#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৩০)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী
“তুমি যদি আরেকবার আমায় ইগনোর করো তবে আজ সত্যি আমার থেকে রেহাই পেতে মুশকিল হবে তোমার।”
আধাঘন্টা আগে কাশফির কাছে পাঠানো লাস্ট মেসেজটা দেখে কৌশিক ফোন অফ করে ডিসপ্লে উল্টে টেবিলে রাখলো। হুট করে ভীষণ রকমের অস্থির অস্থির লাগছে তার।
আজ প্রথম কোনো প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশনে বিন্দুমাত্র মনোযোগ রাখতে পারলো না কৌশিক, চিন্তায় চিন্তায় কপালে দুই আঙ্গুল ঘষছে। কাব্য খেয়াল করার সত্ত্বেও কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে কিছুক্ষণ পূর্বেও ডেটের জন্য উচ্ছ্বসিত হয়েছিল কৌশিক, বুকিং করাও শেষ কিন্তু সকাল থেকে তার কোনো মেসেজই সিন করেনি কাশফি, দুপুরের দিকে কয়েকবার কল করেছিল কিন্তু রিসিভ করেনি এখন কাশফির ফোনে কোনো কলই যাচ্ছে না, লাইনে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না জানাচ্ছে বার বার। ইচ্ছে করে ফোন অফ করে রেখেছে ভেবেই সে রেগে আগুন হয়ে আছে। বিরস মুখে মিটিংয়ের থেকে সরে আসার জন্য সে উঠে দাড়ায়,
“কিছু ব্যক্তিগত কারণে আমার আজ এই পর্যন্ত শেষ করতে হচ্ছে, কন্টিনিউ জেন্টেলম্যান।”
কৌশিক মুখ বেজার করে মিটিং থেকে সরে এসে তার অফিস কেবিনে ঢুকে পড়লো। এসির পাওয়ার কমিয়ে টাই লুজ করে দিয়ে শার্টের দুটো বাটন খুলে দিলো। অস্থিরতা বেড়ে বুকের মাঝে কেমন যেনো ধড়ফড় করতে শুরু করলো। কৌশিক এসব নিয়ে মাথা ঘামালো না লিয়ার নাম্বারে কল দিয়ে রিসিভ করার অপেক্ষা করলো,
“হ্যালো ভাইয়া।”
“তোর ভাবীকে ফোনটা দে।”
কৌশিকের গম্ভীর গলার ঝাঁঝালো কণ্ঠে লিয়া বুঝে নিলো কৌশিকের মেজাজ ভীষণ চটেছে। ঢোক গিলে সে কি বলবে না বলবে খুঁজে পায়না তৎক্ষণাৎ কৌশিকের কড়া ধমকের সুর শোনা গেলো আবার,
“কিরে? তোকে বলেছি ফোনটা গিয়ে তোর ভাবীকে দিয়ে আসতে তুই কি শুনিস নি?! আবার রিপিট করবো?!”
লিয়া ভয়ে অমতা অমতা করে বললো,
“ভাইয়া, ভাবী তো বাসায় নেই।”
কৌশিক কিছুক্ষণের জন্য মৌন রইলো, সে কী ঠিক শুনেছে কিনা যাচাই করলো বোধহয়। কানের থেকে ফোন নামিয়ে সময় দেখলো, এখন তো পড়ন্ত বিকেল প্রায়। কাশফির ড্রাইভার থেকে তো আগেই জানতে পেরেছে যে কাশফি বাসায় এসেছে তবে কি বুঝালো লিয়া। কৌশিক গমগমে সুরে বলল,
“নেই মানে? ভার্সিটি থেকে ফিরে কোথায় গিয়েছে?!”
“ভার্সিটি থেকে ফিরেছিল কিন্তু এরপর তার আর কায়েসের লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে, কোথায় গিয়েছে কিছুই জানিনা।”
কৌশিক আগুনের গোলার মতো বিস্ফোরিত হলো, কাশফির হুট করে না জানিয়ে চলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই যদি না কেউ তাকে হেনস্থা করে। তার আত্মসম্মানবোধ চরম, অন্তত কৌশিক বিশ্বাস করে যে কাশফি সাথে বাজে কিছু ঘটেছে।
“লিয়া, সত্যি করে বল ঠিক কি হয়েছে সেখানে…”
“ভাইয়া…
***
রেস্টুরেন্টের ছাদে বসে কায়েস এলোমেলোভাবে পাস্তা আর জ্যামাইকান ফ্রাইড চিকেন খাচ্ছে। জোভানের সামনে বসা অনুভূতি শুন্য কাশফি আলতো হাতে বার বার টিস্যু দিয়ে মুছে দিচ্ছে কায়েসের সস লেগে যাওয়া মুখ। জোভান তপ্ত নিশ্বাস ফেললো জিজ্ঞেস করতে ভীষণ ইতস্তত বোধ হলো তার। তবে নিরবতা প্রথমে কাশফিই ভাঙলো,
“আপনি শুধু শুধু আমাদের পিছনে সময় নষ্ট না করেই পারতেন জোভান।”
আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গিয়েছে জোভান, প্রাণবন্ত হাসিটাও দেখলো না কাশফি। না চাইতেই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে তাকে, অথচ সে তার প্রতি এখনো সদয়। মনে মনে অনুশোচনা হলো খুব।
“তুমি কল কেনো ধরো নি, ঈশিতা? আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।”
