অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২৭) #প্রোপীতা_নিউমী

0
60

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২৭)
#প্রোপীতা_নিউমী

ক্যাফে ব্লু হ্যাভেনের পার্কিং এরিয়ায় সাদা টয়োটা থামতেই হনহনিয়ে রঙ চটা টিশার্ট, উসখো খুশকো চুলে ড্রাইভিং সিট হয়ে দুম করে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে আসলো জোভান শিকদার। কালি পড়া চোখে রক্ত জমে আছে, রাগে গজগজ করতে করতে লা থি মেরে খুললো ক্যাফের দরজা। মুষ্ঠিমেয় হাতে চোখ বুলিয়ে, মাথা ঘুরিয়ে টেবিলগুলো দেখে খুঁজে নিলো তাকে,

নীল পাঞ্জাবি পরে পায়ের উপর পা তুলে ভদ্র কাদায় কফির কাপে চুমুক দিলো কৌশিক মির্জা। তার পাশে মাউথ এন্ড ইয়ার পিস লাগিয়ে লেভিন সোজা দাঁড়িয়ে হাতের প্যাড ঘেঁটে কৌশিককে কিছু বলতে ব্যস্ত তবে তার ইন্দ্রিয় সজাগ। কিছু একটা আন্দাজ করা মাত্রই সে প্যাড থেকে মাথা তুলে জোভানের চোখে চোখ ফেললো। তারপর খুব দ্রুত অনিমেষ নেত্রে লেভিনের ভাবভঙ্গির পরিবর্তন ঘটলো, তার মুখে একটা রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে জোভানকে দুইদিন আগের কথা মনে করিয়ে দিলো। তৎক্ষণাৎ জোভানের গায়ের ঘায়ে নুন লাগার মতো মনে হলো।

তার আর কাশফির বিয়ের দিন সে আর তার পরিবার বাসা হতে ঠিকই রওনা হয়েছিলেন কিন্তু গাড়ি ভুল জায়গায় এসে দাঁড়ায়, বিয়ের আসরে কনে দেখে সে থতমত খেয়ে গেলো পরে গ্যাঞ্জাম বেঁধে যাওয়ায় বুঝতে বাকি রইল না যে সেখানকার বর অন্যকেউ ছিল। বরযাত্রীর গাড়ি খুঁজতে খুঁজতে আরেকটা বিপত্তি বাঁধলো, বরের গাড়ি ড্রাইভার নিয়ে উধাও, এদিকে বরের গাড়ির ড্রাইভার যে ছিল সে গাড়ি চালিয়েছিল বলে অস্বীকার জানালো। পরে জানতে পারলো ড্রাইভার অন্যকেউ নয় কৌশিকের রাইট হ্যান্ড লেভিন আফসার ছিল বলেই ছলে কৌশলে সকলের অগোচরে এত সুন্দর করে কার্য সাধন করেছে। কিন্তু তখন অতি বিলম্বে অঘটন ঘটে গিয়েছিল তবুও মনের জোরে জোভান পঁয়তাল্লিশ মিনিটের রাস্তা হাই স্পিডে গাড়ি চালিয়ে বিশ মিনিটে এসে পৌঁছায়, ভেন্যু তে হাজির হয়ে সব কিছু এলোমেলো দেখে সে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো।
সেইদিন বহুবার কাশফির নাম্বারে কল করেও তাকে আর পাওয়া যায়নি। শরীর এতটাই খারাপ হয়েছিল যে তার হাত পা অবশ হয়ে এসেছিল। অসুস্থ, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে সে পরের দিন কাশফির বাড়িতে গিয়ে খালি বাড়িটায় শুন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা আতিকুর রহমানকে পেল কেবল।

লেভিন খানিকটা ঝুঁকে কৌশিকের কানে কিছু একটা বলেই অতি দ্রুত প্রস্থান করলো তবে যাওয়ার পূর্বেও জোভানের উদ্দ্যেশ্যে তার মুখের হাঁসি আরো প্রকট করে নিলো। কৌশিক তার ফোন পাঞ্জাবির পকেটে রেখে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নেয়, তারপর মাথা না তুলেই আবার কফির কাপে চুমুক বসায়। এদিকে জোভান ফুঁসতে ফুঁসতে এসে কৌশিকের টেবিলে এসে জোরে শব্দ করে হাত রেখে চ্যাচালো,
“খুব শখ না তোর আমার জিনিসে বাড়াবাড়ি ধরনের আগ্রহ রাখার?!”

