#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২২)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী
(Edited)
অতীত এবং কল্পনা:
দুপাশে সারি সারি মেহগনি আর সেগুন বাগিচা পেরিয়ে, বিশাল এই এস্টেট জুড়ে ড্যানডেলিওনস ফিল্ড। তারপর এই আধুনিক ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বাড়িটার দেখা মেলে। ঠিক কোনো কল্পনার রাজপ্রাসাদের থেকে কম নয়। একসময় এই বাড়ির বৃদ্ধার পিতামহ জমিদার ছিলেন, তাই একে জমিদার বাড়ি বলেও চেনেন অনেকে। বাড়ির বড় বলরুমটায় আজ হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা। মানুষের মুখে মুখে বলাবলি চলছে যে, কিছু মুহূর্তের মধ্যেই বৃদ্ধা তার নিজ ক্ষমতা থেকে সরে দাড়িয়ে তার যোগ্য নাতিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য তোরখোড় করে বিশাল আয়োজন করেছেন। তার বড্ড আদরের নাতি কিনা। ইমপোর্ট এক্সপোর্ট আর শিপিং ছাড়াও স্থাপত্যশিল্প আর হোটেল চেইন এর বড় ব্যাবসা তাদের। এত অঢেল সম্পদ!
এইটুকু তথ্য নীলাম্বরী চশমা পরা লোকটার কাছ হতে পেয়েছে।
নীলাম্বরী শাড়ির লম্বা আঁচল ফেলে, চশমা পড়া লোকটার পায়ের তালে তাল মিলিয়ে চললো। ছোট ছোট পায়ে হেঁটে হেঁটে বিশাল আয়তাকার বলরুম পর্যবেক্ষনে ব্যস্ত সে। বাইরে অত মানুষজন না থাকলেও বলরুম ভর্তি। বোঝাই যাচ্ছে তারা খানিকটা দেরী করে ফেলেছে। মানুষ জন হাতে গ্লাস নিয়ে চিটচ্যাট (Chitchat) করছে নতুবা ব্যবসায়িক আলাপ আলোচনায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে লোকটার সাথে ধাক্কা লেগে নীলাম্বরী থমকে দাড়ায়। অস্ফুট স্বরে গুঙিয়ে, নাক ডলে, মাথা উচু করে লোকটার চোখে চোখ রাখতেই দেখতে পেলো, চশমা পরা লোকটা তার দিকে নিজের বাহু কিঞ্চিৎ উচুঁ করে বাড়িয়ে রাখলো। নীলাম্বরী ভ্রূদ্বয় কুঁচকে সেদিকে চেয়ে বসলো,
“আমার বাহুতে বাহু জড়িয়ে ধরো।”
“কিহ!— কেনো?”
লোকটা চোয়াল শক্ত রেখেই তার মধ্যমা দিয়ে চশমা নাকের উপর ঠেলে দিলো। সে নীলাম্বরীর দিকে তির্যক দৃষ্টি রেখে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়ালো। বিব্রত নীলাম্বরী চোঁখ পিট পিট করে চেয়ে এক পা পিছনে নিবে তার পূর্বে লোকটা বিরক্তির সুরে বলে উঠে,
“তুমি আমার ডেট হয়ে এসেছো রিমেম্বার। So, drop your juvenile act!”
নীলাম্বরী আগের ন্যায় বিব্রত অবস্থায় থেকেই তার অনিশ্চিত হাত বাড়িয়ে লোকটার বাহুতে রাখে। এতে লোকটা আরো বিরক্ত হয়ে বাহু থেকে নীলাম্বরীর হাত ঝাঁটা দিয়ে ফেলে; নীলাম্বরীর শাড়ির আঁচল দিয়ে পিঠ ঢেকে আলতো হাতে তার কোমর ধরে কাছে টেনে নিলো। নিজের পজিশন চেক করে সে একবার তাকিয়ে লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে থাকা নীলাম্বরীকে দেখে নিলো,
“রিল্যাক্স ফিল করতে বাধা নেই। At least, you aren’t my type.”
