অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১৮) #লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী ১৮. (Edited)

0
131

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১৮)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

১৮. (Edited)
অতীত:
গ্রামীণ চওড়া মেঠো পথের একপাশের খড়কুটোর বাড়ি ঘর, টিনের চালা। অন্যপাশের হরিৎ উপত্যকার বুকে হলদে সরিষা ফুলের বিচরণ। মৃদু বাতাসের ঝাপটায় দুলছে চোখ জুড়ানো হরিদ্রা পুষ্প গুলো। রিকশা চালক মনের আনন্দে গুনগুন করে গান ধরে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আজ হুড ফেলে আতিকুর রহমানও দৃশ্য উপভোগ করতে ব্যস্ত। মাথায় পাতলা তুলোর ন্যায় চুল বাতাসে উড়ছে; তবে মাস্টারের বুঝি কোন তাড়া নেই আজ?
এটা শহরের থেকে কিছুটা দূরের সহজ সরল জীবন যাপন।

“এই বছর ম্যালা সৈষ্যা চাষ হয়েছে, পকেট ফাকা না থাকিলে আমি দেশের বাড়ির লিগা কিছু লইতাম।”
রিকশা চালকের হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠের বিপরীতে তিনি ও সরিষার তেল কিনার পরিকল্পনা করে রাখেন।

সরিষা ক্ষেত পেরিয়ে রিকশা প্রবেশ করলো বামের বাঁকে। শীতের শেষ সময়; তবে সন্ধ্যার পরপর তিমির ঘনিয়ে আসলে শীতে প্রকোপ কিছুটা বেড়ে যায়। অসমতল মেঠো পথের দুইধারে সারি সারি গাছ গাছালি, হাতে গোনা কয়েকটা গাছের ডালের পাতা ঝরেছে কেবল। ঝাঁকি দিয়ে চলতে চলতে খানিকটা দূরে রিক্সার গতি কমে যায়, সম্পূর্ন থামে গ্রিলের তৈরি গেইটের সামনে। তাকালেই চোঁখে আসে দূরদূরান্তের দীঘি। বেডি বাঁধ খুলে দেওয়ায় জোয়ারের পানিতে পূর্ণ হয়েছে এসব দীঘি। এসব দীঘির বেশির ভাগই মালিকানা চিটাগং এর বাসিন্দা। জাল ফেললে হরেক রকম মাছের মেলা বসে। দীঘির জলের উপরে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে উড়ে চলছে পক্ষীর তিন চারটা ঝাঁক।
আতিকুর রহমান নেমে ভাড়া পরিশোধ করলেন, গেইট একটু ঠেলে ঢুকে পড়লেন সেথায়, কয়েকটা আইলের উপর দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন তার দীঘির কাছটায়। নিজের একার দীঘি নয় তবে ভাগ বণ্টনে মেলা মাছ পেয়ে থাকেন। এখনকার বেশিরভাগ মানুষের কোটিকোটি টাকার মাছের ব্যাবসা। আইলের মাঝে মাঝে আবার খেজুরের গাছ লাগানো। গাছ হতে রস সংগ্রহের লক্ষ্যে কলসি আর বোতল ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আজকের রোদ গায়ে লাগছে রাতে শীত পড়লে রস ভালো হবে। আতিকুর রহমান দীঘি পরিচর্যার শেষে বেরিয়ে হাঁটলেন কিছুক্ষণ।

পীত বর্ণের এক্সকাভেটর মেশিনে চড়ে দীঘি কাটছে কিছু লোক। তত্ত্বাবধানে আছেন মেয়রের ম্যানেজার, যিনি পান চিবুতে চিবুতে কিছু রঙ শার্টেও লাগিয়ে ফেলেছেন বটে। পাশেই মেয়রের আমের বাগান, গাছে মুকুল এসেছে, বারোমাসি আম কিনা। হাঁটতে হাঁটতে আরো কিছু দূরে দেখতে পেলেন মাঠ জুড়ে মহিষ। এই জেলা মূলত মহিষ, খেজুর গাছ আর মাছের জন্য পরিচিত। টিচিং প্রফেশনে জয়নিং হওয়ার দুইদিন পর ওয়ানে পড়ুয়া এক ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘জাতীয় পশু কি?’ সে চর এলাকার বাসিন্দা। তার উত্তরে বলেছিল, ‘বাংলাদেশের জাতীয় পশু মহিষ।’

