#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১৫)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী
১৫. (Edited)
অতীত:
কনকনে শীতের রাত্রি, কাশফি আর তরী ব্যাডমিন্টন খেলছে। তাদের সাথে পেরে না ঊঠে ফারাবী মুখ ফুলিয়ে বসে আছে কয়েসের সাথে। কুয়াশায় লাইটের হলদেটে আলোয় কাশফির মুখশ্রী জ্বলজ্বল করছে। মেয়েটা এতক্ষন খেলে হাঁপিয়ে উঠেছে তবুও খেলেই যাচ্ছে। এই শীতে তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অন্তু হট চকলেট হাতে তাদের দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে কুয়াশায় ঢাকা কাশফির আবছা মুখশ্রী দেখতে ব্যাস্ত। সাথেই বসা অন্তুর বন্ধু ফিরোজ গানের সুরে গলা ছেড়ে গান গাইছে। সে অন্তুর হাবভাব ইদানিং লক্ষ্য করছে, এই এক সপ্তাহে বেশ কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে তার মাঝে।
“পছন্দ করিস?”
ফিরোজের কথায় কিছুটা বিচলিত হয়েছিল অন্তু তবে অস্বীকার করল না। ফিরোজের ফোনে সফট টোনে গান বাজছে। বন্ধুর কাছে উত্তর না পেয়ে ফিরোজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“তুই তোর ফিলিংসের ব্যাপারে সর(sure) না?”
অন্তু কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে সম্মতি জানালো। মাথা কিছুটা নত করে বলল,
“ঈশিতা বেশ ইন্টারেস্টিং একটা মেয়ে।”
“তা তো বটেই।”
“নতুন কিছু জানার প্রতি বেশ আগ্রহী।”
“বুঝলাম তবে শুনেছি এই মেয়ের দিকে কারো তাকানো নিষেধ, জানিস তো?”
অন্তু জানে তবে কেনো তা জানে না। কোন এক অজানা কারণে যথেষ্ঠ সুন্দরী কাশফির কাছে আজ পর্যন্ত কোন লাভ লেটার পৌঁছায় নি। কেউ সেই দুঃসাহস করে দেখায়নি। হয়ত তার শিক্ষক বাবার কঠোর ব্যক্তিত্বের কারণে, কম বেশী সকলে জানে একসময় তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন।
যদিও অন্তুর ব্যবহার বন্ধুত্বপূর্ন কাশফির কাছে কিন্তু তারা তো বন্ধু নয়। তাই না?
সে কাশফিকে পছন্দ করে তবে তা অতটা প্রকট নয়। সে দ্বিধায় ভুগছে তবে কাশফিকে নিয়ে ভাবতে তার ভালো লাগে আবার মাঝে মাঝে ভয় হয়।
***
আতিকুর রহমান ইদানিং মেয়ে নিয়ে বেশ চিন্তিত। চারুলতা ছিল অভিলাষী আর বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে, তার নিজের উপার্জনই আতিকুর রহমানের চেয়ে চারগুণ বেশি ছিল। সে মারা যাওয়ার পূর্বে তার দুটো গ্যালারি আর তার বিশাল আয়তনের জায়গাটা কাশফির নামে উইল করে দিয়েছিলেন। তার আর্ট গ্যালারির পাশের সুবিশাল জায়গাটার বর্তমান মূল্য প্রায় পঁচিশ কোটির মতো।
কাশফির বয়স আঠারো হওয়ার পর থেকেই চারুলতার সৎ ভাই তার পিছনে পরে আছেন কাশফির বিয়ে তার ছেলে নিহালের সাথে দেওয়ার জন্য। এই নিয়ে তাকে কম হেনস্থা করেন নি। এছাড়া অনেক পরিবার লোভে পরেই কাশফির সমন্ধের জন্য আসছেন। তাই তিনি কাশফির সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন তবে মেয়ে চারুলতার বিষয়ে কিছু শুনতে নারাজ। তাই সাফ সাফ জানিয়েছে যে — ‘বাবা আপনি যা ভালো মনে হয় তাই করবেন।’
