#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২৭ |
——————-
স্টেজে এখন নাচ, গান চলছে। ইরা’দ কোনো বরিং স্পিচ নয় বরং তাঁর শিক্ষা জীবনের কিছু ঘটনা শেয়ার করেছিলো। জীবনের সখ, আহ্লাদ, কিছু বিপদ সম্পর্কেও ধারণা দিয়েছে। মূলকথা, তাঁর স্পিচ ছিলো একদম উত্তেজনাময়, যেমনটা প্রতিটি স্টুডেন্ট পছন্দ করে। মাঝে মধ্যে কিছু ঘটনা শুনে হাসতেও বাধ্য হয়েছে ছাত্র-ছাত্রী’রা।
নওরি, সারিফা, তৃণা এবং রাইসা সকলেই ভার্সিটির পেছন দিকে চলে এসেছে। সড়গোল খুব একটা ভালো লাগছে না নওরির। ভার্সিটির এপাশটা কিছুটা নিরব। নিরব শান্তিও অনুভব করলো নওরি। সবুজ ঘাসের উপর চারজন গোল হয়ে বসেছে। এর মাঝে নওরির ফোনে মেসেজ এলো। নওরি ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ইরা’দের মেসেজ। নওরি একপলক এ তিন জনকে পরোখ করে নিলো। তিনজনই কথা বলতে ব্যস্ত। নওরি এবার মেসেজ এ ঢুকলো। ইরা’দ লিখেছে,
–“কোথায় তুমি?”
নওরি আশেপাশে চোখ বুলালো। সরল মনে রিপ্লাই করলো,
–“ভার্সিটির পেছন দিকটায়। কেন?”
আর কোনো রিপ্লাই আসে না৷ তৃণা ডাকলে নওরি আবার ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে। মিনিট দশেক পর একটি ছেলে আসলো। নওরির সিনিয়র সে। ছেলেটি তাদের মাঝে এসে বলে,
–“নওরি আপু কে?”
নওরি চমকে ছেলেটির দিকে তাকালো। সারিফার দিকে চাওয়া – চাওয়ি করে বলে,
–“জি আমি!”
ছেলেটি এবার চোখ নামিয়ে বলে,
–“আপনাকে ইরা’দ ভাইয়া ডেকেছে। আমার সাথে আসুন!”
তৃণা এবং রাইসা যেন আকাশ থেকে পরলো। ফ্যালফ্যাল করে একবার নওরির দিকে তো একবার ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছে। বিস্ময়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে দু’জন। নওরি সারিফার দিকে তাকালো। সারিফা ইশারায় যেতে বললো। নওরি অস্বস্তি, জড়তার সাথে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
–“আচ্ছা চলুন!”
নওরি একপলক সবার দিকে তাকিয়ে ছেলেটির সাথে চলে গেলো। ছেলেটা ভার্সিটির ভেতরে নিয়ে গেলো। এতে নওরির ভয়ে বুক কেঁপে উঠেছে। ছেলেটি কোনো ক্রমে কী মিথ্যা বলেছে? নওরির আসাটা তাহলে ভুল হয়েছে? এখন কী করবে সে? ফিরে যাবে? ফিরে যাওয়া উচিত হবে? এরকম নানান দ্বিধা- দ্বন্দ্বে ভুগে এগোতে লাগলো। ছেলেটি দো’তলার একটি রুমের সামনে নিয়ে গিয়ে বলে,
–“ভাইয়া ভেতরে আছে। আপনি যান, আমি আসছি!”
বলেই ছেলেটি চলে গেলো। নওরি বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ ক্লাসরুমের দরজা খুলে ইরা’দ বের হলো। নওরিকে দেখে চমৎকার হাসি দিলো। দরজার সাথে হেলান দিয়ে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো নওরির পানে। নওরি হতভম্ব দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইরা’দের পানে। সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুললো না। নওরিকে এভাবে নিঃশ্বাস ফেলতে দেখে ইরা’দ বললো,
–“ভয় পেয়েছিলে? সুন্দরীকে নিয়ে আবার কারা নীল নকশা আঁকলো?”
