অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১১) #লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী ১১. (Edited)

0
66

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১১)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

১১. (Edited)
(অতীত)
সময়কাল — ২৫ অক্টোবর, ২০১৯ [যখন পাঁচ বছর পূর্বে কৌশিকের সাথে কাশফির প্রথম সাক্ষাৎ হয়।]

“মির্জাদের অট্টালিকা হতে কিছুটা দূরে শ্যাওলা পুকুরে পাওয়া যায় ভাসমান পঁচা লাশ।
একসময় বাড়িটায় জমিদার থাকতেন পরবর্তীতে স্বপরিবারে বিলেতে পাড়ি জমান। একশত বছরের বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত বাড়িটায় মানুষের আনাগোনা ছিল না, কিন্তু কিছুদিন হতে আগত দুর্গন্ধে দুর্বিষহ হয়ে পরেছিলো আসেপাশের এলাকায় বসবাসরত মানুষজন এবং পথচারীরা। আজ ভোরে স্থানীয় একজন সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখতে পান পুকুরের পানিতে ভাসমান পঁ’চা লা’শ। খবর দেওয়া হলে সকালে উদ্ধার কর্মী এসে শ্যাওলা পুকুর থেকে তিনটা ফুলে ফেঁপে ওঠা ভাসমান লা’শ উদ্ধার করেন। ম’য়’না ত’দ’ন্ত করে জানা গিয়েছে শ্বাস রোধের ফলে মৃত্যু ঘটেছে। এছাড়া শরীরে ক্ষত এবং একাধিক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। ঘটনা মেয়র কায়েফ মির্জার কানে পৌঁছালে তিনি যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়ে আসামীদের দ্রুত চিহ্নিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন বলে জানিয়েছেন। আরো থাকছে বিস্তারিত…”

কাশফি বিরক্ত হয়ে চ্যানেল পাল্টে নেয়, গরম চায়ের মগে ধোয়া উড়িয়ে এক চুমুক দেয়। মির্জাদের এসব খবর আর নতুন কি? তাদের ক্ষমতা আছে তাই তারা এসব তিনবেলার খাবারের মতো নিয়মমাফিক করে। কাশফির রাগ হয় তবে ভয়ে কিছুই করতে পারে না। তাদের বিরুদ্ধে একটা শব্দ উচ্চারণ করলেই তার পুরো পরিবার গুম হয়ে বসবে। ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য জান প্রানের তোয়াক্কা করে না।
সাবেক মন্ত্রী কামরুল মির্জার সুপরিচিত ঐশ্বরিক অট্টালিকা এই বিজয়নগর শহরে। এই শহরের মেয়র কাইফ মির্জা এবং কৌশিক মির্জা তার নাতি, আর্কিটেক্ট ফিল্ড, হোটেল চেইন ছাড়া তার ক্ষমতাধর নাতিদের প্রভাব টাউন হল হতে দূরদূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে।

কাশফি গুনগুন করে গান ধরে বারান্দায় পাতানো আসনে বসে বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে তুলে এক কামড় বসায়। পাশের বাসার টুটুল ব্যাগ কাঁধে, অগোছালো জামায়, গোমড়া মুখে বাসার দিকে হাটতে দেখে হাঁক ছুঁড়ে। নাদুস নুদুস টুটুল বিরক্তি মাখা মুখে পিছনে ফিরে তাঁকিয়ে চায়,

“কেউ বাইরে বের হলে পিছন থেকে ডাকতে নেই জানিস না ইশিবুবু ?”

ভরকে গিয়ে কাশফি উত্তর দেয়,
“এমা এরকম কোন কথা আগে তো শুনিনি? এসব বিশ্বাস করলে পা’প হবে পা’প!”

“ওসব না শুনলে মা বকবে বুবু, তা কেনো ডেকেছিলে?”

“কায়েসটা নারকেল পুলি খাওয়ার বায়না করছে তাই বানিয়েছিলাম। কাকিমা কে বলে তুই আর ছোট্ট টুকি বুবুর কাছে আসিস। নারকেল পুলি আর ডালের বরা খেতে দিবো।”

“সত্যি?”
উচ্ছ্বাস ভেসে উঠলো তার গোলগাল মুখমণ্ডলে — “তোমার বান্ধবী তরী আপুও আসবে?”

