অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৯) #লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী ৯. (Edited)

0
71

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৯)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

৯. (Edited)
(প্রতি পর্বে আমি ক্লু দিয়ে দিই, তাই বুঝে পড়বেন। প্রায় তিন হাজার শব্দ নিয়ে লিখা।)

“আপনারা আমার ওয়াইফকে সাজানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে কি পারবেন?”
কৌশিক মির্জার আড়ালে উসখুস করতে থাকা নতোমস্থক কাশফির কানে কথাগুলো পৌঁছাতেই সে এক আকষ্মিক ঝাঁকি দিয়ে মাথা উপরে উঠিয়ে নিলো।
বাহ, কি সুন্দর নিঃসংশয় হয়ে কথা বলছে যেন কিছুই ঘটেনি! কাশফির নিজেকে চাপড়াতে ইচ্ছে করলো, কৌশিকের আদো কি লাজ লজ্জা আছে? ভদ্রতা রেখে কোথায় সে তাদের কথা বলতে দিয়ে বেরিয়ে পড়বে তা না।

কৌশিক তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ন ভড়কে যাওয়া কাশফির দিকে দৃষ্টি পাত করে, পরপর তার ঠোঁটের হাঁসি প্রশস্থ করে কিঞ্চিৎ আদুরে গলায় বলল —

“আসলে আমার ম্যাডাম সব কিছু একটু সময় নিয়ে করতে পছন্দ করেন।”
বিষম খেয়ে কাশফির ভ্রু জোড়া ততক্ষনে কপালে উঠে গিয়েছে, লজ্জায় তার কান ঝা ঝা করছে। কেউ মাটি খুঁড়ে দিতে পারলে সে একবার ঢুকে এই জীবনে কৌশিক মির্জার স্ত্রী থাকা অবস্হায় আর বের হওয়ায় নাম মুখে নিতো না। রক্তিম আভা গাল হতে ধীরে ধীরে গলায় ছড়িয়েছে, আজ সকাল থেকে লজ্জা পেতে পেতে মিইয়ে পরেছে।
সকালে কার মুখ দেখেছিল ভাবতেই গা জ্ব’লে উঠে।
অফকর্স, কৌশিক দ্যা গ্রেট মির্জার মুখ সর্বপ্রথম পরিদর্শন করেছিল।

নাস্তানাবুদ ঈশান দম আটকে কেঁশে উঠলো, ফারাবীর মুখ পানি হতে তুলে নেওয়া মাছের ন্যায় একবার খুলে বন্ধ হয়ে আবার খুলছে বার বার। কৌশিকের সৌজন্যমূলক হাসি দেখে বাইরে দাঁড়ানো বিমূঢ় ঈশান যা বুঝবার বুঝে নেয়। সে মাথা ঘুরিয়ে হা করে থাকা ফারাবীর পিঠে হালকা করে চাপড়ে চলে যাওয়ার জন্য তাড়া লাগায়। তরী কিছু বলার আগেই ইতস্তত হয়ে সরে গিয়েছে।

ততক্ষনে কৌশিকের হাত আলগা হয়ে আসলো দেখে কাশফি ছোঁ মেরে সরে দাড়িয়ে দাঁত কড়মড় করে আঙ্গুল তুলে ক্ষীণ স্বরে বলে,
“এভাবে চললে তো দেখছি আমার মান ইজ্জত আপনি আশেপাশের গ্রাম গঞ্জে বিলি করে দিতেও ভাববেন না!”

কৌশিক চোঁখ কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে নেয়, নিজেকে নির্ঝঁঝাট রেখে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তুমি ওভার ড্রামাটিক আচরণ করছো মিসেস মির্জা।”

কশফি তেতো হয়ে তার তর্জনী দিয়ে কৌশিকের বুকের মাঝ বরাবর খোঁচা দেয়,
“আপনি এক্ষুনি আমার রুম থেকে বের হবেন।”
নিজের কণ্ঠে আরো জোর দিয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে নিজেকে কঠোর দেখিয়ে বলে — “রাইট নাও!”

