অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২৪) #লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

0
108

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২৪)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

(Edited)
অতীত:

কোনো অমূল্য ভাস্কর্যের মতো স্টিয়ারিংয়ে রাখা পেশল শিরান্বিত হাত আর শক্ত চোয়ালে থাকা কোল্ড ফেইসের পুরুষ অবয়ব কাশফির মাথায় পরিভ্রমণ করতে থাকলো। অথচ সে স্টিয়ারিংয়ে বসা জোভানের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকিয়েই এসব ভাবতে মশগুল ছিলো, এত থার্ড ক্লাস কবে থেকে হলো সে?

“তুমি কি আমাকে পছন্দ করো না?”
জোভানের থমথমে গলা শুনে কাশফির হিতাহিত জ্ঞান ফিরে পেলো যেনো। সে বড় বড় চোঁখে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ মাথা ঝাঁকি দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলো,

“না তো? এমন কেনো মনে হলো আপনার?”

জোভান যেনো কাশফির কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলো না। এতে কাশফির নিজের কাছেই খারাপ লাগতে শুরু করলো। নিজেকে চরম রকমের সস্তা মনে হলো, বাগদত্তা সাথে নিয়ে বসে তো স্বাভাবিক সুষ্ঠ মানুষ আনমনা হতে পারে না।

এদিকে সে কেবলই এক ভাবনায় মশগুল। যেমন তার স্বপ্নে দেখা কোনো চেহারাই ঘুম থেকে ওঠার পর তার মনে আসে না, এমন কি শেওলা চোখের লোকটার চেহারাও সে একদিনে ভুলতে চলেছে। তার কি আদো কোনো মেডিক্যাল কন্ডিশন আছে? আর মিল তো সেদিন পেলো না, তাহলে কি করে লোকটা কৌশিক মির্জা না হয়? স্বপ্নে কেনো লোকটাকে কৌশিক মির্জা মনে হয়েছিল? এসবের ভিত্তি কতটুকু? উত্তর দিতেই সে চরম ব্যর্থ। ভাবনার মাঝে ইনিয়ে বিনিয়ে কৌশিক মির্জার আনাগোনা হাজার বার হয়। যাকে নিয়ে ভাবতে চায় না তাকে নিয়ে কেনো এমন বাড়াবাড়ি ধরনের চিন্তা তার?
মনে মনে সে বার বার বোঝালো, আজ হোক বা কাল কৌশিক থেকে সরে দাঁড়ানোই উত্তম। কৌশিক আর সে চম্বুকের দুই বিপরীত মেরুর মতো।

“তোমার কি আনকম্ফর্টেবল ফিল হচ্ছে? হলে বলো প্লিজ।”
জোভানের গলার স্বরের কিছু একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলো কাশফি। পাশে বসা লোকটা তার দুটো কাজিন আর কাশফিকে নিয়ে বাদ বাকি বিয়ের শপিংয়ে বেরিয়েছিল। যাবতীয় কেনাকানা শেষ হওয়া মাত্রই হুট করে তার কাজিনরা তাদের একা রেখে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। কেনো বিদায় নিয়েছে তা কাশফি আগে আন্দাজ না করতে পারলেও পরে দুই আর দুই মিলিয়ে নিয়েছে। জোভান একান্ত, ব্যক্তিগত টাইম স্পেন্ড করতে চেয়েছিল তাই এসব প্রি প্ল্যানিং করে রেখেছিল।

“না না তেমন কিছু না। আমি আসলে কথা কম বলি, আপনি বলুন আমি না হয় শুনি।”

কাশফি হাত নাড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি সেরে হালকা হাসার চেষ্টা করলো। এদিকে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে রাস্তা হতে একবার কাশফির দিকে চেয়ে জোভান তপ্ত নিশ্বাস ফেললো,

“তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই যা বলার আমি বলেছি তুমি তো কিছুই বলো নি।”

“আমি দুঃখিত।”

“সমস্যা নেই, আরে তুমি সরি কেনো বলছো? আচ্ছা কথা স্টার্ট না হয় তুমি কর।”
কাশফি মুখ খুলে কি বলবে খুঁজে না পেয়ে মুখ বন্ধ করে নেয়। কি জিজ্ঞেস করা যায় ভাবতে ভাবতে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ উদয় হয়। পরক্ষণে মুখ কালো করে ফেললো যা দেখে জোভান সহজ হওয়ার জন্য আবার বললো,

“আচ্ছা যাও আমিই বলছি, তোমার পছন্দের কোনো জায়গা আছে? আই মিন ঘোরাঘুরির জন্য।”

“আমি তেমন একটা ঘোরাঘুরি করিনি কখনো।”

জোভান চমকালো বোধহয়, আশ্চর্য্যন্বিত দৃষ্টি ফেলে আবার শুধালো,
“কখনো না?”

