#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী
২৩. (অতীত)
মাথার উপর শ্রাবণের কালো মেঘ, আকাশের তীব্র গর্জন শেষে সকাল হতেই নেমেছিল এই ঘন বর্ষা। বৃষ্টি পুরো পুরি থামেনি এখনো তবে এই বিকেল হতে হতে কিছুটা কমেছে। যদিও এই সময় বেলা বুঝবার জো নেই। চারিপাশে ভিজে মাটির মনোমুগ্ধকর ঘ্রাণ, কাদা কাদা হয়ে আছে মাটি। বর্ষণে নাকি গাছ পালা প্রাণ ফিরে পায় তবে সবুজের মাঝে এ কেমন বিষণ্ণতা? এই উদাস প্রকৃতিতে গায়ে হিম ধরা বাতাস বইছে খনে খনে।
সামনে ছোট্ট কবরটার পাশে বেলি ফুলের গাছ লাগানো, ফুল আসতে আসতে এখনো বোধহয় অনেক সময়! তার ভাইটা হওয়ার আগে তার মায়ের বেলি ফুলের ঘ্রাণের প্রতি তীব্র আকর্ষণ হয়েছিল বলেই ছোট্ট নীলাম্বরী কবরটার পাশে বেলির চারা রোপণ করে ছিলো। এখন না তার ভাই আছে আর না মা আছে বলে মনে হয়, এই সম্মোধন সে ভুলতে চলেছে— হয়ত ভুলেই গিয়েছে। আপাদত গাছটার আশেপাশে এখন পানি জমে আছে।
টুইটুম্বর বিকেলে হেঁটে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে নীলাম্বরী, থাকার জায়গা পরিবর্তন করেছে মাস খানেক আগে। যদিও আসার সময় বার বার পিছনে ফিরে চেয়েছিল। কেনো যেনো বার বার মনে হচ্ছিলো কেউ তার পিছু নিয়েছিল তখন…
তার গায়ের হলুদ জামাটা তার শরীর অস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। এমন জুবুথুবু অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছে বেশ অনেক্ষণ ধরেই ভিজছে সে। যেই কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়েছে সেই কদম গাছ বেয়ে টুপটুপ করে পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার কপাল, কদমতলার ফোঁটাটুকু বেয়ে কপাল ছুঁয়ে নেমে গেলো তার গলা হয়ে। নীলাম্বরীর লোম দাঁড়িয়ে গেলো, সারা শরীরে শির শির অনুভুতি হলো ঠান্ডায় তবুও সে অনড় হয়ে রইলো। সকালে তার বাবা বেরিয়েছিলো আজ ফিরবে বলে মনে হয় না। যাওয়ার সময় তার বাবার সাথে কিছু বাক্য আদান প্রদান হয়েছিল কেবল।
সকাল প্রায় নয়টা, দুজন টেবিলের দুই মাথায় বসে নাস্তা সারছিলো তখনই তার বাবা অর্ধেক নাস্তা সেরে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে নেয়। পানির গ্লাসের অর্ধেক পানি খেয়ে দাড়িয়ে পড়লেন, ততক্ষণে নীলাম্বরীর মনোযোগ তার বাবার দিকে।
“তুমি কোথাও যাচ্ছো, বাবা?”
“বাবা একটু কাজে বের হচ্ছি, আসতে সময় লাগতে পারে।”
নীলাম্বরী শব্দ করে প্লেটের উপর চামচ রেখে তার বাবার দিকে অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল। তার বাবা কোথায় কি কাজে বেরোচ্ছে সে খুবই ভালো করে জানে। ঘোর আপত্তির সত্বেও নিজের কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে সে বললো,
“ডাক্তাররা আশা ভরসা দিতে পারছে না বাবা, তাহলে তুমি কেনো এসব করছো?! মানুষটা বিছানায় মেশিনের মাধ্যমে পড়ে আছে শুধু…”
তার বাবা তাকে বাক্য সমাপ্ত করার সুযোগ না দিয়ে মেয়েকে নরম আদুরে স্বরে বোঝালেন,
“মনোবল জোর রাখা খারাপ কিছু না আর এসব বলতে নেই, যতই হোক তোমার মা হয় উনি!”