কৌশিক ভাবলেশহীন, নিজের শক্ত আঙ্গুলের গিট পরখ করে হাত একবার বন্ধ করে আবার খুলে যেনো বিশেষ কোনো ব্যায়ামে মনোনিবেশ করেছে। কাশফি তার কড়মড় করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কৌশিকের নির্বিঘ্ন কন্ঠ শোনালো,
“বসে পরো মিসেস মির্জা, তোমাকে সাজানো বাকি।”

কাশিফ থ বনে গেলো! কৌশিকের পাল্লায় পরে কি বলার ছিল সেটাই গুলিয়ে ফেলেছে । শব্দ করে এক হাত মুখের উপর ফেলে তীব্র বিরক্ত প্রকাশ করে চাপা স্বরে গোঙ্গালো। এতক্ষন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে অথচ মানুষটা তার কথা কানেই তুললো না। সে মনে মনে প্রার্থনা করল— ‘আল্লাহ আমাকে ধৈর্য্য শক্তি দিন আর না হয় কৌশিক মির্জা নামক জীবটাকে শায়েস্তা করার শক্তি দান করুন।’

মুখ দিয়ে একটা লম্বা প্রশ্বাস টেনে শ্বাস বের করে নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে কোমরে হাত দিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে দাড়ালো। পরপর চোখ গরম করে আঙ্গুল তুলে দরজার বাইরে তাক করলো,

“অনেক করেছেন আপনি কৌশিক, আজকের জন্য ইনাফ। আল্লাহর দোহাই লাগে, আমাকে ঝামেলামুক্ত করে বাকিটুকু একা সেজে শেষ করতে দিন।”

কৌশিক এক ভ্রু উচুঁ করে, মাথা কিঞ্চিৎ কাত করে। তার ধারালো চোয়াল শক্ত করে নিলো। কাশফির দিকে কিছুটা ঝুঁকে দাড়ায়, কণ্ঠে গভীরতা এনে স্বর শক্ত রেখে বলে,

“বরংবার তুমি আমার অবাধ্য হচ্ছো আবার তর্কও করছো!”

কৌশিকের আশঙ্কণীয় বাক্যে কাশফির মনে সুপ্ত ভয় জন্ম নিলো। আগের বার কৌশিককে রাগানোর আগে প্রস্তুতি নিয়েও অপ্রস্তুত হয়ে পরেছিল। এমন মোটেও নয় যে সে কৌশিককে ভয় পায় না। বুঝ হওয়ার পর থেকেই সে ভয়কে ইনিয়ে বিনিয়ে কাবু করে নিতে সক্ষম। কিন্তু কৌশিক কে বোঝা দায়, মানুষটার মুড আবহাওয়ার চেয়েও দ্রুত বদলায়। নাকি সে কৌশিক মির্জাকে বুঝতে অক্ষম, আল্লাহ মালুম!

কাশফি চোখ পিট পিট করে, গলা পরিষ্কার করে নেয়। মুখে জোরপূর্বক একটা হাসি টেনে বলে,
“আপনাকে সাজানোর সুযোগ দিয়েছিলাম আপনি সেই সুযোগ এর দুর্ব্যবহার করেছেন।”

“দুর্ব্যবহার?”
কৌশিকের আক্রশপূর্ন কণ্ঠ বাঘের থাবার ন্যায় আক্রমণাত্মক মনে হলো কাশফির কর্ণে।

“বলার টার্ম টা হাইলি অফেন্সিভ !”
অগ্নিমূর্তি বনে থাকা কৌশিক মাথা কিঞ্চিৎ কাত করে একটা অবিশ্বাস্য হাসি হাসলো, যা কাশফির কাছে সংকটময় হয়ে ঠেকলো। সে ঢোক গিলে কৌশিকের মুষ্টিমেয় হাত পর্যবেক্ষণ করে নিলো, শক্ত শিরান্বিত হাত ফুলে ফেঁপে উঠেছে, কপালের ভাঁজ স্পষ্ট। কাশফি আমতা আমতা করে বলে,

“আমি সেটা বোঝাতে চাইনি!”