শনিবার ছুটির দিন হওয়ার সুবাদে আজ কাশফি আর তার বাবা বাসায়, কায়েস টিভিতে কার্টুন দেখছে। বাবা, মেয়ে বাসায় না থাকলে কায়েসকে টুটুলের বাসায় রেখে যান। কাশফি আজ সকালের নাস্তায় খিচুড়ি রেধেছে, তার বাবা খিচুড়ি দিয়ে রান্না করা দেশী মুরগি খুবই পছন্দ করেন। খাবার শেষে আতিকুর রহমান বসার রুমে বসে ফোনে কথা বলে নেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় বেল বাজতে দেখে কাশফি হাতের কাজটুকু শেষ করে আসার আগে দেখে তার বাবা বসার রুমে একজন অল্পবয়স লোকসহ বসে আছেন। তাদের সামনে কিছু কাগজপত্র আর সামনের টি-টেবিলে কিছু ফাইল। তিনি কাশফিকে দেখে বসতে বলেন।
কনফিউজড কাশফি সিঙ্গেল সোফায় বসে টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা কাগজ আর ফাইলগুলোর দিকে প্রশ্নাত্বক দৃষ্টিতে পরখ করল কিছুক্ষণ। আতিকুর রহমান মেয়ের দিকে ফিরে লোকটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
“কাল আমার যে একজন এজেন্টের সাথে কথা হয়েছিল সে, ফাহিম মোর্শেদ আমার পরিচিত। ফাহিম, আমার মেয়ে ঈশিতা। উনি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলবেন।”
কাশফি হেসে ফাহিমকে সুন্দর করে সালাম দেয়। সালামের জবাব নিয়ে ফাহিম বলে,
“আংকেলের কাছে আপনার কথা শুনেছি, আপনি এইচএসসি ক্যান্ডিডেট না?”
“জ্বি, আপনি তুমি করে বলতে পারেন সমস্যা নাই।”
ফাহিম এবার ফাইল খুলে কাশফির দিকে ঠেলে দেয়, কাশফি একবার তার বাবার দিকে চায়। তার বাবা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে সে আরেঙ্গমেন্ট পেপারে চোখ বুলিয়ে দেখে। ফাহিম নিজের হাতে থাকা কিছু লিগ্যাল ডকুমেন্ট চেক করার পর কাশফিকে জানায়,
“আচ্ছা, স্বনামধন্য আর্কিটেক্ট ফার্ম MRCX Inc. তো চিনোই, সেটার Co-Owner দিগন্ত স্যার রেসিডেনসিয়াল এরিয়া থেকে কিছুটা দূরের জায়গার খোঁজে ছিলেন। প্রতিষ্ঠানের কো-ওনার, সিইও আর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের আমাদের এজেন্সির কাছে হিউজ ডিমান্ড ছিল ২০০০ থেকে ৩০০০ ফিটের মধ্যে তার জেট বিমানের জন্য প্রাইভেট ল্যান্ড স্ট্রিপিং এর।”
ফাইলের এমআরসিএক্স ইনকর্পোরেশনের এগ্রিমেন্ট গুলোতে আঙুল দিয়ে দিয়ে পয়েন্ট করল ফাহিম। কাশফি কিছুক্ষণ সেগুলো পরখ করে তার এস্টেটের ডকুমেন্ট গুলোর দিকে একদফা নজর দিয়ে বলে,
“মানে তারা জায়গাটায় তাদের বিমানের জন্য রানওয়ে তৈরি করতে চাইছেন এই তো?”
“ঠিক তেমনটাই।”
“কিন্তু লেন্থ হিসাবে জায়গাটার পরিমাণ ৯০০ মিটার, যা উনার ডিমান্ড থেকে কম।”
ফাহিম কাশফির কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে তার ব্রিফকেস থেকে আইপ্যাড আর ওয়্যারলেস পেন বের করে একটা ম্যাপ দেখিয়ে তার জায়গাটা দেখায় এর থেকে কিছুটা সামনে গিয়ে সে আরেকটা জায়গা জুম করে দেখিয়ে বলল,
“উনারা অনেক আগেই পাশের এস্টেট নিয়ে কথা বলে রেখেছেন, তোমার জায়গাটা কিনা হলেই সেটার দিকে আগাবেন।”
“বুঝেছি তবে আর্ট গ্যালারী গুলো..”