ইরা’দের রসিক কন্ঠস্বর শুনে নওরি বললো,
–“আমি মোটেও সুন্দরী নই!”
–“তাই? সুন্দরী না হলে এভাবে ছেলেদের নজর কেড়ে নিতে পারতে না। একজনের তো পুরো মনটাই কেড়ে নিলে। সাবাশ!”
নওরি পিটপিট করে তাকালো। মন কেড়েছে আবার কার? ইরা’দ হেসে বলে,
–“বুঝতে পারোনি? বোঝার কথাও নয়। আজই প্রায় ছয় জন তোমায় প্রপোজ করতে এগিয়ে গেছিলো কিন্তু আমার লোকেদের জন্যে তোমার কাছেই পৌঁছাতে পারেনি। কী সুন্দর ঘটনা তাই না?”
–“প্রপোজ করলেই বা কী? আমি এক্সেপ্ট করতাম?”
ইরা’দ একমনে নওরির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
–“তা করতে না। কিন্তু তোমার উপর একজনের ভ!য়া!নক নজর পরেছে। তাঁর পক্ষে দেখা সম্ভব না তাঁর প্রিয় ফুলকে কেউ ছুঁতে গিয়েছে।”
–“সেটা কে শুনি?”
–“সেদিন বুঝোনি?”
–“বুঝলে কী জিজ্ঞেস করতাম?”
–“তাহলে তোমার বোঝার বয়স হয়নি। নিতান্তই তুমি পিচ্চি মানুষ!”
–“আপনি কী এসব বলার জন্যে ডেকেছেন?”
–“না তো। তোমায় প্রাণ জুড়ে দেখার জন্যে ডেকেছি। পেইনফুল স্পিচ দিতে গিয়ে তো দেখতে-ই পারলাম না। এখন চোখ জুড়িয়ে নেই!”
নওরি এতক্ষণে ইরা’দের চাহনির গভীরত্ব অনুভব করলো। মুহূর্তে-ই সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেলো। উথাল-পাথাল ঢেঊ খেলে গেলো অন্তঃস্থলে। এ কেমন অনুভূতি? কিছুটা অ!সহ্যকর আবার কিছুটা সুখময়! এই অনুভূতির কী নাম দিবে সে?
–“ছবি তুলবে?”
নওরি আরও চমকে যায় ইরা’দের এরূপ প্রশ্নে। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
–“মানে?”
–“ছবি তুলবো তোমার সাথে। দুজন পাশাপাশি দাঁড়াবো, ছবি উঠবে! ভবিষ্যতে স্মৃতিচারণ করতে অসুবিধা হবে না। আমি চাই না তোমার এই স্নিগ্ধ, হৃদয়কাড়া রূপটি আমার স্মৃতিতে কোনোদিন ঝাপসা হয়ে ঝড়ে যাক! এই স্মৃতিটুকু জীবনের প্রতিটি ধাপে আমি মুখস্থ রাখতে চাই। বুঝলে নৌরি ফুল?”
নওরি অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, “না!”
ইরা’দ শুনলো না নওরির নিষেধাজ্ঞা। জোর করে ছবি তুললো। ছবি তোলা শেষে সেগুলো দেখতে দেখতে বলে,
–“আমি এখন চলে যাবো। অনুষ্ঠানও শেষের পথে। তোমার বোরকা আমি আনিয়েছি, সেটা পরে আমার সাথে বাসার দিকে রওনা হবে।”
নওরি অস্ফুট স্বরে আওড়ায়,
–“বোরকা কেন?”
–“তোমার ঝ!লসা!নো রূপ বাহিরের মানুষের জন্যে নয়। আমি অপেক্ষা করছি, ভেতরে যাও!”
