প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ১১।

0
92

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১১।

মেহতাবের হাত যুগল সহসাই গিয়ে ঠেকল তনুকার বাঁকানো কোমরের ভাঁজে। তনুকা আবিষ্কার করল, সেই হাতের বাঁধন দৃঢ় বেশ। মেহতাব এগিয়ে এসে কপাল ঠেকাল তার কপালে। ক্ষীণ সুরে বলল,

‘আমি আমার হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা তোমার মাঝেই নিংড়ে ঢেলে দিতে চাই। বলেছিলে না, আমি কীভাবে স্বল্প দেখাতেই তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম? সত্যি বলতে এর সঠিক উত্তর আমার কাছেও নেই। আমি জানি না, কীভাবে হলো সব। প্রথম দেখাতেই অনুভূতি আসেনি কিন্তু। অনুভূতি এসেছিল রয়ে সয়ে, ধীরে সুস্থে। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ার মতো পুরুষ আমি নই, তবে প্রেমে আমি পড়েছি, তাও আবার মারাত্মক ভাবে। কবে, কখন, কীভাবে সেটা জানা নেই। শুধু এইটুকুই জানি, প্রেম নামক ভয়ংকর এক ব্যাধিতে আক্রান্ত আমি, যার একমাত্র সমাধান কেবল মৃত্যু। মৃত্যু ব্যতিত আমাকে এই ভয়ানক ব্যাধি থেকে কেউ মুক্তি দিতে পারবে না, তনু।’

মেহতাবের এহেন নিঃসংকোচ বক্তব্যে খানিকটা শিহরিত হলো তনুকা। নিজের অতি নিকটে অবস্থিত মেহতাবের মুখাবয়বের দিকে চেয়ে রইল নিষ্পলক। তখনই মেহতাবের কৃষ্ণাভ ওষ্ঠযুগলে নজর আটকাল ততক্ষণাৎ। ইশ, নিজেকে বড্ড বেশরম মনে হলো তার। মেয়ে হয়েও মনে এসব চিন্তা কেন আসে? স্বামী বলে?

মেহতাব আরেকটু নিকটস্থ হয়। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘আমার সমস্ত ভালোবাসা গ্রহণ করবা তো, বিবিজান?’

তনুকা অদ্ভুত ঘোরে আটকাল। নিজেকে খুঁজে পেল যেন অন্য এক রাজ্যে। যেখানে চারদিকে ছড়ানো কেবল অপরিসীম ভালোবাসা, আর সে আর মেহতাব হলো সেই রাজ্যের একমাত্র অংশীদার। মেহতাবের উষ্ণ প্রশ্বাস চোখে মুখে আছড়ে পড়তেই বুকের কম্পন বৃদ্ধি পায় তার। গায়ে কেমন যেন শির শির অনুভূত হয়। এই অনুভূতি তনুকার নিকট অপরিচিত। এর আগে কখনো কোনো পুরুষের সংস্পর্শে ছিল না বলে, এখন গায়ে কাঁটা দিচ্ছে যেন।

তাদের মাঝে বিরাজমান কয়েক ইঞ্চির দৃরত্বটাও যেন সহ্য হচ্ছে না মেহতাবের। মন চাইছে, ঐটুকু দূরত্বও ঘুঁচিয়ে দিতে। এক করে দিতে দু জোড়া তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠ। তবে সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তনুকার সম্মতি ছাড়া সে এক চুলও অগ্রসর হবে না। তাই সে সরে এল। এত কাছে এসেও হঠাৎ সরে যাওয়াতে খানিকটা বোধ হয় বিরক্ত হলো তনুকা। তবে কিছু বলল না। উঠে দাঁড়াল। তাড়া দেখিয়ে বলল,

‘উঠে দাঁড়ান, বিছানা করতে হবে।’

মেহতাব তাই করল। বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পড়ল তনুকা। মেহতাব ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘এ কি, মশারি কে টানাবে?’

তনুকা ফিরে বলল,

‘আপনি আছেন কী করতে?’

