#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৫)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী
৫. (Edited)
কমলদীঘির বাঁশ বাগানের অন্দরের রাস্তা দিয়ে দুটো চকচকে কালো মার্সিডিজ বেঞ্জ শাঁ শাঁ বেগে ছুটে চলছে। দুই চারটা পাখি আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে খুব কাছ থেকে শোনাচ্ছে খেক শেয়ালের ডাক। দূরের কিছু ঝোপঝাড় হতে জ্বল জ্বল করছে কিছু শিকারী জন্তুর দৃষ্টি। তমসাচ্ছন্ন রাত্রি, বেশ গুমোট আবহাওয়া, ভীতিকর আভার মাঝে কুচকুচে কালো গাড়ির তিরীক্ষ বেগ। সব মিলিয়ে গা ছমছমে একটা পরিবেশ। আট বছরের কায়েস ঘুমন্ত অবস্থায় টের পেয়ে ভয়ে বড় বোন কাশফিকে ঝাপটে ধরে। পরক্ষণে কাশফি তার ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শর্ত মোতাবেক কায়েসকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশের সিটে বসা কৌশিক দুই ভাই বোন কে আড়চোখে দেখে যাচ্ছে। কাশফির পাশে গুটিয়ে থাকা শিশু কায়েস অঘোর ঘুমে মগ্ন আর পাশে তার ম্যাডাম জানলার দিকে ফিরে শূন্যে চেয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে যে কাশফির ধ্যান ধারণা এই জগতে নেই।
কৌশিক মির্জা নিজের অধিপত্যের বিষয়ে সর্বদা সচেতন। সে কাশফিকে তার বশ্যতা স্বীকার করাতে চায়। তবে কাশফি কারো সামনে নজর নিচু করার মানুষ না। কিছুক্ষণ আগে কাশফির দেওয়া প্রস্তাব মনে পড়ে যায়। মুহূর্তমধ্যেই তার কপালের রগ ফুলে উঠল। কাশফি ভাবছে সে কৌশিককে ম্যানুপুলেট করতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু সে আবার ভুল করেছে। কায়েসের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কাশফিও একই ভাবনায় বিভোর। তার মনে হচ্ছে কৌশিক মির্জা আবার মাইন্ড গেইম খেলেছে। খুবই নোং’রা ধরণের গেইম। তবে কাশফি যে তার ছোট্ট বিজয়ের উচ্ছ্বাস নিয়ে আছে তার ধারণা হয়তো কৌশিকের নেই।
কিছুক্ষণ পূর্বে থানায় কাশফি মনে সুপ্ত পরিকল্পনা এটে নিজের ভয়, হতাশা ঢেকে কৌশিকের চোঁখে চোখ রাখে। কৌশিকের চোঁখে মুখে বিজয়ের হাসির রেখা ফুটেছে। কৌশিক মির্জার জন্য ম্যানিপুলেশন একটা আর্ট আর আবেগহীন রূপ একটা মরীচিকা, কেবল মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য যার সৃষ্টি। কৌশিককে জব্দ করার একমাত্র উপায় তার পথ অনুকরণ, তাকে তার নিজ পন্থায় আটকানো।
কাশফি নিজের প্রথম সূক্ষ পদক্ষেপের একটা ছক কষে, খুবই ছোট একটা পরিকল্পনা মাত্র। চিন্তায় ডুবে তার উপরের ঠোঁট নিচের ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে। পরক্ষণে চোখে একরাশ আত্মবিশ্বাসের ঝলক নিয়ে অকপটে বলে,
“লেটস মেক আ ডিল, কৌশিক।”
অতঃপর কৌশিকের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে একটা চেয়ার টেনে তাতে পায়ে পা তুলে বসে। সে মনে মনে নিজের কাঁধ চাপড়ালো আর ভাবলো ‘ আম প্রাউড অফ ইউর বোল্ড মুভ, ঈশিতা’ । নিজেকে বাহবা দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সে আড়চোখে কৌশিকের মুখ অবয়ব দেখে নিলো কয়েকবার। লক্ষ্য করতে পেরে কৌশিক বেশ বিরক্ত বোধ করে।
“তোমার ছোট মাথায় কি খিচুড়ি পাকাচ্ছো কাশফি?”