“না।”

“কোনো সমস্যা ছিল নাকি তুমি ঘরকুনো?”

“বাবা একা অতদূর যেতে আপত্তি করেছিলেন আর তাছাড়া কখনো বাবার সময়ও হয়ে ওঠেনি।”

জোভান জিভ দিয়ে হালকা ঠোঁট ভিজিটর নিলো,
“তুমি কি ঘুরতে যেতে চাও?”

“অবশ্যই! কে না চাইবে?”— কাশফির চোঁখে মুখে ঝলক ফুটলো। সে থেমে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি তো মনে হয় ঘুরতে ভালোবাসেন, তাই না?”

কাশফিকে নিজ থেকে কথা বলতে দেখে জোভানের বেশ প্রফুল্ল মনে হলো,
“এখন তেমন একটা সময় হয়ে উঠে না। তবে আমি সময় পেলেই প্রকৃতি বিলাসে ছুটে যাই। আচ্ছা, তোমাকে যদি সুযোগ দেওয়া হয় তবে তুমি কোথায় ঘুরবে?”

“সিলেট।”

“স্পেসিফিক্যালি তোমার কি কোনো হবি আছে?”

“তেমন কিছু নেই তবে টুকটাক বই পড়ি।”

“কবিতা পড়?”

“মাঝে মাঝে…”
হুট করেই তাদের কথোপকথন কেমন যেন শুন্য শুন্য শোনালো, এরপর একটা অকওয়ার্ড সাইলেন্স কাজ করলো। জোভান মাথার পিছনে হাত দিয়ে কিছু একটা ভেবে সেই নিরবতা মিটিয়ে পা নাড়াতে নাড়াতে বললো,

“আমার খুব পছন্দের কবিতার নাম ‘অনামিকা’ । একবার হলেও পড়ার অনুরোধ রইলো।”

“আপনি বললেন যেহেতু অবশ্যই পড়বো।”

“তুমি আমাকে তুমি করেই ডাকতে পারো।”

কাশফির হাসি মুছে গেলো। তবুও হাসার চেষ্টা করে বললো,
“আমি চেষ্টা করবো।”

কাশফির মুখের হাঁসিটাও যেন দ্বিধান্বিত হয়ে এলো। চেয়েও কথা বলার মতো কিছুই পেলো না। এদিকে হাঁস ফাঁস করতে থাকা জোভান কিছু একটা বলতে নিয়েও ঢোঁক গিলে কথাটুকু নিজের মাঝেই রেখে দেয়। যেতে যেতে রেইলওয়ের সামনে এসে গাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যেই মারাত্বক জ্যামে আটকা পড়লো।

বসতে বসতে বিরক্ত হয়ে কাশফি কাঁচ উঠানো গ্লাস কিছুটা নামিয়ে মাথা তুলে সিগনাল দেখে নিলো, ট্রেন আসতে তেমন সময় নেই। এই যান জটের মাঝে বাইরের ভ্যাপসা গরম গায়ে লাগলো কাশফির। অতিষ্ঠ হয়ে মাথা নামিয়ে এদিক সেদিক ফিরে যেই আবার গাড়ির গ্লাস তুলবে তার পূর্বেই তাঁর গরমের মাঝে শিরশির অনুভূতি হলো, তৎক্ষণাৎ শিরদাড়া বেয়ে এক সূক্ষ্ম শীতল শিহরণ বয়ে গেলো। কাশফি হাত মুঠ করে নেয়, দমকা হওয়ার বেগে মাথা পাশে ফিরিয়ে নিতেই লক্ষ্য করলো একটা কালো মার্সিডিজ তাদের গাড়ি হতে দুই ইঞ্চি দুরত্বে থেমেছে।
পরক্ষণে মার্সিডিজের গ্লাস হালকা নামানো হলে তার সাক্ষাৎ হলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা স্থির ধূসর চোখ জোড়ায়।

