#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
[২য় পরিচ্ছেদ]
৩১.
নওরি বাম গালে যে চ!ড় পরেছে তাঁর টনটনে ব্যথাই জানিয়ে দিচ্ছে৷ বাম গালে এখনো তাঁর হাতটি। নওরির চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত। গালের টনটনে ব্যথার চেয়ে হৃদয়ের ক্ষ!তটি নিবিড়। ক্ষণে ক্ষণে সেখানে যেন ছুঁ!রি দ্বারা আ!ঘাত করা হচ্ছে। চোখ, নাক লাল করে নওরি চেয়ে আছে সম্মুখে দাঁড়ানো আগন্তুকের দিকে। আবেগপ্রবণতা তার সমগ্র গ্রাস করে ফেলেছে। নিজেকে অজস্রবার ভেঙে আবার নিজেকেই জোড়াতালি দিয়ে শক্ত হয়েছে। কিন্তু এত জোড়াতালির কী লাভ হলো? আবারও যে ভেঙে গুড়িয়ে গেলো। কী করে সামলাবে নিজেকে! নওরি চোখ নামিয়ে ফেলে। ফুঁপিয়ে উঠে বলে ওঠে,
–“এখানে কেন এসেছেন আপনি?”
–“এক গালে চ!ড় পরলে শুনেছি জামাই মা!রা যায় অথবা বিয়ে হয় না। এখন তুমি কী চাচ্ছো আরেক গাল লাল হোক?”
নওরি ফোঁপাতে ফোঁপাতে দুই ধাপ পিছে চলে গেলো। এই ভয়!ঙ্কর মানবকে তাঁর চাই না। তাঁর চাই প্রতিবারের সেই মুগ্ধময় মানুষটাকে। যার চরিত্র থাকবে খুব নরম। এই ভদ্র মানুষটা তার গায়ে হাত তুলবে এটা কল্পনারও বাহিরে ছিলো। নওরির ফোঁপানোর শব্দ বাড়িয়ে বলে,
–“আমায় মা!রলেন কেন?”
–“যে যেটার যোগ্য তাকে সেটাই দিতে হয়। বেশি পাকনামি করলে তো কথা-ই নেই!”
নওরি ক্ষণে ক্ষণে নাক টেনে একপলক ইরা’দের দিকে তাকালো। মুহূর্তে-ই নওরির আত্মা কেঁপে ওঠে। ইরা’দের চোখ ফুলে আছে। চোখ জোড়াও অত্যন্ত রক্তিম। অশ্রু টলমল করছে। কী এক বিধ্বস্ত অবস্থা তাঁর! হঠাৎ ইরা’দ দুই ধাপ এগিয়ে নওরির কাঁধে থাকা ব্যাগটা খুলে পাশে রাখলো। ওই ব্যাগে ফ্রিশা রয়েছে। সেটা রেখেই এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে নওরিকে বক্ষে আগলে নিলো। নওরি নির্বাক রইলো। কিন্তু বক্ষের উষ্ণতা পেতেই যেন নওরির আহ্লাদে ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। এবার ফোঁপানো ছেড়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো। ইরা’দ শক্ত করে নওরিকে বক্ষে আগলে আবেশে চোখ বুজে ফেলে। বক্ষঃস্থলের শূণ্যতা পূর্ণতা পেলো। ইরা’দ মিনমিন করে বলে ওঠে,
–“এইতো আমি আমার বক্ষের পূর্ণতাকে পেয়েছি। আমার পূর্ণতার রাণীকে পেয়েছি।”
কিছুক্ষণ দুজন নিরব থাকলো। এদিকটায় নওরির কান্নার শব্দ ব্যতীত আর কোনো শব্দ নেই। মাঝেমধ্যে ট্রেনের সাইরেন এবং মাইকের শব্দ কানে আসছে বটে। ইরা’দ এবার বলতে শুরু করলো,
–“কে বলেছিলো এমন পা!কামো করতে? তুমি জানো আমার কী হাল হয়েছে? তুমি কী ভেবেছিলে আমি প্রিতমের কথা জানতাম না? এত বো!কা কেন তুমি? কাউকে না জানিয়ে বো!কার মতো কাজটা করলে। এখন তোমাকে না পেলে আমার কী অবস্থা হতো জানো?”