“আমি তোমার স্বামী হই, পরপুরুষ না। যখন আমি বলেছি তোমার প্রতিটা লোমকূপের উপর আমার অধিকার আছে তখন আমি মজা করছিলাম না। লেট মি রিপিট ফর ইউ।”

কাশফি নিজের ভালো বুঝে ক্রোধান্মত্ত কৌশিকের থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য এক পা পিছু নিতেই কৌশিকের শক্ত পুরুষালী হাত তার বাহু ধরে আটকে নেয়। এক টানে সে কৌশিকের বুকে আছড়ে পরে, পরপর কৌশিকের রুদ্ধ গরম নিশ্বাস তার বদন ছেয়ে গেলো। আবার পুরুষালী শরীরের ক্লোনের ঘ্রাণ তাকে জেঁকে ধরলো, চেনা মিন্ট আর সিগারেটের ধোঁয়ায় একটা প্রলুব্ধকর ঘ্রান পেয়ে তার নারী সত্তা জেগে উঠলো।
কই আগে তো কখনো সে কৌশিকের এত তুচ্ছ জিনিস খেয়াল করে নি?
তুচ্ছ? যদি তুচ্ছ হতো তাহলে তাকে জব্দ করলো কি করে? নিজেকে আবার প্রশ্ন করল সে।

পরপর ক্ষুব্ধ কৌশিকের রাশভারী কন্ঠ তার কর্নকূহরে পৌঁছালো,
“If I meant you are mine, you are all f**king mine and mine alone, Period!”

কাশফি কৌশিকের বুকের দিকে চেয়ে তখনো, ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে এলো। চরম আশ্চর্যান্বিত হয়ে নিজেকে বাক শক্তিহীন মনে হলো। নিজের এফোঁড় ওফোঁড় করা মনকে বিশ্বাস করানোর জন্য হাতের তালুতে একটা চিমটি কাটলো। না আসলেই সে স্বপ্ন দেখছে না।

অধৈর্য্য হয়ে থাকা কৌশিক আলতো হাতে কাশফির চিবুক উপরে তুলে কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল—
“যখন আমি তোমার সাথে কথা বলছি তোমার নজর আর সম্পূর্ন মনোযোগ আমার দিকে থাকা উচিত মিসেস মির্জা।”

কাশফি বিষম খেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলে, কৌশিক মির্জা কোনো স্বার্থ ছাড়া তাকে বিয়ে করবে এমন রূপকথা সে বিশ্বাস কখনোই করবে না। অতঃপর মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করে বসল,
“আপনি এমন আচরণ করেছেন কেন?”

কাশফিকে শিউরে দিয়ে কৌশিক অরসাত্মক হাঁসি হাসলো, আবার দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে তার প্রখর চিজেল চোয়াল শক্ত করে নেয়। কেবল মৌন রয়ে অদ্ভুত দৃষ্টি ফেলে, কাশফি কেমন একটা মিইয়ে যায়। ধীরে ধীরে কৌশিকের হয়ে আগত তাপ তার মাঝে সঞ্চারিত হয়ে তাকেও উদ্দীপ্ত করছে যেন।

“ সময়টা শুধু পাঁচ বছরের নয়, এত লম্বা সময়ের হিসাব তুমি রাখোনি মিসেস মির্জা। তবে এটা জেনে রাখো তুমি কিছু ধারণা করার আগে থেকেই তুমি কৌশিক মির্জার ছিলে।”
কাশফির শ্বাস আটকে আসে, সদ্য ফোঁটা ফুলের ন্যায় পুলকিত হয় তার মন। পরক্ষণে ভাবে অন্তত কৌশিক মির্জা থেকে এসব অনাকাঙ্খিত। নিজেকে সামাল দিয়ে সে কৌশিক কে ধাক্কা দিয়ে সরাতে গেলে এক চুলও নাড়াতে পারে না বরং তার মনে হচ্ছে এটা মানুষ নয় পাথরের তৈরি দেওয়াল।
ক্ষোভে আর লজ্জায় নিজ থেকেই সরে এসে রাগ ঝেড়ে বলে,
“বু’ল’শিট কৌশিক! আমি কোনো প্রোপার্টি নই যে আপনার হবো, জোর বিয়ে করে হক চাওয়ার বিষয়টা বেমানান।”

কৌশিক মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে সাফ সাফ জানায়,
“তুমি আমার প্রোপার্টি না তুমি অমূল্য কেউ, যার স্থান আমার সন্নিকটে, আমার সাথে, সবটা আমি জুড়ে আর আমার একান্ত জিনিসে অন্যকেউ দৃষ্টিপাত করবে সেটা আমার পছন্দ না। তাছাড়া তোমার তিন কবুল আমার কানে স্পষ্ট এসেছিল।”