কৌশিকের নিচু স্বরের শব্দ মাটিতে পড়ার আগেই কাশফি তার তর্জনী আঙ্গুল নিজের দিকে ঘুরিয়ে স্পষ্টত বলে,
“ঈশিতা ইমরোজ কাশফি আপনাকে রান্না করে খাওয়ানো দুর, এক গ্লাস পানি ঢেলে খাওয়াবে, সেই রাজ কপাল নিয়ে জন্ম হয়নি আপনার কৌশিক মির্জা।”
কাশফির ধৃষ্টতা দেখে কৌশিক চোঁখ জোড়া কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে এক ভ্রু উচুঁ করে চায়।
“তোমার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হলো খোলা আকাশ পেয়ে বেশ উড়াউড়ি করছো মিসেস মির্জা। ভুলে বসো না যে তোমার গন্তব্য আমি আর পার্মানেন্ট ঠিকানা আমার খাঁচায়।”
কৌশিকের শীতল কণ্ঠের কাশফির শিরদাঁড়া বেয়ে একটা সূচের ন্যায় শিহরন বয়ে যায়। মুখে স্মিথ হাসি আর পানির মতো শান্ত রূপ দেখে সব কাশফির মাথায় যেন রক্ত চড়ে বসলো। কতটা ই’ত’র হতে পারলে মানুষ এমনটা বলতে পারে?
আবার নিজেকে আশ্বস্ত করে সে। কৌশিকে কথার জালে নয়, কৌশিককে কথার মাঝে রেখে নিজেরটা বুঝে নিতে হবে। আরেক বারের মতো নিজেকে সামাল দিয়ে আবেগহীন হয়ে বেশ রয়েসয়ে বলে সে,
“ আমি জ্বলজ্যান্ত একজন মানুষ। কোন পোষ মানা পাখি না। তাছাড়া আপনি চুক্তির বিষয়টা খুবই সুন্দর ভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন কৌশিক।”
–বলেই কাশফি কৌশিকের মতো করে কিছুক্ষণ ভবঘুরে হওয়ার অভিনয় করে একটা হাসি দিয়ে, আবার ঠিক কিছুক্ষণ আগের কৌশিকের মতো কিছুটা রসিকতার ছলে বলে— “ভয় পেয়েছেন? পাওয়ারই দরকার।”
এতেও যেন কৌশিকের হাসি কমে নি বরং তার চোখে মুখে আচানক অদ্ভুদ রকমের উচ্ছ্বাস ভেসে উঠলো—
“তুমি নিজেকে চালাক দেখাতে গিয়ে বোকা বনে ঘুরে ফিরে আমার জালে আটকাচ্ছো মিসেস মির্জা!”
কৌশিকের নিচু স্বরের গুরুগম্ভীর কণ্ঠে কাশফি প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তাহলে দ্যা গ্রেট কৌশিক মির্জা তার বিরুদ্ধেও পাল্টা ফন্ধি এটে রেখেছেন?
কৌশিক বুকে হাত গুজে টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল— “ এই ডিলে আমার প্রফিট কি? ”
“আমি কমপ্লেইন তুলে নিব।”
কাশফির সোজা সাপটা জবাবে কৌশিক হো হো করে রুম কপিয়ে শ য় তা নের মতো হেসে উঠলো। ঠোঁট চেপে হাসি আটকে থ্রে ট দেওয়ার মতো কন্ঠে বলল—
“তোমাকে অস্তিত্বহীন করার ক্ষমতা রাখি ডার্লিং, আর তুমি সাধারণ একটা কমপ্লেইনের ভয় দেখাচ্ছো? সো ডাম্ব অফ ইউ!”
কাশফি চটপট নির্ভীক জবাব দেয়,
“ডিল করা তো আপনার থেকেই শিখেছি, কৌশিক। একটু আধটু না হয় দক্ষ। তাছাড়া বউ যেহেতু হয়েছি অনেক কিছুই শেখার আছে, শিখছি।”
কাশফি দুই কাঁধ হালকা ঝাঁকি দিয়ে শ্রাগ করে আরেকটা মুক্ত ঝরানো হাসি দিয়ে আবার বলল,
“এখন শর্ত হলো আপনি আমার ভাইকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন, তারপর আমাকে পুষ্পকুঞ্জ আর্ট একাডেমী নিয়ে যাবেন। পরিবর্তে আমি আপনার স্ত্রী হয়ে নিঃশব্দে আপনার সাথে যেতে রাজি আছি আর কমপ্লেইনও তুলে নেওয়া হবে।”
কৌশিকের চোঁখ জোড়া কিঞ্চিৎ ছোট ছোট হয়ে আসলো। মানে সে মোটেও পছন্দ করে নি। বেশ খানিকক্ষণ কাশফির মুখের দিকে এক নাগাড়ে চেয়ে আছে সে। ঠিক বিরক্ত হচ্ছেন কিনা বোঝা মুশকিল।
“আমি বারবার তোমাকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছি আর ভাবছি তোমার এত সাহস কোত্থেকে হয়, ডার্লিং?”