আগুনের স্ফুলিঙ্গ নিক্ষেপণ করে তাকে ঝ’ল’সে রাখ করে দেওয়ার মতো চাহনি ছিল এই শান্ত রকমের ধূসর চোঁখ জোড়ায়।
তার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো, চোঁখ জোড়া দেখে তার চিনতে বাকি রইলো না কে? কিছুক্ষণের মধ্যেই বুকের ভিতরে উথাল পাতাল শুরু করলো, হাত পা ঘেমে নেয়ে একাকার।
কাশফি জানে, এই দৃষ্টি যতটুকু শান্ত দেখাচ্ছে ঠিক তার বিপরীত। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে কাশফি গাড়ির কাঁচ উঠিয়ে দিলো। কিন্তু তবুও নার্ভাসনেস কমার নাম নেই, তাই জোর পূর্বক নিজের মনোযোগ জোভানের রাখার চেষ্টা করছিল কিন্তু বরাবরই সে ব্যার্থ হলো। কৌশিকের চা’কুর মতো দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে সে আজও হিমশিম খায়।

আধা ঘণ্টা পর জোভানের গাড়ি তার বাসার সামনে এসে থামলো, কাশফি নরম হেসে বাসায় আসার কথা বললে জোভান না করে দিলো।

“চা নাস্তা না নিলেও আপনি বাবার সাথে দেখা করে যান।”

“তোমার হাতের চা খেতে বেশি দিন বাকি নেই, ঈশিতা। তাই আজ চললাম।”
কাশফি বোধহয় একটু ইতস্তত বোধ করলো তবুও মুখে হাসি রেখে বিদায় নিয়ে তার দরজার দিকে পা বাড়ালো। জোভান তখনও হাঁসফাঁস করছিল, কিছু বলার দরকার কিন্তু সে বলতে বরাবরই ব্যার্থ। কাশফি বেল চাপতে নিলে সে জোর গলায় কাশফিকে ডাকলো। কাশফি আশ্চর্য্য হয়ে তৎক্ষণাৎ পিছনে ফিরে তাকালো,

“ঈশিতা, তুমি আমার ‘অনামিকা’ হবে?”

“জ্বি?…”
কাশফি আরেক দফায় চমকালো বোধহয়, অক্ষিপট পিট পিট করে ফেলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

“জবাব না হয় কবিতা পড়েই দিও।”
কাশফিকে জবাব দেওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়ে সে গাড়িতে উঠে দ্রুত প্রস্থান করলো শুধু পড়ে রইলো হতবম্ব কাশফি।

***

অনামিকা
কাজী নজরুল ইসলাম

‘ কোন নামে ডাকব তোমায়
নাম-না-জানা- অনামিকা
জলে স্থলে গগনে-তলে
তোমার মধুর নাম যে লিখা।
গীষ্মে কনক-চাঁপার ফুলে
তোমার নামের আভাস দুলে
ছড়িয়ে আছে বকুল মূলে
তোমার নাম হে নিকা।

বর্ষা বলে অশ্রুজলের মানিনী সে বিরহিনী।
আকাশ বলে, তরিতে লতা, ধরিত্রী কয় চাতকিনী।
আষাঢ় মেঘে রাখলো ঢাকি
নাম যে তোমার কাজল আঁখি
শ্রাবণ বলে, যুঁই বেলা কি?
কেকা বলে মালবিকা।
শারদ-প্রাতে কমল বনে তোমার নামে মধু পিয়ে

বানীদেবীর বীণার সুরে ভ্রমর বেড়ায় গুনগুনিয়ে!
তোমার নামের মিল মিলিয়ে
ঝিল ওঠে গো ঝিলমিলিয়ে
আশ্বিণ কয়, তার যে বিয়ে
গায়ে হলুদ শেফালিকা।

নদীর তীরে বেনুর সুরে তোমার নামের মায়া ঘনায়,
করুণা আকাশ গ’লে তোমার নাম ঝরে নীহার কণায়
আমন ধানের মঞ্জরীতে
নাম গাঁথা যে ছন্দ গীতে
হৈমন্তী ঝিম্ নিশীতে
তারায় জ্বলে নামের শিখা।