–“তাহলে চ!ড় মা!রলেন কেন?”
–“সিল দিয়ে দিলাম, যাতে এই ধরণের বো!কামী আর কখনো না করতে পারো। সাহস কতো বড়ো! আমাকে ছেড়ে চলে এসেছে!”
এই পর্যায়ে এসে নওরি নিরব রইলো। ইরা’দ পুণরায় বলে ওঠে,
–“তোমার কাছে অনুমতি কে চেয়েছে? আমি চেয়েছি? তাহলে কী করে অনুমতি না দেয়ার স্পর্ধা দেখিয়ে এভাবে চলে আসলে?”
এক্ষেত্রে নওরি শুধু নিজেই জানে ইরা’দকে ফিরিয়ে দিয়ে সে কতবার ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে। চোখে কত অশ্রুকণা নিয়ে ওই চিরকুটটা লিখেছে৷ যেন হৃদপিন্ডটা ভেতর থেকে বের করে চিরকুটে ছিঁ!ড়ছে!নওরি কম্পিত স্বরে বললো,
–“আপনি-ই তো অনুমতি চেয়েছেন।”
–“ওটা সব ছেলে-মেয়েই টুকটাক বলে থাকে। তোমার অনুমতি না থাকলেও তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতাম। আমায় তুমি এখন চিনলে? ওয়েট…”
নওরি সরে আসতে চাইলো। ইরা’দ হুট করে নওরির মাথা শক্ত করে বক্ষের সাথে চেপে ধরে বলে,
–“খবরদার! একদম নড়বে না!”
নওরি আর বৃথা চেষ্টা করলো না ছাড়া পাবার। ওভাবে-ই লেপ্টে রইলো। ইরা’দ কিছু একটা ভেবে বলে,
–“অনুমতি দাওনি তাই না? এখন তো তাহলে তুলে নিয়ে বিয়ে করার পালা!”
নওরির চোখ জোড়া কোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম। নওরি এবার নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। কিন্তু প্রতিবারের মতোই সে ব্যর্থ। কী বলছে ইয়া’দ? সে কী মজা করছে? এটা আদৌ কোনো মজা করার সময়? নওরি আশপাশটা দেখার চেষ্টা করলো। অনেক চেনা মুখ, যাদের সবসময় ইরা’দের আশেপাশে দেখা যায়।
——————–
নূরজাহান রান্নাঘরে বুয়ার সাথে কাজ করতে ব্যস্ত। সৈকত সাহেব টিভিতে নিউজ দেখতে ব্যস্ত। নিদ্র এবং সারিফা পাশাপাশি বসে আছে। সারিফা কিছুক্ষণ পরপর ফোন চেক করছে এবং কিছু একটা টাইপ করছে। নিদ্র’র গালে হাত। সকলে ব্যস্ত থাকলেও কারো মুখে হাসি নেই। সকলের মুখশ্রী বিষণ্ণ। কারো মুখে হাসি নেই। নিদ্র’র ভেতরটা আনচান করছে তাঁর প্রিয় ফ্রিশা এবং নৌরি ফুলের জন্যে৷ ঘুম থেকে উঠে ওদের পায়নি। আসল ঘটনাও জানে না। এমতাবস্থায় কেউ কিছু বলছেও না। কী করে পারছে তাঁর মতো ছোট্ট হৃদয়ের সাথে সকলে নি!ষ্ঠুরতা দেখাতে? কেউ ভালো নয়। কেউ না।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। নূরজাহানের গলায় যেন শ্বাস আটকে রইলো। সে তড়িৎ সদর দরজার দিকে ছুটলো। আশার আলো দেখতে পেয়েছে সে৷ সেই আশার আলোকে ছোঁয়ার জন্যে বড্ড ব্যাকুল তিনি। নূরজাহানের সাথে সাথে সারিফা এবং নিদ্রও ছুটে এলো। সৈকত সাহেব কলিংবেলের শব্দ পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে টিভি বন্ধ করে দিলো। নূরজাহান সদর দরজা খুলতেই কাঙ্ক্ষিত মুখখানা দেখতে পেলো সবাই। নওরিকে দেখে নূরজাহানের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।
নওরি মাথা নিচু করে একমনে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত এক অনুতপ্ততা তাঁর মধ্যে বিরাজমান। ভোরে এদের ছেড়েই নওরি চলে গেছিলো। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তাদের কাছেই আবার ফিরে এসেছে। না জানি তাঁরা নওরিকে স্বার্থপর ভেবে বসবে। এই “স্বার্থপর” শব্দটি শোনার মতো সাহস কী আদৌ নওরির মধ্যে আছে?