নীলাম্বরীর কান দিয়ে ধোয়া বের হওয়ার উপক্রম তবুও সে মাথা নেড়ে কাঁধ চওড়া করে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। এই নীল শাড়িতে তাকে কোন কিশোরী নয় বরং পরিণত একটা নারী মনে হচ্ছে। সে নিজেকে এই পরিস্থিতি থেকে ডাইভার্ট করতে চশমা পরা লোকটা কে জিজ্ঞেস করলো,
“আমাকে যদি জিজ্ঞেস করে আমি আপনার কে?”
“তোমার টু শব্দ করার প্রয়োজন নেই, তুমি এতকাল যেমন নির্বাক ছিলে তেমনই নির্বাক ভূমিকা পালন করবে আজও।”
সূক্ষ্ম অপমান গায়ে না মেখে নীলাম্বরী আবার শুধালো,
“এটলিস্ট আপনার নাম জানতে পারি কি?”
“ইউ ক্যান কল মি বিস্ট (Beast) ফর নাও।”
নীলাম্বরী থতমত খেয়ে যায়, আদো কেউ কারো পরিচয় বিস্ট বলে দিতে পারে? বড্ড অদ্ভুত! সে অত ভাবান্তর না ঘটিয়ে চশমা পরনে লোকটা — বিস্টের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটা শুরু করলো।
বলরুমের মধ্যখানে একটা বড় পিয়ানোতে হাত চালিয়ে পিয়ানো বাদক সুর তুলছে। তার পাশেই ভায়োলিন কাঁধে রেখে ভায়োলিন বাও দিয়ে নরম সুর তুলছে সুদক্ষ ভায়োলিনিস্ট। ক্লাসিক নোট আর মাইল্ড টোনের ধ্বনি কানে আসা মাত্রই একটা রোমাঞ্চকর পরিবেশ গড়ে উঠেতে বাধ্য শ্রোতার মনে। নীলাম্বরী হাইটের কারণে দেখতে না পেলেও উপলব্ধি করলো বেশ। যেনো বসন্তের ঝরা পাতায় দাড়িয়ে একজন প্রেমিক আকুল অনুরোধ জানাচ্ছে। পিয়ানো আর বায়োলিনের শব্দ বন্ধ হতেই সামনে একজন বৃদ্ধা গ্লাস উপরে উঠিয়ে তাতে চামচ দিয়ে শব্দ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।
“আপনারা সবাই হয়ত জানেন বার্ধক্য জনিত কারনে আমি আর কোম্পানির দেখাশোনা করতে পারছি না। তাই, আজ আমি আমার নাতিকে আপনাদের নতুন ডিরেক্টর হিসাবে ঘোষণা করছি।”
ততক্ষণে করতালিতে মুখরিত হলো বলরুমটা। অনেকে প্রশংসাও করলো বৃদ্ধার নাতির। তা শুনে বৃদ্ধার মুখে ঝলক দেখা দিলো। গর্বিত স্বরে বৃদ্ধা হেসে আবার বলল,
“আরেকটা বিষয় হলো, আমরা চৌধুরীদের সাথে খুব শীগ্রই পার্টনার হতে চলছি। কেননা চৌধুরী বাড়ির মেয়ে বুশরা শাহরিন চৌধুরী আমাদের বাড়ির নতুন সদস্য হতে চলছে। আর দেরি না করে আমার বংশের সিংহ আর তার বাগদত্তা কে স্বাগতম জানানো হোক।”
চোখে একরাশ আগ্রহ নিয়ে অবুঝ নীলাম্বরী বাকি সবার মতো হাত তালি দিয়ে সিঁড়ির দিকে চেয়ে রইল আর বিস্ট মুখ গোমড়া করে তার দিকে চেয়ে রইল কেবল। পরক্ষণে সে গম্ভীর গলায় মিনমিন করে নীলাম্বরীর উদ্দেশ্যে বললো — “It will be getting worse.”