তখন কামিনী টেবিলের খালি প্লেট গুলো নিয়ে যেতে এসেছিলো, সেও জানে এটা নীলাম্বরীর বাবার জন্য কতটা সেনসেটিভ টপিক তাই নীলাম্বরীকে ইশারায় কথা বন্ধ রাখার জন্য কড়া নির্দেশ দিলেন। তবে নীলাম্বরী অমান্য করে। সে চোয়াল শক্ত করে নেয়,
“উনি আমার মা হওয়া অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে বাবা, আমি তাকে আমার কোনো স্মৃতিতেই খুঁজে পাই না।”
নীলাম্বরীর কথায় তিনি তির্যক দৃষ্টি ফেললেন, বোঝাই যাচ্ছে এমন কথা তিনি বেশ অপছন্দ করেছেন। নীলাম্বরীর ডিফেন্ড করে কামিনী এগিয়ে এসে কিছু বলবে তার আগেই হাত উচু করে তিনি কামিনীকে থামিয়ে দিলেন। পরক্ষণে বেশ কয়েকবার ভারী নিশ্বাস ফেলে কিছুটা কঠোর হলেন এবার।
“তুমি চাইলেই তোমার জেনেটিক স্ট্রাকচার বলদাতে পারো না, যখন তোমার মা আমাদের মাঝে ছিলেন তখন সকল দ্বায়িত্ব নিখুঁত ভাবে পালন করেছিলেন।”
নিখুঁত শব্দটা শুনে নীলাম্বরী চোঁখ বড় বড় করে উড়িয়ে দেওয়ার মতো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। তার মা কখনো আট দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক ছিলো না। মানসিক ভাবেও তাকে অসুস্থ বলা চলে। নিজেকে দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়ে নীলাম্বরী গলা উচুঁ করে কর্কশ স্বরে বললো,
“উনি তো আমাদের কারো পরোয়া করেননি যখন___”
তিনি আর না শুনতে চেয়ে নীলাম্বরী কে থামিয়ে দিয়ে কড়া ভাষা শোনালেন,
“আমি আর বাকিটুকু অনিচ্ছুক। নাস্তাটা শেষ করে নাও, আমি উঠছি।”
কথাটুকু বলা মাত্রই তিনি মেয়ের প্রতি নরম হয়ে যান আবার। মেয়ের মাথায় হাত রেখে কপালে চুমু খেয়েই নিরবে বিদায় নেন। চমকপ্রদ হয়ে অশ্রু ভরা চোখে নীলাম্বরী শুধু তার বাবার দিকে চেয়ে রইলো। একটা জড় বস্তুর পিছনে সময় ব্যায় করতে করতে তিনি তার মেয়েটাকে সময় দিতে ব্যার্থ হচ্ছেন। অথচ তার বাবা জানেন ই না যে সে তার চোখের সামনে তার ছোট ভাইটার নির্মম মৃত্যু এখনো মেনে নিতে পারেনি।
নীলাম্বরী হয়ত তার মায়ের মতো, প্যাথেটিক। হয়ত তার জীবনের সময় গুলোও মধুর হতে পারতো যদি তিনি আত্মকেন্দ্রিক না হতেন। আসাড় হয়ে থাকা নীলাম্বরীর কর্ণিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো, পরপর আরেক ফোঁটা…
এতখানি সময় ধরে ভিজে জবজবে সে। অতিরিক্ত ভেজার কারণে চোখ লাল হয়ে আছে, নাকে অসহনীয় পিট পিট করছে তবুও তোয়াক্কা না করে সে নাক টানলো। হাতে থাকা ছোট কাচের কৌটা টা নিচে রেখে মাটির দিকে হাত বাড়িয়ে ছোট ছোট করে মাটি উঠিয়ে গর্ত খুঁড়তে লাগলো। নিপুণ হাতে অতি মনোযোগ সহকারে মাটি খুড়ার কাজ করলো সে। মোটামুটি ছোট খাটো একটা গর্ত খুড়া শেষে সে ছোট কাচের কৌটার দিকে চেয়ে রইলো। ভিতরে তার জমানো কিছু কাগজের পাখি, সেই কাগজ গুলোয় হিমাদ্রীর সাথে বন্ধুত্বের শুরু থেকে অন্ত অব্দি যতবার সাক্ষাৎ হয়েছিল ততবার নিয়ে তার এক লাইন অনুভূতি লিখা।
এগুলো এখন বড়ই মূল্যহীন!