কৌশিক চিন্তামগ্ন ভঙ্গিমায় তার গালের চাপা দাড়িতে হাত বুলিয়ে আবার বলে,
“বাট দেটস নট ফেয়ার, তুমি একপার্শ্বিক দিকেই সুবিধা নিলে।”
কাশফি এক ভ্রু উচুঁ করে চায়। তার অনেক বলতে ইচ্ছে করল—
“আপনার মতো অ’মা’নু’ষকে দেখলে কিভাবে না’ক ফা’টানো যায় সেই পরিকল্পনায় থাকি। দেখেছি পর্যন্ত ঘৃণা করে এসেছি। দুই দণ্ড আগ বাড়িয়ে কথা বলার কোন ইচ্ছে ছিলোনা, নেই। আর এমন মানুষের সাথে আমি বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনের অপমান করে থাকার প্রস্তাব দিচ্ছি, তাও আপনি বলছেন নট ফেয়ার?”
কিন্তু সে মনের কথা মনেই চেপে মুখের হাসি অক্ষত রেখে বলল —
“আপনিও কখনো ফেয়ার গেইম খেলেন নি কৌশিক। লেটস সে, লার্নট ফ্রম দ্যা বেস্ট (let’s say, learnt from the best)।”
কৌশিক চোয়াল শক্ত করে কাশফির বাহু নিজের মুষ্ঠির শক্ত বাঁধনে আটকে ধরে। কাশফির হাসিতে কেমন এই গা জ্বলা ভাব, যেন সুদর্শন হাসিটা তার উপহাসের লক্ষ্যে দেওয়া। কৌশিক এক ঝটকায় কাশফিকে টেনে চেয়ার থেকে তুলে দাঁতে দাঁত চেপে বেশ নিচু তবে থ্রেটেনিং স্বরে বলে,
” খাঁচায় ফিরার সময় হয়ে গিয়েছে, মিসেস মির্জা।”
অপ্রস্তুত কাশফি কিছু বলার আগেই তাকে টেনে বাইরে আনা হয়। নিজেকে আড়ালে রাখলেও ভয়ে তার বার বার বুকে মোচড় দিয়ে উঠছে। জিপের পাশে দাঁড়ানো ওসি আব্দুস সামাদ দুইজনকে বের হতে দেখে, ক্ষিপ্র কৌশিকের দিকে এগিয়ে আসলেন। কাশফি একটা ঢোক গিলে মাথা নিচু করে ফেলে। এখানে সে ছাড়া পেতে এসে নিজেই আবার খাঁচায় ফিরে যাওয়ার জন্য পিছিয়ে নিয়েছে নিজেকে। কিন্তু কাশফি নিজেকে আবার মনে করিয়ে দেয় তার একমাত্র লক্ষ্য—যা কৌশিক মির্জা আর তার পাওয়ারকে ব্যবহার করেই, সে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে পারবে। ঠিক যেমন কৌশিক তাকে কোন এক অজানা কারণে ব্যাবহার করছে।
“মিস ঈশিতা?”
কাশফির ধ্যান ভেঙে গেল। সবার সামনে দ্বিধায় পড়ে গেল। ঘর্মাক্ত হাতজোড়া মোচড়ামুচড়ি করে একবার কৌশিকের দিকে তাঁকিয়ে আবার ওসির দিকে ফিরে বেশ জড়তা নিয়ে বলল —
“আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল, আমি দুঃখিত।”
দুইজনের মধ্যে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওসি এবার কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললেন— “ মিস ঈশিতা আপনাকে কেউ জোর করলে আপনি আমাকে জানাতে পারেন।”
কথাটা যে ডাইরেক্টলি কৌশিককে উদ্দেশ্যে করে বলা হয়েছে কৌশিক তা বুঝেছে। সে নিজের তীর্যক দৃষ্টি বজায় রেখে চোঁখ জোড়া গরম করে বলে—
“ মিসেস মির্জা সোজা সাবলীল বাংলায় বলেছেন তার কোন সমস্যা নেই। ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করলে দাঁড়ায় ‘she has no problem’ সো প্লিজ এক্সকিউজ আস!”