কাশফি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেয় কৌশিকের দিকে, আসলেই সত্যি বলছে কিনা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছে সে। কৌশিকের ছলনাহীন আবির্ভাব আর চোখে মুখে অকৃত্রিমতা তাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে নিলো। ভাবনার অন্ত একটাই কৌশিক মির্জা নিজের বাইরে কাউকে নিয়ে ভাবতে জানে না।
মানুষ মরীচিকার পিছনে ধাওয়া করতে পছন্দ করে, সত্য থেকেও মিথ্যা কে প্রায়োরিটি বেশি দেয়। কাশফির বেলায় ঠিক তাই ঘটলো। ভলোবাসা আর বিচ্ছেদ দুটো একে অপরের বিপরীত সূত্র। তার জীবনের অস্পষ্ট কিছু অনিশ্চয়তা সে উপলব্ধি করতে পারে আর এসবে কাউকে জড়ানো ও বিশ্বাস করা নেহাতই বোকামি।

সে বিশ্বাস করল না তবে অবিশ্বাসও করল না, দ্বিধা নিয়ে আর মুখ খুললো না; কথায় কথা বাড়বে।

স্মৃতিচরণ করতেই জোভান নামটা মাথায় এলো, লোকটা তাকে পছন্দ করত কিন্তু কাশফি কাউকে নিজের সবটুকু দিয়ে বিশ্বাস করতে জানে না, পারে না। বাবার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে জোভানের সাথে বিয়ে ঠিক হলো। কিন্তু বিয়ের দিন না জোভান আসলো, আর না তাদের পরিবারের কেউ। তখন থেকেই জোভানের প্রতি তার সুপ্ত রাগ। আশেপাশে কানা ঘুষা চললো, মানুষ বদনাম রটানোর পূর্ব মুহুর্তেই কৌশিক হাজির হয় তবে বীর বেশে নয়; একটা ত্রাস সৃষ্টি করতে এসেছিল বোধয়। হুমকির উপর তাকে বিয়ে করে নেয়।

কৌশিক কাশফির দুই গালে আলতো হাত রেখে অতীতের পাতা থেকে তাকে বর্তমানে টেনে আনলো। কাশফি চোখ ঝাপটায়, নিজেকে কৌশিকের সন্নিবেশে আবিষ্কার করে একটা ঢোক গিলতে নেয়। কিন্তু মনে হচ্ছে তার গলা ধরে আসছে, মানুষটার সামনে তার নার্ভ সিস্টেম পর্যন্ত এলোমেলো হয়ে যায়, মাথায় কি কি আজগুবি জিনিস আঁকাবুকি করে। তার ভিতর বড়সর সমস্যা দেখা দিয়েছে হয়তো। নিজের আউলা ঝাউলা ভাবনা ভেদ করে কৌশিকের পুরু হাস্কি গলা শোনালো কানে—
“তাই মাথায় বিদ্রোহ আর কু’বু’দ্ধি না চেপে নিজের স্বামীর যত্ন নিতে শিখ। আলাদা বিষয় যে কাল রাত ছাড়া পেয়েছিলে কিন্তু আর নয়, বিয়ে করেছি বউ নিয়ে না ঘুমালে আমার বিবেক আমার পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।”

বিব্রত হয়ে কাশফি মাথা ঘুরিয়ে নেয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলো যে, কৌশিক যেই দিন থেকে তাকে জবুথবু করা ছেড়ে দিবে সেইদিন কৌশিকের নাম পাল্টে ফেলবে। কাশফি ঘন ঘন শ্বাস টেনে হিস হিস শব্দ করে বলে,
“আপনি একটা যা তা কৌশিক!”

উল্টো কৌশিক তার কথার ধার না ঘেঁষে একটা বাকা হাঁসি দিয়ে নরম গাল ধরে তার দিকে ফিরিয়ে বলে,
“বার বার মানা করার সত্বেও তুমি আমার কথার বিরুদ্ধে যেতে চাইছো, বলো তো কি শাস্তি দেওয়া যায়?”