ছায়া পথের কহেলিকায় তোমার নামের রেণু মাখা,
ম্লান মাধুরী ইন্দুলেখায় তোমার নামের তিলক আঁকা।
মোর নামে হয়ে উদাস
ধুমল হোলো বিমল আকাশ
কাঁদে শীতের হিমেল বাতাস
কোথায় সুদূর নীহারিকা।

তোমার নামের শত-নোরী বনভূমির গলায় দোলে
জপ শুনেছি তোমার নামের মুহহুমুর্হু বোলে।
দুলালচাঁপার পাতার কোলে
তোমার নামের মুকুল দোলে
কুষ্ণচুড়া, হেনা বলে
চির চেনা সে রাধিকা।

বিশ্ব রমা সৃষ্টি জুড়ে তোমার নামের আরাধনা
জড়িয়ে তোমার নামাবলী-হৃদয় করে যোগসাধনা।
তোমার নামের আবেগ নিয়া
সিন্ধু উঠে হিল্লোলিয়া
সমীরনে মর্মরিয়া
ফেরে তোমার নাম -গীতিকা। ’

***

সন্ধ্যার পরপর মুখ কালো করে কাশফি পড়াচোর কায়েসকে লাঠি নিয়ে পড়তে বসিয়েছে। এমনিতেই কৌশিকের জন্য নিজের উপর রাগ জমে আছে তার, আর এদিকে কায়েসের একবার কলম পড়ে যাচ্ছে, একবার রাবার হারিয়ে ফেলছে, একবার পেন্সিল ভেঙে ফেলছে দেখে কাশফির মেজাজ তুঙ্গে উঠেছে। সে কায়েস কে চেঁচিয়ে কিছু বলবে তার আগেই নিচে থেকে কথা বলার শব্দ শুনতে পেলো। উঁকি মেরে নিচে তাকাতেই মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ মানুষকে তার বাবার সাথে কথা বলতে দেখলো। লোকটা কে দেখা মাত্র চিনতে অসুবিধা হলো না। ইনি কৌশিকের বাবা তোফায়েল আহমেদ মির্জা। কিন্তু এখানে কেনো এসেছেন?

সন্দেহ নিয়ে কাশফি এবার মনোযোগ দিয়ে তোফায়েল মির্জার কথা বার্তা শুনতে লাগলো, তার কথার ধাচ ভঙ্গি অনেকটা কৌশিকের মতোই। তবে যখন তিনি কাশফির বাবাকে মেয়ে আয়ত্তে আনার কথা বললেন তৎক্ষণাৎ কাশফির মেজাজ গরম হয়ে এলো। তোফায়েল মির্জা আর কিছু বলার আগেই দোতলার রুম থেকে কাশফি ঝাঁঝালো আওয়াজ এলো—

“আপনার পুত্রকে আমার গলা থেকে নামিয়ে আমাকে উদ্ধার করুন। আপনার ঘাড়ত্যাড়া ছেলে আমার পিছনে কুকুরের মতো পড়ে আছে সেটা আমার মান সম্মানের লাগার বিষয়।”

মেয়ের কথার ভঙ্গি ধরে অতিকুর রহমান কঠোর হয়ে বললেন,
“ঈশিতা, আমি দেখছি!”

কিন্তু কাশফি আজ আর থামলো না, সে আবার আগের মত করে বললো,
“ভুলভাল জিনিস মনে পুষবেন না, দরজা আপনার ঠিক সামনে।”

এদিকে তোফায়েল মির্জা চোঁখ গরম করে মুখ শক্ত করে দাড়িয়ে পড়লেন, রাগে ফেটে পড়ার উপক্রম তার। কিন্তু ঘরে বিয়ের আমেজ তাই আতিকুল ইসলাম কোনো সমস্যা চান না তাই ভদ্রতার খাতিরে বললেন,
“আমার মেয়ের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। আমাদের বাসায় এসেছেন অবশ্যই কিছু খেয়ে যাবেন, আজ খিচুড়ি রান্না হয়েছে আপনি বসুন আমি আনছি।”

আতিকুর রহমান তোফায়েল মির্জার জবাবের অপেক্ষা করলেন না, তিনি পা বাড়ানোর আগেই কাশফি থমথমে গলায় বললো,
“বাদ দাও বাবা, খিচুড়িতে ইঁদুর পড়েছে। বড়লোকের গলায় এসব নামবে না।”

আতিকুর রহমান তপ্ত নিশ্বাস ফেলে মেয়েকে অগ্রাহ্য করে আবার বললো,
“আপনি বরং বসুন আমি চা করে দিচ্ছি।”

“চা পাতা শেষ হয়ে গিয়েছে বাবা।”

তোফায়েল মির্জা ততক্ষণে আর দাঁড়ালেন না, গমগমে সুরে তেজী গলায় বললেন,
“ভারী বেয়াদপ তোমার মেয়ে!”

