ভালোবাসার_ফোড়ন #মিমি_মুসকান ( লেখনিতে ) #পর্ব_৮

0
128

#ভালোবাসার_ফোড়ন
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৮

মা’র ঘরের দরজায় খোলাই ছিলো। তবুও আমি নক করলাম। মা সোফায় বসে ছিলেন, আমাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন..
– এসো তোমার অপেক্ষায় করছিলাম।

– সরি মা! আসলে উনি আমাকে এতক্ষন বলে নি যে আপনি আমাকে ডেকেছেন।

– আচ্ছা ঠিক আছে বসো।
বলেই মা আলমারি থেকে কিছু গয়না’র বাক্স বের করে আমার সামনে রাখলেন। মা গয়নার বাক্স খুলতে খুলতে বললেন..

– তোমার ‌দাদি শাশুড়ি’র গয়না এইসব। তিনি মারা যাবার আগে আমাকে বলেছিলেন তার নাত বউ আর আয়ানা কে দিতে এইসব। তিনি নিজেই আলাদা করে রেখে ছিলেন।

বলেই একটা ভারী হার আমার গলায় রাখলেন। হার’টা দেখতে খুব সুন্দর ছিলো আর ভারীও। মা আবারও বলতে শুরু করেন…
– এই হার আমার শাশুড়ি কে তার শাশুড়ি দিয়েছিলেন, আর আমার‌ শাশুড়ি দিয়েছিলেন আমাকে, আর আমি তোমাকে!

বলেই কতো গুলো চুড়ি বের করে আমার হাতে পরাতে লাগলেন। চুড়ি গুলোও বেশ ছিলো। হারের মতোই কারুকাজ। তার মানে হার’র মতো এটাও অনেক পুরোনো।

আহিয়ান দরজার সামনে এসে বলতে লাগলো..
– এগুলো তো দাদী’র ছিলো নাহ! ( সোফায় বসে পরেন )

মা বলেন..
– হুম। তা নিহা মা পছন্দ হয়েছে তো।

– জ্বি মা খুব সুন্দর এগুলো।

– আচ্ছা আরেকটু পর আমার বান্ধবীরা আসবে, এগুলো পরেই তাদের তাদের সামনে যাবে। আর,হ্যাঁ শুধু তাদের সামনে না সবসময় পরে থাকবে এগুলো।

মা’র কথা শুনে আমি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। চেনা নেই জানা নেই এক দিনের মেয়ে কে এতো কিছু দিয়ে দিলেন তিনি। কিন্তু আমি এইসব পড়বো না। তাই বলেই উঠি…
– মা আজ ঠিক আছে কিন্তু আমি এইসব সবসময় পড়বো না।‌

মা অবাক হয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করে…
– কেন মা পছন্দ হয়নি?

– না মা এগুলো বেশ সুন্দর কিন্তু আমার এতো কিছু পড়ে থাকতে ভালো লাগে না।‌ আন্টিরা চলে গেলে আমি এইসব আপনাকে আবার দিয়ে যাবো।

মা মুচকি হেসে আমার কানে দুল পরাতে পরাতে বলেন..
– সেটা তোমার ইচ্ছা কারন এগুলো এখন তোমার। আমার কাছে না রেখে নিজের কাছেও রাখতে পারো।

– না মা আমি আপনাকেই দিয়ে যাবো।

– আচ্ছা শোন কিছুক্ষণ’র মধ্যে’ই‌ তারা এসে পরবে। তোমাকে কিছু শিখিয়ে দেবো না কারন তোমার নিজের বুদ্ধিমত্তা আছে।‌আর আমি জানি তুমি আমার মান সম্মান‌ রাখবে।

মা’র কথাও মুচকি হাসলাম। আসলেই অনেক বিশ্বাস করে উনি আমায়।‌ সামনে তাকিয়ে দেখি উনি সোফায় বসে আমাকে দেখছে। আমি সাথে সাথে মাথা নিচু করে নিই। মা উনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন..
– নিহা কে আমাদের বাড়ি’টা ঘুরিয়ে দেখাও। ও এখনো কিছু দেখেনি, জানে না কিছু।

উনি দাঁড়িয়ে টি – টেবিল’র ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল নিয়ে খেতে খেতে বলে…
– চলো!
বলেই হাঁটতে লাগলেন। মা ইশারায় আমাকে উনার পিছু পিছু যেতে বললেন। আমি তাই করলাম।