“কেনো টুটুল সোনা, তুই কি তরীকে দেখতে আসবি?”

টুটুলের গাল লাল হয়ে যায় মুহূর্তে। ঘাড় চুলকে বলে,
“নাহ এমনি।”

কিছুক্ষণ পর টুটুল তার তিন বছরের বোন সাথে নিয়ে আসে। এসেই দেখে তরী, ফারাবী বসে বসে গল্প শুরু করেছে। টুকি দৌঁড়ে এসে কাশফির কোলে চড়ে বসে। তাদের হইহুল্লোড় হাঁসি মজার ফাঁকে তাদের বান্ধবীর একটা ফোন কল পরিবেশ শান্ত করে দেয়।

***

মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ শামসুলের নাতি, বেশ নামকরা অভিজাত ব্যবসায়ী ফেলিক্স স্টোন। বিদেশের মাটিতে জন্ম হলেও পড়ালেখা শেষ করেই দেশে ফিরে যুবক অবস্থায় যুক্ত হয়েছিলেন রাজনীতিতে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি ছিলো তার, এরপর নিজের ব্যবসা দাড় করান। তবে শারীরিক ভাবে সুস্থ মানুষটা হুট করেই গত হয়েছেন কাল রাত্রি, মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন। ঘুমের মধ্যেই নাকি স্ট্রোক করেছিলেন তিনি। ফেলিক্স স্টোন ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী, তার ছোট মেয়ে অ্যাবেইগাল হলো কাশফির বান্ধবী, যার জন্যেই কাশফি এর তার বন্ধুবান্ধব হন্তদন্ত হয়ে স্টোন ভিলায় এসে পরেছে।
হাসী খুশী অ্যাবিইগালের মুখে আজ বিষাদ আর বেদনার কালো মেঘ, ছোট মেয়েগুলো সবসময় বাবার আহ্লাদী হয়, সেও ছিল। অ্যাবিও তার বাবার কথায় উঠে বসে এমন; তার বাবা তার বেস্ট ফ্রেন্ড বলা যায়। ক্রন্দনরত অ্যাবির পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিচ্ছে কাশফি, কোন এক সময় সেও তার জীবনে পরপর দুইজনকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। তাও বোধহয় মনে হয়েছিল কেউ অচিরেই তার শরীর থেকে আত্মা খা ব লে নিয়ে তার সত্তাকে পু ড়ে ফেলেছে। আট বছর বয়সী কাশফি তখন অনেক কিছুই বুঝতে শুরু করেছিল। পরিবারের ছায়া মাথা থেকে সরে যাওয়ায় একটা নতুন পৃথিবীর সাথে পরিচিত হয়েছিল, সেখানে কেউ কারো জন্য না। যদিও এখন এসব অতীত মাত্র।

ফিউনারেল বিকালের জন্য রাখা হয়েছে, অনেক দেশী বিদেশী আত্মীয় স্বজন আর রাজনীতিতে জড়িত লোকজন এসে ভিড়েছে ফেলিক্স স্টোনের আবাসস্থলে। খ্রিষ্টানদের রীতি অনুযায়ী প্রায় সবাই তৈরী হয়েছে কালো পোশাকে। কাশফি আর তার বাকি বান্ধবীরা ফিউনারেলে যাবেনা তাই তারা রুমেই অপেক্ষা করছে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার। ছটফটে, দুরন্ত ফারাবীও আজ চুপচাপ, তরী প্যাঁচামুখ করে দেওয়ালে টাঙানো উদ্ভট রকমের ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। হয়ত কোন সমীকরণ মিলাতে ব্যস্ত, ঈশান ফোন স্ক্রোল করছে আর কিছুক্ষণ পরপর নাক টানছে। জ্বর নিয়ে বান্ধবীদের সাথে এসেছে, অচেনা অজানা জায়গায় তিনজন মেয়েকে একা ছেড়ে দেওয়া রিস্কের ব্যাপার। তাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের মাহিন আউট অফ টাউন হয়ে আছে।

