#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৪)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী
৪. (Edited)
(বড় পর্ব, অনেক কিছুই উল্লেখ করা হয়েছে বুঝে পড়বেন, এই পর্ব কাহিনীর সবচেয়ে বড় টুইস্টকে সামনে আনবে, গল্পের থ্রিল আর রহস্য সামনে আরো আসবে।)
আকষ্মিক মুখে কারো উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে সে হকচকিয়ে উঠে গেল। ভেবেছিল জুনায়েদকে দেখতে পাবে, কিন্তু কৌশিককে দেখা মাত্রই আবার চোখ পিটপিট করে তাকায়। মনে হচ্ছে কেউ যেন তার আশায় এক বালতি এ সি ড ঢেলে দিয়েছে।
“আমার ঘুম উড়িয়ে দেখি তুমি বাচ্চাদের মতো ঘুমাচ্ছো?”
কৌশিকের পুরুষালী কণ্ঠে সে পুরোপুরি নিশ্চিত হলো যে, কৌশিকই তাকে মন্ত্রমুগ্ধ নয়নে চেয়ে, তার মুখে আদুরে ভঙ্গিতে হাত বোলাচ্ছে। কাশফি রেগে অবিলম্বে এক ঝাড়া দিয়ে কৌশিকের শক্ত শিরান্বিত হাত তার গাল থেকে সরিয়ে নেয়। অতিশয় ঘৃণায় সে চোখ মুখ শক্ত করে বলে,
“ আমি কোথাও যাবো না! ”
কৌশিক কাশফির উগ্র আচরণে কোন রকম প্রতিক্রিয়া না করে কাশফির দিকে ঠিক আগের দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে সবার উদ্দেশ্যে তুড়ি বাজিয়ে বলে,
“আমার ওয়াইফের সাথে আমার কিছু ব্যাক্তিগত কথা আছে। এই কক্ষ আমি দশ সেকেন্ডে খালি চাই।”
খোলসে থাকা মানুষ গুলো চেনা বড্ড কঠিন; তাদের মুখে হাঁসি অন্তরে বিষ। কৌশিক মির্জা নব নির্বাচিত মেয়র কায়সার মির্জার ছোট ভাই, প্রভাবশালী, বিত্তশালী, এলিট সোসাইটির একজন পার্লামেন্ট সদস্য। নির্দয়, নি র্ম ম, জ’গ’ন্য আর বিকৃত মস্তিষ্কের একজন মানুষ। তবে কাশফির কাছে সে স্বামী হিসাবে একজন টপ নচ অভিনেতা। এই ভদ্র, যত্নশীল, অনুরাগী স্বামীর ভান ধরা মানুষের মন ভোলানোর মুখোশ মাত্র।
কাশফির ঠোঁট ফাঁক করে জোরে জোরে শ্বাস ফেলে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কর্কশ স্বরে বলে উঠে — “আমি কোন কথা বলতে চাই না।”
কেউ তার কথা যেন কানেই নিল না। ছলছল চোঁখে শাড়ীর আঁচলটা শক্ত করে খামচে ধরে ওসির দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকায়। তাকে এখন কৌশিক মির্জার সাথে ছাড়া মানে তার ফিরে যাওয়া নিশ্চিত।
ম্যানিপুলেটিভ কৌশিক মির্জা কোন ক্রমেই হার মানে না। ওসি তার দিকে তাঁকিয়ে হালকা হেসে চোঁখ দিয়ে আশ্বস্থ করে সবার পর তিনি বেরিয়ে পড়লেন।
কক্ষের পিনপতন নীরবতার ফাঁকে কাশফির ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ শোনাচ্ছে কেবল। তার হাত পা ঘেমে নেয়ে একাকার। মনে হচ্ছে এখনই কৌশিক খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে তার প্রা ন কে ড়ে নেবে।
কয়েক মিনিট অতিবাহিত হলো ইতিমধ্যে। চারিদিকে ঘন কালো আঁধার নেমে পড়ায় কিছুক্ষণ পর পর দূরদূরান্তের ঝি ঝি পোকার মিলিয়ে পড়া আবছা ডাকও ভেসে আসছে।