উনি হাঁটছে আর আমি উনার পিছু পিছু হাঁটছি, উনি এটা ওটা বলছে উনার বাড়ি’র সম্পর্কে। যতো টুকু শুনলাম, এই বাড়ি’টা উনার দাদা’র বাবা মানে ‌উনার‌ বড় বাবা তৈরি করেছিলেন। এইজন্য’ই এখানের কিছু কিছু জিনিসপত্র পুরোনো। উনি আমাকে পুরো বাড়ি চিনিয়ে দিলেন। কোথাও কি আছে সব বললেন।‌ হাঁটতে হাঁটতে এবার আমরা বাড়ি’র বাইরে চলে আসলাম। বাড়ি’র বাইরে অনেক গার্ড। বাইরের বাইরে পেছনের দিকে জায়গা জুড়ে একটা বাগান। আমি বাগান দেখে খুব অবাক হলাম কারন এখানে বেশিরভাগ ফুল’ই বিদেশি ফুল। আমি উনার বেলকনিতে দেশি ফুল দেখলাম কিন্তু বাগানে সব ফুল বিদেশি । যেগুলো আমি চিনি না কিন্তু একটা ফুল আমার চোখ কেড়ে নিলো। ফুল গুলো দেখতে চমৎকার। ফ্যাকাশে গোলাপী , আধা-ডবল দেখতে ফুল গুলো।‌ আমি হাঁটতে হাঁটতে সেই ফুলের কাছে গেলাম। নিচে পড়ে থাকা ফুল গুলো তুলে নিলাম।

উনি আমার কাছে এসে বললেন..
– এই ফুল গুলো’র নাম Autumnalis Rosea এর অর্থ শরৎকালীন গোলাপ। এগুলো শরৎকালে ফুটে, এখন তো শরৎকালের শেষ হতে চলেছে। জানো এই ফুল গুলো কিছুদিনের মধ্যে’ই ছোট ফলের মতো হয়ে যাবে। আর সেই ফল গুলো পাখিরা খাবে।

আমি অবাক হয়ে উনার কথা শুনতে লাগলাম। আমি তাকে প্রশ্ন করি…
– এখানে সব ফুল বিদেশি কেন?

কিঞ্চিত হেসে বলল…
– আমার বাবা’র পছন্দ তাই!

– আর আপনার বেলকনিতে দেশি ফুল!

– ওগুলো আমার পছন্দ। কিন্তু তোমার হাতের এই ফুল টা আমার অনেক ভালো লাগে।‌

– এতো সুন্দর ফুল দেখে কার না পছন্দ হবে।

– ঠিক বলছো। আমার বাবা পড়াশোনা জন্য বিদেশে ছিলেন অনেক বছর। তাই ওখানকার এইসব ফুল তার খুব পছন্দের। বাবা অবসর হলে মাঝে মাঝে এদের যত্ন নেয়।
.
আমি উনার কথায় মুচকি হাসলাম। সামনে আগাতেই দেখি আরেকটা দোলনা। কিন্তু এটা উনার ঘরের থেকে বড়। আমি সেই দোলনায় বসে পরলাম। উনি আমার সামনে একটা গাছেল সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু আজ একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম। উনার হাতে ফোন নেই। ব্যাপার’টা কেমন লাগলো আমার কাছে কারন কখনো আমি এভাবে ফোন ছাড়া তাকে দেখেনি।

আমি কৌতুহল নিয়ে উনাকে প্রশ্ন করি…
– আচ্ছা আপনার ফোন কোথায়?

উনি আমার কথায় হয়তো অবাক হয়ে গেলেন। কপাল কুঁচকে বলল..
– কেন?

– আসলে এই প্রথম আপনাকে ফোন ছাড়া দেখলাম তাই!