জোভানের কণ্ঠ কিছুটা ভঙ্গুর, চোখজোড়া বোধহয় ছলছল করছিল। কাশফি শুকনো ঢোক গিললো তারপর নজর আড়াল করে মিনমিনে কন্ঠে বললো,
“ভুল বুঝাবুঝির কারণে রেগে ছিলাম।”
“আমি সেদিন সত্যি তোমার জন্য এসেছিলাম।”
— জোভান থেমে গিয়ে কিছু একটা ভেবে মুখ বেজার করে নেয়। কৌশিকের দেওয়া প্রমাণ মনে পড়লেই তার ভিতর ছলাৎ করে উঠে। আবার কাশফির দিকে একনাগাড়ে চেয়ে বিরস কণ্ঠে বললো —
“হয়ত তুমি আমাকে কৃপা দেখিয়ে বিয়েতে রাজি ছিলে কিন্তু আমি সত্যিই তোমায় ভালোবেসে ছিলাম।”
নজর লুকিয়ে চুরিয়ে থাকা কাশফি অপরাধীর ন্যায় মাথা নত করে নিলো। জোভানের গলার দুর্বল স্বর শুনে তার গলা কাপছে, ভীষণ কাপছে। জেনে বুঝে তার দ্বারা এত বড় অপরাধ কি করে হলো? অন্তত সে করো অনুভূতি নিয়ে বিশ্রী রকমের খেলা খেলতে চায় নি। কখনোই না! চোখ বন্ধ করে শুকনো ঢোক গিললো সে।
“I’m sorry, জোভান। আমি সত্যিই খুব লজ্জিত, আমি ভেবেছি বাবার কথায় রাজি হয়ে আমি ঠিক জিনিস করছি।”
জোভানের রাগ জায়েজ, সে চেয়েও রাগ লুকাতে অক্ষম হলো। রাগ, দুঃখ, হতাশা মিলিয়ে জটলা পাকিয়ে প্রকাশ্য হলো,
“এটলিস্ট তুমি আমায় বলতে তো পারতে যে তুমি আমাকে পছন্দ করো না। ভালোবাসার পরিবর্তে করুণা তো আমি মোটেও চাইনি ঈশিতা।”
কাশফি থমকায় তারপর চমকে উঠলো,
“তুমি কিভাবে—”
নিজের পুরে কথা অসম্পূর্ণ রেখে দেয়, হঠাৎ চট করে মাথায় ধরে—
“কৌশিক বলেছেন এমন?”
“হয়ত তার মাধ্যমে জেনেছি তবে তোমার মুখ থেকে জানতে চাইছি এটা কি সত্যি নয়?”
কাশফির চোখ বন্ধ হয়ে এলো, হাত মুঠ করে নিয়ে আরেকদফায় বিষণ্ণ হয়ে এলো তার বদন। ভীষণ অনুতপ্ত সে কিন্তু ক্ষমা চাইবার কোনো পন্থা যে নেই তার কাছে।
“আমি ক্ষমা চাইলেও কম হয়ে যাবে, জোভান। বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে হার্ট করতে চাইনি। আমি…”
কাশফির গলায় কথার দলা পাকিয়ে যায়, চোখে জমতে দেখে জোভান থামিয়ে দিলো। এসব নিয়ে সে আর কিছুই শুনতে চায় না যত শুনবে ততই রাগ বাড়বে।
“ঈশিতা, যা চলে গিয়েছে তা নিয়ে কথা না বলাই শ্রেয়।”
কাশফি হাত বাড়িয়ে জোভানের হাতের উপর হাত রাখলো। জোভান থমকালো, এই প্রথমবার বুঝি স্বেচ্ছায় কাশফির ছোঁয়া পেলো তবে তা ক্ষনিকের জন্য। তাকে নিরাশ করে কাশফি হাত সরিয়ে নিলো তারপর মুখে হাসি রেখে বললো,
“ইউ ডিজার্ভ বেটার জোভান, আশা করি তুমি কোনো একদিন আমায় ক্ষমা করে দিবে।”
জোভান নিজের উপর নিজে হাসলো, সে বেটার ডিজার্ভ করে কিন্তু কাশফি তার সেই বেটার একজন নয়। কথা পাল্টানোর জন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে নেয় সে।
“তুমি বলো আমায়, তুমি কৌশিকের সাথে কেমন আছো?”
“ভালো।”
“লাগেজ নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলে?”
কাশফি জোর পূর্বক হেঁসে ঝট করে উত্তর দিলো,
“সামনেই আমার ছোট চাচার বাড়ি, সেখানে যাচ্ছিলাম।”
জোভান ভ্রু কুঞ্চিত করলো, কৌশিকের দায়িত্বহীনতা তার চরম অসহ্য লাগলো। আর আগে থেকে তো রাগ ছিলোই তাই আচ্ছা মতন ঝেড়ে দিলো,
“কৌশিক তোমাকে দিয়ে আসছে না? এত কিসের ব্যস্ততা তার?”
কৌশিকের নাম শোনা মাত্রই কাশফির ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। জোভানের মুখে কৌশিকের বিরুদ্ধে এমন কিছু শুনে তার মন বিষিয়ে উঠলো। দায়িত্বহীনতা আর কৌশিককে এক বাক্যে বসানো অসম্ভব কিছু। তবুও নিজের অসন্তোষ লুকিয়ে সে বললো,
“উনি অফিসে ছিলেন তাই জানাই নি।”
অবিশ্বাস্য লাগলো কাশফির এতগুলা মিথ্যে সে নিমিষেই বলে ফেললো, মুখে পর্যন্ত বাঁধলো না।
জোভান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার কিছু একটা খটকা লাগছে, কাশফির আচরণও তার কাছে খুব একটা সুবিধার ঠেকছে না।
“তুমি কি আসলেই ঠিক আছো কাশফি? কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো, I can help you.”
