প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ১২।

0
170

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১২।

শ্বশুরমশাইয়ের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষের সম্মুখে এসেই থমকাল তনুকা। দরজার বাইরে উপস্থিত দুইজন পুরুষ মানুষের দিকে নজর পড়ল। এরাই কি তবে শ্বশুরমশাইয়ের সেবকগণ, যাদের কথা মেহতাব বলছিলেন? প্রশ্নটা মনে মনেই আওড়াল সে। আবার ভাবল, সেবক হলে দরজায় এমন পাহারাদারের ন্যায় দাঁড়ানো কেন?

তনুকা প্রশ্নবিদ্ধ মন নিয়ে সামনে অগ্রসর হলো। তাকে দেখা মাত্রই কুর্নিশ জানিয়ে সটান সরে গেল দুই প্রহরী। তনুকা কিছু বলতে গিয়েও বলল না। এই সময় অগত্যাই কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হলো না তার। তাই সহসাই প্রবেশ ঘটাল শ্বশুরের কক্ষে। গিয়ে দেখল, গত রাতের ন্যায় নিমীলিত চোখে শায়িত তিনি। তনুকা এগিয়ে যায়। খাবারের প্লেটটা রাখে সাইড টেবিলে। মৃদু আওয়াজে ডাকে,

‘বাবা, বাবা শুনছেন?’

পিটপিট করে এক জোড়া চোখ ঈষৎ পল্লব মেলে তাকায়। তনুকার মুখাবয়ব চোখের সম্মুখে ঠাহর করতে পেরেই উত্তেজনার এক ভারি ছাপ প্রকাশ পায় বৃদ্ধর চোখে মুখে। তনুকা কিঞ্চিৎ হাসে। জিজ্ঞেস করে,

‘আমাকে চিনতে পেরেছেন, বাবা? আমি তনুকা, আপনার বড়ো ছেলে মেহতাবের স্ত্রী।’

চোখ মুখের অস্থিরপনা ভাব কমার নাম গন্ধ নেই। লোকটা কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে যেন। চোখের দৃষ্টি এমন যে, তিনি তনুকাকে আগে থেকেই চেনেন। তনুকা মাথা ঘামাল না সেসব নিয়ে। হেসে হেসে বলল,

‘বাবা, আমি আপনাকে খাইয়ে দিতে এসেছি। আর আজ থেকে তিন বেলা আপনাকে খাওয়ানোর দায়িত্বও আমার।’

মোহন লাল মজুমদারের মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়ার দেখা মেলল না। তিনি চেয়ে রইলেন আগের মতোই। তনুকা স্যুপ এর বাটিটা হাতে তুলল। ডান হাতে চামুচ নিয়ে অল্প স্যুপ তুলে এগিয়ে দিল শ্বশুরের মুখ পানে। তার বৃদ্ধ শ্বশুরের জন্য ঠোঁট নাড়ানোও বড্ড দায়। তাই সে নিজেই চামুচ দিয়ে হালকা চাপে নিচের ঠোঁটখানা ফাঁকা করল। স্যুপটা পুরোটা মুখে পুরে বলল,

‘আজ যদিও আমি রান্না করিনি, তবে কাল থেকে আমিই রাঁধব। ধীরে ধীরে আপনার সমস্ত দায়িত্ব আমি নিব, বাবা। আপনার এত কাছের মানুষ থাকতে, বাইরের দুইজন ছেলে কেন আপনাকে সেবা করবে? তাই ভেবেছি, সব আমিই করব। আর মা আর আপনার ছেলে তো আছেই আমাকে সাহায্য করার জন্য।’

শ্বশুরমশাইয়ের মুখ দেখে প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না। তাই তনুও বুঝল না কিছুই। আস্তে ধীরে খাইয়ে দিল কেবল। খাওয়ানো শেষ করে একটা ছোট্ট রুমালে মুখ মুছে দিল। তারপর প্রসন্ন সুরে বলল,

‘এবার আপনি শুয়ে রেস্ট নিন, দুপুরে আবার খাবার নিয়ে আসব।’