ততক্ষণে বোঝার আগেই নীলাম্বরীর পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছে যেনো। শুন্য চোখে কেবল সিঁড়ির মাথায় নজর গেঁথে রইলো তার। লোকজনের করতালি শোনার পরিবর্তে তার কানে কেবল ভো ভো শব্দ এলো কিছুক্ষণ। তার বুকের বেগতিক উঠানামা আর মাথা হতে গরম কিছু বের হচ্ছে তা বুঝে এলো কেবল। সিঁড়ির উপর হতে ছাই রঙা চোখের হিমাদ্রী শক্ত মুখে নেমে আসছে, তার পাশেই রূপকথার রাজকন্যার মতো দেখতে একটা মেয়ে হিমাদ্রীর বাহুতে নিজের অলঙ্কৃত বাহু জড়িয়ে ধরে নেমে আসছে।
পাথর বনে থাকা নীলাম্বরীর চোঁখ পর্যবেক্ষণ করে ঠিকই মেয়েটার অনামিকায় থাকা চকচক করা হিরের আংটি খুঁজে নিলো। তার নেতিয়ে যাওয়া শরীর হতে ঘাম ছাড়ার মুহূর্তের মধ্যেই জায়গাটায় প্রচণ্ড গরম লাগতে শুরু করলো তার। তার ভিতরটা গুলিয়ে আসছে যেনো আকস্মিক খুবই নোং’রা ধরনের কালো চাদর তাকে জড়িয়ে ধরেছে। সিঁড়ি হতে নেমে হিমাদ্রী তার বাগদত্তার অনামিকায় চুমু খেলো।
চোখের কোনায় জমে থাকা পানি চোঁখ ঝাপটে বিলীন করতে নেয় কিশোরী নীলাম্বরী। সে আর দাড়ালো না, তার বুকের ভেতর অস্বাভাবিক মোচড় উপলব্ধি করেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে হেঁটে আসলো। মাথায় তার একটা ভাবনা ঘুরছে, বয়সে ইম্যাচিউর ছিলো বলেই কি সে এতোকাল একজন তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে ছিল?
হিমাদ্রীর থেকেও নিজের উপর ঘৃণা ক্ষোভ নিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো। হিমাদ্রীর আসল নাম জানার কোন ইচ্ছে অবশিষ্ঠ রইলো না। উপলদ্ধি হলো বটে, সে বাবার কথা না শুনে বিশাল ভুল করে ফেলেছে!
এস্টেট হতে বেরিয়ে রাস্তা পেরোনোর আগেই বিস্ট এসে তার পথ রুখে দাড়ায়।
“বাস্তবতা দেখাতে নিয়ে এসেছিলাম, দেখা শেষ। গাড়িতে উঠো।”
নীলাম্বরী চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে ভেজা ঘন পাপড়ি দিয়ে চোঁখ লাল করে চায়,
“আমি একা যেতে পারবো, পথ ছাড়ুন।”
“গাড়িতে উঠো।”
নীলাম্বরী রাগ না দমাতে পেরে বিস্টের বুকে জোরে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
“সমস্যা কি? যেতে দিচ্ছেন না কেনো?”