আর এদিক ওদিক না ফিরে টেনে এনে কাশফিকে গাড়ীতে ঢুকিয়ে নিজেও অন্যপাশে এসে ঢুকে পড়ল। তবে যাওয়ার আগে কৌশিক মাথায় আইস ব্যাগ দেওয়া এসআই আশরাফ কে চোখ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে সে চলে যাচ্ছে মানে ছেড়ে দিবে না।
***
(কল্পনা/ অতীত)
“তুমি আমার গর্ভের রত্ন ঈশিতা, আমার মাস্টারপিস!”
কাশফির সামনে একটা বড় ক্যানভাসে তার নিজ হাতে আঁকা ছবি। ক্যানভাসে নানান রঙে একটা শহুরের জীবনযাত্রার ছবির মাঝে একটা উদাসীন ছোট মেয়ের ছবি আঁকা। একজন পোলিশ মিলিয়নের ছবিটা 20,000$ এ নিলামে কিনেছেন। তাই আজ চারুলতা বেশ খুশি।
চারুলতা আর কাশফির শুধু পেছনের অংশ দেখাচ্ছে। হঠাৎ করে ফোপানোর শব্দ এলো। কাশফি কি তাহলে কাদঁছে? চোখ গরম করে চারুলতা কষে এক থাপ্পড় লাগলেন কাশফির মুখে। জী’র্ণশী’র্ণ দেহের বারো বছরের কাশফি ছি’ট’কে পড়ল স্টু’ডি’ও রুমের এক কিনারায়। মিনমিন করে বলতে লাগলো— “আমার বাবার জন্মদিনের জন্য ছিল ছবিটা।”
পরপর শোনালো চারুলতার তেজী কর্কশ স্বর,
“বাবা মিশন থেকে জীবিত ফিরবে কিনা মৃত নির্ভর করছে তোমার উপর। তাই বলছি ভদ্রভাবে আচরণ করো।”
ফ্লোরে থাকা কাশফির ফোপানি আর গোঙানির শব্দ আরো বেড়েই চলছে হঠাৎ সব হওয়ায় মিলে যায়। ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারের গভীরতা ও নিঃশব্দতা সম্পূর্ন স্টুডিও গ্রাস করে ফেলে।
***
কিছুটা তীক্ষ্ণ শব্দে গাড়ী থামে সরকারী স্কুলের শিক্ষক আতিকুর রহমানের দোতলা বাড়ির সামনে। আকষ্মিক ব্রেকে কাশফির মাথা ঝাঁকি দিয়ে সামনের দিকে ঢলে পরে। চোঁখ কুঁচকে সে দুই আঙ্গুলে কপাল টিপে ধরে। কিছুক্ষণের জন্য সে ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধহয়। (প্রোপীতা নিউমী)
আগে নাক বাঁকানো লোকটা, লেভিন গাড়ী থেকে নেমে পরে, পরপর ড্রাইভার বেরিয়ে পরে। কৌশিক আলগোছে বেরিয়ে আসে। তন্মধ্যে একজন গার্ড এসে কৌশিকের ঈশারায় কায়েসকে গাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ভিতরে চলে যায়। কৌশিকের তীর্যক দৃষ্টি উপেক্ষা করে কাশফি বাঁধা দিতে চাইলেও গার্ড তাকে বিশেষ পাত্তা দিল না।
গার্ড যাওয়ার পর কৌশিক কাশফির জন্য গাড়ির দরজা খুলে দাড়ায়। তার চাহনী তিরিক্ষি তবে বাহ্যিক অঙ্গভঙ্গী নিরুদ্যম। চোঁখ দিয়ে যদি ভস্ম করতে পারত তাহলে হয়ত কাশফির ছাই টুকুও কেউ খুঁজে পেতো না। কাশফি নিজের ঘর্মাক্ত হাত শাড়ীতে মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। তার অস্বস্থি বোধ যেন তিনগুন বেড়ে গেল। কৌশিকের শকুনের মতো নজর তার প্রতিটা পদে যেন আটকে আছে। কাশফি গাড়ির দরজা আটকে নিজের চুল, শাড়ির কুচি আর আঁচল ঠিক করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। তবে এসব লুকিয়ে চুরিয়ে নজর এড়িয়ে চলার প্রয়াস মাত্র। কৌশিক গম্ভির গলায় আবেগশূন্য হয়ে বলে,
“ আমার চুক্তির ভাগ আমি সম্পূর্ন করলাম এবার তোমার পালা। কা’ন্না’কা’টির এপিসোড শেষ করে সব গুছিয়ে নাও। কালই তুমি আমার সাথে মির্জা নিবাসে ফিরছো।”