বিশ মিনিটের মাথায় কাশফি দাঁতে দাঁত পিষে চোখ শক্ত করে বন্ধ করে ফেললো। কক্ষে বিরাজমান নিঃশব্দতা যেন তার গলা চে পে ধরছে।
“নয় ঘণ্টা হলো তুমি আমার থেকে পালানোর চেষ্টা করেছ…”
কৌশিকের হাস্কী কন্ঠ থেমে গেল। সে কাশফির দিকে এক পলক চেয়ে মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলল,
“কিন্তু তুমি ব্যার্থ। ইউ ফেইলড ইউর্সেলফ, ওয়াইফি।”
সমবেদনার ঠাট্টা করায়, কাশফির যেন পিত্তি জ্বলে উঠলো। কিন্তু প্রতিত্তরে কিছুই বলল না। সে জানে কৌশিক তাকে অতিষ্ঠ করতে পছন্দ করে। তাই সে আজ কোন ক্রমেই নিজের ভাব ভঙ্গি দেখাবে না।
চোখ মুখ মুছে কাশফি অনড় হয়ে রইল,
“আপনার সাথে আমি কোত্থাও যাবনা।”
তার ভাবমূর্তিহীন হয়ে থাকার ব্যার্থ প্রচেষ্টা দেখে কৌশিক আনমনে হেসে ফেলে। পরপর শোনালো কৌশিকের জবাব — “আমি জানি।”
কাশফির চোঁখে মুখে বিস্ময় দেখে, কৌশিক হাত বাড়িয়ে কাশফির মুখের সামনে পড়ে থাকা অবাধ্য চুল আঙ্গুলের ভাঁজে আলগোছে সরিয়ে দেয়।
“বাসর রাতে স্বামীকে রেখে পালিয়ে যাওয়া ঘোর পাপ।”
কাশফির ঘেন্নায় নাক মুখ কুঁচকে ফেলতে দেখে কৌশিক স্মিথ হাসে। পরক্ষণে কাশফি আবার নিজেকে আবেগশুন্য করে ফেলে। কৌশিক মনে মনে আওড়ালো — “ওয়েল প্লেইড কাশফি, বেশ ভালোই খেলছো।”
“তুমি মনে করছ নিজের আবেগ অনুভূতি লুকাতে পারলে আমি তোমাকে ছেড়ে দিব? কাম’অন!”
তবুও কাশফির কোন হেরফের না দেখে কৌশিক পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ফোন বের করে তার সামনে ধরে। কাশফি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কৌশিকের ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই আঁতকে উঠে। বিস্ময়ে ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে যায়। একবার ফোনের স্ক্রিনে আরেকবার কৌশিকের কুটিল হাসির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। ফোনের ডিসপ্লেতে অজ্ঞাত অবস্থায় তার ছোট ভাইয়ের হাত দুটো জড়ো হয়ে বাঁধা ছবি। কাশফির বুক মুচড়ে উঠে। ততক্ষনে তার অজান্তেই চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পরছে, তবুও মুখ দিয়ে টু শব্দও বের করছে না। সে কৌশিকের মতলব জানে। উগ্র মস্তিষ্কের কৌশিক মির্জা তার দুর্বলতা দেখতে চায়, তার ভয়, আর কান্নার কারণ হতে চায়। এক কথায় তাকে নিজের বাধ্যগত পুতুল বানাতে চায়।
সে তো বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে আইনের সাহায্য নিতে অথচ এখানে এসেও রক্ষা পেল না বরঞ্চ মনে হচ্ছে আরো বাজে ভাবে ফেঁসেছে।
“এত কাঁদলে মানুষ ভাববে আমি তোমায় মে রে ছি।”
কৌশিক গম্ভির গলায় বলে পকেট হতে টিস্যু বের করে নিয়ে তার গাল মুছে দেয়। সে কৌশিকের ছোঁয়া হতে দ্রুত মুখ সরিয়ে নিয়ে চোয়াল শক্ত করে তেজ দেখিয়ে চেঁচালো–
“আমার ছোট্ট ভাইকে এই জ ঘ ন্য খেলায় না আনলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত?”