তনুকা উঠে দাঁড়াতেই আঁচলে টান পড়ল। চেয়ে দেখল, আঁচলের কোণে ঝুলে থাকা ছোট্ট সুতার ঝালর তার শ্বশুরের আঙ্গুলের নিচে। তনুকা মৃদু হেসে আঁচল টেনে সরিয়ে নিল। মোহল লাল মজুমদারের চোখে মুখে অদ্ভুত উৎকন্ঠা। তিনি চেয়ে আছেন। তনুকার অত শত ভাবল না কিছুই। বেরিয়ে গেল সে। চেয়ে রইলেন এক বৃদ্ধ অপলক। প্রাণহীন, স্বচ্ছ সেই চাহনি; যেন কতকিছু বলে দিচ্ছেন ঐ চোখ জোড়া দিয়েই। অথচ কেউ দেখল না, কেউ বুঝল না।

তনুকা চলে যেতেই সেই দুই যুবক আবারও এসে দরজার সম্মুখে দাঁড়াল। তনুকা সোজা গেল শাশুড়ির কক্ষে। সকালের খাবার শেষে তিনি নিজ কক্ষে বই নিয়ে বসেন। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তনুকা বলল,

‘আসব মা?’

অনুমতি দিলেন আম্বিরা বেগম। বললেন,

‘এসো।’

তনুকা ঘোমটা ঠিক করল, এরপর ঢুকল শাশুড়ির কক্ষে। আম্বিরা বেগম চাইলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

‘শ্বশুরমশাইকে খাইয়ে এসেছ?’

তনুকা মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘জি, মা।’

‘তোমাকে দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখালেন তিনি?’

‘তেমন কিছুই না, কেবল তাকিয়ে ছিলেন।’

আম্বিরা বেগমের বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। বললেন,

‘তিন বছর তো তাকিয়ে তাকিয়েই কাটিয়ে দিলেন, এভাবে যে আরো কত বছর কাটাবেন কে জানে?’

‘বাবার কী হয়েছিল, মা?’

‘স্ট্রোক করেছিলেন তিন তিনবার, তারপর থেকে এই অবস্থা।’

তনুকার চিত্তপটে বিষন্নতার স্রোত ঝলমলিয়ে ওঠল। সে বলল,

‘বাবাকে কি কোনো ডাক্তার দেখছেন না?’

‘শহরের সবচেয়ে নামি দামি ডাক্তার দিয়ে মেহতাব উনার চিকিৎসা করিয়ে যাচ্ছে, তাও আশানুরূপ কোনো ফলই পাচ্ছি না আমরা।’

‘এত চেষ্টা করেও কি ডাক্তার কোনো আশা দিতে পারছেন না?’

‘না। কেবল বলছেন, আস্তে ধীরে উনি ঠিক হয়ে উঠবেন। কিন্তু সেই অপেক্ষার প্রহর কতটা বিশাল সেটা কেউ বলছেন না।’

কথাগুলো বলার সময় কেমন থেমে থেমে যাচ্ছিলেন তিনি। তনুকা যেন টের পেল শাশুড়ির বুকে চাপা প্রকাণ্ড আর্তনাদের ধ্বনি। সে ম্লান সুরে বলল,

‘কষ্ট পাবেন না, মা। বাবা একদিন ঠিক হয়ে যাবেন। আমার একজন পরিচিত ডাক্তার আছেন, আমি উনার সাথেও কথা বলব। আমরা সবাই একসাথে বাবাকে সাহায্য করলে, বাবা ঠিক একদিন সুস্থ হয়ে ওঠবেন।’

আম্বিরা বেগম তনুকার মাথায় হাত ঠেকালেন। আপ্লুত সুরে বললেন,

‘আজ মনে হচ্ছে, আমি ছেলের বউ না, আরেকটা মেয়ে নিয়ে এসেছি। জীবনে অনেক সফল হও, মা।’

তনুকা খুশি হলো ভীষণ। জিজ্ঞেস করল,

‘আজ দুপুরে কী রাঁধব, মা?’