বিপরীতে বিস্ট চশমা মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে নাকের উপরে ঠেলে শক্ত হাত নীলাম্বরীর কাঁধে রেখে নিচু স্বরে বলল,
“গাড়িতে উঠে বসো।”
লোকটার উচ্চারিত প্রতিটা শব্দই যেনো তার কাছে থ্রেটেনিং মনে হলো। বিষণ্ণ হয়ে ভারী পদে বিস্টের পিছু পিছু গাড়ির সামনে এসে দাড়ালো। বিস্ট গাড়ি আন লক করার পর পরই নীলাম্বরী দরজা খুলে ঢুকে পড়ল। বাকিটা পথ তার কাটলো জানালার বাইরে তাকিয়ে। নিজেকে নিশ্চুপ আর আড়ালে রেখে বেশ গুটিশুটি মেরে বসে রইলো। মনে মনে কেবল লম্বা পথ টুকু শেষ হওয়ার প্রার্থনা করলো।
অন্ধকার পথে বিছানো শুকনো পাতায় গুড়িগুড়ি বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ, দুর হতে ভেসে আসছে ঝি ঝি পোকার ডাক। কিছুক্ষণ পর এক পাশের খাল হতে টুপ করে ব্যাঙের ডুব দেওয়ার শব্দ এলো, পরপর কানে এলো ব্যাঙের ডাক। বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ বরাবরই নীলাম্বরীর প্রিয়, দুই এক বৃষ্টির ফোঁটা নামানো কাঁচ হয়ে তার মুখ ছুঁয়ে দিলো। প্রলম্বিত শ্বাসে বাতাসের ঘ্রাণ নিয়ে সে গাড়ির নামানো কাঁচটুকু উপরে উঠিয়ে দিলো। এখন ভালোলাগা টুকুও তার গ্রহণ করতে ইচ্ছে করছে না।
“এইটুকু মেয়ে তুমি ভালোবাসা বোঝো?”
ড্রাইভিং সিটে বসা চশমা পরা লোকটা উপহাস করে বললো বোধহয়। জবাবে নীলাম্বরী নির্বাক ভূমিকা পালন করে অপলক গাড়ির কাঁচের বাইরে চেয়ে রইলো। আসলেই সে এসবের কিছুই বুঝে না। প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল তার, আর কিছুই না। হয়ত এসব ঘটেছে কারণ তার ঘরে বাবা আছে মা আছে তবে তাকে সময় দেওয়ার মতো কেউ নেই। একটা মাত্র ভাই ছিল তার ঠাইও হলো মাটির তলায়।
ভিলার গেইটে পৌঁছাতেই নীলাম্বরী নামিয়ে দেওয়ার জন্য বলবে তার আগেই তাদের দারোয়ান গেইট খুলে দেয়। নীলাম্বরী বড় বড় চোখে চেয়ে ঢোক গিলে শুকনো গলা ভিজিয়ে নিলো। তবে কি তার বাবা জেনে গিয়েছে সব? গেইট পেরিয়ে গাড়ি থামে ঠিক ভিলার সামনে। সেখানে শুভ্র চাদর জড়িয়ে দাড়িয়ে আছে তার বাবা। নীলাম্বরী শাড়ির আঁচল শক্ত করে ধরে ঝিম ধরে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। নেমে তার বাবার সামনে দাঁড়ানোর সাহস টুকু নেই। ঠিক কবে বাবার আদেশ অমান্য করেছিল মনে পড়ছে না তার। দুরু দুরু বুকে গাড়ি থেকে নেমে কম্পমান হাতে গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিলো। এদিকে বিস্ট কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই তার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তিনি বিস্টের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে যেনো ইশারায় ধন্যবাদ জানালেন।
“তুমি আসতে পারো।”
বিস্ট নীলাম্বরীর দিকে সূক্ষ্ম নজরে চেয়ে গাড়িতে উঠে গেলো, যেনো সে শাসিয়ে ‘এমন গা’ধার মতো কাজ না করার আদেশ দিয়ে গেলো।’ তার গাড়ি প্রস্থান মাত্রই নীলাম্বরী ছোট ছোট পায়ে হেঁটে এসে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তার বাবার বিষণ্ণ চোখে চোখ রাখলো। তার বাবা তার গায়ে কখনো হাত তুলেনি, তার বাবা আজ হাত তুলবে ভাবতেই তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
“এদিকে এসো!”