উপস্থিত ক্যাফের সকলেই ঘাড় ঘুরিয়ে মনোযোগ কৌশিকের টেবিলে রাখলো, ক্যাফের ভিতরের আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা তবুও কৌশিক সুধীর এবং নিরূদ্বেগ। তাকে কেবল কফির কাপের রিমে আঙ্গুল ঘুরাতে দেখা গেলো। এতে জোভানের মেজাজ আরো বিগড়ালো, নিমিষেই হাত দিয়ে এক ঝাটায় টেবিল হতে কাপ আঁচড়ে ফেলে ভেঙে টুকরো করে ফেললো।

“ওই অ’জা’ত, কথা কি কানে যাচ্ছে না?”

কৌশিকের কান খাড়া হয়ে এলো, মাথার রগ ফুলতে শুরু করেছে। টেবিলে রাখা হাত জোড়া মুষ্ঠিমেয় করে তির্যক দৃষ্টি ফেলে আঙ্গুল উঠিয়ে ইশারায় বসার জন্য দেখলো। তারপর কৌশিকের নিচু স্বরের গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“বসে কথা বল জোভান শিকদার।”

জোভান শুনলো না বরং আরো কয়েকটা গালি গালাজ করে ক্ষান্ত হলো।
“শু য়ো রের বা’চ্চা কি করেছিস ঈশিতার সাথে? কোথায় আটকে রেখেছিস?!”

কথা গায়ে মাখলো না সে। ভাবলেশহীন ভাবে শ্রাগ করে জবাব দিল কৌশিক,
“আমার নতুন বউ যেহেতু আমার সাথে নেই অবশ্যই আমার বাড়িতে থাকবে, Where is your common sense?”

“তুলে নিয়ে বিয়ে করেছিস, আবার সাহস কি করে হয় বউ বলার?! তোকে আমি খুন করবো খুন!”

একটা তপ্ত নিশ্বাস বেরিয়ে এলো কৌশিকের, চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্তির ভাবভঙ্গি প্রগাঢ় করে নিলো। তারপর বুকে হাত ভাঁজ করে নিয়ে বিরস কণ্ঠে বললো,

“মিসেস মির্জাকে কবে থেকে চিনিস? তিন দিন? তিন মাস? তিনবছর? কিন্তু আমার আর তার সম্পর্ক এক যুগের চেয়েও পূর্বের। তাহলে বল তুই কে রে? কেনো কানের কাছে প্যান প্যান করছিস?!”

ক্রুদ্ধ হয়ে তেজস্বী গলায় উত্তর দিলো জোভান,
“আমি কে?! ঈশিতাকে আমি ভালোবাসি, সেও আমাকে পছন্দ করে!”

“আতিকুর রহমান তোকে পছন্দ করেছিল আর ঈশিতা তার বাবা বাবার বাধ্য মেয়ে বলেই টু শব্দ করেনি।”

“তোর বলা একটা কথাও আমার বিশ্বাস হয়না কৌশিক। শি হেইটস ইউ এন্ড আই নিড টু টক উইথ হার!”