তবে কাঁচের কৌটায় একটা নীল রঙের খাম ভরা, সেই খামের দিকে নীলাম্বরী অনুভূতি শূন্য হয়ে চেয়ে রইল। দু হাত ভরে মাটি তুলে ধীরে ধীরে কাঁচের কৌটাটা চাপা দিয়ে ঢেকে দিলো। কাজ শেষ হওয়া মাত্রই কর্দমাক্ত হাত জামাই মুছে নিলো। বেলা গড়িয়েছে সাথে বৃষ্টিও বেড়েছে মনে হয়। সে মাথা উচু করে আকাশের দিকে চেয়ে কয়েক ফোটা পানি উপলব্ধি করলো। অতঃপর ফিরে যেতে পা বাড়ালো, তবে যেতে যেতে খামে টানা ইতি কথা শেষ বারের মতো মনে মনে আওরালো—
“শিক্ষা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ হিমাদ্রী, যদি পরবর্তীতে কখনো দেখা হয় তবে আমরা আর বন্ধু পরিচয় নিয়ে নয় কেবল পারিবারিক শত্রুর পরিচয় দিয়ে দেখা করবো।
ইতি,
কাশফি।”
শেষ বারের মতো হিমাদ্রীর চিঠিতে নীলাম্বরী লিখার অদম্য ইচ্ছে চাপিয়ে সমাপ্তি টানলো সে।
মাস খানেক আগে ভিলা ছেড়ে অন্য শহরে অবস্থিত তার বাবার এই ফার্মহাউসে এসেছিলো তারা। শহরটা ঠান্ডা রকমের, আগেরটার তুলনার কিছুটা কোলাহল মুক্ত, শান্তিপ্রিয়। এখানকার বেশির ভাগ লোকদের জীবনযাপন বর্ণনায় গ্রামীণ জীবন যাপনের মতোই বলা যায়। এই উচু ভূমিতে বেশ কয়েকটা টিলা দেখেছিলো সে, এছাড়া পাহাড়ি গাছগাছালি আর ফলমূলও আছে শুনেছে। এতে অবশ্যই নীলাম্বরীর কোনো আপত্তি নেই, থাকলেও সে আপত্তি রাখে না। তবে ইদানিং বাজে ধরনের অনুভূতি হয় তার, রাস্তায় বের হলেই মনে হয় কেউ চেয়ে আছে, খুবই প্রখর ভাবে। এই যে বৃষ্টির মাঝে এলোমেলো হয়ে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছে এখনো মনে হচ্ছে কেউ তার পিছু নিয়েছে। তবে প্রতিদিনের মতোই সে ভাবলো কে তার পিছু নিবে? তাই নিছকই ভ্রম বলে উড়িয়ে দিলো সে।
যতক্ষনে সে বাসার গেইটের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে ততক্ষণে বৃষ্টি প্রায় থেমে গিয়েছে, অন্ধকার নেমে চারপাশে মাগরিবের আযান শোনা যাচ্ছে। তাদের প্রতিবেশী একজন বৃদ্ধা মহিলা, যার কোনো সন্তান সন্ততি নেই— থাকলেও মায়ের খেয়াল রাখেনি এমন। তার স্বামী বোধহয় ভালো পরিমাণ সম্পদ তার নামে লিখে গিয়েছেন, তাই শুয়ে বসে খেলেই দিন চলে যায়।
নীলাম্বরী মহিলাটা কে দেখা মাত্র হাসি অফার করলো বিপরীতে বৃদ্ধাও হাসলেন। সে স্বাভাবিক ভাবে গেইটে কোড চেপে গেইট খুলে ভিতরে ঢুকে এলো। প্রথমত গেইটে কোনো গার্ড না দেখতে পেয়েই বিচলিত সে। পরক্ষণে নামাজ পড়তে গিয়েছে তা ভেবে নেয়।
নীলাম্বরী গেইট পেরিয়ে আসতেই অদূরের আধারে কিছু সন্দিহান উপলব্ধি করলো। চোখ ছোট ছোট করে স্পষ্ট কালো কিছু দেখতে পেয়ে থমকে দাড়ায়। মনে সাহস জুটিয়ে এক পা দুই পা করে এগিয়ে যেতেই দেখলো গায়ে গার্ডের পোশাক, লোকটা উপর হয়ে পড়ে আছে। সে একবার দুই বার ডেকে সাড়া না পাওয়ায় লোকটার গায়ে হাত রেখে একটু ঝুঁকে দেখতেই আতকে উঠলো। তাকিয়ে তার পা রক্তের ওপর টের পেয়ে জমে গেলো যেনো!
গার্ডের বুকের বুলেটের আঘাত হতে এখনো রক্ত বের হচ্ছে শুধু জমিনে পড়ে আছে তার নিথর দেহ।
হতবম্ব নীলাম্বরী মুখে হাত দিয়ে তার চিতকার চেপে ধরলো, তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। চোঁখ ভরা অশ্রু নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেখান থেকে সরে দাড়াতেই আরো একটি নিথর দেহ একই রকম উপুড় অবস্থায় মাটিতে দেখতে পেলো। নীলাম্বরীর গা গুলিয়ে এলো, দুর হতে নাকে রক্তের গন্ধ এলো। কোনো রকম নিঃশব্দে বাসার নিকট অব্দি যেতে যেতে সে আরো কয়েকটা লাশ পড়ে থাকতে দেখলো। চোখে ভয় নিয়ে সে ঝোপের আড়ালে হেঁটে হেঁটে বাসার সামনে উকি দিয়ে একটা ধূসর রঙের গাড়ি দেখতে পেলো। নাম্বার প্লেট দেখে কিছুক্ষণ সূক্ষ্ম নজরে পরখ করতেই তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো,
মনে পড়ে গেলো পিচ ঢালা রাস্তায় মিশে যাওয়া তার সাত মাসের ভাইয়ের কথা, তার মায়ের ছি’লে থেত’লে যাওয়া দেহ, সেই নির্মম দিনের কথা!
সেদিন হিতাহিত জ্ঞান শুন্য হওয়ার আগে উপলব্ধি করতে পেরেছিল সেই গাড়িটার ধূসর রঙের টয়োটা গাড়ি ছিল, স্পষ্টত দেখেছিলো নাম্বার প্লেট যা তার সামনে থাকা গাড়িটার অনুরূপ!