কাশফি ঘষে ঘষে ঘর্মাক্ত হাত জোড়া প্যান্টে মুছে নেওয়ার পরও বার বার ভেজা ভেজা বোধ হচ্ছে। অচেনা জায়গায় অচেনা মানুষজন দেখলেই অস্বস্থিবোধ হয় আর তখনই বার বার হাত মুখ ধোয়ার জন্য হাত পা নিশপিশ করে। গলা, জ্বিভ, ঠোঁট শুকিয়ে টানটান হয়ে আছে। আসেপাশে তাকিয়ে দেখলো অ্যাবিইগালের খাটের পাশে পানির খালি বোতল, কিচেন কোথায় সেটাতো জানা নেই। ঈশান চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। চোঁখ নাক মুখ লাল হয়ে আছে জ্বরের প্রকোপে। ভাবনার অন্ত ঘটিয়ে কাশফি নিজেই বেরিয়ে পড়ল পানি নিতে। দুই মিনিট ঘোরাঘুরি করে কিচেনে ফিল্টারের দেখা মিলল।

আনমনে কাচের বোতলের ঢাকনা আটকাতে আটকাতে আসার সময় কিছু অদ্ভুত শব্দে তার পা জোড়া বড় ব্যালকনির সামনে স্থগিত হয়। এটা অ্যাবিইগালদের বাড়ীর পিছনের বড় গার্ডেনটা। কাশফি আরেকটু সামনে গিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিতেই দেখতে পায় কয়েকজন পুরুষকে,
তাদের মধ্যে শুভ্র শার্ট পরিহিত একজন পুরুষ। তার এলোমেলো চুল আর ইন করা শার্ট বের করায় কিছুটা কুচকে আছে, বয়স আনুমানিক ২৫ কি ২৬, গলার টাই লুজ, মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম চিক চিক করছে। তার আসেপাশে সুট, ফরমাল এটায়ারে বলিষ্ঠ চার পাঁচ জন— দেহ রক্ষক ঘেরাও করে দাড়িয়ে। দেহরক্ষীরা আর শুভ্র শার্ট গায়ে জড়ানো বিশৃঙ্খল লোকটার শকুনের মতো চেয়ে আছে, বেটে গোলগাল কাচুমাচু হয়ে থাকা মধ্যবয়স্ক লোকটার দিকে। তাদের কথবার্তার হালকা হালকা আওয়াজ শোনাচ্ছে। কাশফি বাইরের দিকে কান পেতে দিলো।

“ তাহলে ১৯ তারিখ রাত পনে বারোটায় মতিঝিলে তাকে লাস্ট দেখা গিয়েছে? কিন্তু আমার জানা মতো সে তো অন্যত্র ছিল? চালাকি করছো সাইফুল?”
লোকটার শক্ত পুরুষালী কণ্ঠে কাশফির মেরুদন্ড বেয়ে একটা অজানা শিহরন বয়ে গেল। এই শিহরন বেশ পরিচিত —কোন এক অজানা শঙ্কার আগাম বার্তা যেন।

গোলগাল লোকটা সাইফুল, সে মাথা এদিক ওদিক নেড়ে হাত জোর করে বলে — “না না! আমি যা শুনেছি তাই বললাম মির্জা সাহেব। ভুল তথ্য জানালে ক্ষমা প্রার্থী।”

মির্জা সাহেব তথা শুভ্র শার্ট জড়ানো লোকটা তার চোখ জোড়া কিঞ্চিৎ ছোট করে নেয়, উপর হতে মুখের ভাব ভঙ্গি নিরুদ্বেগ— দেখে বোঝার জো নেই যে মানুষটা মুখ দিয়ে ছু রি চা লা তে মাহির। এতটা শান্ত আর কম্পোজড থাকতে দেখে সাইফুলের ঘাম ছুটছে। মির্জা সাহেব দুই কদম এগিয়ে দাড়ায় তবে তীক্ষ্ণ তীরের ন্যায় দৃষ্টি এখনো সাইফুলের উপর সীমাবদ্ধ।

ঠোঁটের এক কোণে ক্রুর হাসির রেখা টেনে হাস্কি কণ্ঠে বলে উঠে,
“রোয়ান বেশ চওড়া দামে তাহলে তোমার বিশ্বস্ততা কিনে নিয়েছে। এক্সাকটলি কত? ত্রিশ নাকি পঁয়তাল্লিশ? আমার জানা মতে এইদুটো তার লাকি নাম্বার। ”

“না— ”
মধ্যবয়স্ক লোকটা কথা সম্পূর্ন করার পূর্বেই মির্জা সাহেব এক ভ্রু উচুঁ করে তাকে চুপ করিয়ে দেয়।