“আমি ঠিক আছি জোভান, থ্যাংকস বাই দ্যা ওয়ে।”
কাশফির কথায় সে ধরে নিলো কাশফি কথা বাড়াতে অনিচ্ছুক। তবুও সে আরেকবার তাকে সাহায্যের হাত বাড়িতে জিজ্ঞেস করলো।
“যদি তুমি চাও আমি তোমাদের ড্রপ করে দিয়ে আসতে পারি।”
“ইটস ওকে জোভান, আমি ক্যাব বুক করে দিয়েছি। আমরা চলে যেতে পারবো কোনো সমস্যা হবে না।”
— কাশফি ইশারা করে বিল নিয়ে আসতে বললো তারপর জোভানের দিকে ফিরে একটা বন্ধুসুলভ হাসি হেসে নরম গলায় বললো,
“লাইফ কখনো কারো জন্যই থেমে থাকে না, এখন ক্ষনিকের জন্য কষ্ট পাচ্ছ কিন্তু সৃষ্টিকর্তার প্ল্যান হয়ত আরো ভালো কিছু। নিজের খেয়াল রেখো আমি উঠছি।”
ওয়েটার টেবিলে বিল নিয়ে আসলে কাশফি বিল দেওয়ার পূর্বেই জোভান বিল পরিশোধ করলো,
“আমি থাকতে তোমার বিল দেওয়ার প্রয়োজন নেই ঈশিতা।”
কায়েসকে নিয়ে কাশফি বিদায় জানিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে নেমে পড়লো। ম্লান হাসলো জোভান, দুই চোখ কাশফির যাওয়ার পথে নিবন্ধিত। সব কিছু ভুলে যাওয়া কি এতো সহজ? হয়ত।
“তুমিও নিজের খেয়াল রেখো ঈশিতা, বিদায়।”
***
কাশফি ফ্রেশ হয়ে এসে বসলো বিছানায়, আর বিছানার শুয়ে শুয়ে নানান রকমের উল্টোপাল্টা ছড়া আওড়াচ্ছে কায়েস। কাশফি হাই তুললো, সারাদিনের ধকলে তার শরীর প্রচুর ক্লান্ত। তারপর সে এগিয়ে গিয়ে কায়েস কে বললো,
“গায়ে ধুলো বালি জমেছে, চল ফ্রেশ হতে হবে।”
কায়েস প্রথমে বাহানাবাজি করলো কিন্তু কাশফি টেনে কোলে তুলে নিয়ে চললো।
“আচ্ছা বুবু দে’হ ব্য’ব’সা মানে কি?”
কাশফির থমকে দাড়ায়, গায়ে অজস্র হুল ফুটলো যেন। সে বিস্মিত চোখে কায়েসের নির্মল মুখের দিকে চায়। তারপর কড়া কণ্ঠে ধমক দিয়ে বললো,
“ভালো মানুষদের এসব বলতে নেই। আর যেনো কোনো দিন এই শব্দ মুখে না শুনি!”
“তাহলে ওরা কেনো বললো? ওরা কি পঁচা?”
কাশফির গলায় বিশাল পাথর বাঁধলো যেন। সে কোনো উত্তর না দিয়ে কায়েস কে বাথরুমের নিয়ে গেলো। হাত মুখ ধুয়ে টাওয়াল দিয়ে মোছানোর পর সে কায়েসের কপালে চুমু দিয়ে বললো,
“আজ যা হয়েছে তা ভুলে যাবি। ওরা যেমনই হোক ওদের মতো থাকুক, তুই ভালো তো দুনিয়া ভালো।”
কায়েস মনোযোগ দিয়ে শুনে বুঝদারের মতো মাথা নাড়ায়। কিছু কিছু জিনিস ভুলে বাঁচতে ক্ষতি নেই। যেমন কৌশিক মির্জা, তাকে ভুলতে সময় লাগবে তবে ভুলে যাবে, হয়ত। কাশফি নিশ্চয়তা দিতে পারলো না।
কিছুক্ষণ পর রুমে নক করলো কেউ, ঘড়ির কাঁটায় নয়টা বেজে পার হতে দেখে ভাবলো ডিনার নিয়ে এসেছে। সে দরজা খুলে দাড়িয়ে অনড় হয়ে রয়।
তৎক্ষণাৎ প্রাণহীন ক্লান্ত একজোড়া ধূসর চোখের তির্যক দৃষ্টিতে আটকা পড়লো সে। দরজার অপর পাশে উষ্কখুষ্ক চুলে, ভাঁজ নষ্ট হয়ে আসা শার্ট পরে, ক্লান্ত মুখশ্রী নিয়ে দাড়িয়ে আছে কৌশিক। কৌশিকের আলুখালু অবস্থা দেখে বিস্মিত কাশফির বুকের ভিতর নিঙ্গড়ে উঠলো, বুকের বাম পাশে সূক্ষ্ম ব্যাথা অনুভব করলো। সে তো লুকিয়ে চুরিয়ে এসেছে তবে কৌশিক তার কাছে পৌঁছালো কি করে?
কাশফিকে দেখা মাত্রই নিমিষে কৌশিকের সব ক্লান্ততা মুছে গিয়ে মুখশ্রী ক্রোধান্মত্ত হয়ে উঠলো। দুই কদমের দূরত্ব ঘুচিয়ে কাশফির কাছে পৌঁছাবে তার পূর্বেই আতঙ্কিত কাশফি ধরাম করে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়।
“ওপেন দ্যা ফাকিং ডোর, কাশফি!”