00062783B
নীলাম্বরীর সারা দেহ কাঁপতে কাঁপতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে বারবার। তার মাথা ফাকা ফাকা মনে হচ্ছে। কে সে? যে তার পরিবারের সুখ কেড়ে নিয়েছিলো?! আতঙ্কিত নীলাম্বরী আসেপাশে চোঁখ বুলিয়ে একটা নিথর দেহ দেখা মাত্রই সেটার পকেট হাতিয়ে ফোন বের করে আনে। পরপর কম্পিত হাতে একটা নাম্বার ডায়াল করে ফোন লাগায়, প্রথম কয়েকবার রিং হওয়ায় নীলাম্বরী অধৈর্য্য হয়ে পড়লো। মনে মনে প্রার্থনা করলো যেনো তার বাবা ফোন উঠায়, শেষবার রিং হতেই কল রিসিভ করে ওপর পাশ থেকে শোনালো,
“কাদের, এই সময় কল কেনো করেছো? বাসায় কোনো ঝামেলা হয়েছে কি?”
নীলাম্বরী কাপা কাপা স্বরে “বাবা” বলে থেমে যায়, আবার ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে বললো — “কাদের কে মেরে ফেলেছে, সবাইকে মেরে ফেলেছে বাবা!”
নীলাম্বরীর বাবা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিলেন অনেক বড় বিপদ হয়েছে, কেননা বাড়িতে তিনি বার বার কল করেছিলেন কিন্তু রিসিভ হচ্ছিলো না। তিনি গাড়িতেই ছিলেন বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন তবে তার মেয়ের কথা কানে আসা মাত্রই তিনি আতঙ্কিত হয়ে গেলেন। তবুও নীলাম্বরী কে কিছু বুঝতে না দিয়ে বললেন শান্ত হতে,
“তুমি কি বাসার বাইরে?”
নীলাম্বরী ভয়ে ভয়ে ‘হ্যাঁ’ বললো। তিনি শুকনো ঢোক গিলে মেয়েকে বুঝিয়ে বললেন,
“বাবা আসছি তোমার কাছে, খুব দ্রুতই আসছি। তুমি যথাসম্ভব লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করো। ঠিক আছে?”
তার কথা শেষ হওয়া মাত্রই ফোনের ওপর পাশ থেকে গুলির শব্দ শোনা গেলো, তৎক্ষণাৎ তার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। তার মেয়েটা ঠিক আছে তো? এর পরপরই ফোনটা কেটে যায়, তিনি নীলাম্বরী কে আবার কল করতে গেলেই সংযোগ সম্ভব হচ্ছে না শুনতে পান।
এদিকে গুলির শব্দে নীলাম্বরীর হাত থেকে ফোনটা মাটিতে পড়ে গিয়ে বন্ধ হয়ে পড়েছে। সে দ্রুত ফোনটা নিচে থেকে তুলে চেক করতে লাগলো তার আগেই একজন মহিলার চিৎকারের শব্দ ভেসে আসলো। নীলাম্বরীর বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা আর কেউ নয় ছোট মা মানে কামিনীর কন্ঠ। তার বুকের ভিতর অসহনীয় ধড়ফড় আরম্ভ হলো, অতঙ্ক জেঁকে বসলো। এক দৌড়ে বাসায় প্রবেশ করে স্টাফদের লাশ পড়ে থাকতে দেখেও নিজেকে যথা সম্ভব সামাল দিয়ে নেয়। এত রক্ত দেখে তার ভীষণ বমি পাচ্ছে। সে গুটি গুটি পায়ে প্রথমে রান্নাঘর তারপর কামিনীর ঘরটা দেখে নিলো। তাকে কোথাও না পেয়ে উপরের তলায় নিজের রুমটায় পা বাড়ালো…
দ্বিতীয় তলায় পা রাখতেই কামিনীর গোঙানির শব্দ আরো স্পষ্ট হলো। শব্দটা শুনে এতো অমনোযোগী হয়ে উঠেছিলো যে সে সামনে কাউকে লক্ষ্য করলো না। সে রুমে প্রবেশ করার পূর্বেই কর্কশ স্বরে কেউ যেনো ডাকলো তাকে— “মায়াহরিণী!”