তৎক্ষণাৎ কাশফির চোখ কপালে। সে প্রথমে ভেবেছিল কৌশিক মজার ছলে বলেছে। কিছুক্ষনপরও যখন কৌশিকের ভাবুমূর্তি অপরিবর্তিত দেখলো তখন তার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা মনে হতে লাগলো। তার এখনো চারুলতা নামের মহিলাকে দেখার বাকি। এখানে তার বাবা , ভাই কে রেখে সে অন্যত্র কী করে যেতে পারে? কাশফি ঢোক গিলে কৌশিকের চোঁখে চোখ রাখে,
“আমিও শর্ত পালন করেছি কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমাদের শর্তের মোতাবেক পুষ্পকুঞ্জ একাডেমী যাওয়া বাকি।”
কৌশিক বেশ শান্ত মেজাজে বলে,
“তুমি ন্যায়সঙ্গত কোন চুক্তি করো নি কাশফি আর না আমি ফেয়ার গেইম (fair game) খেলি, সেটা তুমি নিজেই তো বললে।”
কাশফি একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়। সে কিছুটা ধারণা করেছিল কৌশিক এমন কিছুই করবে। তাই সে ছোট একটা ব্যাক আপ প্ল্যান করে রেখেছে। খুঁটে খুঁটে কৌশিক মির্জার দুর্বল পয়েন্ট বের করার পরিকল্পনা। সে কৌশিককে অনুকরণ করে শান্ত গলায় বলে,
“কৌশিক আপনি চুক্তিতে না করেন নি। তাই শর্ত মোতাবেক আমাকে সেখানে নিয়ে যাবেন।”
কৌশিক চোঁখ জোড়া ছোট ছোট করে চায়। এবার তার কপালের ভাঁজ গাঢ় হয়ে এলো, সাদা চামড়ার উপর ফোলা ফোলা রগ দেখাচ্ছে। বাঘের ন্যায় জ্বলন্ত শিকারী চোঁখ জোড়ায় নজর বন্ধী করল কাশফিকে। কিছুক্ষণ চেয়ে গমগমে গলায় বলল,
“তুমি আমাকে অর্ডার করছ? সিরিয়ালি কাশফি? লাস্টবার বলছি তোমাকে কোত্থাও নিয়ে যাওয়া হবে না আর কাল সোজা আমরা মোহাম্মদপুরের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিবো। প্রস্তুত থাকো।”
কৌশিকের কথায় ভয় পেলেও কাশফি নিজের ভয়কে দমিয়ে বড় গলায় প্রত্যুত্তর করে,
“আমিও শেষবারের মতো বলছি আমাকে হালকাভাবে নিয়ে আপনি আবার ভুল করেছেন কৌশিক।”
কৌশিক এবার দুই হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে নেয়। চোঁখের রগ লাল দেখাচ্ছে। সে চোয়াল শক্ত করে শুধালো — “ ঠিক কি বলতে চাইছো?”
“আপনি আপনার শর্ত পালন করেন নি কৌশিক, তাই আমি আপনার বাড়ির চৌকাঠে পা রাখছি না।”
কাশফির মুখে আবার সেই গা জ্বালানো হাসি দেখে কৌশিক অপ্রস্তুত কাশফিকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির সাথে লাগিয়ে, তার দুইপাশের দিকের গাড়ির অংশে হাত দিয়ে তাকে আটকে নেয়।
“তুমি আমার অবাধ্য হওয়ার অনেক শাস্তি জমিয়েছো সোনা। ট্রাস্ট মি, প্রতেকটা কর্মের শুধে আসলে হিসাব নেব।”
কৌশিকের উষ্ণ নিশ্বাস কাশফির মুখ ছেয়ে গেল, ঘৃণায় ধাক্কা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতে গিয়েও আবার কিছু মনে পরতেই একটা ফিচেল হাসি দিয়ে কাশফি কৌশিকের দিকে তাকায়,
“মির্জা পরিবারের মানুষদের নৈতিকতার বড্ড অভাব। যেমন কথা দিয়ে কথা রাখতে না জানার মতো কাপুরুষ কৌশিক মির্জা— ”