জোভানের জোরালো ডিমান্ডেও কৌশিক অনড় রইলো। চোয়াল শক্ত করে বিরক্তিমায় চোখ উল্টে নেয় তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে একটা কল রেকর্ডিং অন করলো। জোভান ভ্রু কুঁচকে বিচলিত হলো, রাগে আরো কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই ফোনে তাদের এঙ্গেজমেন্টের দিনের কাশফির আর ডক্টর খানের কথোপকথন শোনালো। পুরো কথপোকথনে কাশফিকে বেশ নার্ভাস আর গিল্টি শোনালো। কথপোকথন কি নিয়ে সেটা বুঝার পরপরই জোভান স্তব্ধ, শুন্য চোখে শুধুই শুনে গেলো। তার বুক চিরে হাহাকার আর বেদনা অক্ষিপটে ভাসা ভাসা প্রকাশ পেলো কেবল। পুরোটা রেকর্ডিং শোনার পর জোভান বিপর্যস্ত অবস্থায় বসে পড়লো চেয়ারে। মাথা নিচু করে চুল খামচে ধরতে ধরতে ভাবলো দরদ না দেখিয়ে মেয়েটা যদি তাকে জানাতো তবে কষ্ট কম হতো বোধহয়।

“She was meant to be mine. Now and always.”
আঙ্গুল তুলে প্রমাণ সহযোগে প্রকট অধিকার দেখিয়ে কৌশিক ক্ষ্যান্ত এবং পুরোদমে সন্তুষ্ট।

নির্দয় কৌশিকের কোনো খারাপ লাগা কাজ করলো না, বরং সে বুক ফুলিয়ে একটা তৃপ্তির হাসি দিলো। বের হতে উঠে দাড়িয়ে পড়লো তারপর ফোন পকেটে ঢুকাতে যাবে তার আগেই একটা মেসেজ দেখলো স্ক্রিনে। মেসেজ শো করতেই সে একটা ছবিতে সে রেস্টুরেন্টে বসা এক উদ্ভট দেখতে পুরুষ আর কাশফিকে দেখতে পেলো।
চোয়াল শক্ত করে কৌশিক বেরিয়ে পড়লো, ব্যাস্ত গতিতে গাড়িতে উঠে দ্রুত কল লাগিয়ে তার অ্যাসিসটেন্টকে শুধু এক বাক্যে বললো সে অফিসে আসছে তার মিটিং অ্যারেঞ্জ করতে।

তার পাশে রোবটের ন্যায় বসা লেভিন প্যাডে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছিল। কৌশিক চোখ বন্ধ করে মাথা পিছনে এলিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে সোজা হয়ে রইলো। তার স্কাল্পটেড পুরুষালি তীক্ষ্ণ চোয়াল শক্ত করে নেয় পরপর কনুই হাঁটুতে রেখে হাতদুটো জড়ো অবস্থায় মুষ্ঠিমেয় করে চিবুকের নিচে তুলে ভাবুক ভঙ্গিমায় ধরলো।

“লেভিন, আমাকে এই মুহূর্তে লোকটার ব্যাপারে সব ডিটেইলস বলো।”

লেভিন প্যাড থেকে মাথা না তুলেই তার বলিষ্ঠ রুক্ষ কণ্ঠে গড়গড় করে বলে গেলো,
“রবার্টের আসল নাম মিনহাজ করিম। সে একজন সরকারি গুপ্তচর ছিলো, মোটা অংকের টাকা খাওয়ায় বরখাস্ত করা হয়েছিল তাকে। তারপর থেকে রবার্ট প্রাইভেট গুপ্তচর হিসাবে নিয়োজিত আছে। তার কাজ ভালো তবে বর্তমানে ডিমান্ড খুবই কম। তার বাবা মা জীবিত নেই, স্ত্রী ছিল তবে সে তার এক ধনী ক্লায়েন্টের সাথে পরকীয়ার লিপ্ত হয়ে তাকে তালাক দিয়ে সেই ক্লায়েন্টকে বিয়ে করে নেয়। মিসেস মির্জা আজ সকালে সেখানে মূলত আপনার প্রাইভেট স্কুলগুলোর ডোনেশন আর শেয়ারস নিয়ে যাবতীয় তথ্য জানতে রবার্টকে হায়ার করেছেন।”

কৌশিক চোখ বন্ধ করে মাথা নড়লো,
“তোমার ম্যাডাম তাকে কত টাকায় সাইন করেছেন?”