কথার দলা পাকিয়ে আসছে গলায়। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে চাইছে, যে তাদের পরিস্থিতি এমন না হলেও পারতো।
কৌশিক চোঁখ জোড়া কিঞ্চিৎ ছোট করে নিম্ন স্বরে তবে কর্কশ পুরুষালী কণ্ঠে বলে,
“তুমি বাধ্য করেছো।”
কাশফি মাথা নেড়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। ক্ষিপ্র মেজাজে বলে,
“আমার জীবন নষ্ট করে এক্সপেক্ট করেছেন আমি বুকে হাত গুঁজে তামাশা দেখবো?”
“আমার কোলে বসে দেখতে পারো। এই স্পেস কেবল তোমার জন্য বরাদ্দ।”
কাশফির সুপ্ত রাগ উপলব্ধি করে কৌশিক বাকা হাসে। বেশ ভালোভাবে ম্যাডামের মাথায় চড়ে বসতে পেরেছে । কাশফি দাঁতে দাঁত চেপে ঠোঁট জোড়া একত্রে করে সরু লাইনের মতো করে। কৌশিকের বে’হা’য়া’পনা অগ্রাহ্য করে বলে,
“আপনি কেনো হাত ধুয়ে আমার পিছনে পরে আছেন?”
প্রতিত্তরে কৌশিক এক নাগাড়ে চেয়ে থাকে। তীর্যক দৃষ্টিতে বেষ্টিত করে। পরক্ষণে কিছু ভেবে বুকে হাত ভাজ করে ঠোঁটের সূক্ষ্ম কোণা উপরে তুলে হেঁসে বলল —
“কাশফি, তুমি কি আমার মুখ থেকে নিজের প্রশংসা শুনতে চাইছো?”
কাশফি তেতে উঠে কৌশিকের দামী ফোন কেড়ে নিয়ে ফ্লোরে আছড়ে ভেঙে ফেলে। ভাঙ্গা গলায় জোর দিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
“আমাকে কথার মাঝে ফাঁ সি য়ে ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা ভুলেও করবেন না!”
কান্নায় ফোলা মুখমণ্ডল, ক্রোধে লাল হয়ে থাকা চোখ-মুখের দিকে মনোযোগ দেয় কৌশিক। মেয়েটা কে রাগাতে তার ভীষণ ভালো লাগে। চোঁখ চিকচিক করছে তবুও জেদ চেপে আছে। কৌশিক মির্জার সামনে সে কোন ক্রমেই কাঁদবে না।
কৌশিক তার এক হাত বুকে রাখে আরেক হাত হাতের ওপর রেখে নাটকীয় ভাবে বলে—
“ইউ অলমোস্ট গট মি, ওয়াইফি। আম ট্রুলি ইমপ্রেসড!”
কাশফি চোখ শক্ত করে বুজে, দাঁত কড়মড় করে। সে জানতো কৌশিক উত্তর দিবেনা বরং ভুলিয়ে ভালিয়ে যা তা বলা শুরু করবে।
“আমাকে সবাই ঈশিতা ডাকে, আপনিও ঈশিতাই ডাকবেন। আর কোন বড়সর মতলব ছাড়া, আপনি কারো পিছনে পরা মানুষ না কৌশিক। খেলার গুটি যেহেতু আমি, জানার অধিকার আমার আছে।”
কৌশিক চোখ কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে। কাশফি বরাবরই খেয়াল করেছে যতবারই সে কৌশিককে উত্তেজিত করার লক্ষ্যে পাল্টা জবাব দিয়েছে, ততবার কৌশিকের এমন অঙ্গভঙ্গি করেছে। খুবই নিচু তবে তার তেজস্বী কণ্ঠে বলল,
” আমার যা ইচ্ছে তা ডাকতে পারি আর আমি পুরুষ তুমি নারী। ওয়ান্স আপন এ টাইম, তোমার মতো ডেড-ড্রপ গর্জিয়াস একজন আমার চোখে পড়েছিল। তারপর ইটস অল নিউরোট্রানসমিটার এন্ড ডোপামিন। সহজ বিষয় প্যাঁচানোর কিছু নেই!”