কাশফিও থামলো না, তোফায়েল মির্জা বেরোনোর আগেই বললো,
“সেটা আপনার যোগ্য পুত্র বুঝে যদি আমাকে বিরক্ত করা ছেড়ে দেয় তবেই হলো।”

***

“তুই না ছেলেটারে দেখেই বিরক্ত হতি?”

কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অলস পায়ে হেঁটে চলছে চারজন, তবে তরীর কথার উত্তর দিতে কাশফির হিমশিম খেতে হলো। কেবল ঈশান মূলত আছে ফোন নিয়ে, দিন দুনিয়ার খবর না রাখলেও চলে। কেবল কাশফির বিয়ের কথা শুনে সে হ্যাবলার মতো হেঁসে উত্তর দিয়েছিল— “দাওয়াত দিয়েছিস ভালো কথা কোনো গিফট নিতে পারবো না।”

সংশয় নিয়ে তাকিয়ে থাকা তরীর উত্তর ফারাবী মুখ বাঁকা করে দিলো,
“তার কি আবার পছন্দ আছে নাকি? তার তো অভ্যাস যাকে দেখবে তাকে নাক সিটকাবে।”

তাদের দুজনের মতামত উপেক্ষা করে কাশফি বললো —
“বাবার পছন্দ মানে আমার পছন্দ, তাছাড়া আমার তেমন কাউকে পছন্দ ছিল না যে আমি বিরোধিতা করতে যাবো।”

“কেনো কৌশিক মির্জা কে কি বিবেচনায় রাখলি না?”

তরীর কথা শোনা মাত্রই কাশফির লোম দাঁড়িয়ে গেলো, খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সে,
“বিবেচনায় রাখার মতো সে কেউ ছিল না।”

কিন্তু তরী নাছোড় বান্দা তাই কোমরে হাত দিয়ে কাশফির পথ রুখে দাড়ায়,
“কম বেশি সবাই জানে কৌশিক মির্জা কেনো ক্যাম্পাসে নজরদারি রাখে। বলতো কি লুকাচ্ছিস তুই?”

“আমার জন্য সে মানুষ হিসাবে খুবই নির্দয় ধরনের, রাজনীতিতেও জড়িত ছিল। তাই তাকে এড়িয়ে চলতে চাই, এইটুকুই।”

তরী আর কথা বাড়ায় কেবল মাথা নাড়ায়। কাশফি বুঝতে পারলো না সে বিশ্বাস করেছে কিনা। তরী কিছুক্ষণ পর দ্বিধাগ্রস্থ হয়েই জিজ্ঞেস করলো,
“মাহিন কি আসছে?”

“কথা হয়নি আমার।”
তরী আবারও মাথা নেড়ে চুপ হয়ে গেলো, তরী আর মাহিনের ঝামেলার পর থেকে কাশফি এমনিতেও তার সাথে খুব একটা যোগাযোগ রাখেনি। এখন তরীর মনের অবস্থা সে বুঝলো না তবে আর ঘাটলো না।

তাদের মাঝে নিরবতা কাটলো তখন, যখন একটা বলিষ্ঠ হাত হুট করে কাশফির হাত টেনে নিয়ে শক্ত করে ধরলো। কড়া ম্যানলি পারফিউমের ঘ্রাণ আর জোর দেখে যা বোঝার কাশফি বুঝে নিলো। ক্যাম্পাস কাঁপিয়ে তার রাগী স্বরে হাস্কি কন্ঠ শোনালো,

“কাল বাবা আতিকুর রহমানের বাড়ি গিয়েছেন, তোমাকে দেখেছিলেন?”