“এক লাখ। Command me boss, রবার্টকে তুলে নিতে দেরি হবেনা।”

কৌশিক ডিসমিস ভঙ্গিতে হাত তুলে মাথা নাড়লো। একটা গেইম যদি শুরুতেই শেষ করে দেওয়া হয় তবে মজা কিসের? উত্তেজনা কাজ করুক সে তো আছেই। এমনিতেই কাশফিকে দমানো সম্ভব না। অতীত যে করেই হোক কাশফি জানবে, আজ হোক কাল। সে চায় তার বউ সন্ধান করুক, যতদূর চায় সে যাবে সমস্যা নেই। তবে তাকে আড়ালে রেখে নয়, তাকে আর নেমসিস রেখে নয়।

“আমি তোমার ম্যাডামের শুভাকাঙ্ক্ষী, আশা করি সে যে কাজ করছে সেই কাজে সফল হোক।”

***

কোনো রকম রুমে প্রবেশ করে গায়ের ওড়না ফেলে এসি অন করে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লো কাশফি। এই খা খা রোদ্দুরে রিক্সা করে আসা যাওয়ায় ঘেমে নেয়ে আর গলা শুকিয়ে চৌচির। গরমে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে, এদিকে চোখ বন্ধ করে হাঁপাতে হাঁপাতে ক্লান্ত সে। কম কথা বলার দরুন খুব একটা মানুষের সাথে মিশতে অনিচ্ছুক সে। আর আজ তো বিরক্তিই চলে এসেছিল। কিছুক্ষণ আগে কাজের সূত্রে এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে রবার্টের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।

সেখানে গিয়ে প্রচুর উদ্ভট রকমের একজন লোক দেখতে পেলো সে, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে বোধহয়। দুই কানে, কানের লতিতে, নাকে, চোখের ভ্রূদ্বয়ে পিয়ার্সিং করা তার। চুলে ব্লন্ড সেড করার জন্য ব্লিচ করেছিল বোধহয় কিন্তু ব্লন্ডের পরিবর্তে চুল গুলোতে ঝাড়ুর মতো রং হয়ে আছে। বয়সের সাথে তার পোশাক আশাক বড্ড বেমানান। কাশফি টেবিলের সামনে এসে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললো,
“রবার্ট?”

সাথে সাথেই লোকটা তাকিয়ে কেমন অদ্ভুত হাসি হাসলো,
“ওয়ান এন্ড অনলি, বিউটিফুল। আর তুমি?”

“আমি সামিয়া।”
ফট ফট করে মিথ্যা কথা বলতে কাশফির এক মুহুর্ত ও লাগলো না।

“কিছু অর্ডার করিনি কারণ আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, প্লিজ।”

কাশফি মাথার ঘোমটা আরো কিছুটা টেনে ব্যাগ টেবিলে রেখে বসতে বসতে বললো,
“আমি খেতে বসিনি রবার্ট, মূল কথায় আসি। আমি কৌশিক মির্জার শেয়ারস নিয়ে ডিটেইলস জানতে চাই।”

“এমপির ছেলে কৌশিক মির্জা?”

“জ্বি।”

“কেনো?”

প্রশ্ন করার ধরন দেখে কাশফি আরো বিরক্ত, মেজাজ খারাপ করে লাভ হবে না তাই চোখ পাকিয়ে থমথমে গলায় জানালো,
“ব্যক্তিগত কোনো প্রশ্ন করার প্লেসে আপনি নেই মিস্টার রবার্ট।”

“My, My, আমি আসলেই জানতে ইচ্ছুক এতো সুন্দর মেয়ে কৌশিক মির্জা নিয়ে কেনো ইন্টারেস্টেড!”

“Stay out of my business.”