কাশফি মুহুর্তমধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে কৌশিকের দিকে বিস্ফারিত নয়নে তাকায়,
“ইউ মিন ইনফ্যাচুয়েশান কৌশিক? মোহের বসে আপনি আমার জীবন নষ্ট করেতেও ভাবলেন না? ফ্যান্টাস্টিক!”
কৌশিক কাশফির বিদ্রুপ শুনে চোখ মুখ শক্ত করে নেয়। উগ্র মেজাজ নিয়ে কাশফি নিজেকে চেয়ার থেকে টেনে তুলে, দুর্বল কদমে থানা থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হয়। মাথায় একটা চিন্তা, প্রথমে তার ভাইকে খুঁজে বের করতে হবে। কৌশিক এতক্ষন কাশফির কাজকর্ম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যাস্ত। ঠিক চার কদমের জন্য পা বাড়ানোর আগেই সে কাশফির কোমর টেনে ধরে। শক্ত হাতে তার গলার পিছনের অংশ ধরে নিজের বুকে মিশিয়ে নেয়। পরপর পুরুষালী কণ্ঠে স্ট্রেইটফরোয়ার্ড জবাব দেয়,
“ক্ষণিকের মোহ হলে এত লম্বা সময় অপেক্ষা করতাম না কাশফি। আমি তোমার ভয়, রাগ, ঘৃণা ভীষণ উপভোগ করি। এতটাই উপভোগ করি যে তোমার চোখে অন্য কারো জন্য ঘৃণা দেখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় মিসেস মির্জা….”
কাশফির কোমরে পুরুষালী হাত আরো শক্ত হয়ে আসলো। কৌশিকের গরম নিশ্বাস তার মুখে আছড়ে পড়ছে। হঠাৎ কাশফির কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কাশফিকে অপ্রস্তুত আর সম্পূর্ন বিহ্বল করতে পেরে কৌশিক বাঁকা হাসে,
“আমি তোমার ডেনায়াল গেইম অনেক পছন্দ করি, সোনা। সাউন্ডস ফা’ক’ড আপ রাইট?”
কাশফি হিতবুদ্ধির মতো চেয়ে আছে। আজ সে যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। বড় একটা ঢোক গিলে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে — “ব’ল’দ পেয়েছেন?”
“নিজেকে এত ছোট করে কেন দেখছো? এছাড়া তুমি যা জানতে চেয়েছো আমি তো তাই বললাম।”
কৌশিকের নিচু স্বরে আওড়ালো। ঘন ঘন গরম শ্বাস কাশফির মুখে এসে লাগলো। তাদের মাঝের অতি নগণ্য দূরত্বে নিজের অবস্থান কৌশিকের বুকে আবিষ্কার করে তড়িৎ গতিতে সরে দাঁড়ায়। চোখে আশ্চর্য আর বিভ্রান্তি নিয়ে বলে,
“ইউ আর সিক অ্যান্ড ইউ নিড টু সি আ ডক্টর কৌশিক। ASAP! আপনি বড়সড় মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।”
তার বলে শেষ হওয়ায় আগেই কৌশিক কাশফিকে তার দিকে ফিরিয়ে চোয়াল শক্ত করে ধরে। ক্রুর হেসে তার কান্না শুকিয়ে যাওয়া মুখ বেশকিছুক্ষণ পরখ করে। তারপর হিম শীতল কণ্ঠে বলল,
” আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই বলেছ, কিন্তু তুমি কি জানো তুমি এতটা প্যাথেটিক যে, নিজের ভুল স্বীকার করার ভয়ে অতীত ভুলিয়ে দিয়েছ কাশফি। ট্রাস্ট মি, তুমি একটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড লাইফ লিড করছো, ডার্লিং।”
নিজের ব্যাপারে এসব বাজে কথা শুনে কাশফির মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো,
“কারো ব্যাপারে না জেনে কিছু বলবেন না। টাকার দাপট আর ক্ষমতা আছে মানে কি আমার মাথা কিনে নিয়েছেন?”