কাশফি হতবাক বনে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল, পরক্ষণে হুস ফিরে পেতেই দেখলো আশপাশের সবাই তাকেই দেখছে। তাই পরিস্থিতির সামাল দিয়ে মোচড়ামুচড়ি না করেই শান্ত কণ্ঠে বললো,

“তাতে আপনার কি?”
কৌশিক এবার যেনো রেগে আগুন কাশফিকে নিজের একেবারে কাছে টেনে তার নরম গাল শক্ত করে চেপে ধরলো। ফলে কাশফি তৎক্ষণাৎ চোঁখ কুচকে বন্ধ করে কঁকিয়ে উঠলো।
“প্রশ্ন করছি ঠিক ঠাক জবাব দাও!”

কৌশিকের কণ্ঠে তেজ দেখে সে থমকালো না বরং তার দুই হাত দিয়ে কৌশিকের হাত খামচে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“আমাকে ছাড়ুন, সবাই দেখছে!”

“আমার বাবা তোমাকে দেখেছিল? তুমি তার সামনে এসেছিলে?”

কৌশিকের তুমি সম্মোধন তার বড্ড অচেনা তবে সে কথা বাড়ালো না তাই ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“দেখেন নি।”

“তাহলে কথা কিভাবে শুনলেন?”

“আমি উপরে ছিলাম”
এবার কৌশিকের হাত আলগা হয়। তবুও সে ক্ষুব্ধ দৃষ্টি কাশফির দিকে রেখেই বললো— “তুমি বাবার সামনে কক্ষনো যাবে না।”

কাশফি দ্রুত সরে গিয়ে কৌশিক কে রাগানোর জন্য গা জ্বালা হাসি দিয়ে বলল,
“আপনার বাবা থেকে আমাকে কেনো লুকাতে চাইছেন, মিস্টার মির্জা?”

কিন্তু কৌশিক রাগলো না, বরং গম্ভীর স্বরে বলল,
“কল মি কৌশিক। মিস্টার মির্জা আমার দাদা ছিলেন আমি না।”

কাশফি বিশ্রী রকমের একটা গালি দিয়ে চলে যেতে চাইলে কৌশিক তার হাত ধরে ফেলে। এতে কাশফি চোয়াল শক্ত করে,শক্ত করে ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ছাড়ুন!”

“জোভান কে না করে দাও।”
মুহূর্তেই কাশফি থমকে যায় যেনো। চৌকিত হয়ে সে বড় বড় চোখ করে একটা হিউমরলেস হাসি দিলো,

“বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আগেই, দুইদিন পর আমি তার ঘরণী হবো। আর আপনি কোথাকার কে হয়ে নিজের মতামত রাখলেন?”

“বড্ড জ্বালাতন করছো কাশফি। কথা দিলাম একবার বিয়ে করে নিই তোমার ব্যবস্থা নিজ হাতে করব।”

“ছিঃ আপনাকে বিয়ে কে করবে?”

“ছিঃ নয় ডার্লিং জ্বি হবে ওটা।”

“আর যাই হোক আমার বিয়ে জোভানের সাথেই হবে, এবার অন্তত বিরক্ত করা ছেড়ে দিন!”

“সুইটহার্ট, আমার এসবে তুমি মোটেও বিরক্ত হও না কাশফি, বরং তুমি বিরক্ত হতে চাও কিন্তু পারো না। এম আই রাইট?”
কৌশিকের কথায় কাশফি শুকনো ঢোঁক গিললো, তার হাত পা ঘামছে প্রচুর। আর এভাবে মানুষজন তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সে আরো নার্ভাস। সে মুখ শক্ত করে ঝাঁঝালো গলায় বললো,

“কত বার বলেছি আমায় ঈশিতা ডাকবেন, ঈশিতা!”

“এইযে, কি সুন্দর আমার কথা এড়িয়ে চললে তুমি।”

“ছাড়ুন!”

কিন্তু উল্টো কৌশিক তাকে কাছে টেনে তার তর্জনী দিয়ে কাশফির চিবুক উপরে তুলে কপালে প্রলম্বিত চুমু আঁকে, ততক্ষণে পরিবেশ ভয়ঙ্কর রকমের শান্ত।

“কাশফি, বিয়ে তুমি আমাকে করছো আর ঘরণীও আমার হবে, দেখে নিও!”

#চলবে…

আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here