কঠিন গলার সম্মোধনে নীলাম্বরীর তনু মন কেঁপে উঠলো। সে মাথা নত করে বাবার ঠিক বরাবর এসে দাড়ায়। তবে তার বাবা অভাবনীয় কিছু করে বসলেন। তিনি নীলাম্বরীর মাথায় হাত রেখে কণ্ঠ নরম করে বললেন,
“ভুল করে শিক্ষা যদি অর্জন করে থাকো তবে আমি সফল। বাবা কোনো দিন তোমার খারাপ চাইনি, মনে রাখবে, Blood is thicker than water. ”
(Blood is always thicker than water একটি প্রবাদ বাক্য যার অর্থ রক্তের টান বড় টান।)
টুপ করে নীলাম্বরীর কর্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এতটা বিশ্বাস তার বাবার আর সে কিনা বিশ্বাস গুড়িয়ে দিয়েছে। কিসের জন্য? একটা অপক্ক আবেগের বশে? এতটা কেয়ারলেস কি করে হলো সে? আর না ভেবে সে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো তার বাবাকে। এখানে তার ভরসা, তার বাবা সময় না দিতে পারলেও এই বুকই তার আশ্রয়স্থল, তার ভিটেমাটি। বাবার বুকে ঢলে পড়ে কান্নার বাঁধ ভাঙলো। অতপর কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো,
“ওয়াদা করছি বাবা তোমার কথার বাইরে এক পা ও অনড় হবো না। তুমি যেহেতু চেয়েছো আমি পুষ্পকুঞ্জ একাডেমী ছেড়ে দিই, আমি আজই ছেড়ে দিতে প্রস্তুত বাবা।”
(কল্পনার সমাপ্তি)
***
কাশফি ঠিক পনেরো মিনিটের মাথায় চোঁখ খুলে বসে পড়লো। বাকি পাঁচ মিনিট সময় নিলো তার পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে। পাঁচ মিনিট পর নিশ্চিত হলো যে সে বর্তমানে অবস্থান করছে, কল্পনা কিংবা অতীতে নয়। ডক্টর খান এতক্ষণ তাকে এডজাস্ট হওয়ার সময় দিচ্ছিলো। সে তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেওয়া মাত্রই সে গড়গড় করে পানি পান করে শেষ করে নেয়। ডক্টর খান তার দুই হাত নিজের দুই হাতে নিয়ে কাশফির চোখের সামনে তুলে ধরলো,
“আমি এই সেশন তাই বন্ধ রাখতে বলেছি ঈশিতা।”
কাশফির হাতের নখ গুলো কিছুটা বড় ছিল, হাতের মুঠোয় এতটা শক্ত করে আকড়ে ধরেছিলো যে তার প্রতিটা নখ উল্টে গিয়েছে। হাতের তালু লাল হয়ে নখের দাগও বসে আছে। পরিস্থিতির সামাল দিতে কাশফি দ্রুত হাত সরিয়ে আশ্বস্থ দিয়ে বলল,
“একটু ভয় পেয়েছিলাম বোধহয় আর কিছুই না।”
ডক্টর খান তার কথায় অসন্তুষ্ট প্রকাশ করলেন। তিনি মাথা নেড়ে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“এভাবে যদি ব্রেইনের উপর প্রেশার দাও তবে ব্রেইন স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
ডক্টর খান কাশফির আর কোনো বাড়তি কথা কর্ণকুহরে নিলেন না। তিনি উঠে দাড়িয়ে পড়লেন,
“তোমার স্বপ্নটা কেমন ছিলো?”
“কেবল ঘটনা কেন্দ্রিক, ভুতুড়ে কিছু নয়।”
ডক্টর খান মাথা নেড়ে কিছু একটা ভেবে বললেন,
“তুমি ঘুমানোর পূর্বে আমার প্রেসক্রাইব করা ঘুমানোর ওষুধ খেয়ে ঘুমাবে আর একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে বলব দোয়া পাঠ করে ঘুমাবে।”
“কেনো?”
“এমন স্বপ্নের অর্থ আমার নিকট ‘calm before the storm’ হয়ে ঠেকছে।”
কাশফি গভীর চিন্তায় ডুব দেয়। এইতো কয়েকদিন আগের দেখা স্বপ্ন সে এনালাইসিস করতে ন্যায়,
“স্বপ্ন যদি অতীত হয় তবে কল্পনা কি বাস্তবতা হয়ে দুঃস্বপ্ন দেখাতে সক্ষম?”