তৎক্ষণাৎ নীলাম্বরীর শিরদাঁড়া সোজা হয়ে আসে, এটা ঠিক কোনো অভিশপ্ত নামের মতন। এক ফোঁটা ঘাম তার কপাল বয়ে নামলো, পরপর গায়ে হুলের মতো কাঁটা ফুটলো। ভেজা শরীর অনেকখানি শুকিয়েছিলো প্রায় তবে এখন আবার ঘাম ছেড়েছে। জুতোর ঠক ঠক শব্দ শোনা মাত্রই বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। সে মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই তার অনিষ্ঠকারীকে দেখতে পেলো।
লোকটা Lean রকমের, লম্বা চওড়া তবে কিছুটা ঝুঁকে থাকে, শক্ত চোয়াল, মোটামুটি পেশল শরীর। লোকটার একজোড়া শ্যাওলা রঙের চোঁখ তার দিকে প্রখর ভাবে চেয়ে আছে, তার হাতে ব’ন্দু’ক। চোখে মুখে অলুক্ষণে —সিনিস্টার একটা হাসি ঝোলানো, ঠিক যেনো নরক থেকে সদ্য পৃথিবীতে এই শয়তানের প্রবেশ হয়েছে! তবে এই চেহারা এক প্রকার চেনা, পরিচিত নীলাম্বরীর মানে কাশফির কাছে।
নীলাম্বরী মূর্তির মতো দাড়িয়ে রইলো,
এদিকে লোকটা মাথা কাত করে সশব্দে হেঁসে আবার আগের সন্মোধনে ডাকলো! ডেকে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলে ততক্ষণে নীলাম্বরীর টনক নড়লো যেনো। সে শুকনো ঢোক গিলে দৌড়ে রুমে প্রবেশ করে দরজার হাতল ঘুরিয়ে লক করে দিলো। লোকটা দ্রুত গতিতে দৌড়ে আসলো তবে নীলাম্বরী তার আগেই রুমে এসে পড়েছিলো। সে ‘মায়াহরিণী’ বলে বার বার চেচালো আর লাথি দিয়ে দরজা ভাঙার চেষ্টা করলো কিন্তু নীলাম্বরী মুখ চেপে কান্না করতে করতে দরজা ধরেই দাড়িয়ে রইলো। বহু কষ্টে কাপা কাপা পায়ে দরজা থেকে সরে সে দৌড় দিয়ে কামিনীর কাছে এসে পড়লো।
কামিনী নিচে পড়ে আছে, সে এখন আর গোঙাচ্ছে না, তার নিশ্বাসও কমে এসেছে। নীলাম্বরী গলায় কান্নার দলা পাকিয়েছে তবুও সে ভাঙ্গা স্বরে কামিনী কে ডাকলো কিন্তু কোনো রেসপন্স এলো না। এদিকে দরজার বাইরে হতে আবার বিদঘুটে সেই শব্দ এলো,
“তুমি কিন্তু ভালো করছো না মায়াহরিণী!”
নীলাম্বরীর তনুমণ কেঁপে উঠল, সে মুখ চেপে অশ্রুর বাধ ছাড়লো। আতঙ্কে তার সারা দেহ কাঁপছে, ভয়ে মুখ থেকে শব্দ বের হলো না। মস্তিষ্কে এখনো লোকটার প্রতিচ্ছবি জলজ্যান্ত হয়ে ভাসছে। সে মনে করতে চায়না লোকটার ছবি, সে দেখতে অনেকটা কৌশিক মির্জার অবয়ব যেনো!
নীলাম্বরী ততক্ষণে মাথার চুল খামচে ধরে চোঁখ বুঝে নেয়, মনে মনে প্রার্থনা করলো যেনো এই স্বপ্ন ভেঙে যাক। আর পারছে না সে নিতে!
নীলাম্বরী তার ড্রায়ার থেকে ছোট্ট ফোনটা বের করে ইমারজেন্সি নাম্বার ডায়াল করলো কিন্তু কোনো নেটওয়ার্ক পেলো না। হতাশ আর ভয়ে সে এবার শব্দ করে কাঁদলো কিছুক্ষণ, এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ মৃত এখন। কেনো লোকটা এমন করেছে? কিসের শত্রুতা নীলাম্বরী কিছুই জানে না!
নীলাম্বরী চোঁখ মুখ মুছে কামিনী কে সোজা করে নিলো তারপর অদক্ষ হাতে তার পেটের গুলি বের করে নিলো। রক্ত দেখে তার দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে সে তার তিনটা ওড়না নিয়ে কামিনীর পেটে ভালো করে বাঁধতে লাগলো, অন্তত রক্তক্ষরণ কিছুটা হলেও কমবে। ততক্ষণে বাইরে থেকে লোকটার জুতোর শব্দ আর এলো না।
নীলাম্বরী এট্যাচড বাথরুমে ঢুকে ভালো করে হাত ধুয়ে নিলো। তারপর বেরিয়ে এসে সে হাঁটু বুকে জড়িয়ে ধরে কামিনীর পাশে এসে বসলো। হাত বাড়িয়ে আবার পালস চেক করলো, হার্ট রেট অনেক কমে এসেছে। এখনই কামিনীকে দ্রুতই হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন। তার বাবা কতটুকুই বা এসেছে সে কিছুই জানে না। এভাবে আধা ঘণ্টা চলে গেলো নীলাম্বরী একই রকম ভাবে বসে রইলো। চোখে মুখে অশ্রু আর বৃষ্টির ফোঁটা লেপ্টে একাকার!
সে উঠে গিয়ে জানালার বাইরে চোঁখ রাখলো, তার অশ্রু থেমে নেই। অদো কি কেউ তাদের বাঁচাতে আসবে?