“ক্লায়েন্টের সাথে সিভিলভাবে কথা বলতে চাইছি, এসব জানতে হবে। হোপ ইউ এঞ্জেইজ উইথ মি।”

কাশফি মুখ দিয়ে বিরক্তির শব্দ বের করে, তারপর মুখ বেজার করে গম্ভীর গলায় বানোয়াট মিথ্যা সত্য সাজিয়ে বললো,
“সে আমার এক্স, but we are over the phase.”

“আসলেই…?”

“So over, রবার্ট। এখন কাজের বিষয়ে আসি?”

“অবশ্যই।”

“গত ১০ বছরে কৌশিক মির্জার যতগুলো প্রাইভেট স্কুলের ডোনেশন আর শেয়ার্স কিনেছে তার সকল তথ্য আমার চাই। বিশেষ করে পুষ্পকুঞ্জ একাডেমী নামের প্রাইভেট স্কুল নিয়ে আমি আগ্রহী। তাছাড়া আপনাকে আমি পঞ্চাশ হাজারে সাইন আপ করছি, কোনো এডভ্যান্স ছাড়া।”

“মাত্র পঞ্চাশ হাজার? আমি কি অত সস্তা?!”

“দেখুন রবার্ট, You need me more than I need you.”

কাশফির স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড জবাবে রবার্ট থতমত খেয়ে গেলো। অপমানে কড়া কিছু একটা বলবে তার আগেই কাশফি আবার বললো,
“হ্যাঁ নাকি না? আমি অপেক্ষা করছি, আপনি কাজ করতে অনিচ্ছুক হলে আমার আরো কয়েকজনের সাথে দেখা করা বাকি।”

পরিস্থিতি বুঝে রবার্ট অপমান গিলে নেয়, তবে মুখে আগের মতো বাজে হাসি টেনে বললো,
“ঠিকাছে কিন্তু কৌশিক মির্জার টেষ্ট বলে কথা, তাই আমি তোমাকে জানতে আগ্রহী। কী বলো?”

কাশফি সজোরে টেবিলে দুম করে হাত রেখে উঠে পড়ে, তারপর দাঁত কড়মড় করে চোখ দিয়ে শাসিয়ে দিলো,

“এক লাখ টাকা আপনার, পরিবর্তে আপনি আমার কোনো পারসোনাল জিনিসে ইন্টারফেয়ার করবেন না এবং কৌশিক মির্জা যেনো এসবের কিছুই জানতে না পারে। শেষ বারের মতো প্রস্তাব রাখছি!”

“ঠিক আছে।”

“উঠছি, আশা করি শীগ্রই সঠিক তথ্য উদ্ঘাটন করে কল করবেন।”

“এটা আমার কার্ড আর আমার পার্সোনাল নাম্বার যদি…”

“রবার্ট লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম, নিজেকে সংযত রাখার। প্রয়োজনে কল দিবেন নতুবা ডিস্টার্ব করবেন না, আপনি অবশ্যই চান না এই ছোট ক্যারিয়ারে আরেকটা নতুন অভিযোগ যুক্ত হোক!”

কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে না নিতেই তার দরজায় টোকা পড়লো, সে প্রথমে ভাবলো কায়েস কিন্তু দরজা খুলে দেখলো একজন মহিলা স্টাফ এসে তাকে নিচে যেতে বলে চলে গেলো। ওড়না ঠিকঠাক গায়ে দিয়ে নীচে নামতেই মাধবীর পাশে একজন মধ্যবয়সী মহিলা আর অন্যজন স্ট্রেইট চুলে স্লিভলেস টপস্ পরা মেয়েকে দেখতে পেলো। মেয়েটার গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, ওয়েস্টার্ন কালচার মেইনটেইন করা অত্যাধুনিক এপিয়ারেন্স তার। মাধবী কাশফিকে দেখেই পরিচয় করিয়ে দিলেন তার বোন মালতী আর তার বোনের মেয়ে অনামিকার সাথে।
অনামিকা তার দিকে চাইলো না বরং এমন একটা ভঙ্গি করলো যেনো সে এখানে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনিমন্ত্রিত। মাধবী কাশফির পাশে দাঁড়িয়ে তাকে রান্নাঘরে আসতে বললো, পিছন পিছন কাশফিও এসে পৌঁছালো কিচেন রুমে।