কৌশিক তার চাপা দাড়িতে হাত রেখে কিছুক্ষণ ভাবতে নেয়। ভোঁতা মুখী কাশফি তার বিরুদ্ধে বাক্য ছুড়ে দেওয়ার জন্য মুখ খুলে,

“কৌশিক —”

“শাস্তি হলো তোমাকে সবার সামনে কোলে করে গাড়িতে তুলব আর কোলে করে বের করব। আর আমার বিপক্ষে কিছু বলার সাহস নিয়ে তোমার মিষ্টি তুলতুলে ঠোঁট জোড়া যদি খুলে, তাহলে ২৪ ঘণ্টার জন্য আমার কোলে তুমি নিজেকে দেখবে।”

হতবম্ব কাশফি জোর গলায় কিছু বলতে নেয়,
“আপনি কিভাবে—?”

“বাহাত্তর ঘণ্টা আমার কোলে আর নিজের উপর আমি কোন প্রকার নিয়ন্ত্রিত রাখবো না মিসেস মির্জা।”
কথা সম্পূর্ন করার আগেই কৌশিকের কাঠ কাঠ কণ্ঠ শুনে সে আঁতকে উঠে মুখ কুঁচকে ফেলে। দ্রুত দুই হাত তুলে আত্মসমর্পণ করার ভঙ্গিতে ফটফট করে বলে,

“ওকে, ওকে, কৌশিক! আমি আর কিছু বলছিনা, আই প্রমিস!”

কৌশিক তার ঠোটের কোণে হাসি রেখে গলা নামিয়ে বলল,
“গুড গার্ল”
কাশফি মনে মনে তাকে অনুকরণ করে ভাঙ্গলো। গুড গার্ল না, কৌশিকের তারছেড়া মাথার মুন্ডু!

“আর শোনো…”
বিরস মুখে কাশফি কৌশিকের মুখ পানে চাইলো। কৌশিক বিশুদ্ধ রকমের অল্প তবে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। যেন সে নিজের হাসি কমানোর জন্য ঠোঁট কামড়ে আছে। কৌশিক সন্তপর্নে কাশফির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফেঁসফেঁসে কণ্ঠে গলা নামিয়ে বলল,
“আর আমি অসমাপ্ত কাজ ফেলে রাখতে পছন্দ করি না, জান।”

কাশফি লক্ষ্য করল কৌশিকের শার্প জ-লাইনের নিচে দৃশ্যমান এ্যাডাম অ্যাপেল ওঠানামা করছে। সে কি কিছু নিয়ে নার্ভাস, তারও কি উদ্বিগ্নতা কাজ করে?
কাশফি কিছু বলার আগেই কৌশিকের ঠোঁট তার ঠোঁটের ভাঁজে মিলিয়ে গেলো। আনমনে কাশফির হাত কৌশিকের বুকে পাঞ্জাবির অংশ খাঁমচে ধরে। শক্ত পোক্ত হাত ঘিরে ধরে কাশফির মাথার পিছনের অংশ, আরেক হাত কড়া অধিকারবোধ নিয়ে বেষ্টিত করে তার কোমর। সেই পরিচিত ক্লোন, মিন্ট আর স্মোকের সুবাস। কৌশিক কাশফির জন্য একটা রিফ্রেশমেন্ট বটে; নিজের প্রতিটা নিশ্বাসের মাঝে কৌশিকের অস্তিত্ব পাচ্ছে সে। প্রভাবশালী হাতের প্রতিটা কাঁপিয়ে তোলা স্পর্শ, জিভের স্ট্রোক, যেন সময় নিয়ে আরধিত করেছিল সে কশফিকে, খুবই ধীরে সুস্থে,
প্রতি ক্ষণ উপভোগ করে।

কৌশিক বেশ সময় নিয়ে কাশফিকে ছেড়ে তার মুখ গুঁজে কাশফির গলায়। নিজের বেগতিক শ্বাস নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত কাশফি আপত্তি করেনি।

হালকা চাপা গোঙানির আওয়াজে কৌশিক হাস্কি কন্ঠে বলে—
“তোমার চেরি ব্লোসম আর ভ্যানিলার সুবাস দুইদিনে আমার সেলফ কন্ট্রোলকে নাকানিচুবানি খাইয়ে দিলো, কাশফি। তুমি শীতের সকালের মিষ্টি রোদের ন্যায়, নামে মাত্র মিষ্টি কিন্তু তেজ ঠিক একই, আমার সানশাইন।”