ততক্ষণে কিসের শব্দ হলো যেনো, তবে অমনোযোগী নীলাম্বরী বোধহয় শুনেও শুনলো না। পরক্ষণে দরজার হাতল ঘোরানোর শব্দ শোনা মাত্রই তার শিরদাঁড়া বেয়ে হিম শীতল শিহরণ বেয়ে গেলো। কক্ষে ঠক ঠক জুতোর শব্দ শুনে মাথা ঘুরে এলো যেনো তার। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পিছনে ফিরে লোকটার দেখা মিললো, ওই শ্যাওলা রঙের চোখ জোড়ায় যেনো সকল অশুভ শক্তি নিহিত রয়েছে।
সে ভাবলো দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকে পড়বে কিন্তু তার আগেই লোকটা তার হাত ধরে কাছে টেনে নিলো। তৎক্ষণাৎ সে ছুটে যাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করলো, তার নখ দিয়ে লোকটার মুখে আঁচড় দিলো এতে লোকটা ক্ষিপ্ত হয়ে তার হাত দুটো পিছনে চেপে ধরে তার চোয়াল লোকটার হাতে শক্ত করে ধরলো। এই বিদঘুটে শ্যাওলা রঙের চোঁখ জোড়া দিয়ে যেনো তাকে সাবাড় করে ফেলবে। নীলাম্বরী ভাঙ্গা স্বরে তাকে ছেড়ে দেওয়ার আকুল আবেদন জানালো কিন্তু লোকটা শুনলো না বরং তার দিকে ঝুঁকে বিশ্রী ভাবে হেঁসে ভয়ঙ্কর কণ্ঠে বললো,
“মায়াহরিণী তুমি বড্ড জা’লিয়েছো!”
নিজের তীক্ষ্ণ একটা আর্তনাদ আর কান্না ভেসে এলো কানে, লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর। তারপর তার শরীর যেনো অবশ হয়ে এলো, কতক্ষনের জন্য সে অনুভূতিহীন হয়ে ছিলো জানা নেই। শরীরে লোকটার হাতের উপস্থিতি পেলো তবে চোখে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না। চেয়েও কিছু বলতে পারলো না।
সে কি মা’রা গিয়েছে?!
ম’রে গিয়ে হয়ত ভালোই করেছে।
নীলাম্বরী একটা ভারী নিশ্বাস ফেলে, এরপর অন্ধকারে সপে দেয় নিজেকে। কানে শেষ একটা কথা ভেসে এলো কেবল,
“বাবা চলে এসেছি, কাশফি। আর ভয় নেই।”
***
কৌশিক মির্জা নিজের কেবিনে বসে ইন্টারকমে তার এসিস্ট্যান্টের সাথে কথা বলে শেষ করার পর পরই তার ফোন হাতে নিয়ে কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে কল করে, কিছুক্ষন পর কল রিসিভ করা মাত্রই কৌশিক মির্জা বললো,
“গত সপ্তাহে কোম্পানি যে প্রজেক্ট লঞ্চ করেছিলো তার দায়িত্বে যে ছিলো তার ফুল ডিটেইলস চাই।”
এই বলেই সে তৎক্ষণাৎ ফোন কেটে দেয়। ফোনে ভাইব্রেট করে দিগন্তের আপকামিং মেসেজ শো করলো,
“হাবিব কে তোমার বেজমেন্টে রেখে এসেছি, গত সপ্তাহের শিপিং থেকে কিছু বড় বড় অস্ত্র আর দামী জিনিস সে সরিয়েছিলো।”
কৌশিক মির্জা ওয়েস্ট কোট আর শার্ট ঠিকঠাক করে, চেয়ার থেকে সুটটা হাতে নিয়ে বের হবে এর আগেই ইন্টারকম বেজে উঠলো। কৌশিক মির্জা চোঁখ মুখ শক্ত করে কানে ধরতেই রিসিপশনিস্টের মেয়েলী কন্ঠ কানে এলো,
“স্যার একজন আমাদের প্রচুর বিরক্ত করছে আর বলছে আপনার সাথে সাক্ষাৎ না করা ছাড়া সে বের হবে না।”
কৌশিক মির্জা বিরক্ত ছিলো, এমন হেঁয়ালি কথা শুনে রেগে ফেটে পড়ার উপক্রম যেনো। সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
“এসব নতুন কি? তোমাকে কি আমি ঘণ্টায় ঘণ্টায় কে আপয়েন্টম্যান্ট ছাড়া এসেছে না এসেছে সেটা বলার জন্য রেখেছি?!”