কৌশিক কাশফির নরম গালে আরো চাপ প্রয়োগ করায়, সে কেঁকিয়ে উঠে বড় বড় নখ দিয়ে কৌশিকের হাত খামচে ধরে। কৌশিক শব্দ করে হেসে মাথা নেড়ে বলে,
“তুমি আসলেই প্যাথেটিক!”
কাশফি কৌশিকের হাত থেকে নিজের মুখ ছাড়িয়ে নিয়ে আঙুল দিয়ে শাসিয়ে বলে,
“শাট আপ! আমি কখনোই এমন ছিলাম না।”
কৌশিক মুখে জিপার টানার ভঙ্গী করে চুপ হয়ে গেল। এতে কাশফি যেন আরেক দফায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।
“জাস্ট ড্রপ ইয়ুর এ্যাক্ট কৌশিক মির্জা। আমি এতোই প্যথেটিক হলে আমার ভাইকে কি’ড’ন্যাপ করার প্রয়োজন ছিলনা। আমি ডাবল স্ট্রান্ডার্ড হলে প্রয়োজন ছিল আমাকে মুক্ত করে দেওয়ার। তাহলে কেন করছেন না?”
(যারা জানেন না তারা কাইন্ডলি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এর অর্থ জেনে নিবেন।)
কৌশিক মাথা ঝেকে বোঝায় যেন সে কাশফির কথা মেনে নিয়েছে যা দেখে হতবম্ব কাশফির কাছে নিজেকে পাগল পাগল মনে হতে লাগলো। লোকটা এত সহজে মেনে নিয়েছে? কাশফি নিজেকে আশ্বস্থ করার জন্য আরেকবার জিজ্ঞেস করতে নিয়েও আটকে যায়। সে যেন আরেক দফায় বোকা বনে, যখন কৌশিক তার গুটিয়ে নেওয়া পাঞ্জাবীর হাতা খুলে সোজা করে কাফলিঙ্ক আটকে নেয়। তাহলে সে কি কাশফির কথা মেনে নিয়েছে? এত সহজে?
“আপনি চলে যাচ্ছেন?”
“অবশ্যই। অন্তত থানায় হানিমুন করার মতো ফালতু রুচি আমার নেই।”
কাশফি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কৌশিকের হাতে তার নখের আঁচড় দেখেই তার মন প্রফুল্লতায় ভরে উঠে। পরক্ষণে আবার কৌশিকের ত্যাড়া কথা শুনে পিন্ডি চটকায়,
“আপনি আমার টেস্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন?”
“এমন কিছু কি বলেছি?”
“আপনি এমন টাই বুঝিয়েছেন।”
কাশফি থেমে গিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করল, এটা সে কি করছে? খ’চ্চ’রের বা’চ্চার মতো আবার কৌশিকের কথায় ফেঁসে কি বলার ছিল সেটাই ভুলে গিয়েছে।
কাশফিকে তপ্ত নিশ্বাস ফেলতে দেখে কৌশিক মাথা এপাশ ওপাশ কাত করে ঝাঁকি দিতেই মট করে শব্দ হয়। নিজের ভাবনায় আদাজল খাওয়া কাশফির কানের কাছে এসে বলে,
“আমি জীবিত থাকতে তোমার মুক্তি হবে না আর তোমার ভাই নিরাপদে আছে। তবে এখন, তুমি কৌশিক মির্জার বাধ্য স্ত্রীর মতো তার সাথে ফিরবে, ওকে? ”
কানের কাছে গরম শ্বাস আর পরপর কৌশিকের কন্ঠ শুনে কাশফি আঁতকে উঠে বুকের উপর থাকা শাড়ি খামচে ধরে। স্বভাবসুলভ কৌশিকের পিঠে চাপড় দেওয়ার জন্য হাত তুললে কৌশিক ভ্রু জোড়া উচুঁ করে কাশফির হাতের দিকে দৃষ্টি পাত করে।
“আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না। আর আমার ভাইকে আমি খুঁজে নিব। সো কাইন্ডলি, গেট লস্ট!”