কৌশিকের ভয়ঙ্কর গর্জনে কাশফির আত্মা কেঁপে উঠলো, কৌশিককে নিজের কিংবা কায়েসের শব্দ না শুনতে দেওয়ার জন্য মুখে আঙ্গুল তুলে কায়েসের দিকে ইশারা করলো চুপ থাকার জন্য। কৌশিক দুই একবার দরজায় ঘুষি, লাথি মেরে তাকে খোলার জন্য হুমকি দিলো।
কৌশিক আরেক দফায় হুংকার ছুড়লো,
“আমার থেকে পালানোর অনেক সাহস না তোমার, কাশফি? তাহলে লুকিয়ে কেনো আছো। এক্ষুনি বের হয়ে আসো!”
প্রতুত্তরে কাশফি কিছুই বললো না, ভয়ে ভয়ে অপেক্ষায় রইলো কৌশিক কবে প্রস্থান করবে সে ক্ষণের। এদিকে কৌশিক নাছোড় বান্দা, জ্বলন্ত উল্কা পিণ্ডের মতো আগুনের গোলা ছুঁড়ছে অনবরত।
“আরেকবার ওয়ার্ন করছি, যদি তুমি না খোলো তবে আমি অন্য উপায়ে ভিতরে আসছি।”
কৌশিক কাশফির জবাবের অপেক্ষা করলো কিন্তু কাশফির কোনো উত্তর এলো না। হতাশা আর রাগে গজগজ করে ফেটে পড়ার উপক্রম তার, তৎক্ষণাৎ লেভিন ম্যানেজার থেকে রুমের অতিরিক্ত চাবি নিয়ে হাজির হয়। কৌশিক চাবি দিয়ে খুলে রুমে প্রবেশ করেতে গেলে কাশফি দরজায় চাপ প্রয়োগ করে ঠেলে ধরলো। এই চাপ কৌশিকের কাছে পিঁপড়ার সমতুল্য মনে হলো। সে নিমিষেই দরজা হালকা ফাঁক করে জুতো পরা পা প্রবেশ করালো, এদিকে কাশফি কৌশিকের জুতা দেখে আরো জোর লাগালো কিন্তু কৌশিক অনায়াসে ঢুকে পড়লো অবশেষে।
কৌশিকের গায়ের অত্যধিক জোরে কাশফি সরে গিয়ে কিছুটা দূরে হটলো। কৌশিক ভাবলেশহীন পকেটে হাত দিয়ে কাশফির সম্মুখে এসে দাড়িয়ে তার হা হয়ে থাকা মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে দেখে নেয়। তারপর তার বামে দাড়ানো গার্ড কে ইশারা করে কায়েসকে নিয়ে যেতে বললো। ঘাবড়ে গিয়ে কাশফি কৌশিকের উদ্দ্যেশে কিছু বলবে তার পূর্বেই কৌশিকের ক্রুদ্ধ কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হলো,
“চুপ, একদম চুপ!”
কৌশিকের হিংস্র চাউনি আর রাগের প্রকোপ উপলব্ধি করে কাশফির প্রতিবাদ গলায় আটকে গেলো। মৌন রয়ে ভয়ার্ত মুখে কেবল দেখে গেলো কিভাবে বুঝিয়ে ভুলিয়ে গার্ডটা কায়েসকে কোলে তুলে নিয়ে যায়। সাথে আরেকজন এগিয়ে গিয়ে তার লাগেজ দুটো নিয়ে নিয়ে প্রস্থান করলো।
লেভিন কৌশিকের কানের কাছে এসে কিছু একটা বলে বাকি পাঁচ জন গার্ড নিয়ে দরজা আটকে বাইরে বেরিয়ে গেলো। রুমে রইলো কেবল ভীতিগ্রস্ত কাশফি আর শিকারীর মতো নজরে চেয়ে থাকা ক্ষিপ্ত কৌশিক।
“আমি ম্যানেজারের সাথে কথা বলবো, কৌশিক পথ ছাড়ুন।”
কাশফির ভয়ার্ত কন্ঠে কৌশিক যেনো আরো আগুন।
“আজ কুকুরের মতো দৌড়ের উপর রেখেছ আমায়। তোমাকে না পেয়ে আমার ভিতর কি চলছিল সেই খবর কী রেখেছো?”
“কৌশিক প্লিজ —”
বাকি কথাটুকু শোনার ইচ্ছে হল না কৌশিকের, উন্মাদের মতো ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে কাশফীকে দেওয়ালে চেপে ধরলো। চিৎকার করে আবার প্রশ্ন করলো,
“১৯৬ বার কল দিয়েছি তোমায়, ইচ্ছে করে কি ফোন ধরো নি?!”
কাশফি প্রতুত্তরে কেঁপে উঠলো কেবল, নিজেকে শক্ত রাখার ঢের চেষ্টা করলো কিন্তু অক্ষম হলো বারবার। তবুও হার না মেনে চোখ নামিয়ে কৌশিকের চোখের আড়াল থেকেই ধরা গলায় বললো,
“ধরার কোনো কারণ ছিল না কৌশিক। আমাদের মাঝের ক্লাস ডিফারেন্স কি আপনার চোখে পড়ে না?!”
কৌশিকের মেজাজ বেজায় তুঙ্গে, বিস্ফোরিত নয়নে উগ্র কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
“ক্লাস ডিফারেন্স— সেটা কোত্থেকে এলো?!”
“এক্সাক্টলি, আপনি এলিট সোসাইটির একজন মানুষ আর আমি মিডেল ক্লাস।”
“I don’t fúcking care.”