মূর্তি হয়ে থাকা কাশফির গলা থেকে মাথা তুলে কৌশিক। কাশফির কপালে কপাল ঠেকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে আসা কন্ঠে বলল,

“তুমি যেই বাতাসে শ্বাস নাও সেই বাতাস কেবল আমার হোক, কাশফি।”
কৌশিকের বলার চাহনিতে এমন কিছু একটা ছিল যা তার ভিতরটা দুলিয়ে সায় দেয়।

কৌশিক কিছুটা সরে জুয়েলারী আর বাদ বাকি অর্নামেন্টর পরিয়ে কাশফিকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। এতটা আলতো করে ধরছে যেন এদিক সেদিক হলেই সে ব্যাথা পাবে। কাশফির বুঝে আসছেনা কিছুই। কোন ক্রমেই তার মাথায় জট পাকা সমীকরণ মিলছে না।
একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের উদ্দ্যেশ্য মনে করিয়ে দিলো, কৌশিকের ক্ষমতা আর কৌশিক কে কাজে লাগানো।

আর কিছু নয়।

সত্যি কি আর কিছু নয়। উত্তর দিতে কাশফি অনিচ্ছুক।

সম্পূর্ন কাশফির মাঝে অভিনিবেশ করা কৌশিক কাশফির চুল পিছনের দিকে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে এক নাগাড়ে চেয়ে আছে। অতঃপর অস্ফুট স্বরে “মাশা’আল্লাহ” বলে কপালে গাঢ় চুম্বন আঁকে।

***

কুনুই টেবিলে রেখে দুই হাত জড়ো করে মুষ্ঠীতে মাথার ভার রেখে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে বসে আছেন আতিকুর রহমান। স্মৃতির পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখেন,

এক আর্ট গ্যালারিতে তার আর চারুলতার দেখা হয়েছিল। চারুলতা ধনী পরিবারের মেয়ে ছিল, উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়ার সত্ত্বেও ভালোবেসে বিসর্জন দিয়েছিল সবকিছু। এত ভালোবাসার মাঝে সব পাল্টে যায়, চারুলতা ড্রা’গ এডিক্টেড হয়ে পরে।

তাদের প্রথম সন্তান ঈশিতা ইমরোজ কাশফি, আনেক্সপেক্টেড ছিল। তবে ভালোবাসার কমতি ছিল না। ধীরে ধীরে চারুলতা কাশফির প্রতি বেশ উদাসীন হয়ে গেলো। প্রায়ই কাশফিকে কেয়ার টেকারের কাছে রেখে সে দুই তিনদিন উধাও হয়ে যেত। ফুর্তি করে ক্লাবে রাত কাটানো যেন তার রুটিন হয়ে উঠলো। এক মধ্যরাতে আতিকুর রহমানের কাছে ফোন আসে যে তার মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে, তাকে পুকুর পাড় থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। আতিকুর রহমানের মাথায় যেন বাজ পরলো! সে কোন রকম এসে পৌঁছে খবর পায় ফুসফুসে পানি ঢুকে যাওয়ায় কাশফির নিশ্বাস আসছে না, বেঁচে ফেরার চান্স খুবই কম। জন্মের পরপর তার মেয়ে তার পৃথিবী হয়ে উঠে, বাবা হিসাবে এমন কিছু মানতে পারেন নি। খোঁজ নিয়ে চারুলতাকে মাতাল অবস্থায় অন্যপুরুষের অ্যাপার্টমেন্টে দেখে মুখে তালাক দিয়ে বসেন কিন্তু পরে আবার ফিরিয়ে নেন।

এতকিছুর মধ্যে তার একমাত্র সন্তান কাশফি তার বাবা মায়ের সম্পর্কের বি’ষা’ক্ত’তা, তিক্ততা সহ্য করতে না পেরে ভুল পথ বেছে নেয়। আতিকুর রহমানের শূন্যতা আর অনুশোচনা এই জীবনের চিরসঙ্গী।
যেমন কিছুক্ষণ আগে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছে কৌশিক মির্জা—

“কাশফিকে আজ আমি যথাস্থানে নিয়ে যাবো; যেখানে তার থাকার প্রয়োজন – আমার কাছে, আমার পাশে। আপনার অতীত নিয়ে পড়ে থাকার মতো একটা সিদ্ধান্ত অনেক গুলো জীবন বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। আপনাকে বিশ্বাস করা আবরার কবীরের হয়ত পুরোপুরি ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না।”

তিনি ডুকরে কেঁদে উঠেন। পরিশেষে তিনি সব হারালেন।
সব!