আতিকুর রহমান পনেরো একরের দীঘির আশপাশ হাঁটতে উদ্যত হলেন। এই দীঘি নাকি তার দাদা কাটিয়ে ছিলেন, তিন চার বছর পরে বিক্রিও করে ফেলেন। দীঘি পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা কাছেই জেলে পাড়া। একপ্রকার মেঘনা নদীর শাখা বলা যায়। আসরের পরপরই জোয়ার আসায় জেলেরা নৌকা নিয়ে বেরিয়েছে। জেলেরা একবার মাছ ধরে এনে বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে গেছেন। এরাই মূলত বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করবেন। ব্যাস্ত জেলেরা আবার জাল নিয়ে নৌকায় উঠেছে, দ্বিতীয় দফায় জাল ফেলার উদ্দ্যেশে। তাজা নদীর মাছ দেখে রিকশা চালক আর আতিকুর রহমান কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দর দাম করে কিনে ফেললেন। এই মাছ আর কোথায় পাবেন? অবশ্যই জেলেদের থেকে সরাসরি কেনা গেলে ভালোই হতো, কম দামে পেয়ে যেতেন।

***

“এভাবে আমার বাড়ীর আশেপাশে দাড়িয়ে থাকা চরম ছ্যাচড়ামী ঠেকছে আমার নিকট।”

কাশফি ঝাঁঝালো কণ্ঠে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখলেও, তার এক বালতি কাপড় থেকে বের করে আনা; টকটকে লাল ওড়না খানা হতে আসা পানির ঝাটকায় সে পলক ফেলতে নেয়। পাশাপাশি ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে জোভান। ভাগ্যক্রমে আজ কাশফির দেখা মিলল। সে পরক্ষণে চোঁখ খুলে কাশফির দিকে চেয়ে প্রাণবন্ত হাসি হেসে বলল,
“আমি দুঃখিত!”

কাশফির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং অনমনীয় অঙ্গভঙ্গি অনড় রেখে পূর্বের স্বরে চয়ন করলো,
“আপনি দুঃখিত নন। আমাকে এভাবে দেখা বন্ধ করে দিন, আমার অস্বস্থিবোধ হয়।”

জোভান হেলদোলহীন, তার মতো যুবক একটা মেয়ের পিছনে লেগে থাকার মানে কি সে বুঝে না? নাকি বুঝতে চায় না?

“আমি তোমাকে পছন্দ করি ঈশিতা।”

“সেটা আপনার আর বাবার ব্যাপার।”

জোভান প্রত্যুত্তরে কিছু বলার আগে আবার মনে মনে কাশফির কথা পুনরাবৃত্তি করে, ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে নেয়,

“আপনি কি সম্মতি দিচ্ছেন ঈশিতা?”

“কিসের?”

“আমাকে পছন্দ করেন?”

“সেটা কবে বললাম?”
কাশফির কণ্ঠে বিরক্ত আর নাকের ডগায় রাগের লাল আভা।

“তাহলে আপনার বাবাকে জানানোর বিষয়…?”

কাশফি মহা বিরক্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্লাস্টিকের টকটকে লাল বালতিটা হাতে তুলে নেয়। যে বুঝতেই চায় না তাকে কি করে বুঝানো যায়? তাই দুই বছর ধরে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকা জোভান কে খানিকটা শাসিয়ে বলল,

“আমার মাইন্ড সেটআপ ওল্ড ফ্যাশন টাইপ। আমি বিয়েতে বিশ্বাসী, প্রেম আমার দ্বারা হবে না। আমার বাবাও এসব সমর্থন করেন না। আর আমি এখনকার স্থানীয়; আপনার এখানে দাড়িয়ে থাকা নিয়ে মানুষ আমার ব্যাপারে বাজে মন্তব্য করতে পিছপা হবে না।”

ততক্ষণে আতিকুর রহমানের চড়ে বসা রিকশা এসে থামলো তাদের প্রাঙ্গণে। কাশফির হাক পড়তেই কাশফি নজর সরিয়ে নিয়ে ছুট লাগায়। জোভানের জন্য জমিয়ে রাখা রাগ তারপর রিক্সায় থাকা মাছ দেখে মাথায় যেনো আ’গুন দপ করে জ্ব’লে উঠলো। পুরুষ মানুষ কেনো বুঝতেই চায় না যে, অসময়ে আনা মাছ কাটলে শরীর নোংরা হয়। বাবার প্রতি রাগ দেখিয়ে হনহনিয়ে ভিতরে চলে গেলো সে। এই মাছ কুটা বাছা করলে সারা গায়ে গন্ধ বাঁধবে।
আতিকুর রহমান নজর বাঁচিয়ে চললেন আর না মেয়েকে টু শব্দ করে কিছু বললেন।