“আমি যখন এই বাড়িতে নতুন এসেছিলাম তখন আমার শ্বাশুড়ি আমাকে দিয়ে বাইশ পদের রান্না একা করিয়েছেন।”

কাশফি ঘাবড়ে গেলো। এই গরমে ক্লান্ত হয়ে আবার এসব ঝামেলার কাজ ধরবে? মাথা নত করে মুখ শক্ত করে দাড়িয়ে রইলো। আগে রান্নাবান্না করেনি এমন নয়, প্রায়ই করতো তবে তাদের বাসার মানুষজনের জন্য দুই পদই যথেষ্ট ছিল। কায়েস বাহানাবাজি করে যা খেতো আর তার বাবার যেকোনো সবজি হলেই চলতো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে আবার মাধবীর কথা শুনলো,

“ঘরে মেহমান এসেছে তাই আমি চাইছি আজকের রান্না তোমার হাতেই হোক। কি কি পদ তৈরি করবে রিম্পির কাছে আমি লিস্ট করে দিচ্ছি।”

***

যেখানে কৌশিকের ফিরার কথা সন্ধ্যায় সেখানে কৌশিক দুপুরের আগেই হাজির হলো। তার বাবার সাথে কথা বলার পর থেকেই মেজাজ তুঙ্গে আছে। সে শক্ত মুখে তড়িঘড়ি করে উপরে উঠে কামরায় কাশফিকে খুঁজে না পেয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। কক্ষ থেকে বের হয়ে একজন মহিলা স্টাফ কে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তরে জানায়,
“ম্যাডাম তো রান্নাঘরে।”

কৌশিক সতর্ক হয়ে গেলো। তেতে উঠে কড়া গলায় বলল,
“রান্নাঘরে মানে কি?!”

“মাধবী ম্যাডামের বোন মালতী আর বোন ঝি অনামিকা এসেছে তাই ম্যাডামকে বলেছেন রান্না করার জন্য।”

“আশ্চর্য! আমার বউ রান্না করবে আর তোমরা কি করবে? ড্রামা দেখবে?!”

ভয় আড়ষ্ট হয়ে মহিলা স্টাফ মিনমিনে কণ্ঠে বললো,
“স্যার মাধবী ম্যাডাম সাহায্য করতে মানা করেছেন।”

কৌশিক কপালে আঙ্গুল ডলে বিশ্রী একটা গালি দিলো। শুধুমাত্র কাশফি যাতে একাকী বোধ না করে ভেবেই সে এখানে এসেছিল কিন্তু এখন বুঝতে পারছে কেনো মেয়র এখানে থাকতে অনিচ্ছুক ছিল। তার পারিবারিক ভবনের মতো এমন একটা জায়গা যে কারো জন্যই টক্সিক।

রাগে ফেটে পড়ার উপক্রম কৌশিকের। বড় বড় কদম ফেলে গিয়ে রান্না ঘরে পৌঁছালো, যতটা রাগ নিয়ে কড়া ভাষায় কাশফির সাথে কথা বলার উদ্দ্যেশ্য নিয়ে এসেছিল সেটা কাশফির ঘেমে নেয়ে লাল হয়ে থাকা মুখ দেখা মাত্রই পানির মতো গলে গেলো। তবে সে দমলো না, এই দৃশ্য সুচের মতো ফুডলো তার নিকট।

“নাসরিন!”
আচমকা রাশভারী ভয়ার্ত কন্ঠের ডাকে কাশফি আতকে উঠে সামনে তাকাতেই কৌশিকের মুখশ্রীর পরিদর্শন করলো। মারাত্বক রকমের চটেছে বুঝাচ্ছে।

“এক্ষুনি তোমার ম্যাডামের জন্য একটা ফ্যানের ব্যাবস্থা করো।”