কাশফি শক্ত করে চোখ বন্ধ করে নেয়, তার নিশ্বাসের উঠানামা বেগতিক। কৌশিকের পুরুষালি দেহের উষ্ণতা তার দেহ ছুঁই ছুঁই, দুটো শরীর কেবল কাপড় দ্বারা পৃথক হয়ে আছে। কৌশিকের এতো কাছে পেয়ে নিজেকে মাতাল মনে হলো কাশফির। ড্রাগ এডিক্টের মতো সে স্বামীর শরীর হয়ে আসা কোলন, ঘামের গন্ধ আর পুরুষালি মাস্কি ঘ্রাণের মিশ্রণ নাকে টেনে নেয়।
পরক্ষণে নিজেকে ধাতস্থ করে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
“কিন্তু মানুষ তো ঠিকই আমার দিকে আঙ্গুল তুলে প্রশ্ন করবে।”
“যে আঙ্গুল তুলবে তার হাত আমি আলাদা করে ফেলবো।”
“কৌশিক, আমি আমার চরিত্রে কোনো দিন দাগ লাগতে দিই নি কিন্তু এখন আপনার জন্য মানুষ আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এবার তফাৎ বুঝলেন?!”
কৌশিকের রাগ কমলো না তরতর করে বেড়ে চললো সে চোয়াল শক্ত করে বজ্র কণ্ঠে জানালো,
“তোমাকে যে যাই বলুক না কেন তোমার প্রয়োজন ছিল আমাকে জানানোর। আমি যে মুখ তোমার অপমান করেছে সে মু’খ ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দিতাম।”
“কয় জনের মুখ বন্ধ করবেন আপনি কৌশিক?”
“যতজন তোমার বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলবে ততজনের।”
“এসব সম্ভব না, আমার কাধে আমার বাবা আমার ভাইয়ের দায়িত্ব আছে আর আপনার বাড়ির পরিবেশ আমার ভাইয়ের জন্য উপযুক্ত না।” — কাশফি থামলো তারপর ঠোঁট কামড়ে ধীর শব্দে আবার বললো —
“আমি আপনার সাথে আমার ভবিষ্যত দেখতে পাই না কৌশিক।”
কিন্তু কাশফির নাজুক সত্তা তার কথাটার ঘোর বিরোধিতা করলো। একথা সম্পূর্ন মিথ্যে দাবি করলো। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো সে, এতটা দুর্বল নিজেকে ভাবতেই অবাক লাগলো তার।
“আমার হাত আকড়ে ধরে রাখো কাশফি তবেই ভবিষ্যত দেখতে পাবে।”
কৌশিক কাশফির ইন্সিকিউরিটি বুঝতে পারলো। তাই নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় কাশফির মুখের দিকে মুখ বাড়িয়ে নাকে নাক লাগালো, এক হাতে কাশফির নরম গাল ধরে অন্য হাত তার কোমরের খাঁজে রেখে গলা নামিয়ে তীব্র অধিকারবোধ নিয়ে বললো,
“ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ কিংবা অধিকার কোনোটাই আমি তোমাকে দিচ্ছি না — দিবো না।”
কাশফি নিজের মনোযোগ ক্ষুণ্ন হতে দিলো না তবে কৌশিকের হাত তার কোমরে বিচরণ করছে সেটাও উপেক্ষা করতে পারলো না। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেকে যথা সাধ্য শক্ত রেখে দৃঢ় কণ্ঠে জানালো,
“আমার জন্য আমার সেলফ রেস্পেক্ট বড় তাই আমি আপনার সাথে মির্জা বাড়িতে ফিরছি না।”
“যেখানে তোমার অপমান হয়েছে সেখানে তোমাকে ফিরতে হবে না। তুমি শুধূ আমার হাত ধরে চলো, তোমাকে রাজ্য আর সিংহাসন দেওয়ার দায়িত্ব আমার।”
কাশফি স্তব্ধ হয়ে পড়ে, মানুষটা নিজে, তার কণ্ঠ আর তার প্রতিটা শব্দ প্রেমে পড়ার মতো। তার পেটের ভিতর হাজার হাজার রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলে উড়োউড়ি করতে লাগলো। আগত কৌশিকের ঘ্রাণ তার শ্বাস প্রশ্বাসে মিশে একাকার।
“বিশ্বাস করো আমায়?”
কাশফি সরাসরি কৌশিকের চোখে চোখ রাখলো, কৌশিকের মুখে অকপটভাব, বেশ সিরিয়াস সে। কাশফি নিমিষেই গলে গেলো যেনো, চাতক পাখির মতো কিছুক্ষণ কৌশিকের দিকে একনাগাড়ে চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ, এক যুগ পর দেখা হলো যেন। আর যাই হোক কৌশিক মির্জা নামক তুফান এই মন থেকে ধুয়ে, মুছে কিংবা তুলে ফেলা অসাধ্যকর।
অতপর কাশফি মেনে নিলো, খুবই হালকাভাবে মাথা নেড়ে কৌশিকের সাথে যাওয়ার জন্য রাজি হওয়া মাত্রই কৌশিক কাশফিকে চট করে কোলে তুলে তার কোমল অধর নিজের ওষ্ঠাধরের মাঝে চেপে, টেনে ধরলো।
কাশফির উরুদ্বয় কৌশিকের শক্ত পেটানো কোমরে জড়ানো।
তার মেয়েলী নমনীয় অধরে দাঁতের আঁচড়ে শিরশিরানি অনুভূতি হলো পরক্ষণে প্রবল বেগে জিভের আদ্র স্পর্শে মাতোয়ারা হয়ে উঠলো। বলিষ্ঠ অবাধ্য হাত জোড়ার বিচরণ চললো তার সর্বাঙ্গে, প্রতিটা ভাজে। ঘণ্টার পর ঘন্টা কৌশিক থেকে আড়াল থেকে ব্যাকুল হয়ে উঠে কাশফিও। নিজেকে সপে দিতে বিলম্ব করলো না।
“You taste divine, Kashfi. My sweetest sin.”