***

শিকদার পরিবারের বড় ছেলে সফিক শিকদার আর ছোট ছেলে সুমন শিকদার। তবে তারা সব ভাইবোন আলাদা আলাদাই থাকে। বোনদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অনেক বছর। সুমন শিকদারের ইচ্ছে ছিল ছেলেকে তার আদরের ভাগ্নির সাথে বিয়ে দিয়ে বোনদের পরিবারের সাথে সম্পর্কটা গুছিয়ে নিবেন। কিন্তু তা আর হলো কই? তার ছেলেটা ঘাড়ত্যাড়া। ফুফাতো বোনকে বিয়ে করার কথা শুনেই না করে দিয়েছে। সুমন সাহেব বুঝানোর চেষ্টা করায় অন্য সম্পর্কে পর্যন্ত জড়িয়েছে তার ছেলে, তাও শোবিজের এমন এক মেয়ের সাথে যে চরম রকমের বেহায়া।
পরবর্তীতে তিনি আর জোরাজোরি করেন নি বরং এড়িয়ে চলেছেন। কেননা ছেলের প্রতি সুপ্ত নারাজ ছিলেন। কিঞ্চিৎ প্রয়োজন ছাড়া তাদের ঠিকঠাক হয়ে কথাবার্তা কবে হয়েছিল, আল্লাহ মালুম!

বাগিচায় হাঁটতে হাঁটতে ডালিম গাছ পেরিয়ে দেখা মিললো তার পছন্দের লেবু গাছটার। তবে লেবু গুলো পূর্বের চাইতে ছোট হতে দেখে খানিকটা বিচলিত হন সুমন সাহেব। কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন কিছুক্ষন। ইশ্, কিসের ঘাটতি হলো! এটা সুমন সাহেবের অতি শখের বাগান। আর শখের তো দাম গুনতে নেই। চওড়া গলায় মধ্যবয়স্ক মালিকে ডেকে তিনি এটা সেটা করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন, তৎক্ষণাৎ হুড়মুড়িয়ে আগমন ঘটে তার সেই অবাধ্য ছেলেটার। জিন্স আর টি-শার্টে ফকফকা সাদা চামড়ার যুবকটা দৌড়ানোর দরুন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে থামে তার বাবার সম্মুখে। অতঃপর ব্যাগ্র কণ্ঠে উচ্চারণ করল,

“বাবা, আমি বিয়ে করতে চাই।”

ছেলের কথা শোনা মাত্রই বুকে জড়ানোর ইচ্ছা সম্পূর্ণ মাটি চাপা দিলেন। মুখ ফিরিয়ে নিলেন তৎক্ষণাৎ। এই তারছেরা ছেলেটার মাথায় নতুন ভুত কি করে চাপলো? নাঈমা মেয়েটা তো ওয়াইফ ম্যাটেরিয়ালই না, তাকে বাড়ির বড় বউ করার মতো দুঃ’স্বপ্ন তিনি কখনোই দেখেন না। তবে আদো কিছু করার আছে? তপ্ত নিশ্বাস ফেলে তিনি গাছ পর্যবেক্ষণ করায় মনোযোগ দেন।

“যা করার করো, প্রেম করার আগে তো আমাকে জিজ্ঞেস করোনি।”
তার বাবার ত্যাড়া কথায় সে থতমত খেয়ে যায়,

“প্রেম?”
গম্ভীর সুমন সাহেব প্রত্যুত্তরে কিছুই বলেন না।
এদিকে কনফিউজড জোভান চিন্তাভাবনার পরিশেষে মুখে মিষ্টি হাঁসি টানে। কাশফির মতো বাধ্য মেয়ে তার বাবার পছন্দের শীর্ষে। আজ হয়ত তার বাবা তার উপর সন্তুষ্ট হবেন ভেবে, সে মুখ ফিরিয়ে থাকা বাবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে বাবাকে শুধরে বাধা বিপত্তি ছাড়া বলে,

“আতিকুর রহমানের একমাত্র মেয়ে ঈশিতা ইমরোজ কাশফিকে বিয়ে করতে চাই বাবা। তোমার পছন্দ হলে তবেই বিয়ে করব।”

#চলবে…

Note: প্রথম পার্ট এর বর্ণনাটা আমার জামাইর গ্রামের বর্ণনা আর শ্বশুর বাড়িতে টাইম দিতে দিতেই আর লেখার টাইম পাইনি। ২৩ তারিখের পর রেগুলার গল্প পাবেন ইনশাল্লাহ। নেক্সট পার্ট লিখতে বসেছি। আমার জন্য দোয়া করবেন আর অনেক ভালোবাসা। ওহ, এই পার্ট কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here