– ওহ্ আচ্ছা। আসলে ফোন নিয়ে বসে থাকি বলে আম্মু এই পর্যন্ত আমার অনেক ফোন ভেঙেছে তাই এই ভয়ে বাসায় ফোন কম ধরি।

– ওহ্ তাহলে আহিয়ান চৌধুরী ও ভয় পায়।

– মা বাবা কে সবাই ভয় পাই। আর ভয়টা আম্মু কে না। ভয়টা ফোনের, কারন আম্মু যেই ফোন ভাঙে তার কোনো অস্তিত্ব থাকে না। আর এতে আমার ফোনে থাকা সব ইনফরমেশন বাঁশ।

উনার কথায় আমি জোরে হেসে দিলাম। পরে উনার চোখ রাঙানি তে হাসি বন্ধ হয়ে গেল। এই ছেলেটার জন্য একটু মন খুলে হাসতেও পারি না।

এখনকার প্রকৃতি টা অনেক নীরব। ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। মন ভালো করার মতো একটা সময়। হুট করেই একটা কথা মাথায় আসলো। কিন্তু এই কথাটা যদি আমি উনাকে জিজ্ঞেস করি তাহলে এখন’র এই ঠান্ডা পরিবেশ কতোক্ষণ থাকবে বলতে পারছি না। কিন্তু কথা টা জিঙ্গেস না করেও পারছি না। নাহ যা হবে দেখা যাবে কিন্তু প্রশ্ন টা আমি করব বলে মনস্থির করে ফেলি।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠি…

– একটা কথা বলবো?

– কিহ?

উনার দিকে তাকিয়ে…
– আমাকে বিয়ে করলেন কেন?

উনি আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকালেন। তারপর নিচে তাকিয়ে আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল…
– তোমার কি মনে হয়?

– কি মনে হবে আমি জানি আমাকে ভালোবেসে বিয়েটা করেনি।

– হ্যাঁ ঠিক বলেছো আমি তোমাকে ভালোবেসে বিয়েটা করি নি। কিন্তু একটা কারন তো আছে! নাহলে তো আর এতো বড় সিদ্ধান্ত নেই নি।

উনার এই কথা’টার আশা আমি করছিলাম। কিন্তু তাও কেন জানি মনের কোথাও উনার কথায় একটু খারাপ লাগলো। এই খারাপ লাগার কারনটা আমার কাছে অজানা। আমি চুপ হয়ে গেলাম। দু’জনের মধ্যে আবার একটা নিস্তব্ধতা কাজ করলো। হুট করেই মনে পরলো উনি বললেন একটা কারন আছে।‌আমি এবার আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম…

– কি কারন?

উনি আমার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিত হেসে বলল…
– সব কারন জানতে হয় না নিহা!

– কেন? কি এমন কারন যার জন্য আপনি এতো বড় সিদ্ধান্ত নিলেন? আমার থেকে শোধ নিবেন বলে, আপনাকে চড় মেরেছিলাম বলে। কি মানুষ বলুন তো আপনি। ওই একটা চড়ের জন্য আমাকে এভাবে বিয়েটা করলেন।

উনি আমার কথায় মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হলো আমার কথায় উনি খুব মজা পেয়েছেন। উনি আর উওর দিলেন না। বুঝে গেলাম আমার ভাবনা’টাই সত্যি। বিরক্ত বোধ করলাম। দোলনা থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে এলাম। উনি আমার পিছু পিছু আসলেন না। যাই হোক আসবে কেন? উনি তো বলেই দিলেন আমাকে ভালোবেসে বিয়েটা করে নি। এজন্য আমার প্রতি উনার কোনো চিন্তা না থাকা স্বাভাবিক। উফ বুঝতে পারছি না আমার এতো রাগ লাগছে কেন? আমি তো আর উনাকে ভালোবাসি না। আর বাসবোও না কারন উনার মতো একটা লোক কে আর যাই হোক ভালোবাসা যায় না। একটা চড়ের শোধ নেবার জন্য কতোবড় কাজ করল আমার সাথে। উনার পরিবার টা যত ভালো উনি ঠিক ততোটাই খারাপ।

রেগে খাটের উপর আসন পেতে বসে আছি। ভালো লাগছে না কিছু। খানিক বাদে উনি আসলেন। উনি আমার দিকে তাকালেন। আমি মুখ ভেংচি দিয়ে অন্য পাশে তাকালাম। উনি বলে উঠল..

– নিচে মেহমান’দের সামনে গিয়ে এমন ভাবে মুখ করে বসে থেকো না। তারা তোমাকে এভাবে দেখে পালিয়ে যাবে।

– মানে নিচে মেহমান চলে এসেছে।

– হুম। মা তোমাকে যেতে বলেছে!