কৌশিক উন্মাদের মতো অধর ছেড়ে ফতুয়ার বোতাম এক টানে খুলে ফেলে এলোপাথাড়ি নাক ঘষলো গলায়, মোহ আচ্ছন্ন হয়ে সুরসুর করে চেরি ব্লোসোমের ঘ্রাণ এলো নাকে, সম্পূর্ণ কাবু হয়ে পড়লো কৌশিক। তার শক্তিধর চুমুতে সিক্ত হলো কাশফির গলা, বক্ষস্থল, উরোজ। ধূসর চোখের স্পষ্টত কামুক দৃষ্টি ফেলে ব্যক্তিগত নারীর ত্বকে নিজের করা লালাভ আবরণে ঢের সন্তুষ্ট হয়।
“I think I’m badly enamoured of you.”
কৌশিকের নিচু স্বরের হাস্কি কণ্ঠে প্রগাঢ় উত্তেজনা, কাশফি রুদ্ধশ্বাস হয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো কিন্তু কৌশিক তার বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কাশফির দাঁত থেকে ঠোঁট টেনে নিয়ে বললো,
“আমার কাজ আমায় করতে দাও।”
আরেকটা প্যাশনেট চুমুর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রনহারা দুজন, একে অপরের মাঝে ডুবে আরেক ধাপ এগিয়ে গেলো। তাদের ভার ছেড়ে দিলো বিছানা, একজোড়া শক্ত বাহু তার কোমর প্যাচিয়ে আলিঙ্গন করে নিলো তার ধরে চুমুতে সিক্ত করে দুই কায়া একে অপরের মাঝে মিশে একাকার।
হঠাৎ দরজায় শক্ত হাতের ঠকঠক শব্দ শুনে অর্ধনগ্ন কাশফির উপর থাকা কৌশিক রুষ্ট হলো। লেভিনের উল্টোপাল্টা টাইমিং দেখে মেজাজ খারাপ হলো। সে তাকালো রুদ্ধশ্বাস হয়ে বিমূঢ় বনে থাকা কাশফির দিকে। সে কাশফিকে অনিচ্ছাকৃত টেনে তুলে ফতুয়া গায়ে জড়িয়ে নিয়ে কাশফির লালাভ ঠোঁটে শক্ত একটা চুমু বসিয়ে দিলো। তারপর কড়া ভাষায় নির্দেশসূচক জানিয়ে দিলো,
“We are not done yet, wife.”
কাশফির লাজ গাল হয়ে গলা আর কান ছুঁয়েছে। সুবিধাবাদী কৌশিক সুযোগ বুঝে কানের লতিতে কামড়ে ফিসফিস করে রুক্ষ স্বরে বললো,
“একা পাই তোমায় তারপর বাকি অসম্পূর্ণ কাজটুকু সেরে ছাড়বো ইনশ’আল্লাহ।”
কাশফির কান দিয়ে দিয়ে ধোয়া বের হয়ে লজ্জায় ঝা ঝা করলো। আড়ষ্ট হয়ে সে উঠে দাড়িয়ে পড়লো, এদিকে কৌশিক শার্ট ইন করে দরজা খুলে দাড়ালো।
মুখে হাসি নিয়ে লেভিন বললো — “সরি টু ডিস্টার্ব ইউ বস।” তারপর সে কৌশিকের দিকে বাড়িয়ে একটা পেন ড্রাইভ দিলো।
কৌশিক বিরস মুখে পেনড্রাইভ নিয়ে গাড়ি রেডি করে রাখতে বলে তারপর কাশফির কোমর ধরে টেনে তার সঙ্গে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো দুজন। হোটেল ছেড়ে গাড়ি চলতে শুরু করলো।
কিছুক্ষণ আগের কথা ভেবে লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাওয়া কাশফি পাশাপাশি বসে থাকা কৌশিকের দিকে অবিশ্বাস্য নজরে দেখে, কাশফির গা ঘেষে বসা কৌশিক গাড়ি তে উঠেই কানে ইয়ারপডস গুঁজে ল্যাপটপের স্ক্রিনে কিছু একটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। কৌশিকের কর্ম ব্যস্ততা দেখে কাশফি যেনো বোকা বনে গেলো অথচ কিছুক্ষণ আগে কিনা কা মুকতার উত্তাপে দগ্ধ হয়েছিল দুজন আর এখন কি করে সে এতটা নিরুদ্বেগ হয়ে আছে? কই কাশফি তো এমন হতে পারছে না।
কৌশিকের নজর অনড়, চোয়াল শক্ত, মনোযোগ অক্ষুণ্ন। মাঝে মাঝে সে হাত মুষ্টিমেয় করছে। তার এতো গভীর মনোযোগ কিসের প্রতি তা আড়চোখে দেখে নিলো কাশফি তবে ল্যাপটপ স্ক্রিনে দুপুরের ঘটনার ফুটেজ দেখে কাশফি স্তব্ধ হয়ে গেল। ভাবলো এসব কৌশিক কেনো দেখছে? কাশফি কৌশিকের দিকে ভালো করে তাকিয়েও কিছুই বুঝতে পারলো না। নিজের চিন্তা চেতনা আড়াল করে রেখেছে কৌশিক মির্জা।
গাড়ি থামলো মির্জা বাড়ির সামনে, কাশফি ভ্রু কুঁচকে নেয়। কৌশিকের কিছুই বোধগম্য হলো না তার। সে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি ফেলে কৌশিকের দিকে,
“আমাকে এখানে কেনো এনেছেন?”