কাশফি আর কিছু বলার আগেই কৌশিকের শক্ত পুরুষালী হাত তার গ’লা টি’পে ধরে। খুব একটা জোরে না তবে হালকাও নয়। কাশফির বাকি কথাটুকু গলায় আটকে আসে। মনে হলো তার শ্বাস আটকে আসছে। আশ্চর্য্য হয়ে থাকা কাশফির চোখ বড় বড় হয়ে আসে। শ্বাস না নেওয়ার ফলে তার মুখ র’ক্ত’শূ’ন্য দেখাচ্ছে। দুর্বল হাতে কৌশিকের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায়, কৌশিকের বাহু খামচে ধরে আরেক হাতে কৌশিকের বুকে আঘাত করে। একপর্যায়ে চোখে পানি চলে আসায় কৌশিক ছেড়ে দিয়ে স্বর ছোট করে বলে,
“আমি তোমার শ্বাস রোধ করিনি, তুমি চাইলেই নিঃশ্বাস নিতে পারতে কিন্তু তোমার মাইন্ড সেট করা যে তুমি নিশ্বাস নিতে পারবে না। Work smart not hard, মিসেস মির্জা। ”
কাশফি গলা ধরে হালকা করে কেঁশে উঠলো। আসলেই কৌশিক তার শ্বাস রোধ করেনি। তখন ভয়ে তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। তাকে স্পেস দিয়ে কৌশিক সরে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়ায়। শক্ত পুরুষালী কণ্ঠে বলে,
“জাস্ট তোমাকে ছোট খাটো একটা লেসন দিয়েছি। আশা করি ভবিষ্যতে সাবধান থাকবে।”
কাশফি শূন্যে তাঁকিয়ে আছে নিজেকে ধাতস্থ করার লক্ষ্যে। মুখ হা করে কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নিলো। অন্যপাশে থাকা কৌশিক নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার জন্য নিজের উপর রেগে আছে। শক্ত মুষ্ঠিতে ব্যাক ব্রাশ করা চুল খামচে ধরে চোয়াল শক্ত করে নেয়। কৌশিককে ক্রুদ্ধ অবস্থায় দেখে, কাশফি চোঁখে চকচক করতে থাকা অশ্রু নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কন্ঠে বলে,
“ দ্যা গ্রেট কৌশিক মির্জাকে এই তুচ্ছ কাশফি রাগিয়ে দিল! Hats off to me, তাইনা? নিজেকে নিয়ে আমি গর্বিত।”
কৌশিকের চোখে বিস্ময় আর মুখে তীব্র রাগ উপলব্ধি করতে পেরে কাশফি বাঁকা হেসে বলে,
” দ্যা পারফেক্ট কৌশিক মির্জা নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানে না। উপস মোমেন্ট ছিল, দুর্বলতা ধরে ফেললাম কৌশিক।”
কৌশিকের রাগ যেন চরম পর্যায়ে ছুঁই ছুঁই। তবে সে মুখ শক্ত করে কাশফিকে দেখেই গেল শুধু।
স্কোর: কৌশিক ২ | কাশফি ১।
“তাই বার বার বলেছি ডোন্ট টেক মি লাইটলি।”
কাশফি আর কোন রকম আগে পিছে না তাকিয়ে দুর্বল পায়ে বাড়ির কাঠের খচিত দরজা ডিঙ্গিয়ে ঢুকে পরলো। তবে তাদের বাড়ির দরজায় কৌশিকের বাজখাঁই কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হলো— ”নিয়মানুযায়ী তোমাকে রাতে যেন আমার বিছানায় বধূ সেজে আমার পাশে দেখতে পাই, মিসেস মির্জা।”
কাশফি থমকে দাঁড়ায় মুখে তবে পিছনে ফিরে না। কিছু ভেবে তার মুখে একটা রহস্যময় হাসি নিয়ে শাড়ির অগোছালো কুচি ধরে দোতলার দিকে তার বাবার রূমে অগ্রসর হতে হতে ভাবলো কৌশিক মির্জার কিছুক্ষণ আগের বাক্য —
“ Work smart not hard.”
কাশফি ফিচেল হাসে। স্ত্রী হিসাবে স্বামীর কথা মেনে চলা তার গুরুগম্ভীর দায়িত্ব।
#চলবে…
আমি কোনো পারফেকশনিস্ট কিংবা বাংলা ব্যাকরণ বানান নিয়ে বিজ্ঞ নই তাই গল্পে বানান ভুল থাকতে পারে। কোনো সাহিত্য উপস্থাপন আমার লক্ষ্য নয়, ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনারা বন্ধুমহলে পেইজ শেয়ার করে দিবেন আর অবশ্যই মন্তব্য করবেন ♥️