ। তাহলে ও আসবে না কেনো?
কথাটা বলেই আম্মু হনহন করে রান্নাঘরের চলে গেলো। ইফতি ভাইয়া আসবে শুনেই মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেলো। ঠিক করলাম ইফতি ভাইয়া আসলে ওর সাথে একটা কথাও বলবো না আর প্রয়োজন ব্যতীত রুম থেকে বেড়ও হবো না। ভাবতে ভাবতেই রান্নাঘরে গেলাম আম্মুকে সাহায্য করতে।
রান্নাবান্না এবং ঘরের যাবতীয় সকল কাজ শেষ করে ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসলাম। আজকের মতো কাজ বোধহয় জীবনে কখনো করেছি কিনা সন্দেহ। সোফায় বসতেই কলিং বেলের আওয়াজ কানে আসলো। আম্মু রান্নাঘরে তার আদরের ভাতিজার জন্য নারু বানাচ্ছিলো। মানুষ তার বড় ভাসুরের ছেলেকে এতোটা আল্লাদ কিভাবে দিতে পারে তা আম্মুকে না দেখলে জানতামই না। আম্মু এখন রান্নাঘরে কাজ করায় দরজাটা যে আমাকেই খুলতে হবে তা আমার জানা ছিলো। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে দরজাটা খুলতেই এক পরিচিত মানুষকে দেখতে পেলাম। লোকটা সেই ব্যক্তি ছিলো যার মাধ্যমে সেই অপরিচিত শ্যামপুরুষটি আমাকে চিঠি আর কাজল দিতো। এতো মাস পর এই লোক এখানে কি করছে? আমি তো ভেবে নিয়েছিলাম শ্যামপুরুষটিও হয়তো ইফতি ভাইয়ার মতো ধোকা দিতে পছন্দ করে।
– আসসলামু আলাইকুম মেডাম। কেমন আছেন?
-ওয়ালাইকুম আসসলাম। জি আলহামদুলিল্লাহ।
– এই নিন আপনার চিঠি আর উপহার।
– উপহার? কিসের উপহার?
– সেটা তো বলতে পারছিনা মেডাম। স্যার আমাদের যেগুলো দিতে বলেছে সেগুলোই আমরা আপনাকে দিচ্ছি।
– ওহ আচ্ছা।
– জী তাহলে আসি মেডাম ভালো থাকবেন।
– আপনিও।
লোকটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চুপিচুপি রুমে চলে এসে দরজা আটকে দিয়ে বিছানায় বসলাম। মনের মধ্যে হাজারে প্রশ্ন নিয়ে চিঠিটা খুলতেই ভেতরের লেখা দেখে কিছুটা অবাক হলাম। কেননা চিঠির ভেতরের সম্বোধনটা কাজললতার পরিবর্তে প্রেয়সী দেওয়া। এই প্রথম শ্যামপুরুষটি আমাকে প্রেয়সী বলে সম্বোধন করেছে। ভাবতে ভাবতেই চিঠিটা পড়া শুরু করে দিলাম।
“প্রিয় প্রেয়সী ”
কেমন আছো তুমি? আমাকে কি তোমার এখনো মনে আছে?নাকি দীর্ঘ দুই মাস তোমাকে প্রেম পত্র না দেওয়ার ফলে তুমি আমাকে ভুলে গেছো? তুমি আমায় ভুললেও কিন্তু আমি তোমাকে ভুলি নি। আমার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে তোমার মায়াবী মিষ্টি মুখখানি মিশে রয়েছে। তোমাকে সরাসরি যেদিন দেখে ছিলাম সেদিন থেকেই আমার মনে তোমার জন্য ছোট্ট এক ভালোবাসার ঘর তৈরি হয়েছিলো। যেমনটা তোমায় মনে মনে ভেবেছিলাম তার থেকেও অধিক সুন্দরতম মায়াবী বর্ণের অধিকারী তুমি প্রেয়সী। আমাকে দেখার অধিক আগ্রহ যে তোমার মধ্যে রয়েছে তা আমি বেশ ভালো করেই জানি। তাই তোমার সকল অপেক্ষার প্রহর মিটিয়ে তোমার সাথে দেখা করার জন্যই আজকের এই প্রেমপত্র। প্রেম পত্রের সাথে রয়েছে তোমার মায়াবি চেহারার মিল নিয়ে একটি বেগুনী শাড়ি। বেগুনী বর্ণে ছেয়ে যাক তোমার আমার প্রেম। এই বেগুনী শাড়িতেই তোমার ওই মায়াবী চেহারা দেখতে চাই। এবার তাহলে আমাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ করা যাক। পত্রের সাথে পাঠানো ঠিকানায় তোমার আমার দেখা হয়ে যাক।আজ বিকেলে তোমার জন্য আমি পত্রে লিখা ঠিকানায় অপেক্ষা করবো। আমার বেগুনী প্রেয়সীকে আমি অধিক আগ্রহে দেখার জন্য বসে থাকবো।
“তোমার শহরের আঙ্গিনা জুড়ে
যেদিন ঘাস ফুল ফুটবে,
গাঢ় বেগুনী রংয়ের আকাশের গায়ে
সাদা মেঘ ঘুরে বেড়াবে।
রঙধনুর রঙে মাখা
তোমার মায়াবী মুখখখানা
সেদিন ভেবো আমি পাঠিয়েছি
বেগুনী ফুলের ভালোবাসা 💜”
ইতি
তোমার অচেনা প্রেমিক পুরুষ।”
চলবে,,,,,,,,,💜