ডক্টর খানের কপালে বলিরেখা প্রগাঢ় হয়ে চিন্তার ছাপ দেখা দিলো।
“আমাকে বুঝিয়ে বলো ঈশিতা।”
“এই স্বপ্নগুলো আমার অতীত ছিল। বর্তমানে এমন একজন মানুষ আছে যাকে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম, সে কি আমার অতীতে আসলেই ছিল নাকি কল্পনা মাত্র?”
“তোমার স্বপ্ন গুলো পুরোপুরি অতীত নয় এবং কল্পনাও নয় ঈশিতা, আমি বলবো নিজের উপর প্রেশার ক্রিয়েট করা বন্ধ করো।”
***
ব্যস্ত সড়কের পাশে কাশফি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে শূন্যে একদিকে চেয়ে আছে। এমতাবস্থায় কেউ যদি তার কাছ থেকে ছিনতাই করে পালায়, তবুও তার টের পেতে পেতে খানিক সময় লাগবে বোধহয়। মাথায় তার নানান চিন্তা, কে সেই হিমাদ্রী? কেনো এত রহস্য তাকে ঘিরে? কেনই বা সে এত কাছের হয়ে উঠেছিল? তবে কি কারণে নীলাম্বরীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ছিল? বিস্ট কে? কেনো তার সাহায্য করেছিলো? তার মা – চারুলতা কোথায় ছিলো? সে কি তাদের সাথে থাকতো?
কুচকুচে কালো মার্সিডিজ তার গা ঘেঁষে থামতেই এসব আকাশ কুসুম ভাবনার অন্তু ঘটে। রিয়্যাক্ট করার কোনো সময় পেলো না সে। গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে পরিপাটি হয়ে থাকা কৌশিক মির্জা বেরিয়ে এলো। তাকে দেখা মাত্রই এক দফা বিষম খেয়ে গেলো। কপালে চিন্তার ভাঁজ আর চোখে বিস্ময় নিয়েও নির্বিকার চিত্তে চেয়ে রইল কাশফি।
তাহলে কৌশিক মির্জাকে কি অফিসিয়ালি তার স্টকার বলা যায়?
ইন করা নেভি ব্লু শার্ট আর অফ হোয়াইট প্যান্ট পরিহিত কৌশিক বেশ পরিপাটি বেশভূষায় আছে। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা আর তার ফাঁকে সানগ্লাস আটকানো। সামনাসামনি দাড়িয়ে থাকায় তার হতে আগত কড়া কোলোন আর ম্যানলি ঘ্রাণ কাশফির নাকে শুড়শুড়ি দিচ্ছে যেনো। ততক্ষণে উপলব্ধি করতে দেরি হলেও কৌশিক মির্জাকে নিজের কাছাকাছি পাওয়া মাত্রই তার গলা শুকিয়ে গেলো যেনো। সরে দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত পেলো না। পরপর শোনালো কৌশিকের পুরুষালী কণ্ঠ,
“গাড়িতে উঠে বসুন কাশফি, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।”
কাশফির তৎক্ষণাৎ বিস্টের কথা মনে আসলো, এমন ডমিনেটিং আচরণ ছিলো তারও। তবে কি বিস্ট কৌশিক মির্জা? কোনো ভাবে কি কৌশিক মির্জা তার অতীত নিয়ে জড়িত? কাশফি সংশয়ী হয়ে গেলো।
“আপনি আমার পার্সোনাল ড্রাইভার না, যেভাবে এসেছি সেভাবে যেতেও পারবো আমি।”
কৌশিক নিজের মুখ অবয়ব অপরিবর্তিত রেখেই চোঁখ কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে একটা ভারী শ্বাস ফেলে। কৌশিক কণ্ঠ খাদে নামিয়ে সাবলীল ভাবে বললো,
“আপনাকে আমি সোজা কথায় বলে দেখতে চেয়েছি কাশফি, না শোনার দায় কি আপনি নিবেন?”