উপরে তোলা হাত নামিয়ে কাশফি ঠান্ডা মাথায় হালকা পাতলা অপমান করে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই, কৌশিক মুখে একটা রহস্যময় হাসি রেখে বলে উঠে,
“তুমি আর তোমার বান্ধবী আরিয়ানা মেহনাজ কাশফি, পুস্পকুঞ্জ আর্ট একাডেমী থেকে জাতীয় শিশু শিল্প প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচিত হয়েছিলে। মনে পড়ে?”
কাশফি থ মেরে দাড়িয়ে থাকে। তার মস্তিষ্কে আবার সেই একাডেমির গেইট, ক্যানভাস, রঙ, তুলি আর একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ তলায় গ্রুপ ওয়ার্কের প্রতিচ্ছবি ভাসতে থাকে। সে চোখ শক্ত করে বুঝে ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে আবার পিছনে ফিরে কৌশিকের দিকে তির্যক দৃষ্টি দেয়। অবিশ্বাস্য ভাবে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে কিছু বলার আগেই কৌশিক আবার বলে,
“আরিয়ানার বাবা মারা যাওয়ার পর তোমার বাবা অপরাধ বোধে ভুগেছিলেন।”
কাশফির হৃদপিণ্ড জোরে জোরে লাফাতে শুরু করলো। পাশের নোংরা দেওয়াল ধরে নিজেকে ধাতস্থ করল। সে যেনো এবার আশ্চর্য্যের সপ্ত আসমানে। মাথা ঝিম ধরে আসছে তার। অতি কৌতূহলের বসে সে সেদিন দুই পাতা পড়েছিল। এখন মনে হয় সেইদিন জার্নালটা না পড়লেই ভালো হতো। দু দিকে মাথা নেড়ে চেঁচিয়ে বলল,
“আপনি কিছুই জানেন না!”
সে কথাটা যেন নিজেকে বুঝ দেওয়ার জন্য বলেছে। আবার কৌশিকের দিকে র’ক্ত চোঁখে চেয়ে থেকে মেঝের দিকে তাকিয়ে বলে— “ আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই আপনার অজানা কৌশিক।”
কৌশিক তাদের মাঝের দুরত্ব কমিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। উষ্ণ নিশ্বাস আছড়ে পড়ল তার বদনে। মাস্কি পুরুষালী ঘ্রান নাকে গিয়ে বিধলো। ধীরে ধীরে কৌশিকের দেহ হতে আগত উষ্ণতা যেন আলোর ন্যায় তার মাঝে বিচ্ছুরিত হলো। পরবর্তীতে শক্ত পুরুষালী কণ্ঠ এলো কানে—
“ ভয় পেয়েছিলো?” — কিছুক্ষণ থেমে সে আবার বলল— “পাওয়াটাই দরকার।”
বিস্ফোরিত নয়নে কাশফি জিজ্ঞেস করল, “কি?”
সে থেমে গিয়ে আবার গলা পরিষ্কার করে বলল,
“কি এমন বিষয় জানেন আপনি?”
চোঁখ পিট পিট করে সে কৌশিকের দিকে চেয়ে থাকলো।
“নিগূঢ় আর তমসাচ্ছন্ন একটা অধ্যায়! সামথিং ক্রিপটিক অ্যান্ড স্কেপটিক্যাল…”
তৎক্ষণাৎ কাশফির মাথায় হাজার চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো। পশ্চিমের জানালা দিয়ে শাঁ শাঁ শব্দে দমকা হওয়ায় এসে তার গায়ে লাগছে, তবুও তার কোন হেলদোল নেই।
অতীত মানে ভালো খারাপ এর মিশ্র জিনিস। তবে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড লাইফ মানে সে কি বুঝিয়েছে?