কৌশিক কাশফির কপালে চুমু দিয়ে উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে গম্ভীর স্বরে বলল,
“তুমি গাড়িতে বসো, আমি আসছি।”
তারপর কৌশিক নেমে হনহনিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। গাড়িতে কাশফিকে একা রেখে ড্রাইভার আর লেভিন নেমে গাড়ির কাছেই দাড়ালো। বেশ কিছুক্ষণ পরও কৌশিক বেরিয়ে এলো না। কাশফির মন আরো উতলা হয়ে উঠলো। কেনো কৌশিকের কোনো সাড়া শব্দ নেই? তার কাছে শান্ত কৌশিক থেকে রাগান্বিত কৌশিক ঢের ভালো লাগে। অন্তত সে রাগান্বিত কৌশিকের রাগ আন্দাজ করতে জানে কিন্তু শান্ত কৌশিক মৃগতৃষ্ণার মতো।
হুট করে একটা তীক্ষ্ম চিৎকারের শব্দ কানে এলো তার, সে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে উচ্চস্বরে লেভিন কে ডাকলো, সিগারেট ধরে দাড়ানো লেভিন পাশ ফিরে কাশফির দিকে চেয়ে এক ভ্রু উচু করলো।
“মাত্রই ভিতর থেকে চিৎকারের আওয়াজ শোনা গিয়েছে।”
“তো?”
লেভিনের দায়িত্বহিনের মতো কাণ্ডে কাশফি ভরকে গেল।
“তো মানে কি? আপনার গিয়ে দেখার দরকার!”
“কেউ মরুক বাঁচুক তাতে আমার কি?”
কাশফি পুরোপুরি বেকুব বনে গেলো যেনো,
“আপনি কি আমাকে দায়িত্বহীনতা দেখাচ্ছেন?”
“আমার দায়িত্ব এখন আপনাকে দেখে রাখা যা আমি একনিষ্ঠ হয়ে করছি।”
কাশফি সাফ সাফ বুঝতে পারলো কেনো কৌশিকের রাইট হ্যান্ড লেভিন কারণ উভয়ই একই ক্যাটাগরির লোক, তারছেড়া।
“কিন্তু, এতক্ষণ হলো কৌশিক বের হচ্ছে না কেনো তা তো জানা দরকার!”
“কুল ডাউন, ম্যাডাম। বস ঠিকাছে।”
কপাল চাপড়ালো কাশফি তারপর বিরক্ত হয়ে গাড়ির দরজা খুলে বললো,
“আপনাকে কিছু বলাই সময় নষ্ট, আমিই নামছি।”
কাশফি নেমে গিয়ে বেশ দ্বিধা নিয়ে হেঁটে আসলো। দরজার কাছাকাছি আসতেই কৌশিকের ক্ষুব্ধ কণ্ঠ শুনতে পেলো,
“আপনি কাপুরুষ ছিলেন চাচা তাই আপনার বউ এতগুলো জীবন নষ্ট করার সত্ত্বেও আপনি কিছুই করতে পারেননি।”
কৌশিকের এমন কথায় সে স্তব্ধ হয়ে গেলো, এবার দ্রুত পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পুরোপুরি থমকে গেলো। পুরো দৃশ্য আবার নিজ চোখে দেখে নিমিষেই তার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। ভাবতে পারেনি এই মুহূর্তে ঠিক পাঁচ বছর আগের কৌশিকের ভয়ানক রূপ আবার দেখতে পাবে,
নিষ্ঠুর, নির্দয়, নির্মম।
The cold blooded brutal murderer Koushik Mirza.
পাঁচ বছর আগের কথা ভাবতেই তার গা গুলিয়ে আসলো, তখন তার বয়স ১৯ বছর ছিল আর এখন ২৪। এত লম্বা সময় পেরিয়েও সেদিনের কথা সে আজও ভুলতে পারে নি।
কৌশিকের দুজন গার্ড অনামিকা আর মালতীর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে, টেবিলে কৌশিকের চাচা থ মেরে বসে আছেন যেনো তিনি অবিশ্বাস্য কিছু দেখেছেন আর মাধবী অশ্রু মুখে কৌশিকের কাছে মিনতি করছে।
কৌশিক করো কোনো কথা কানেই তুললো না, সে তার গার্ডের হাত থেকে কেরোসিন নিয়ে নিচে ফেলে রাখা দামী দামী ব্র্যান্ডের ব্যাগ, ড্রেস, শাড়ি, এক্সপেনসিভ সব এন্টিক জুয়েলারির উপর ছড়িয়ে দিলো তারপর পকেট থেকে লাইটার নিয়ে এসব দামী জিনিসের উপর ছুড়ে ফেললো। মুহূর্তেই দাউ দাউ করে আগুনে জ্বলতে শুরু করলো জিনিস গুলো আর শোনা গেলো মাধবীর চিৎকার। মাধবীর চোখের সামনে সকল দামী শখের জিনিস পুড়তে লাগলো আগুনে। জ্বলন্ত আগুন অতি দ্রুত গ্রাস করে নিলো সব কিছু।
“চাচা, বাড়ি যেহেতু আমার তাই সিদ্ধান্তও একান্ত আমার হওয়া উচিত, তাছাড়া আমার ওয়াইফ এই বাড়িতে থাকতে অনিচ্ছুক তাই আমি কালই এই বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছি, এসব নিচু ক্লাসের প’তি’তা’দের আমার বাড়িতে জায়গা নেই। কালকের মধ্যে আমি এই বাড়ি খালি চাই। আপনার যদি যথেষ্ঠ অর্থ থাকে তবে আপনি আমার এস্টেট ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।”
কৌশিকের গলার স্বর শান্ত তবে চোখে মুখে হিংস্রতা। তার চোখ জোড়ায় প্রশান্তির চাপ, আগুনে জ্বলন্ত সব জিনিসের দিকে দৃষ্টি রেখে মাধবীর দিকে চেয়ে হুংকার ছুড়ে বলে,
“আমার মা তোমার মতো নিচু মহিলার জন্য সারা জীবন সাফার করেছেন। আমার মায়ের পর মিসেস কৌশিক মির্জা আমার সব আর তাই তুমি আমার ওয়াইফ কেও আঘাত করলে।”
কৌশিক এবার মাথা ফিরিয়ে অনামিকার সামনে দাড়িয়ে একটা ক্রুর হাসি হাসলো,
“তোর মতো হাই ক্লাস প্র/স্টি/টি/উ/টের সাহস কি করে হয় আমার ওয়াইফের গায়ে হাত তোলার? হুম?”