কাশফি ভ্রু কুঁচকে চোঁখ পিট পিট করে চেয়ে শুধালো,
“কিসের দায়?”
“আমি যদি আপনাকে কোলে তুলে গাড়িতে বসাই? তার দায়।”
কৌশিকের নির্বিকার কণ্ঠে কাশফির ঝাঁঝালো জবাব আসতে সময় নিলো না,
“আমি মা’রা’ত্বক চড় দিতে জানি।”
“আপনার একটা চড় আমার পনেরো মিনিটের ফ্রেঞ্চ কিস, Deal!”
কাশফি থতমত খেয়ে যায়। নির্বাক হয়ে চেয়ে কনফার্ম হয়ে নেয় যে, সে যা শুনেছে তাই ঠিক কিনা। পরক্ষণে বাজ খাই কণ্ঠে থেমে থেমে তো তো করে বলে,
“আপনি, আপনি এতো অসভ্য? ছিঃ!”
“চাইছি দমিয়ে রাখতে কিন্তু পাঁচ বছর পরও একজন পুরুষ মানুষ হয়ে ধৈর্য্য ধরা কঠোর পরিশ্রমের কাজ।”
***
আতিকুর রহমান ব্যালকনিতেই ছিলেন। মেয়েটা ঠিক দুপুরে ডক্টর খানের কাছে গিয়েছিল কিন্তু সন্ধ্যা নামলো এখনো ফেরেনি। তিনি স্কুল থেকে ফিরে কায়েস কে ফারাবীর বাসায় থেকে এনেছেন। তার পাশে চেয়ার ঘেঁষে কায়েস বসে বসে রঙ পেন্সিল দিয়ে যোগ করছে, পেন্সিল দিয়ে লিখতে লিখতে সে বিরক্ত। অবশ্যই বিরক্ত হওয়ার কারণ তিনি খুঁজে পান না। কারণ কায়েস পড়তে বসে সর্বোচ্চ পনেরো মিনিটের জন্য। এই নিয়ে আতিকুর রহমান যোগ আর বিয়োগ চিন্হ কোনটা সেটা বুঝাতে বুঝাতে সময় পার করেছেন, কিন্তু বাচ্চাটা বারবার যোগ করতে গিয়ে বিয়োগ আর বিয়োগ করতে গিয়ে যোগ করছে।
আজ তার পরিচিত একজনের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। সে বেশ আগে থেকেই জোভান শিকদারের বাবার সাথে কাজ করছেন। সেই থেকে তাদের ব্যাপারে বেশ ভালো কিছুই জানতে পেরেছেন। সুমন শিকদারের সাথে যতবার কথা হয়েছে ততবারই মনে হয়েছে কি আময়িক মানুষটা।
মেয়ের জন্য এত ভালো সমন্ধ এসেছে শুনে চেনা পরিচিত অনেকেই বলছে কথা আগে বাড়ানোর জন্য। কিন্তু তার তো মেয়েটাকে পড়ানোর ইচ্ছে।
“বাবা, বুবু বলেছে ওয়াটার গান আনবে। ফোন করে জিজ্ঞেস করো তো মনে আছে কিনা?”
আতিকুর রহমান চোখ গরম করে ছেলের দিকে তাকান। নিজের রক্ত না হলেও তিনি কখনো তাকে কাশফির থেকে আলাদা করেন নি।
“তোমার বুবু ওয়াটার গান নিয়ে আসলে তাকে বিনা বাক্যে বের করে দিবো।”
কায়েস ততক্ষণে মুখ কালো করে ফেলে,
“কেনো? এটা ওর বাসা!”