আনমনা কাশফি এমন ভাবে মেঝের দিকে চেয়ে আছে যেন, তার সকল প্রশ্নের উত্তর সেখানে পুঁ’তে রাখা আছে। তার হৃদপিণ্ডের বেগতিক ওঠানামার শব্দ মোটামুটি কৌশিকের কর্ন কূহরে পৌঁছানোর মতন। বার বার মস্তিষ্কের ফ্ল্যাশব্যাক দেখায় যেন তার মাথায় কেউ বেশ জোরে জোরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে।
কৌশিক তার ছুঁই ছুঁই অবস্থায় দাঁড়িয়েই ছিল। আকষ্মিক ভাবুক কাশফির চিবুকে আঙুল রেখে মাথা উপরে তোলে,
“তোমার আর আমার মাঝে তফাৎ কোথায় জানো? আমি নিজে কতটা জঘন্য সেটা স্বীকার করতে জানি, আর তুমি নিজের মিথ্যা ও প্রতারণা ঢেকে নিজেকে ভালো উপস্থাপন করতে সব করতে পারো। ”
বেশ কিছুক্ষণ পর কাশফি বলে উঠে,
“আপনি কি আমাকে স্টক করছেন?”
জবাব এলো কৌশিকের নিচু স্বরের গুরুগম্ভীর কণ্ঠে–
“আবরার কবীর বিজনেসের জগতে খুবই পরিচিত একটা নাম আর তুমি তার বন্ধুর মেয়ে ছিলে।”
কাশফি রাগে পাশে থাকা চেয়ার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তেতে উঠে চোঁখ, মুখ খিঁচে বলে,
“আমাকে কি আপনি ক খ শেখাচ্ছেন? আর কি জানেন আপনি আমার ব্যাপারে?”
প্রত্যুত্তরে কৌশিক শুধু বাঁকা হাসে। কাশফি ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো। জবাব না পেয়ে মেজাজ তুঙ্গে ওঠে। চোখ গরম করে চেঁচিয়ে শুধালো,
“কিছু বলছেন না কেনো?”
কৌশিক একবার কাশফির ঠোঁট জোড়ার দিকে তাকিয়ে আবার তার চোখের দিকে তাকায়—
“তোমার বেষ্ট ফ্রেন্ড আরিয়ানা মেহনাজ কাশফি সু’ই’সা’ই’ডা’ল ছিল। আর আরিয়ানা কে সামাল দিতে তুমি আরিয়ানার ছায়া হয়ে থাকতে কেন জানো?”
কাশফির মাথার ভিতর একটা সুক্ষ্ম ঝাঁকি দিল। আরিয়ানা তার জীবনের একজন গুরুত্বপূর্ন মানুষ হয়েও স্মৃতির কোথাও তার বিন্দুমাত্র আনাগোনা নেই। শুধুমাত্র একটা দৃশ্য চোখে ভাসলো, পুস্পকুঞ্জ একাডেমীর সামনের পোড়া কৃষ্ণচূড়া গাছটার ধ্বংসাবশেষ আর কিছু না।
তির তির করে তার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে।
ইন্ট্রোভার্ট ঈশিতা ইমরোজ কাশফিকে একাডেমীর সবাই একটা ফ্রিক(freak) মনে করত। তাকে সবাই অস্বাভাবিক ভাবার কারণ সে শূন্যে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকতো। নিজে নিজে হাসতো আর তার আর্ট গুলো মনস্তাত্বিক আর আধ্যাত্মিক রকমের ছিল। মুলত তাই কেউ তার সাথে মিশতো না। আরিয়ানা ছিল খাপ ছাড়া আর সব সময় অনিশ্চয়তায় ভুগতো। পরে সে ইন্ট্রোভার্ট কাশফির প্রাণপ্রিয় বান্ধবী হয়ে উঠে।
এতক্ষন তার ধ্যানে ছিলোনা যে তার স্বামী, কৌশিক তাকে ছুঁয়ে দাড়িয়েছে। ইলেকট্রিক ভোল্টের মতো তার দেহে আচানাক শিহরণ পৌঁছায়। কৌশিকের মুখে জলের মতো শান্ত রূপ যেন সমুদ্রের ভয়াবহ ঝড়ের আভাস।