ফাহিম কাশফিকে আশ্বস্থ আরেক দফা হেসে বলে,
“এজেন্সী আর্ট গ্যালারি দুটো সমস্যার কারণ হবে না বলে জানিয়েছে। যেহেতু সেগুলোর মালিকানাধীন তুমি তাই তারা সেগুলো সহ জায়গাটা চাইলে প্রফিট তো পাবেই সাথে নাহয় তোমাদের ডিমান্ড তুলে ধরতে পারবে। তবুও দেখা যাক কোম্পানীর বোর্ড কর্তৃক কি সিদ্ধান্তে উপনীত হয় তারা।”
এবার কাশফির বাবা নাকের চশমা আঙুল দিয়ে উপরে তুলে গলা পরিষ্কার করে বলেন,
“কাশফি আমি আগাতে চাইছি কারণ কোম্পানিটার Co-Owner আমার স্টুডেন্ট নীলা চৌধুরীর ছেলে দিগন্ত চৌধুরী। সে হার্ডওয়ার্কিং, যথেষ্ঠ ভদ্র আর মার্জিত একজন ছেলে। তোমার বান্ধবী ফারাবীর উড বি, তুমি চিনেছো?”
কাশফি মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ, কেন চিনব না ভাইয়াকে। তাহলে আপনি বরং দিগন্ত ভাইয়ার সাথে সিভিল ঠক (civil talk) সেরে ডিসিশন ফাইনালাইজ করুন বাবা।”
আতিকুর রহমান কাশফির প্রতি কঠোর হয়ে বেশ শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার কোন মতামত নেই?”
“আমার মনে হয় এসব আপনারা ভালো বুঝবেন।”
“একজন অ্যাডাল্টের মতো সিদ্ধান্ত নাও, ঈশিতা।”
“বাবা…”
“তুমি বুঝে বলছ? তারা অনেকটুকু মতামত দিয়ে ফেলেছেন। তোমার তাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করা মাত্রই তারা তোমার সিগনেচার নিয়ে এস্টেট কিনে ফেলবেন।”
কাশফি শ্রাগ করে নিরুদ্বেগ হয়ে বলে,
“আমার সাক্ষাতের কি প্রয়োজন? ডকুমেন্ট তো আছেই সিগনেচার আমি বাসায় থেকেই দিতে পারি।”
বাবা মেয়ের কথাবার্তার মাঝে ফাহিমের গলা খাঁকারি শোনা যায়। কাশফির মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেই সে কাশফির উদ্দেশ্যে বলে,
“Sorry to say but তাদের নেগোশিয়েটে (negotiate) উপস্থিত থেকেই স্বাক্ষর করতে হবে, এটাই নিয়ম ঈশিতা।”
কাশফি তপ্ত নিশ্বাস ফেলে তার হাতের আঙ্গুল গুলো গুটিয়ে নেয়। বড়দের মাঝে নিজের বসে থাকাটা তার কাছে বোধগম্য হচ্ছিল না এক্ষেত্রে গণমান্য লোকদের সামনে গিয়ে আহাম্মকের মতো দাড়িয়ে থাকার কোন মানে হয়? ভেবে কোন উপায়ন্তর না পেয়ে কাশফি জবাব দিলো,
“টাইমটেবিল জানিয়ে দিবেন আমরা উপস্থিত থাকবো ইনশ’আল্লাহ।”
***
শীতের দিনে ঝলমলে মিঠা রোদ্দুর এসে ভিড়েছে ক্লাসের বড় জানালা দিয়ে। দ্বিতীয় পিরিয়ড শেষ হওয়া মাত্রই নিজের অস্থিরতার সামাল দিতে বহুল কাঙ্ক্ষিত সেই মেয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখে মুখে আনমনা ভাব দেখে ছেলেটি নরম স্বরে ডাকলো,
“ঈশিতা।”
“হু?”
“তুমি কখনো নিজের স্বভাবসিদ্ধির বাইরে গিয়েছো?”
অন্যমনস্ক হয়ে থাকা কাশফির এবার ভ্রুদ্বয় কুচকে কপালের মাঝ বরাবর দুটি ভাঁজ দেখা গেলো।
“তোমার কথা ঠিক ধরতে পারলাম না…”
“লাইক তোমার ইউজুয়ার সেলফ থেকে বিচ্যুত হয়েছো?”
“মনে হয় না।”
“আমি হয়েছি।”
“সেটা কি করে হয়?”
ঠিক তখনই থার্ড পিরিয়ডের স্যার ক্লাসে এসে পরে, তাই বাধ্য হয়ে না বলা কথাটুকু অন্তু সন্তপর্নে গিলে নেয়। অথচ যে ছেলে ক্লাসে বসে কখনো টু শব্দ করেনি সেই ছেলে ক্লাসের ফাঁকে নিজ থেকে কাশফির সাথে কথা বলছে এটা কি কাশফির চোঁখে পরে না? মেয়েটা কেমন বেপরোয়া, অচল ধরনের। নিজের একান্ত জিনিস কিংবা কোন গুরুতর বিষয় ছাড়া অন্য কিছুতেই সে মাথা ঘামায় না। মাঝে মাঝে তাকে মেশিন মনে হয়।
অন্তু নিজের চিন্তায় নিজেকে হেসে আবার ভাবলো — ‘মেয়েটা বড্ড স্বার্থপর বটে, তাকে মুগ্ধ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।’
বাসায় পৌঁছেই কাশফি গোসল সেরে নেয়। আড়চোখে বার বার কায়েসকে দেখে নেয়। সে কিসব উল্টাপাল্টা আজগুবি ছড়া পড়ছে যা কাশফির জন্য বিরক্তিকর আর হতাশাজনক। কিছুক্ষণ পরপর শোনাচ্ছে কায়সের চিৎকার করে করে সারা ঘর পায়চারি করে ছড়া আবৃত্তি—
“হাট্টিমাটিম টিম
তোতা বুবুর মাথায় পারে ডিম
পঁচা বক খায় শিম
ও তোতা তুই খাস কি?
চিকেন ফ্রাই!
মাছ আমি খাই না
বুবু চিকেন ফ্রাই বানায় না।
একটা যদি বানায়
ঝাল বেশি দেয়।”
মুলত ছোট্ট কায়েসের অপছন্দনীয় খাবার শিম আর মাছ, কাশফি জোর করে খাওয়ায়। চিকেন ফ্রাই তার অতি পছন্দের খাবার। ভাই বোন গুলো হলো মীর জাফর। অজস্রবার নানান রকমের পদ বানিয়ে খাওয়ালেও সুনাম তো হবে না, বরং দুর্নাম রটাবেই।
দুপুরের খাবার শেষে কাশফি তার ওভারসাইজড হুডি পাল্টে একটা হাটু সমান ফতুয়া আর জিন্স প্যান্ট পরে গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে নেয়। ফিরতে ফিরতে হয়ত রাত হবে। রাতে পড়ায় মনোযোগের জন্য বিকেলে ঘুমানোর অভ্যাস আছে তার, আজ না ঘুমাতে পারায় তার এখন ঘুমে ঢুলুঢলু অবস্থা। মুখে কয়েকবার ঠাণ্ডা পানি ছিঁটিয়ে সে দাঁতে দাঁত চেপে মুখখানা টাওয়েলে মুছে নিলো।
কিছুক্ষণ ফারাবী এসে কায়েসকে নিয়ে গিয়েছে। এদিকে সে রেডী হয়ে মেইন দরজা লক করে বের হতেই দেখে তার বাবা আর ফাহিম একটা গাড়ির সামনে দাড়িয়ে আলাপ আলোচনা করছে। ফাহিম কাশফিকে দেখা মাত্রই ভদ্রতা বজায় রেখে এক গাল হাসে, আর দেরী না করে তারা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
***
“I, I knew you
Your heartbeat on the High Line
Once in twenty lifetimes, I
And when I felt like I was an old cardigan under someone’s bed
You put me on and said I was your favorite
To kiss in cars and downtown bars
Was all we needed
You drew stars around my scars
But now I’m bleeding…”
সামনের নিয়ন লাইটে সজ্জিত ক্যাফেটায় এই গান বাজতে দেখে মনে মনে সুর তুলে আওড়ালো কাশফি। গাড়ীতে ঘনঘন হাই তুলছে সে। সুবিশাল জায়গাটার থেকে কিছুটা দূরে ফাহিমের টয়োটা ক্যাফের পাশেই থামল। আতিকুল রহমান নেমেই এজেন্সির দুটো লোকের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে ক্যাফের উপরের রুফটপ রেস্টুরেন্টের দিকে এগোচ্ছেন। তার বাবার পিছনে পিছনে কাশফি চলছে, এখানে তার বাবাসহ সবাই ফরমাল গেটআপে এসেছে তাই নিজের দিকে চেয়ে তার এই জায়গার বেমানান মনে হচ্ছে। ড্রেসিং সেন্সটা তার বরাবরই সূক্ষ্ম।
রেস্টুরেন্টের ভিতরটা ফাঁকা কেননা আজ সন্ধ্যার জন্য বুকড। রেষ্টুরেন্টের ভিতরের দিকটা দারুন, সফট গ্লো টাইপের থিমে সাজানো। তাদের দেখামাত্র একজন ওয়েটার এসে সৌজন্যতা মূলক হাঁসি হেসে দাঁড়ায়,
“Observation under the name of Digonto Chowdhury. This way please!”
তরুণ ওয়েটার তাদের টেবিল দেখিয়ে বসতে বলে চলে যায়। কাশফি বসেনা, আশেপাশে হেঁটে হেঁটে দেখতে লাগলো কিছুক্ষণ পর ফাহিম দুটো ক্যাপুচিনো (cappuccino) হাতে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। একটা তার দিকে বাড়িয়ে দেয়,
“সুগার কম, খেয়ে দেখো ভালো লাগবে।”
কাশফি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে হেসে এক চুমুক দেয়, রিচ একটা টেষ্ট। কফির ক্রিম তার ঠোঁটের উপরে লেগেছে বুঝতে পেরে আনমনে জিভ দিয়ে মুছে ফেললো। পরক্ষনে এই কাজের জন্য কিছুটা লজ্জাও পেলো। ফাহিম পকেট থেকে রুমাল বের করে কাশফির দিকে এগিয়ে দিলো। সে আরেকবার হেসে মুছতে যাবে তখনই বাইরের গ্লাসের দেওয়াল ভেদ করে বাইরে চোখ পরলো।
রাস্তায় পরপর তিনটা কালো গাড়ী এসে থেমেছে। প্রথমটা থেকে চারকোল ব্ল্যাক সুট পরিহিতা একজন সুঠাম দেহী বের হয়ে এলো। তার মুখে আর কানে মাউথ এন্ড ইয়ার পিস লাগানো। কাশফি মনের অজান্তেই তাকে বেশ গাঢ় করে পরখ করতে লাগলো, লোকটাকে তার চেনা জানা ঠেকছে।
কোথাও দেখেছিল কি? প্রথম গাড়ি থেকে অফ হোয়াইট সুটে আরো একজন অপরিচিত পুরুষ বেরিয়ে এলো। এতক্ষন চারকোল ব্ল্যাক সুট পরিহিতা লোকটার একপাশ দৃশ্যমান সে গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া লোকটার সাথে কথা বলার জন্য অন্যপাশে ফিরতেই কাশফির চোখ ছানাবড়া।
লোকটার গালের কাটা দাগ দেখে তার ভাষা ভাষা কিছু মনে আসছে। লোকটার নাম মুখে আসছেনা কেন? কোথায় আর কবে দেখেছে সে?