“পানি ধরে ভাই বোন দুটো জ্বর বাঁধবে তাই না? তোমাকেও বের করে দিবো।”
কায়েস এর ঘোর বিরোধিতা করলো। এতে আতিকুর রহমান চোঁখ পাকিয়ে আরো কিছু বলার আগেই একটা কালো গাড়ি তাদের বাসার সামনে থামতে লক্ষ্য করলেন। তিনি সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। গাড়িটি থামা মাত্রই ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে কৌশিক মির্জা বেরিয়ে আসার পরই তার ভয় গাঢ় হয়। সে ঘুরে গিয়ে অপর পাশের দরজা খুলে দেয়, পরপর হাতে ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে কাশফিকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো। আতিকুর রহমান ততক্ষণে মুখ বেজার করে নিলেন।
কায়েস বুবু বলে চিৎকার করায় কাশফি উপরে তাকানো মাত্রই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। তারপর কৌশিক মির্জাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দরজার সামনে এসে বেল চাপলো। বেলের শব্দে আতিকুর রহমান সময় নিয়ে দরজা খুললেন। ভয়ে ভয়ে থাকা কাশফি দুই হাতের তালু একসাথে ঘষে তার বাবার চোঁখে চোঁখ রাখলো,
“বাবা, কৌশিক মির্জা আর আমার মধ্যে কোনো কিছুই নেই, সে আমাকে বিরক্ত করার জন্য…”
আতিকুর রহমান হাত উপরে উঠিয়ে তাকে থামিয়ে দিলো। তিনি ইশারায় ভেতরে আসার অনুমতি দিয়ে দরজা হতে সরে দাঁড়ালেন। মিনিট খানেক অতিবাহিত হওয়ার পর রাশভারী গলায় বললেন,
“তোমার জন্য একটা ভালো পাত্র এসেছে, তোমাকে তার ভীষণ পছন্দ। ভালো ফ্যামিলির ছেলে, তার কোনো বাজে স্বভাব নেই। আমার মতে এমন পাত্র ছেড়ে দেওয়া নেহাতই বোকামি, তার নাম জোভান শিকদার। আমি চাইছি তুমি আমাকে তোমার সিদ্ধান্ত জানাও, সময় নিতে চাইলে সমস্যা নেই।”
কাশফির পাশ দিয়ে ততক্ষণে যেনো হিম শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। পিলে চমকে তার মুখ হলদে হয়ে এলো যেনো। জোভান কে নিয়ে এমন ভাবনা সে কল্পনা ও করতে পারে না। কিন্তু এমন তো নয় যে তার বাবা তাকে সন্দেহ করছে। মুহূর্তেই তার অতীতে করা ভুলের কথা মনে পড়ে যায়। তার বাবা তার খারাপ কখনোই চাইবে না। মনেমনে আওড়ালো তার বাবার বলা ইংরেজি প্রবাদটা — ‘Blood is thicker than water.’
অতঃপর সে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়,
“আসলে এসব নিয়ে কখনো ভাবিনি তবে তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো। আমার কোনো আপত্তি নেই বাবা।”
আতিকুর রহমান মেয়ের কথায় সন্তুষ্ট হলেন এবং আশ্বস্থ হয়ে কিঞ্চিৎ হেসে কেবল মাথায় হাত বুলালেন। তার পাশে মাথা তুলে দেখতে থাকা অবুঝ কায়েস হয়ত কিছুই বুঝলো না। আতিকুর রহমান তাকে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিতে বলে চলে গেলেন। এদিকে কাশফি কোনো এক অজানা কারণে চেয়েও আশ্বস্থ করতে পারছিলো না নিজেকে। সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। অজানা শঙ্কা বেড়েই চলছে তার মনের কোণে, তবুও নিজেকে বুঝ দিলো যা করছেন তার বাবা তার জন্য উত্তম কিছুই করছেন…
যতক্ষণ না অধম নিজে এসে আঁধার ছেয়ে তাকে লাল রঙে রাঙায়।
#চলবে
Author’s Note:
অনেক ক্লু রেখে বেশ বড় করে দিয়েছি। বেশী রিয়্যাক্ট আসলে পরের পর্ব লিখতে মন চায় আর কমেন্ট জানাবেন কেমন হলো।