বাঁকা মানুষটার সাথে তর্কে যাওয়া সময় নষ্ট ব্যতীত কিছুই নয়। এজন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে নওরি ক্লাসরুমের ভেতরে চলে গেলো। ইরা’দ সেখানেই অপেক্ষা করলো।
সারিফার মুখে ইরা’দের কথা শুনে তৃণা এবং রাইসা মোটামুটি নয় বরং অনেকটা শকে আছে। ভেতরে ভেতরে এত কারবার ঘটলো আর ওরা সামান্য টের অবধি পেলো না? অনেকক্ষণ নির্বাক থেকে হঠাৎ তৃণা উচ্ছ্বাসের সাথে বলে ওঠে,
–“তাহলে এবার পুলিশের গু!লি খেতে হবে না তাইতো? ডিরেক্ট বাসায় গিয়েই প্রপোজ। আহা!”
এমন সময়ই বোরকা পরিহিত নওরি আসলো ওদের মাঝে। তাঁর আসতে ইচ্ছে করছিলো না কিন্তু সারিফাকে নিয়ে যাবার জন্যে আসাটা প্রয়োজন ছিলো। নওরি তৃণা এবং রাইসার দিকে তাকিয়ে বেশ ভালো করে বুঝে গেলো ওরা সব জেনে গেছে। নওরি তপ্তশ্বাস ফেলে বলে,
–“দুঃখিত। সারিফা, বাসায় যেতে হবে। চলো!”
–“বাসায় যাবার এত তাড়া কেন? এছাড়া বোরকা-ই বা পেলি কোথায়?”
তৃণার প্রশ্নে নওরি কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলে,
–“আসলে, ইরা’দ আমাদের এখুনি যেতে বলেছে। উনি অপেক্ষা করছেন!”
–“ভাইয়া বলেছে? আচ্ছা। কিন্তু বোরকা?”
নওরি লজ্জায়, জড়তায় মাথা নিচু করে ফেললো। আমতা আমতা করে বললো,
–“তোমার ভাইয়া বাসা থেকে আনিয়েছে!”
তৃণা এবং রাইসা যা বুঝার বুঝে নিলো। সারিফাও কিছুটা বুঝতে পারলো। নওরির এরূপ উক্তিতে তৃণার স্বল্প আলোকিত আশার আলো ধপ করে নিভে গেলো।এদিকে নওরি অস্বস্তিতে রীতিমতো থরথর করে কাঁপছে। এমন পরিস্থিতিতেও জীবনে পরতে হবে কে জানতো? নওরি ওদের এড়িয়ে চলে তাড়া দিয়ে বলে,
–“তুমি আসো, আমি এগোচ্ছি!”
নওরি এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরলো। তৃণা ভ্রু কুচকে নওরির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সারিফার উদ্দেশ্যে বলে,
–“ইরা’দ ভাই নিজে আনিয়েছে? অবিশ্বাস্য।”
–“অবিশ্বাসের কিছু নেই আপু। ভাইয়া আপুর ব্যাপারে খুবই পজেসিভ। চলো একসাথেই গেট পর্যন্ত যাই!”
তৃণা ব্যথিত মন নিয়ে বললো,
–“চলো!”
তিন জন হাঁটছে। এমন পর্যায়ে রাইসা তাঁর মুখ তৃণার মুখের সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
–“প্রেম করার আগেই ছ্যাঁকা খেয়েছিস। সমবেদনা বান্ধুবী! এখন সমবেদনার জন্যে ট্রিট দিস!”
তৃণা গরম চোখে রাইসার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“আমি ম!রলেও ট্রিট চাইবি?”
–“কেন চাইবো না? চল্লিশা তো পাচ্ছি-ই!”
–“তাহলে সেই অপেক্ষা না করে এখনই গরম কড়াইয়ে ভেঁজে আমায় খা। অ!সভ্য!”