‘তুমি কেন রাঁধতে যাবে? বাড়ির কাজের লোকেরাই সব করবে। জমিদারের বউ তুমি, সেভাবেই চলো।’

তনুকা ইতস্তত সুরে বলল,

‘আমি কি কিছুই করব না?’

‘না, কেবল তোমার হুকুম চালাবে।’

তনুকা অবাক হলো। আম্বিরা বেগম হেসে বললেন,

‘যাও এবার।’

নিজ কক্ষে ফিরে এসে তনুকা ভাবল, শাশুড়ি মা তার মোটেও খারাপ না, বরং ভালো ভীষণ। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা তাঁর এখনো কমেনি। তখন কথা বলার সময় কেমন চোখগুলো ছলছল করছিল যেন, টুপ করে এক্ষুনি এক পশলা বৃষ্টি নামবে। তনুকার বক্ষঃস্থলে শান্তির স্রোত বইল তাই। মনের চিন্তা কিছুটা হলেও ক্ষীণ হলো। তবে একটা ব্যাপারে এখনও কিঞ্চিৎ প্রশ্ন জাগছে। সেটারও সে সমাধান বের করে ফেলবে, মেহতাব এলে। মনে প্রশ্ন জমা রাখতে নেই, সময় সুযোগে সমাধান করে ফেলা ভালো।

__________

‘ছোট কাকা।’

বিচার মহল ছেড়ে কেবলই বেরুচ্ছিলেন মতিব মজুমদার। মেহতাবের স্বর পেয়েই পদযুগল স্থির হলো। ফিরে চাইলেন। না চাইতেও হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

‘কিছু বলবে?’

মেহতাবের চোখের দৃষ্টি নিগূঢ় এক চাদরে আবৃত। সেই চোখ দেখলেই গলা শুকায় কিছু প্রতারকদের। আজ তবে মতিব মজুমদারের গলা শুকাচ্ছে কেন? সেও কি তবে প্রতারক?
মেহতাব চোয়াল শক্ত করল। এগিয়ে এসে ঠিক মুখ বরাবর দাঁড়াল তাঁর। গম্ভীর সুরে বলল,

‘আপনি জানেন কাকা, প্রতারকদের একটা হারও আমি অবশিষ্ট রাখি না, তারপরও কী করে এত সাহস পাচ্ছেন?’

ভয় পেলেন মতিব মজুমদার। ঘাম ছুটল সঙ্গে সঙ্গেই। মেহতাব পকেট হাতড়িয়ে তার রুমাল এগিয়ে দিল কাকার দিকে। হেসে বলল,

‘আরে আরে, ঘামছেন কেন? শুধু কথাতেই এত ঘেমে গেলে কাজের বেলায় কী করবেন?’

মতিব মজুমদার ঢোক গিললেন। ভীত সুরে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী বলতে চাইছো তুমি?’

মেহতাব এগিয়ে কাকার কাঁধে হাত রাখল। একপাশের পাঞ্জাবী ঝেরে বলল,

‘আমার খেয়ে, আমার পরে আবার আমার সাথেই শত্রুতা, এটা মূর্খের কাজ বৈ আর কিছু নয়। সময় থাকতে শুধরে যান, নয়তো পরে আফসোস করতে হবে।’

চলে গেল মেহতাব। মতিব মজুমদার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন সেই যাওয়া পথে। হঠাৎই প্রচন্ড রাগে শরীর কেঁপে উঠল তাঁর। মেহতাবের রুমালটা ছুড়ে মারলেন দূরে। রাগে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,

‘এভাবেই দিন যাবে না, ভাতিজা। সময় একদিন আমারও আসবে। আর আমার সবথেকে বড়ো তুরুপের তাসও তো ইতিমধ্যেই চলে এসেছে, এবার তাকে দিয়েই তোমার জীবননাশ ঘটাব। প্রস্তুত থাকো, ভাতিজা।’

বলেই ক্রূর হাসলেন তিনি।

চলবে….

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here