উনার কথায় সাথে সাথে খাট থেকে নেমে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগলাম। হ্যাঁ সব ঠিকঠাক আছে। পাশে লক্ষ্য করলাম উনি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি উনার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালাম যার অর্থ কি? উনি বলে উঠলেন…

– তোমরা মেয়েরা এমন কেন? তোমাদের নিজেদের ওপর কনফিডেন্স এতো কম!

উনার কথা পুরো মাথা’র ওপর দিয়ে গেলো..
– মানে?

– এই যে মেহমান এর কথা শুনে নাচতে নাচতে গিয়ে আয়নায় সামনে দাঁড়ালে কেন তুমি জানো না তুমি দেখতে কেমন?

আমি আহাম্মক’র মতো উনার দিকে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা এটা কোনো প্রশ্নের মধ্যে পরে বলে আমার মনে হচ্ছে না। বুঝলাম উনার মাথা পুরোটাই গেছে। তাই আর কিছু বললাম না।

ঘর থেকে বের হতে যাবো তার কিন্তু খেয়াল হলো উনি ঘরে বসে আছেন। মানে কি আমার সাথে কি যাবেন না উনি।
উনার কাছে গিয়ে বললাম..
– আপনি যাবেন না?

– না তুমি যাও!

– কেন?

– তারা আমাকে অতিরিক্ত আদর করে যা আমার ভালো লাগে না তাই।

উনার কথায় প্রচুর রাগ হলো। কারন এটা আমার কাছে পুরোই অযুক্তিকর একটা কথা। আমি জানি উনি ইচ্ছে করে আমার সাথে এটা করছে। একা একা নিচে গেলে আমি অপমানিত হবো এর এতে উনি মজা পাবে। আমি রেগে বললাম..
– রাখুন আপনার বাহানা! চলুন তো আমার সাথে। আমি একা একা কিভাবে যাবো।

– নিহা আমি যাবো না বললাম তো। তুমি যাও!

– আমি আপনাকে ছাড়া যাবো না ব্যস। ( বলেই খাটে বসে পরলাম)

– নিহা জেদ করো না।

– বললাম তো আমি যাবো না।

– নিহা! ( শান্ত গলায় )

মুখ ভেংচি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। এর মাঝে একটা সার্ভেন্ট এসে বলে গেলো আমাকে আর আহিয়ান কে নিচে যেতে।‌আহিয়ান তার কথা শুনে অসহায় ভাবে আমার দিকে তাকালো। আমি জোরে হেসে দিলাম। উনি বেজায় রেগে গেলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন…

– চলো এখন।

আমি দাঁত বের করে হেসে উনার পিছু পিছু যেতে লাগলাম। যাবার আগে একটা ঘোমটা টানলাম।

সিঁড়ি দিয়ে আমি আর আহিয়ান নামছি। সামনে তাকিয়ে দেখি কিছু ভদ্রমহিলা সোফায় বসে আছেন। মা’ও বসে আছেন তার সাথে। সবাই কথা বলছেন। আমাদের নামতে দেখে তারা এখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আর আহিয়ান নিচে নেমে তাদের সালাম দেই। উনারা হাসি মুখে উওর দিয়ে আমার থিতুনিতে হাত রেখে আমাকে দেখলেন। প্রশংসাও করলেন। আমার পাশেই আহিয়ান দাঁড়ানো। তারা আমাকে দেখে সবাই আহিয়ান গাল ধরে টানলেন। কেউ কেউ কানও মুলে দিলো। আমার এসব দেখে খুব হাসি পাচ্ছিল। কারন তাঁরা আহিয়ান কে একটা বাচ্চার মতো ট্রিট করছে। আহিয়ান কে দেখে বোঝা যাচ্ছে উনার ভীষন রাগ হচ্ছে। কিন্তু সব হজম করে নিচ্ছেন তিনি‌।
মা আমাকে ধরে সোফায় বসিয়ে দেন, আহিয়ান কে আমার পাশে বসান। আমি ফিসফিসিয়ে উনাকে বললাম..

– ঠিক’ই তো বলেছিলেন, তারা তো আপনাকে অতিরিক্ত আদর করে, লাইক আ কিউট বাচ্চা। বলেই হেসে দিলাম।
উনি রেগে আমার দিকে তাকান। হুহ তাতে আমার কি। আমি উনার থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। তারা আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন আমি উওর দিলাম। পরে তারা আমাকে অনেক উপহার দিলেন।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here