মেহতাবের কুঁচকানো চামড়া আরো দৃঢ় হয়। বলে,

‘বিয়ে করেছি কি নিজে মশারি টানানোর জন্য? তাহলে বিয়ে করে লাভ কী? উঠো বিবি, মশারি টানাও।’

‘উঁহু। আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ।’

তনুকা গায়ে কাঁথা জড়িয়ে চোখ বুজল। অগত্যাই বিরক্ত হয়ে মশারি টানাতে হলো মেহতাবকেই। সব শেষ করে সে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,

‘শুনো বিবি, আইজ আমি করসি কাইল তুমি করবা। দুইজন মিলে মিশে করমু। আর জামাইর কাজ করে দিলে সওয়াব হয়।’

তনুকা চোখ বুজেই বলে উঠল,

‘স্ত্রীর কাজ করে দিলেও সওয়াবের কিছু কম পড়বে না। কাল থেকে বিছানাটাও আপনি গুছাবেন।’

মেহতাব কপাল কুঁচকে চেয়ে রইল। হতাশ সুরে বলল,

‘তুমি ভালা না, বিবি। স্বামীরে দিয়া কাজ করাইতে হয় না, স্বামীর সেবা করতে হয়; তবেই না জান্নাত পাইবা।’

‘স্ত্রীর সেবা যত্ন করলেও জান্নাত পাওয়া যায়। আপনি কি সেই জান্নাত পেতে চান না?’

বিরক্ত হলো মেহতাব। জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘উফ, তোমার সাথে কথা বলে আমি আর পারলাম না। ঘুমাও।’

তনুকা ঠোঁট চেপে হাসল অতঃপর।

_______

ঝোপের আঁড়াল থেকে বেরিয়ে এসেই স্তব্ধ হয় লোকটি। পরনের লুঙ্গি খামছে ধরে ততক্ষণাৎ। ঢোক গিলে পরপর দুখানা। রোদহীন প্রভাতেও ফরফর করে ঘেমে উঠে শরীর। ভয়ে নিভু নিভু স্বরে বলে উঠে,

‘জমিদারবাবু, আপনে?’

মেহতাব চোখের দৃষ্টি সরু করে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘তুমি এসময় এখানে কী করছো?’

লোকটি কেঁপে উঠে অযথা। কপালের ঘাম গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। মাথা নত করে। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,

‘ছোট সাহেবের লগে দেহা করতে আইছিলাম।’

‘এত ভোরে?’

লোকটি ফের ঢোক গিলে। ভয়ে গা গোলাচ্ছে তার। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বমি হবে। মেহতাব তার আপাদমস্তক পরখ করে বলে,

‘কী হলো, জবাব দিচ্ছ না যে?’

ভয়ে জবুথবু লোকটি এবার কেঁদেই ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ছোট সাহেব’ই তো ডাকছেন, আমার কোনো দোষ নাই।’

‘ছোট কাকা ডেকেছেন?’

‘জি, সত্যি কইতাছি।’

মেহতাব নিঃশব্দে কী যেন ভাবল কিছুক্ষণ। এরপর বলল,

‘তোমার ভাইয়ের খু’নিকে ধরা গিয়েছে?’

‘না বাবু, কেইস করছি আমি। পুলিশ কইছে খুঁইজা বের করব।’

‘তোমার ভাইয়ের মুখ না কি খুব কুৎসিত ভাবে থেতলে ফেলা হয়েছে? আবার নাকি শরীরের বিভিন্ন অংশের চামড়াও তুলে ফেলা হয়েছে, এমন ভয়ংকর ভাবে কে মারল তাকে? কাকে সন্দেহ হয় তোমার?’

লোকটি ভড়কাল। কী বলবে বুঝতে পারল না। এদিক ওদিক চোরের মতো চেয়ে কী যেন দেখল কিছুক্ষণ। অতঃপর বলল,

‘আমার ভাই আপনার বিশ্বস্ত লোক আছিল, আপনার শত্রু মানেই আমার ভাইয়ের শত্রু। হয়তো আপনার শত্রুর মাঝেই কেউ আমার ভাইরে মারছে।’

মেহতাব দুহাত বুকের উপর ভাঁজ করে টানটান করে দাঁড়াল। বলল,

‘তা যা বলেছ, আমিও তাই ভাবছিলাম। তবে চিন্তা নেই, খু’নিকে আমি নিজে খুঁজে বের করব। আর যেহেতু তোমার ভাই নেই, সেইজন্য তোমার ভাইয়ের সব কাজের দায়িত্ব আজ থেকে তোমার। সকালের ভোজন সেরে আমার সাথে এসে দেখা করবে। আর হ্যাঁ, আমার অনুমতি ব্যতিত আমার মহলের আশেপাশে যেন তোমাকে আর না দেখি। মনে থাকবে?’