রাইসা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো তৃণার এরূপ বক্তব্যে। গেট থেকেই চারজন বিদায় নিলো। সারিফা নওরির পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
–“আচ্ছা আপু, তোমার এবং ভাইয়ার মধ্যে কিছু চলছে?”
নওরি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, “না!”
–“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
নওরি উত্তরে আর কিছুই বললো না। সারিফাও প্রশ্ন করলো না। ইরা’দ গাড়ি নিয়ে ভার্সিটি থেকে দূরে দাঁড়িয়েছে। এপাশটা ভীষণ নিরিবিলি। খুব একটা মানুষজন নেই। হঠাৎ নওরির ফোনে কল এলো। নওরি কল রিসিভ করতেই ইরা’দ বললো,
–“আমি নামবো না গাড়ি থেকে। গাড়ির সামনে এসে পেছনের ডোর খুলে সোজা বসে পরবে। ঠিকাছে?”
—————–
এভাবে-ই কেটে যায় পুরো একটি বছর। ইরা’দের প্রতি নওরির ভালো লাগা, অদ্ভুত অনুভূতি ক্রমশ বেড়েছে, একটুও কমেনি। তবে ইরা’দ আজকাল ভীষণ ব্যস্ত। এর কারণ সামনে ইলেকশন। ইলেকশনের জন্যে ইরা’দ সেই সকালে বের হয় এবং রাত করে ফিরে।
নওরি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের পানে চেয়ে আছে। নির্বাক তাঁর ভঙ্গিমা। আজ এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। রাফিয়া কল করেছে। রাফিয়া তাঁর নাম্বার কই পেলো সেই ভেবেই নওরির ঘুম আসছে না। নওরি রাফিয়ার কোনো কথা না শুনেই কল কেটে দিয়েছে। দেড় বছর পর কেন রাফিয়া তাকে কল দিলো? কী তাঁর উদ্দেশ্য? সবটাই নওরিকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
হঠাৎ কী মনে হতেই নওরি বাগানের দিকে তাকালো। বাগানের এক পাশে তাকিয়ে নওরি থমকে গেলো। রাত বাজে প্রায় বারোটা। এই সময়ে ইরা’দ বাগানে বসে কী করছে? বাগানের ঝাপসা আলোয় বুঝলো ইরা’দের কপাল র!ক্তাক্ত। আর হাতে সাদা কিছু পেঁচানোর চেষ্টা করছে। এরকম দৃশ্য দেখে নওরি অনেকটা আঁতকে উঠলো। ভেতরটা দুমড়ে মু!চড়ে গেলো তাঁর। এ কী বিধ্বস্ত অবস্থা ইরা’দের?
ইরা’দ আধো চোখে তাকিয়ে হাতে ব্যান্ডেজ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বাসাতেও যেতে পারছে না সে। কারণ, তাঁর মা মৌসুমি। তাঁর চোখে পরলে এই মাঝ রাতেই মৌসুমি তাঁর ক্লাস নিবে। যা এই মুহূর্তে ইরা’দ চাইছে না। বড্ড ক্লান্ত সে।
আজ আসার সময় ইরা’দ একাই বাইক নিয়ে আসছিলো। হঠাৎ কোথা থেকে দুটো বাইক এসে তাঁর বাইককে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। ইরা’দ বাইক নিয়ে ফুটপাতের ওপর পরে যায়। পায়ে কোমড়ে চরম ব্যথা পেয়েছে। পায়ে দুই জায়গায় ছি!লে গেছে। হাত তো কেটে রীতিমতো র!ক্ত বেরিয়েছে। কপালেও চট। ভাগ্যিস বাইকে ব্যান্ডেজ নিয়ে ঘুরে সে। নয়তো এখন কোনো ফার্মেসী খোলা থাকার আশা নেই। পায়ের শব্দ পেতেই ইরা’দ চোখ তুলে তাকালো।
———————-
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকলাম।