#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২০)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী
২০. (Edited)
অতীত:
কাশফি জানালার পাশে ছোট্ট একটা গোল টেবিলে বসে অনিমেষ নেত্রে চেয়ে আছে ক্যাম্পাসের বাইরের দিকটায়। দুই চারটা চুল তার মুখের উপর এসে পড়েছে। রাস্তায় একটা কালো গাড়ি আসা মাত্রই সে তার সূক্ষ্ম নজর গাড়িতে দেয়, পরক্ষণে হতাশ হয়ে যায়; এটা সেই কালো গাড়ি নয়। সকালে গোসল দেরীতে করায় তার চুল কিছুটা ভেজা ছিল তাই খোলাই রেখেছে।
আজ ঠিক একসপ্তাহ হতে চলল,
অজানা শঙ্কায় তার মন কু গাইছে; হঠাৎ কোন দিন না কোন দিন লোকটা তার পিছনে এসে দাড়িয়ে নিখুঁত অভিনয় করে বলবে — ‘কাশফি, হোয়াট আ কো ইনসিডেন্ট’
কাশফি আনমনা হয়ে কিছুক্ষণ হাতের প্লাস্টিক কাপ নাড়াচ্ছে, নয়ত অলস গতিতে স্ট্র মুখে দিয়ে টেনে লেমনেইড টুকু পান করছে। তার দুই বান্ধবী গোল টেবিলের উপরে রাখা ছোট গোলাপের বুকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যাস্ত।
“Roses are red
Violets are blue
Don’t know when
I fell in love with you.
এটা গম্ভীর শান্ত স্বভাবের মেয়ের জন্য যে আমাকে ইগনোর করে চলে।”
টকটকে লাল গোলাপের বুকেতে এমন ক্লিশে টাইপ টাইপের লাইন লেখা দেখে তরী নাক সিটকায় আর অন্যদিকে ফারাবী আবেগকম্পিত। একই সময়ে তরী আর ফারাবী একসাথে দুই বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া দেখলো।
“ছিঃ… Ewww”
“Awww, how sweet!”
তারা দুইজন দুজনের রিয়্যাকশন দেখে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। তরী চোঁখ পাকিয়ে শাসানোর সুরে বলে—
“Are you gushing over this?”
তরীর চোঁখে মুখে বিতৃষ্ণা দেখেও ফারাবী শ্রাগ করে বলে—
“তো কি হয়েছে, I like that!”
“Grow up Farabi…”
“How mean of you!”
ফারাবীর কণ্ঠে ন্যাকামি টের পাওয়া মাত্রই তরী চোঁখ গরম করে ওয়ার্ন করার সুরে বলে —
“Don’t start!”
এতক্ষণ নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করা কাশফি, তাদের দুইজনকে একে অপরের গলায় ঝুলে ঝগড়া করতে দেখে চোখ উল্টে ফোঁস করে মুখ দিতে শ্বাস ফেলে। টেবিলে জোরে হাত রেখে নিচুস্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠে—
“ফুল আমাকে দিয়েছে তোদের এতো মাতামাতি কিসের রে?”
বলেই কাশফি কপালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে পুনরায় চিন্তায় ডুবে গেলো। জোভান শিকদার নাছোড়বান্দা, পাত্তা না পাওয়ার পরও কেমন জানি পিছনে লেগে আছে। এসব নিয়ে সে কম বিরক্ত নয়, তবে আপাতত চিন্তার কোন কারণ দেখছে না। তার চিন্তার কারণ একটাই; তির্যক আর নির্জীব দৃষ্টির হিং’স্র পুরুষ।
“আচ্ছা ছেলেটা কি তোকে প্রোপোজ করেছিলো?”
ফারাবীর কথায় কাশফি তপ্ত নিশ্বাস ফেলে পূর্বের অবস্থানে থেকেই মাথা নাড়ায়,
“আমি তাকে কথা বলার কোনো সুযোগ দিলেই তো!”
ফারাবী আরো কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই তাদের টেবিলে কাশফির ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠে। ডিসপ্লেতে আননোন নাম্বার দেখে কাশফি ভ্রু কুঁচকে নেয়। পরক্ষণে নাম্বারটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতেই তার ভ্রু কপালে উঠে যায়! তৎক্ষণাৎ তার বুকে কাপন ধরে। ঠিক আননোন নাম্বার বলা যায় না, বলা চলে খুবই পরিচিত নাম্বার কেবল কন্টাক্ট লিস্টে সেভ করা হয়নি। মোবাইল হাতে সে ডিসপ্লে থেকে চোঁখ সরিয়ে আশেপাশে চোঁখ বুলিয়ে দেখলো, তবে দূরদূরান্ত পর্যন্ত কৌশিক মির্জার ছায়ার সন্ধান ও পেলো না।
এদিকে ফোন ভাইব্রেট হতে হতে কেটে গেলো দেখে, কাশফি স্বস্থির নিশ্বাস ফেলতে নিলেই আবার ভাইব্রেট করে ইনকামিং কল শো করছে। কাশফি চোঁখ বন্ধ করে মুখ জটিল করে নেয়। টেবিল থেকে উঠে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে কল রিসিভ করে,
“আমার busy schedule থেকে সময় বের করে আপনাকে কল করার সময় থাকে। কিন্তু আপনার কি রিসিভ করার সময় নেই, ম্যাডাম?”
কৌশিকের পুরুষালী হাস্কী কণ্ঠে তীব্র অধিকারবোধ স্পষ্টত। কাশফি হকচকিয়ে যায়, ঠিক কি জবাব দিবে ভাবতে পায় না। ভাবতে ভাবতে কৌশিক আবার বলে উঠে,
“কেমন আছি জিজ্ঞেস করবেন না কাশফি?”
“কল কেনো দিয়েছেন?”
“আপনার কণ্ঠ শোনার জন্য কল দিয়েছি।”
কাশফি হতবিহ্বল বনে যায়, পরক্ষণে নিজেকে সামলে কৌশিকের উদ্দ্যেশে বলে — “হেঁয়ালি করবেন না!”
অপর পাশে কৌশিকের কণ্ঠে যেনো হাঁসির আভা পাওয়া গেলো, কণ্ঠে আরো গম্ভীরতা এনে বলল,
“All right, Let’s get to the point.”
কাশফিও আইঢাই না করে ফট করে উত্তর দিলো,
“I’m all ears.”
বেশ কিছুক্ষণ কৌশিক নিরবতা পালন করে রইল, যেনো সন্তপর্নে এবং আলগোছে সময় গুনছে। অতঃপর একটা ভারী নিশ্বাস ফেলে অত্যন্ত রাশভারী কণ্ঠে উচ্চারণ করলো—
“জোভান শিকদার এই মুহূর্তে আপনার ক্যাম্পাসেই আছে।“
কাশফি আশ্চর্য্য বনে পিছনে ফিরে চাইতে গেলে কৌশিক ঝাঁঝালো তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল— “তার দিকে ফিরে তাকে আশকারা দিবেন না, কাশফি।”
কাশফি নিজের সাফাই দিয়ে ছোট্ট করে বলে ‘জ্বি তাকাইনি’। কৌশিক নিজের কণ্ঠ খাদে নামিয়ে, কর্কশ স্বরে বললো,
“আমি চাই আপনি ফুলগুলো ডাস্টবিনে ফেলে এখনই ক্লাসে ফিরে যাবেন। রাইট ফাকিং নাও!”
কাশফি মনে শঙ্কা তবে কণ্ঠে জোর এনে জিজ্ঞেস করেন,
“আপনি চাইলেই কি মানতে হবে?”
শরীর কাঁপিয়ে হেঁসে উঠে কৌশিক, যেনো হাস্যরসিক কোন আসরে জমিয়ে মজা নিচ্ছেন। পরক্ষণে হাঁসি থামিয়ে রাশভারী কণ্ঠ নামিয়ে শুধলো,
“আমার অবাধ্য হয়ে বিপদ টেনে নেওয়ার মতো বোকা আপনি নন।”
কাশফি খট করে কল কেটে দেয়। ফিরে এসে তার বান্ধবীদয়ের প্রশ্নোত্বক দৃষ্টি উপেক্ষা করে চেয়ার থেকে ব্যাগ তুলে কাঁধে নেয়, তারপর গোলাপের বুকেটা টেবিল থেকে তুলে হাঁটতে শুরু করে। তার পিছন পিছন তার বান্ধবীরা ছুটছে। ক্যান্টিনের বাইরে ডাস্টবিনের সামনে এসে চোয়াল শক্ত করে অনিমেষেই ফুলের বুকেটা ফেলে দিয়ে দ্রুত প্রস্থান করে।
যতসব উটকো ঝামেলা তার!
***
সেই দিন রাতে কাশফি রাত জাগার সিদ্ধান্ত নিলো। খেয়ে দেয়ে টেবিল গুছিয়ে নিতেই হঠাৎ বেলের আওয়াজ শুনে দৌঁড়ে দরজা খুলে। দরজার সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে খানিকটা বিরক্ত হয়। পরক্ষণে নিচে একটা কালো রাপিং পেপারে মোড়ানো ছোটবক্স দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। বিভ্রান্ত হয়ে আশেপাশে তাঁকিয়ে দেখে নিলো কেউ আছে কিনা। কাউকে দেখতে না পেয়ে হাঁটু গেটে বসলো বক্সটার সামনে। সংশয়াপন্ন হাতে বক্সের উপরে আটকানো ট্যাগটায় সে নিজের নাম দেখতে পেলো শুধু — “Kashfi”
তৎক্ষণাৎ তার কৌশিক মির্জার কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু নিজের ভাবনা কে ভুল মনে করে নেয়। সে ভয়ে ভয়ে রেপিং পেপার ছিঁড়ে বক্স খুলে কিছু পাঞ্চ ক্লিপ, হিট প্রটেক্টর আর একটা ব্লো ড্রায়ার সাথে একটা নোট। কাশফি নোটটা তুলে নিলো। ব্যাক কার্ডে বোল্ড গোল্ডেন অক্ষরে এলোমেলো হাতের লিখা—
“আপনার কলেজ ক্যাম্পাসে আনুমানিক তেত্রিশ হাজার স্টুডেন্টের আনাগোনা, অথচ তাদের কাউকে আপনার চুল দেখার পারমিশন আমি দিই নি। এখন থেকে কলেজে যাওয়ার পূর্বে গোসল করে ব্লো ড্রায় দিয়ে চুল শুকিয়ে নিবেন, ম্যাডাম। ভেজা চুল ছেড়ে রেখে কাউকে বেসামাল করবেন না। আমি কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই।”
মুহূর্তেই কাশফির পুরো গাল চেরির মতো লাল বনে গেলো। শুন্য মস্তিষ্কে হতবিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে রইলো কেবল। দুরু দুরু বুকে ভাবতে উদ্যত হয়,
অপেক্ষা? কিসের অপেক্ষা?
গভীর রকম করে ভাবতেই তার গলা শুকিয়ে আসে, লাজ রাঙা মুখ শক্ত করে গলায় ঝুলন্ত ওড়না হাতে মুঠ করে ধরে চোঁখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়,
“আপনি এতো অসভ্য কেনো কৌশিক!”
নিজেকে সামলে সে ঠোঁট কামড়ে নেয়, তার পেটের ভিতরে কেমন জানি সুড়সুড়ি লাগছে। এসব ভাবনার অন্ত ঘটাতে সে নিজের হাতে চিমটি কাটে। বক্স কোলে তুলে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে হুট করেই থমকে দাড়ায়। কেনো জানি বাইরে এক বার চোখ বুলানোর জন্য মন খচখচ করছে। নিজের মনকে বোঝানোর জন্য সে দরজার ফাঁকে মাথা বের করে, অতঃপর চোখ ছোট ছোট করে আরো ভালো করে সামনে পরখ করে হতচকিত হয়ে যায়।
কিছুটা দূরে একটা কালো SUV দাঁড় করানো, তার পাশেই একটা সুঠাম দেহের ছায়ামূর্তি পিঠ গাড়ীতে ঠেকিয়ে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে; আর তার পাশ দিয়ে মন্থর গতিতে উড়ে যাচ্ছে নিকোটিনের ধোয়া । সে ঠিক সম্মুখে দাঁড়িয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকা সিগারেট মুখে চেপে ধোঁয়া টেনে নিয়ে, কিছুক্ষন পর ধোঁয়াটুকু নাক দিয়ে ছেড়ে দিলো।
তার নজর ঠিক কোনদিকে বুঝতে পেরে কাশফির কাধ চওড়া হয়ে এলো। কালো আর গোল্ডেন মানে এলিগেন্ট এবং পারফেক্ট। এই পারফেক্ট কৌশিক মির্জা যাই করুক না কেনো, তার কাকের ঠ্যাং এর মতো হাতের লেখা পরিবর্তন করতে অক্ষম। তার আগেই বুঝে নেওয়ার উচিত ছিল যে, এটা অন্য কেউ নয় কৌশিক মির্জা তার জন্য পাঠিয়েছে।
সে এলোমেলো হাতের লেখা আবার দেখে নেয়, এতো বাজে হাতের লিখা কারো হয় নাকি?
চুল ভেজা ছিল দেখে অফ পিরিয়ডে দশ মিনিটের জন্য চুল ছেড়ে দিয়েছিল। তেমন কেউ না দেখলেও কৌশিকের বাজপাখির মতো নজরের আড়াল হওয়ার সাধ্য কি তার আছে?
নেই।
রুমে এসে পৌঁছাতেই তার ফোনে টুংটাং মেসেজের শব্দ শোনা যায়। বক্সটা পড়ার টেবিলে রেখে ফোনে মেসেজ দেখে নেয়,
“ধন্যবাদ না হয় আমি নিয়ে নিলাম। তবে বলুন তো, আপনার এই সুন্দর হাঁসিটা দেখতে পাওয়ার জন্য কি প্রতিদিন বাজে হাতের হ্যান্ডনোট লিখতে হবে?”
মেসেজ টা দেখতেই তার উজ্জ্বল গাল আবার লাল বর্ণের হয়ে উঠে, সে কি আদো হেসেছিল?
নিজেকে একটা কড়া ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেনো হেসেছে সে? মনে মনে লজ্জা পেয়ে সে নিজেকে কঠিন করে মেসেজের উত্তর দিলো,
“এতো বাজে হাতের লিখা পড়ে দৃষ্টিশক্তির অপচয় করতে অনিচ্ছুক।”
তৎক্ষণাৎ এর ছোট্ট জবাব এলো — “Rude!“
কাশফি দেখেই বেরিয়ে পড়লো, ফোন টেবিলে রাখার পরপরই তার মাথায় চট করে ধরলো যে, সে আজ কৌশিক মির্জার সাথে নিজ থেকে কথা বলেছে। তার তো কৌশিক মির্জা কে ঘৃণা করার কথা!
নিজের কাণ্ডে নিজে হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলো।
#চলবে