***

কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবতেই কাশফির লোম দাড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু বেহায়া মন যেন কৌশিকের বাহু ধরে ঝুলছে এখনো। আসলেই কি কৌশিক তাকে পছন্দ করে? নাকি আবার কোন মাইন্ড গেইম খেলছে। ফারাবীর বকবক শুনে সে কিঞ্চিৎ হাসলো। সোফায় ঈশান বাকিদের জন্য আনা ফল আর নাস্তা সাবাড় করছে। তাদের মাঝে কায়েস বসে বসে কাজু বাদাম খাচ্ছে আর কিছুক্ষণ পরপর কাশফিকে একটা একটা খাইয়ে দিচ্ছে। কাশফির আনমনা ভাব তরী ঠিকই খেয়াল করলো,

“ঈশিতা, তুই ঠিক আছিস?”
কাশফি মাথা নেড়ে বোঝায় সে ঠিক আছে।
আসলে সে ঠিক নেই তার মন মেজাজ একে অপরের প্রতি বিক্ষিপ্ত আচরণ করছে, একপ্রকার সংশয়িত পর্যায়ে থেকে সে পাগল প্রায়।

“কৌশিক মির্জা নিজেকে তোর উপরে চাপিয়ে দেয়নি তো?”

“নাহ, তেমন কিছু না।” — কাশফি কপালে হাত ঘষে একটা শ্বাস নিয়ে বলে,
“আসলে ভীষণ কম্প্লিকেসিতে ভুগছি।”

তরী একটা হাঁসি দিয়ে কাশফির পাশে বসে তার কাঁধ জাপটে ধরে বলে,
“ভয় পাওয়ার দরকার নেই ঈশিতা, আমরা তোর পাশেই আছি।”
ফারাবী উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে সায় দেয়। পরক্ষণে সে আবার দুষ্টু হাঁসি হেসে কাশফির পাশে বসে। আশেপাশে তাঁকিয়ে সে ফুসুর ফুসুর করে বলে,

“আচ্ছা, তোদের মাঝে কতদূর গড়িয়েছে?”

কিছুক্ষন আগের মুহুর্ত ভেবে লজ্জায় কাশফি বিষম খেয়ে গেলো। ঘটনা সামাল দিয়ে কাশফির পিঠে চাপড় দেয়,

“কেনো দিগন্ত ভাইকে খবর দিয়ে দেখাতে বলব নাকি?”
তরী ভ্রু নাচিয়ে বলে। তার কথায় ফারাবীর মুখ ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে যায়। তাদের মাঝে আর কিছু বলে উঠার আগে কাশফির ডাক পরে যায়।

কৌশিকের দ্বিতীয়বার “কাশফি” ডাকের সাথে সাথেই কাশফি উঠে পৌঁছানোর জন্য দৌড় লাগায়। এখানে পৌঁছে সে আবার কি না কি বলে বিব্রত করে ছাড়ে!

শাড়ির কুচি ধরে হন্তদন্ত হয়ে কৌশিকের কামরায় আসতেই দেখে কৌশিক হাতে ওয়াচ পরে নিচ্ছে। কৌশিক তার দিকে না ফিরেই বলে,

“আধা ঘণ্টার মধ্যে ড্রাইভার এসে পরবে, তুমি রেডি?”