নূরজাহান প্রাণভরে নওরিকে দেখে নিজ বক্ষে আগলে নিলো। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলতে লাগেন,
–“অবশেষে তুই ফিরলি নওরি! কতো চিন্তায় ছিলাম জানিস? তোর জন্যে আমার হাত-পা জমে ঠান্ডা হয়ে গেছিলো রে মা। এভাবে কেন চলে গেছিলি?”
নওরির নিকট এবারও কোনো উত্তর নেই। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে তাঁর। এই মানুষগুলোকে ফেলেই সে গন্তব্যহীন রাস্তায় পা রেখেছিলো! এতটা নির্বোধ কেন হলো সে? নওরির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো ইরা’দ। ইরা’দকে দেখে এগিয়ে এলো সৈকত সাহেব।
–“কোথায় পেলে ওকে? তাও এত দ্রুত?”
–“আমি খুঁজতে বের হয়েছিলাম তখন-ই আমার বন্ধু নিখিল কল করে। কল করে জানায় নওরি স্টেশনের এক পাশে বসে আছে। নিখিলের গ্রামের বাড়িতে একটা প্রোগ্রাম ছিলো, এজন্যে দশটায় ওর ট্রেন। ভাগ্যিস নিখিল ছিলো, নয়তো এই মেয়েটাকে কখনোই খুঁজে পেতাম না।”
ইরা’দের কাতর কন্ঠস্বর। সৈকত সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–“যাক, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন!”
–“ভালোর জন্যে করে বুঝলাম কিন্তু এই ম্যাডামকে খুঁজতে গিয়ে আমার সকলের নাস্তা হয়নি। চাচী, কিছু নাস্তা কী হবে এই অধমের জন্যে?”
নূরজাহান চোখে জল নিয়ে হেসে দিলেন। নওরি নূরজাহানকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে লজ্জায় লাল হয়ে রইলো। কেন যেন ইরা’দের সামনে বড্ড জড়তা কাজ করছে। তাঁর উপর নওরি এবং ইরা’দ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। ইতঃস্ততায় নওরি নিঃশ্বাস আটকে নির্বাক রইলো। সৈকত সাহেব দু’জনের উদ্দেশ্যে-ই বলে,
–“দু’জন বাহিরে কেন? ভেতরে আসো!”
নওরি এবং ইরা’দ এক সাথে ভেতরে প্রবেশ করলো। নওরিকে দেখতে পেয়েই নিদ্র ছুটে চলে আসলো নওরির দিকে। নওরির কাঁধের ব্যাগ নিজ উদ্যোগে খুলেই চেইনটা খুলে দিলো। ফ্রিশা বদ্ধ থেকে স্বাধীন হতেই নিদ্র’র কোলে লাফ দিলো! ফ্রিশাকে নিজের সাথে আগলে নিদ্র নানান রকম বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলো।
নূরজাহান খাবার সার্ভ করার আগেই নওরি নিজের ঘরে চলে এলো। বুক ভরে নিঃশ্বাস ফেলে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রথমেই মুখ থেকে মাস্কটি খুলতেই পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
–“নথ পরলে আরেকটু বউ, বউ লাগবে তোমায় নৌরি ফুল।”
পরমুহূর্তে আবারও বলে ওঠে,
–“আচ্ছা দাঁড়াও, নাস্তা শেষ করে-ই আমি নথ কিনতে বেরিয়ে পরবো। ইচ্ছে এবং সৌন্দর্যের অপূর্ণতা রাখতে নেই। আমার বেলায় তো মোটেও না। তোমার ভাষায় ত্যাড়া স্বভাবের ছেলে বলে কথা!”
®লাবিবা ওয়াহিদ
—————————-
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
আগের পর্বের মতোই রেসপন্স আশা করছি। সকলের গঠনমূলক মন্তব্য চাই কিন্তু। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
আগামী পর্ব হয়তো-বা কাল আসবে, ইন-শা-আল্লাহ্।