মেয়েটা ভয় পেলো বোধহয় সে কাপা কাপা স্বরে আবার বললো,
“স্যার তিনি মহিলা, নাম কাশফি বলছেন।”
কৌশিকের মেয়েটাকে আচ্ছা মতন ঝাড়ি দিতে ইচ্ছে করলো কিন্তু কাশফির নাম শোনা মাত্রই সে স্তম্ভিত আর নিশ্চুপ হয়ে গেলো। কপাল কুঁচকে ভাবতে নেয়, এই সময় কাশফি এখানে কি করছে?! সে তৎক্ষণাৎ নিজেকে শান্ত হতে উপলব্ধি করলো, কণ্ঠ গম্ভীর রেখে বললো,
“ম্যাডাম কে আসতে দাও।”
রিসিপশনিস্ট থ হয়ে গেলো বোধহয় তাই লাইন কাটার শব্দ ও কানে পৌঁছালো না। ততক্ষণে কাশফি কত নাম্বার ফ্লোর জেনে নিয়ে লিফটে উঠে পড়লো।
কান থেকে ইন্টারকম রেখে কৌশিক সুটটা আবার চেয়ারের উপর রেখে দেয়। ফোন হাতে নিয়ে দিগন্তের উদ্দ্যেশ্যে টাইপ করলো,
“কাজে ফেঁসে গেছি তুই না হয় হাবিবের বন্দোবস্ত কর।”
কৌশিক হাতের ফাইলটা খুলে চোঁখ বুলালো, তার হাঁটু অনবরত নাড়িয়ে যাচ্ছে তবে ভিতর ভিতর কাশফির দেখা মিলার অধীর অপেক্ষায় সে। দুই মিনিটের মাথায় কাঁচের দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো, কৌশিক ফাইল থেকে মাথা তুলে চাইলো না সে তো কেবল কাশফির বাক্য বিনিময়ের অপেক্ষায়। ম্যাডামের হুট করেই আগমনের কারণ তার বুঝে আসলো না ঠিক।
কাশফি ক্ষিপ্র গতিতে কৌশিকের হাতের ফাইল টেনে নিচে ছুড়ে ফেলে, চোয়াল শক্ত করে চোঁখ বড় বড় করে দাত কড়মড় করে বললো—
“কবে থেকে চিনেন আমায়? কেনো আমার পিছনে পড়ে আছেন?!”
কৌশিক প্রথমে তির্যক দৃষ্টিতে চাইলেও পরে নির্বিঘ্নে শ্রাগ করে জানালো,
“আমি আপনাকে পছন্দ করি কাশফি, ইটস আল নিউরোট্রানসমিটার এন্ড ডোপামিন।”
কাশফি এমনিতেই রেগে ছিলো কালকের স্বপ্ন নিয়ে তার উপর এমন ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কথায় ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা আরো বিরক্ত লাগছে তার। সে টেবিলের উপর এক হাত রেখে কিছুটা ঝুঁকে আঙ্গুল তুলে চেচালো,
“ইউ আর ফাকড আপ! ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা একদমই করবেন না!!”
কৌশিকের দৃষ্টি ততক্ষণে তার মুখ হতে তার হাতে এলো, তার এক হাতে নখের আঁচড় বসে জখম হয়ে আছে। কৌশিক চোঁখ কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে পরখ করা শেষে খট করে তার হাত ধরে নেয়,
“এটার মানে কি?”
কাশফি তার হাতের নখের আঁচড়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো। দুঃস্বপ্ন শেষে রাত চারটায় যখন তার ঘুম ভেঙে যায় তখন নিজের অনেকটুকু ক্ষতি সাধন করে ফেলেছিলো সে। বাবার করা সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঔষুধটাও খেতে ভুলে গিয়েছিলো। কৌশিকের প্রখর দৃষ্টি এখনো তার উপরে হওয়ায় সে অমতা অমতা করে বলে,
“None of your business.”
“I’m taking it as my business.”
কৌশিকের গম্ভীর স্বর ডমিনেটিং স্বরে পরিবর্তিত হওয়া মাত্রই কাশফি ভ্রু কুঁচকে ফেলে।
“এমন অভিনয় কেনো করছেন?”
“কেমন অভিনয়?”
“Like you care…”
কৌশিক কাশফি কে কিছু বলেনা। তার ইন্টারকম প্রেস করে কানে দিয়ে বললো— “এন্টিসেপ্টিক আর ফার্স্ট এইড নিয়ে আমার কেবিনে নিয়ে আসো।”
সে ফোন কান থেকে নামানোর পরপরই একজন পুরুষ এসিস্ট্যান্ট এসে ফার্স্ট এইড আর এন্টিসেপটিক দিয়ে চলে যায়। কাশফি হতবম্ব হয়ে দেখলো শুধু কৌশিক তার হাতে ডিসইনফ্যাক্ট করার জন্য স্প্রে নিবে তার আগেই কাশফি টেনে তার হাত সরিয়ে নেয়।
“আমি আপনার পেশেন্ট না কৌশিক! আপনার কাছে উত্তর চাইতে এসেছি, জবাব দিলেই আমার কাজ শেষ।”
কৌশিক যেনো কাশফির কথা কানেই নিলো না। তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললো,
“বসুন কাশফি, আমি সব উত্তর দেবো।”
“আমাকে কাশফি নামে ডাকবেন না।”
“বউ হয়ে যান মিসেস মির্জা বলে ডাকবো।”
কথায় কথায় লজ্জায় ফেলে দেওয়ার জন্য কাশফি চোঁখ বাঁকা করে তাকিয়ে মিন মিন করে কৌশিকে গালি দিলো বোধহয়। সবাই ঈশিতা ডাকতে পারলে সে কেনো কাশফি বলে সম্মোধন করে তাকে? কৌশিক দেখেও না দেখার ভান করে কাশফিকে বসতে বললো, তারপর সে কাশফির হাতটা নিয়ে ডিসইনফ্যাক্ট করার জন্য স্প্রে করলো। আস্তে আস্তে ক্ষতটুকু তুলো দিয়ে পরিষ্কার করে ক্রিমের পাতলা প্রলেপ লাগিয়ে দিলো।
কাশফি এতক্ষণ যেনো শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো, কৌশিকের কাজ শেষ হওয়া মাত্রই গমগমে সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“এবার বলুন আপনি আমাকে আগে থেকে চেনেন বলেই কি আমার পিছনে কোনো উদ্দ্যেশ্য নিয়ে পড়ে আছেন?”