দ্বিতীয় গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো কিছু দেহরক্ষী তারপর আলগোছে দিগন্ত নেমে গেলো। পরপর দিগন্তের বিপরীতের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো আরেকজন, তার পিঠ দেখা যাচ্ছে কেবল। পড়নে শার্ট আর ডার্ক ব্লু ওয়েস্ট কোট। ডার্ক ব্লু ওয়েস্ট কোট নিচে টেনে ঠিক করে গলার টাই ফিক্স করে নেয়।
ততক্ষণে কাশফির মাথায় চট করে গালের কাটা দাগযুক্ত লোকটার নাম মনে পড়ে, কিছুদিন আগেই তো দেখেছিল। তার নাম লেভিন — লেভিন আফসার, কৌশিক মির্জার রাইট হ্যান্ড, তার মানে?
কাশফির শ্বাস আটকে আসে, ডার্ক ব্লু ওয়েস্ট কোট পরা লোকটা তার বলিষ্ঠ বাহুতে থাকা সুটটা গায়ে জড়িয়ে কান থেকে ইয়ারপডস বের করে সামনে ফিরতেই যেনো কাশফি আঁতকে উঠে। কৌশিক মির্জা তার শান্ত দৃষ্টি বেশ ধীরে সুস্থে উপরে তুলে যেন সে কাশফির ভাবমূর্তি দেখার অপেক্ষায় ছিল। কাশফির কাছে এই হাসি বড্ড চেনা, ফিউনারেলের সেইদিন পোডিয়ামে ইউলোজি পাঠকালীন যে ক্রুর হাসি হেসেছিল ঠিক তেমন হাঁসি ফুটে তার ঠোঁটের কোণে তবে এই হাসিতে বিজয়ের প্রবল উত্তেজনা।
“দিগন্ত স্যার, সিইও কৌশিক মির্জা আর ডিরেক্টর কাব্য মির্জা এসে পড়েছেন।”
ফাহিম সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, কথাটা কাশফির কানে সূচের ন্যায় তীক্ষ্ণ হয়ে পৌঁছালো তবে সে হতবিহ্বল, হতচকিত, বাহ্যিক কোন রকম হেলদোল দেখা না গেলেও তার ভিতরে শীতল ঝড় বয়ে গেলো।
ভুল করে ফেলেছে সে, অনেক বড় ভূল। কৌশিক মির্জাকে হালকা ভাবে নিয়ে সে নিজের বিপদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কেন সে সি ই ওর নাম জানতে গেলো না, কেনো?
কিভাবে এত বড় ভুল করে বসলো।
শিট, শিট, শিট!
তার মনোযোগ এখন সম্পূর্ন কৌশিক ঘিরে, যে আপাদত তার দিকে বাঁকা চোখে চেয়ে আছে। কৌশিক তার বাহুদ্বয় ফ্লেক্স করে হেন্ড ওয়াচে সময় দেখে নেয়। ঠোঁটের কোণে হাঁসি বজায় রেখে সে কাশফির দিকে আবার চেয়ে ঠোঁট নেড়ে কিছু একটা উচ্চারণ করল, কাশফির বুঝতে বেশিক্ষণ লাগলো না,
❝ You lost, Darling.❞
শব্দগুলো তার মস্তিষ্কে সাজানোর সাথে সাথেই সে শিউরে উঠলো। সে আবার মুখ নেড়ে কাশফির উদ্দেশ্যে কিছু বলে হাটা শুরু করল। উচ্চারিত শব্দ গুচ্ছ মনের অজান্তে আওড়াতেই তার গলা ধরে এলো, শরীরের রক্তস্রোতে যেন হিম ধরে গেলো,
❝ Game over❞
দুটো শব্দ কিন্তু আধিপত্য বিস্তর।
#চলবে…
অনেক বড় পর্ব দিলাম, মন্তব্য করতে ভুলবেন না। গল্পটা পছন্দ হলে রিভিউ দিবেন এবং পেইজটা শেয়ার করে দিবেন।