শপিং ব্যাগ হাতে বোন আর বোন ঝিকে নিয়ে মাত্রই ফিরেছে মাধবী, আকস্মিক সামনে পড়ে কৌশিককে দেখা মাত্রই তার গায়ে কাঁটা বিধলো যেনো। বাঘের কবলে পড়ে যেমন বোধবুদ্ধি হারিয়ে নির্বাক হয়ে রয়, মাধবীর দশাও এক হলো।
তাদের আমোদ ফুর্তি দেখে কৌশিকের চোয়াল শক্ত হয়ে এসে তৎক্ষণাৎ শিরা উপশিরা ফুলে ফেঁপে ওঠে। তার বাম চোখের কোণ লাফিয়ে উঠলো, চোখজোড়া ছোট ছোট করে তিরীক্ষ চাহনি ফেলে তিনজনের মুখপানে তাকিয়ে চাইলো। প্রাণহীন ধূসর নজর যদি ছু রি চালাতে জানতো তবে র ক্তে র বন্যা বয়ে যেত। কৌশিকের চোখ স্থির তবে দৃষ্টি হিংস্র, অনামিকার দিকে চেয়ে মন্থর গতিতে প্রতি পদ কিয়ালকুলেটেড স্টেপে হেঁটে এসে বরাবর মাধবীর সম্মুখে এসে থামলো। তার ধূসর চোখে গ্রাসকারি জ্বলন্ত দহণ নিয়ে চওড়া হয়ে কেবল মাধবীর উদ্দ্যেশে বললো,

“আমার বড্ড শখের নারী ঈশিতা ইমরোজ কাশফি, সে এমন মারা’ত্ব’ক আবিষ্ট শখ যার জন্য আমি খু ন হতে এমনকি খু ন করতেও রাজি। আর শখের মূল্য তুমি ভালোই বুঝো ছোটমা। তাই না?!”

মাধবী বিমূঢ়, তার গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ, ভয়ে কন্ঠনালী কম্পিত হলো বোধহয়। কৌশিকের শান্ত দৃষ্টি তাকে আরেক দফায় নাড়িয়ে দিলো। কি এমন প্রয়োজন ছিল তার বোনের কথায় এসে মেয়েটাকে দিয়ে রান্না করানোর?!
কৌশিকের রাগ আগুনের দেদীপ্যমান শিখা। আগুনের মতো সে নিজেও জ্বলে অন্যকেও জ্বালায়। আর মাধবী তো আগুনের প্রথম স্ফুলিঙ্গের আভাস পেলো মাত্র, নিঃশেষ হয়ে ছাই হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

হনহনিয়ে কৌশিক রান্নাঘরে ঢোকার সাথে সাথেই নাসরিন সামনে হাজির হয়ে কৌশিকের হাতে একটা কিচেন এপ্রোন তুলে দিলো। কৌশিক পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে তার উপর উপর এপ্রোন বেঁধে কাশফির পাশে গিয়ে দাঁড়িলো। তারপর কাশফির হাত থেকে ছুরি নিয়ে নিপুণ হাতে পেঁয়াজ ডাইস করে কেটে নিতে লাগলো। ক্লান্ত কাশফি বাধা না দিয়ে সরে দাঁড়িয়ে প্যান চুলোয় বসিয়ে রান্নার প্রস্তুতি নিতে যাবে তার পূর্বে ঝড়ের বেগে কৌশিক গ্যাস অফ করে তাকে অপ্রস্তুত টেনে নিয়ে তুলে কিচেন কাউন্টার টপে বসিয়ে দিলো। পরপর অনিমেষ নেত্রে কাশফীর মাথা কিছুটা কাছে টেনে সে টুপ করে চুমু খেয়ে ঘোর লাগা কণ্ঠে বললো,

“এতক্ষণ যথেষ্ঠ কাজ করে ফেলেছো, এখন তোমার স্বামী তোমার অ্যাটেনশন চায়, কাশফি। So, be my good wife and eyes on me!”

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here