মেহতাবের নিগূঢ়, কঠিন গলার স্বর যে কারোর হৃদকম্পন বন্ধ করতে সক্ষম। লোকটি পরপর কয়েকবার মাথা নাড়িয়ে জলদি সেই জায়গা ছেড়ে প্রস্থান ঘটাল। আর সে চলে যেতেই গভীর ভাবনায় মগ্ন হলো মেহতাব। মনে মনে আওড়াল, “আমার বেড়াল আবার আমাকেই না ম্যাঁও বলে বসে।”

________

তনুকার ঘুম ভাঙে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। চোখ কচলে তাকায় ঘড়ির দিকে। ঠিক নয়টা বাজে। নয়টা পনেরোতে সবাই সকালের নাস্তা করে। তার এখন পনেরো মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে হবে। তাই আর বিলম্ব না ঘটিয়ে দ্রুত সব প্রাসঙ্গিক কাজ সারল সে। পনেরো মিনিট শেষ হওয়ার পূর্বেই নিচে নামতে সক্ষমও হলো। খাবার ঘরে গিয়ে দেখল, টেবিলে সব খাবার সাজানো। এখনও বসেনি কেউ। সে উঁকি দিয়ে দেখল, রান্নাঘরে ভৃত্যরা সব কাজে ব্যস্ত। তখন মনে পড়ল, আজ তার শ্বশুরমশাইকে খাবার দেওয়ার কথা। মাথায় হাত চাপড়ে ধরে, এক্ষুনি যে ভুলতে বসেছিল। ততক্ষণাৎ আবার মনে পড়ে, মেহতাবের কাছ থেকে তো খাবারের লিস্টটাও নেওয়া হয়নি। কী হবে এখন? পরক্ষণেই মাথায় এল, মা তো নিশ্চয়ই সব জানেন? উনার থেকেই তবে সব জেনে নেওয়া যাক।

মেহতাব দ্রুত আম্বিরা বেগমের কক্ষের দিকে যায়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘মা, আসব?’

‘এসো।’

জবাব আসে সঙ্গে সঙ্গেই। তনুকাও ভেতরে প্রবেশ করে। আম্বিরা বেগম খাবারের জন্য এক্ষুনি কক্ষ ছাড়ছিলেন, তনুকার গলা পেয়ে থমকে দাঁড়ান। তনুকা মৃদু হেসে এগিয়ে আসে। প্রসন্ন গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘মা, বাবার সকালের খাবারে কী দেব?’

‘লতা রেঁধে রেখেছে। রান্নাঘর থেকে নিয়ে নাও।’

উত্তর শুনে তনুকা জবাবে আর কিছু বলল না। চলে এল আবার রান্নাঘরে। তাকে দেখেই লতা বলে উঠল,

‘বউমনি, ঐ যে বড়ো সাবের খাওন, আপনি দিয়া আইয়েন।’

তনুকা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল,

‘আপনি কী করে জানলেন যে, আমি বাবার খাবারের জন্য এসেছি?’

লতা হেসে বলল,

‘বড়ো আম্মা তো আগে থেকেই সব কইয়া রাখছিল। আপনে নাকি আইজ থেকে বড়ো সাবের খাওয়েনের সব দায়িত্ব নিবেন, তাই আম্মা কইছে, আমি যেন সব রান্না কইরা আগে থেকেই তৈরি রাখি, আপনার যেন আর কোনো কষ্ট করতে না হয়।’

তনুকা অবাক হলো এই কথা শুনে। তার শাশুড়ি তাকে নিয়ে এত ভাবে? সে কি তবে অযথাই মানুষটাকে এত সন্দেহ করছিল। এই ভেবে ভীষণ বিরক্ত হলো তনুকা। বলল,

‘ঠিক আছে, দিন খাবার। আমি নিয়ে যাচ্ছি।’

চলবে….

(কাজিনের বিয়ে উপলক্ষে ঢাকা এসেছিলাম। এখনও ঢাকাতেই আছি, বাসায় ফিরতে হয়তো আরো তিন থেকে চারদিন সময় লাগবে। আর এই সময়ের মাঝে গল্পে গ্যাপ পড়লেও পড়তে পারে। তাই দয়া করে কেউ ধৈর্যহারা হবেন না। তবে সবটুকু দিয়ে চেষ্টা চালাব রেগুলার দেওয়ার। যদি না পারি, তবে আগে থেকেই দুঃখিত। বাসায় ফিরে গেলেই, ইনশাল্লাহ আবার পুরোপুরি রেগুলার হয়ে যাব। ততদিন অবধি একটু সহ্য করে নিন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here