তারপর সে চওড়া গলায় তার গার্ড কে অর্ডার করলো ‘তার হাত ভেঙে গুড়িয়ে দাও যাতে মৃ/ত্যুর আগ পর্যন্ত চরম শিক্ষা হয়ে থাকে।’
কাশফি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লো। সে চায় না কৌশিক করো খুন করুক তাই এসব আর মেনে নিলো না, কৌশিক কে থামানোর জন্য পা এগোবে তার আগেই লেভিন তার সামনে এসে পথ রুখে দাঁড়ায়,
“বসকে থামানো এখন অসম্ভব মিসেস মির্জা।”
“তাহলে আপনি তো আর থামাবেন না।”
“আমি আগেও বলেছি আমার নির্দেশ ছিল আপনাকে দেখে রাখা আর কিছু না।”
“আপনি সামনে থেকে সরে দাঁড়ান লেভিন, It’s an order.”
লেভিন চোয়াল শক্ত করে চোখ ছোট করে নেয় কিন্তু সরলো না। কাশফি হতাশ হয়ে কৌশিকের দিকে আরেকবার তাকালো কিন্তু কৌশিক যে নিজের আগুনে নিজে জ্বলছে, কাশফিকে দেখার সময় কই…
কিন্তু কাশফি তো একটা স্টেবল লাইফ চায়, যেখানে তার ভবিষ্যত দেখতে সুন্দর হবে কিন্তু কৌশিকের এমন রূপ সে মানতে নারাজ। তার শান্তিময় জীবনে খুন খারাপি সে কখনো চায় নি। আর দেরি না করে সে চিৎকার করে কৌশিক কে ডাকলো,
“কৌশিক এমন করবেন না, প্লিজ।”
কৌশিক থমকে গেলো, তারপর মাথা পাশ ফিরিয়ে বিস্ফোরিত নয়নে কাশফিকে চায়। কপালের রগ ফুলে ফেঁপে আছে, চোয়াল শক্ত, রাগে তার হিতাহিত জ্ঞান শুন্য। লেভিনের দিকে চেয়ে সে রুষ্ট কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো,
“লেভিন, তোমাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম তাকে এখানে না নিয়ে আসতে।”
লেভিন কিছু বলার আগে কাশফি বলে উঠলো ‘ তার কোনো দোষ নেই, আমি লেভিনের কথা শুনিনি’
সে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে মনে ঢের সাহস জুটিয়ে কৌশিক কে ডিস্ট্রাক্ট করার চেষ্টা করলো। তাই কৌশিকের কাছে এগিয়ে গিয়ে নরম কণ্ঠে বোঝালো,
“কৌশিক প্লিজ এভাবে অকারণে করো খুন করবেন না, প্লিজ।”
“অকারণ?! তোমাকে অপমান করেছে কাশফি মানে আমাকে অপমান করেছে, আমি কি করে তাকে ছেড়ে দিই?”
কৌশিকের গর্জনে কাশফির গলা শুকিয়ে গেলো তবুও সে দমলো না। কৌশিক যেভাবে তাকে কথার মাধ্যমে কাবু করে ঠিক সেভাবে কাবু করার চেষ্টা করলো।
“আমার কথা শুনুন কৌশিক, আমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে চলুন, কায়েস আমাদের অপেক্ষা করছে। আপনিই তো বললেন আমাদের এখানে থাকতে হবে না। এসব করে নিজের কাঁধের পাপের বোঝা নিবেন না প্লিজ।”
“Are you worried about me, Sunshine?”
কাশফি মাথা নেড়ে তাকে হুট করেই জড়িয়ে ধরলো তারপর মিনমিনে কণ্ঠে জানালো ‘অনেক’
কৌশিকের তৃপ্তি অনুভব হলো, তার বুকের আগুনের দগ্ধ উত্তাপের পরিবর্তে ঠান্ডা ধরনের প্রশান্তি অনুভব করলো। উত্তপ্ত লাভার মতো রাগ তার সেতো কবেই গলে পানি হয়ে গিয়েছে বেমালুম কৌশিক।
কাশফি শার্ট ধরে টেনে আবার আকুল অনুরোধ জানালো বাসায় নিয়ে যেতে। কৌশিক স্তম্ভিত হয়ে গেলো। বাসা? তবে কাশফি কি তার সাথে নিজেকে দেখতে চাইছে?! তার সাথে ভবিষ্যত দেখতে ইচ্ছুক কাশফি? কৌশিক মাথার মাথার উপর শক্ত চুমু দিয়ে কাশফির পিঠে হাত রেখে গার্ডদের নির্দেশ দিলো তাদের ছেড়ে দিতে। তারপর কাশফিকে বুকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো,
“কাশফি, যেদিন আমার হাত ছেড়ে দিবে সেদিন জানে মেরে ফেলব তোমায়, এরপর নিজে ম’রে যাবো।”
#চলবে…
Note: ৩৮২৫+ শব্দ ব্যবহার করেছি। রিয়েক্ট দিয়ে মন্তব্য করবেন অবশ্যই আর বিভিন্ন গ্রুপে গল্পটা শেয়ার করতে ভুলবেন না।