তার জীবনের অনেক বড় অংশ তার স্মৃতি থেকে হারিয়ে গিয়েছে। তার মায়ের চেহারা কিংবা তার পরিবারের কারো চেহারা তার মনে নেই। তার জীবনে কী হয়েছে?কেন হয়েছে? কেন সে এমন ছিল? সেই অজ্ঞাত চিঠি প্রেরক, জুনায়েদ তারা কি তার কল্পনা মাত্র? সে জানে না।
কৌশিক বলিষ্ঠ হাত দিয়ে কাশফির এক হাত তার হাতে তুলে নেয়। বিস্ফোরিত কাশফির চোঁখে চোখ রেখে তার পরানো আংটিতে চুমু দেয়। বিমূঢ় কাশফি ছোট করে প্রশ্ন করে — “ কেন? ”
“কারণ তুমি তোমার মায়ের চলে যাওয়া মানতে পারো নি। সবাই ভাবত তুমি বাক্শক্তিহীন; কিন্তু প্যাথেটিক কাশফি সিলেক্টেড মিউট ছিল_ মানে ইচ্ছাকৃত মূক বধির। যে সব কিছুতে চুপচাপ ছিল আর না কখনো নিজের ডিফেন্ড করতো।”
কৌশিকের উত্তরটা যেন তার পৃথিবী কাঁপিয়ে তোলে। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে আর মাথা ঘুরছে। সে যেন এক গোলক ধাঁধায় আটকে পরেছে। এমন কিছু কৌশিক জেনেছে যা তার জানার কথা নয়। কৌশিক বিরাট রকমের মাইন্ড গেইম খেলেছে আর সে কাশফিকে জব্দ করতেও সফল হয়েছে।
“মাই বিলাভড, মিসেস মির্জা। তুমি আজকাল থেকে নয়, অনেক আগে থেকেই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড লাইফ লিড করছ।”
প্রতিটা মানুষ তার জীবনের অনেক জিনিস মুছে ফেলতে চায়। কাশফিও মুছে ফেলেছিল কিন্তু কাল হয়ে দাঁড়ায় কৌশিক মির্জা। যা সবার অগোচরে থাকার কথা সেটাও সে জেনে গিয়েছে। ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে এসেছে তার কায়া। যেমনটা কৌশিক মির্জার সাথে প্রথম দেখায় হয়েছিল। একটা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়, ফেলিক্স স্টোনের ফিউনারেল সিরিমনিতে। সেদিন কৌশিক মির্জা দুঃস্বপ্ন হয়ে এসেছিল।
আর এই দুঃস্বপ্ন কা’টা’তে ঈশিতা ইমরোজ কাশফির, আরিয়ানা মেহনাজ কাশফিকে খুঁজতে হবে। অতীত আর বর্তমানের প্যারানরমাল লাইন ভেদ করতে তার বান্ধবী আরিয়ানার প্রয়োজন।
তৎক্ষণাৎ যেন তার মাথায় চট করে একটা সুপ্ত পরিকল্পনা চাপে। এমন পরিকল্পনা যা সফল হলে কাশফির সব জটলার সমাধান পাবে আর অসফল হলে সে প্রাণ হারাবে। এটা লোহা দিয়ে লোহা কাঁ’টা’র একটা পরিকল্পনা। তার মত তুচ্ছ একজন কিছুই করতে পারবে না, আর আরিয়ানাকে খুঁজতে হলে কৌশিক মির্জাকে সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
কৌশিক মির্জাকে, কৌশিক মির্জা নিজেই পরাজিত করার ক্ষমতা রাখে; ঠিক যেমন হীরা কে হীরা কাটতে পারে।
জাপানিজ একটা প্রবাদবাক্য আছে,
弱肉強食
যার ইংরেজি অর্থ,
‘The weak are meat; the strong do eat.’
©️প্রোপীতা নিউমী( Propi Newmi )
#চলবে….
আমি কোনো পারফেকশনিস্ট কিংবা বাংলা ব্যাকরণ বানান নিয়ে বিজ্ঞ নই তাই গল্পে বানান ভুল থাকতে পারে। কোনো সাহিত্য উপস্থাপন আমার লক্ষ্য নয়, ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।