কাশফি হালকা করে ‘হুঁ’ বলে ব্যস্ত কৌশিকের দিকে তাকায়। তারপর নিঃশব্দে তার কামরার দিকে পা বাড়ায়। কামরায় ফিরতে গিয়ে আবার কিছু একটা মনে করে উপরের দিকে মাথা তুলে, চিলেকোঠার ঘরে ছোট একটা তালা ঝুলছে।
হনহন করে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে, আলমারির ড্রায়ার থেকে একটা চাবি বের করে চিলেকোঠার ঘরে পা বাড়ায়। সেদিকটায় কিছুটা অন্ধকার, কেউ তেমন একটা যায় না। সে পা টিপে টিপে দরজার সামনে এসে চাবি ঢোকায় তলায়, মৃদু শব্দ করে তালা খুলে যায়, আঙ্গুলের হালকা ধাক্কা দিতেই ক্যাট ক্যাট শব্দে দরজা ফাঁক হয়ে যায়।

স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ ভেতরটায় কেমন এক ভ্যাপসা গন্ধ। কাশফি ইঁদুরের ভয়ে হাত মুঠ করে রেখেছে। কোন রকম এগিয়ে এসে খাটের তলা থেকে ধুলো ঝেড়ে ব্রিফকেসটা বের করে নেয়। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লক খুলে খুব পুরনো একটা জার্নাল বের করে নেয়।
এর উপর তিড়িং বিড়িং অক্ষরে লিখা একটা নাম,

“আরিয়ানা”

নামের নিচে কয়েকটা ফুল আঁকা। কাশফি জার্নালের কভার ফু দিয়ে ময়লা উড়িয়ে আবার হাত দিয়ে মুছে।

প্রথমবার যখন সে এসেছিল তখন গন্ধে আর ভয়ে নিজের কক্ষে ফিরেই বমি করে ভাসিয়েছিল। বহু বছর আগে দ্বিতীয়বার জার্নালটা হাতে নিয়ে শুধূ দুটো পেইজ পড়েছিল, ঠিক পড়েছিল নয় চোখ বুলিয়েছিল।

পেইজ নং ২৪৩, ২৪৪
পাশাপাশি দুটো পেইজ। প্রথম এক লাইন পরে তার মাথা ঘুরিয়ে গিয়েছিল, তার রাতের দুঃস্বপ্ন গুলো আক্রমণাত্মক হয়ে ফিরেছিল। তখন ডক্টর ইয়াহিয়া খান তাকে কিছু ঔষুধ, ব্যায়াম আর অতীত নিয়ে চিন্তা করতে কঠোর ভাবে মানা করে দেন। এরপর আর আশা হয়নি।

আজ বহুবছর পর তৃতীয়বারের মতো সাহস জুটিয়ে এসেছে। কাশফি ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা হাতে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে নেয়। নিজেকে হাজার বার আশ্বস্থ করতে করতে কাঙ্ক্ষিত পৃষ্ঠায় চোখ পরতেই তার হাত থেমে যায়। পুরোটা লিখা পড়ে তার মাঝে শীতল ঝড় বয়ে যায়। তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট। ঘনঘন শ্বাস প্রশ্বাসের মিলিয়ে পরা শব্দ।
কপাল গড়িয়ে টুপ করে এক ফোঁটা ঘাম পড়ল মাটিতে,
অনুসরণ করল ঘামের দ্বিতীয় ফোঁটা।

টিউবলাইটের আবছা আলো জার্নালের ভাঁজে পড়েছে, মোটা কালিতে পেইজ নং লেখা,
243 Page

অগোছালো হাতের কালো কালিতে লিখা শব্দগুলো—

“আমি মারা যেতে চাই কারণ আমার আত্মার মৃত্যু অনেক আগেই হয়েছে। ঈশিতার পরিণতির জন্য শুধুই আমি দায়ী, তার থেকে শেষ মুহূর্তে ক্ষমা চাওয়া হলো না। কি নিষ্টুর আমি! আমার বাবা আমাকে বাঁচাতে প্রতি নিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন, কিন্তু তিনি কি জানেন? যে ব্যাক্তি মারা যেতে চায় তাকে বাঁচিয়ে রাখার মতো পীড়াদায়ক আর কিছু না।”

244 Page

“আমি না হয় সবার কষ্ট কমিয়ে দিলাম।”

#চলবে…

Author’s Note: পরের পর্বে অতীত থাকবে, এই গল্পের জন্য অতীত এবং কাশফীর কল্পনাগুলো তুলে ধরা গুরুত্বপূর্ন বিষয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here