“আমার সাথে প্রতারণা করে এখন অভিনয় করছো আবার মিথ্যে বলছো। তিনটা ভুল— চরম ভুল। তোমাকে দুটো পথ দিচ্ছি, স্বীকার করে নিজের নিয়তি কে বেছে নাও আর নাহয় প্রত্যাখ্যান করতে থাকো তোমার মৃ ত্যু কঠিন থেকে কঠিন হবে।”

কিছুক্ষণ কোন জবাব দেওয়া ছাড়াই সাইফুল নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। মাথা তুলতেই দেখা গেল তার চোখে পানি টলটল করছে, নিজের আসন্ন ধ্বংসকে দেখতে পারে শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে। আর নিজেকে ধরে না রাখতে পেরে বলে ফেলে—
“রোয়ান রাশিয়া ব্যাক করেছে, কাল রাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর সাথে ডিল ফাইনালাইজ করেছে আমি আর বেশি কিছু জানি না।”

লোকটার কথা শেষ হওয়ায় পর পর সব স্তব্দ হয়ে যায়। পিনপতন নিরবতা চারদিকে, কাশফি কোন শব্দ না পেয়ে তাকিয়ে দেখতেই হকচকিয়ে মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে যায়। মির্জা সাহেবের সাদা শার্টে স্পষ্টত র ক্তে র দাগ আর ছোট-বড় ছিটেফোঁটা লেগে আছে, হাতের রিভলভারটা তাক করা ঠিক সামনে যেখানে কিছুক্ষণ আগে সাইফুল দাড়িয়ে ছিল। কচুমাচু হয়ে থাকা সাইফুলের নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রইল, চোখ জোড়া উল্টে গিয়েছে, বুকের বা পাশ চুইয়ে চুইয়ে লাল রঞ্জক তরল পড়ছে মাটিতে।

এহেন দৃশ্য দেখে কাশফি যেন প্রতিক্রিয়া করতে ভূলে গিয়েছে, চোঁখের পলকে কিভাবে কি হয়ে গেল? এত সুক্ষ প্রদক্ষেপে কি করে প্রাণ কেড়ে নিল? কিছুক্ষণ যেন সে মূর্তি বনে গেল পরক্ষণে তার শরীরে অসহনীয় কম্পন অনুভব হয়। হঠাৎ করে আবার সেই পুরুষালী হন্টেড কন্ঠটা শোনা যায় —
“ কৌশিক মির্জা কাউকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না।”

কাশফি মির্জা সাহেব— কৌশিক মির্জার চোখে চোখ রাখতেই তার বুক মুচড়ে উঠলো, দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কৌশিক মির্জার প্রাণহীন ছাই রঙ্গা চোখ জোড়া তাকে পরখ করে চলেছে — তাহলে কথাটা কি তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে?
এত নির্জীব কেন তার চাহনি? কাশফি কেঁপে উঠলো যেন।

ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া কাশফির হতবিহ্বল মুখের দিকে তাঁকিয়ে তার চোখ মুখে আকষ্মিক উত্তেজনার ঝলক দেখা গেলো। পরপর খুবই সন্তপর্নে তার ঠোঁটের ভাঁজ গাঢ় হয়ে ঠোঁটে সূক্ষ্ম কিনারা বেঁকে উপরে উঠে যায়।
উপলব্ধি করতে পেরে কাশফির গায়ে কাঁ টা দিয়ে উঠলো।

শিট শিট শিট!

মির্জা পরিবারের সবচেয়ে উ’গ্র, নি’র্ম’ম, কু’খ্যাত একজনের দৃষ্টিতে আসা মানে স্বয়ং মৃ’ত্যু’র সাথে সাক্ষাৎ।
তবে তিনিই কি সেই কুখ্যাত কৌশিক মির্জা? তিনিই কি তথা কথিত জ্বলজ্যান্ত আতঙ্ক?

“Well, you are truly doomed.”

#চলবে….

আপনারা প্লিজ গল্পটা এবং আমার পেইজটা বেশি বেশি শেয়ার করে দিবেন, অনুরোধ রইলো।
নতুন বছরের শুভেচ্ছা 💜

যারা আগের পর্বে রিয়েক্ট দেননি রিয়েক্ট করে ফেলবেন।
আগের পর্ব—
https://www.facebook.com/61554595523141/posts/122111430242153184/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here