কৌশিক অবিশ্বাস্য নজর রেখে হালকা হাসলো,
“তুমি এসব নিজে থেকেই অনুমান করে আমাকে স্বীকার করতে বলছো?”
“সোজা সুজি কথা বলুন কৌশিক।”
কৌশিক হাত দুটো একত্র করে মুষ্টিতে পুরে তার থুতনির নিচে রাখলো, এরপর ভারী নিশ্বাস ফেলে কাশফির দিকে এক নাগাড়ে চাইলো। কেন জানি কাশফি তার নির্জীব চোখে আটকে গেলো, হাজার চেষ্টা করেও সে এই ছাই রঙের চোঁখ আর শেওলা রঙের চোখের কোনো মিল খুঁজে পেলো না। কৌশিকের গড়ন মাস্কিউলিন বলা যায়, তার মুখ দেখে অনুভূতি বোঝার দায়। কৌশিক সর্বদা নিজের আইস কোল্ড সেলফ আর স্টোন ফেইস মেইনটেইন করে চলে। তীক্ষ্ণ চোয়াল, পরিপাটি ধরনের মানুষ সে। তবে শেওলা চোখের লোকটা আর কৌশিক কিভাবে এক হলো?
হতে পারে তার কল্পনা শুধুই?
এতো বিদঘুটে জিনিস তার কল্পনা হতে পারে ভাবতেই পারেনা। নিজের শরীরে অন্যকরো হাত ভাবতেই তার গা গুলিয়ে আসছে।
“পাঁচ বছর আগে যদি আপনার অস্তিত্ব আমার নজরে আসতো তবে আমি কখনো আপনাকে আমার অগোচরে হতে দিতাম না, কাশফি।”
কৌশিকের কথা তার কাছে যুক্তি যুক্ত মনে হলো। কথা শেষ হওয়া মাত্রই কাশফি মাথা নেড়ে উঠে দাড়ায়, কেবিন ত্যাগ করার আগে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়,
“আমার থেকে দূরে থাকবেন কৌশিক, প্লিজ!”
কৌশিক এক নাগাড়ে তার প্রস্থানের দিকে চেয়ে রইলো। যেই গতিতে কেবিনে প্রবেশ করেছিল সেই গতিতে প্রস্থান ও করেছে সে।
“সম্ভব হবে না, কাশফি।“
***
মুখ ভার করে কাশফি বাসায় পৌঁছেই মানুষ জনের আনাগোনা শুনতে পেলো, তার বাবা হেঁসে হেসে কথা বলছেন করো সাথে। সে ভিতরে ঢুকে প্রথমেই বসার রুমে নতুন কিছু মুখ দেখতে পেলো সাথে জোভান শিকদারের দেখা ও মিললো। বুঝতে বাকি রইলো না যে, তার বিয়ের কথা পাকাপাকি করা হচ্ছে হয়ত। জোভান তার দিকে চাওয়া মাত্রই হাসলো, তবে বিপরীতে কাশফি হাসতে অক্ষম হলো, কিছু বলতেও পারলো না।
তার গলায় যেন অদৃশ্য কোনো পাথর আটকে আছে। এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না।
সে সালাম দিয়ে হাসার চেষ্টা করলো, তার বাবা এগিয়ে এসে বললেন,
“ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে জোভানের সাথে কথা বলে নিও। তোমাদের বিয়ে হতে চলছে তাই ফ্রি হলেই ভালো হয়।”
কাশফির চেহারার রঙ ততক্ষণে উড়ে গিয়েছে, সে সম্পূর্ন মূর্তি মানব বনে গিয়েছে যেনো। তবুও মাথা নেড়ে সে আর কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজের কামরার উদ্দ্যেশে হাঁটতে শুরু করলো।
#চলবে…
পর্ব বড় করে তাড়াতাড়ি দিয়েছি, তাই রিয়্যাক্ট আর কমেন্ট করে জানাবেন কিন্তু❤️